হেনা হত্যা-চিকিৎ সকেরাও দায় এড়াতে পারেন না by মো. তাজুল ইসলাম

ফতোয়ার আরেক নিষ্ঠুর বলি হেনার করুণ ও অপমানজনক মৃত্যুর কাহিনি প্রথম আলোসহ অন্যান্য সংবাদপত্রে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়ার কারণে উচ্চ আদালত ত্বরিত ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এর জন্য সংবাদমাধ্যম ও আদালত শুধু ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য নয়। কোটি কোটি বেদনাহত মানুষের কৃতজ্ঞতাও তারা পাবে।


তবে কিছুটা প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে প্রাথমিক ময়নাতদন্তে সংশ্লিষ্ট চিকিৎ সকদের প্রতি। কেননা দ্বিতীয় ময়নাতদন্তে হেনার শরীরে আঘাত ও জখমের চিহ্ন ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা প্রথম ময়নাতদন্তে ছিল না। অথচ প্রথম ময়নাতদন্তেই আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট বোঝার কথা।
আদালতের জেরার মুখে সিভিল সার্জন বলেন, ‘দুটি টিমের চিকিৎ সকের মধ্যে অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে।’ অন্য চিকিৎ সক বলেন, ‘বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামের একটি বিষয় রয়েছে।’ দুটি বক্তব্যই অন্তঃসারশূন্য ও বিভ্রান্তিমূলক। দেশের সিভিল সার্জন অফিসে ওই প্রথম টিমের মতো অভিজ্ঞ চিকিৎ সকেরাই সাধারণত ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দিয়ে থাকেন। তাহলে কি এত দিন তেমন শত শত ভুল বা বিভ্রান্তিমূলক রিপোর্ট দেওয়া হয়ে আসছে? এমনটি হলে সেটি জাতির জন্য, সুবিচারের জন্য চরম দুর্ভাগ্যের কথা। দ্বিতীয়ত, বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম দিয়ে শারীরিক আঘাত শনাক্ত করতে হবে, সেটিও সঠিক তথ্য নয়। সংবাদপত্রে প্রচার পাওয়ার পর মানুষ জানতে পেরেছে ৭০-৮০টি দোররা মারার ফলে হেনার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় চিকিৎ সকেরা সেই আঘাতের চিহ্ন খুঁজে দেখলেন না বা খুঁজে পেলেন না কেন, সে প্রশ্ন সবাই করতেই পারেন। আদালতের কাছে সত্য উদ্ঘাটনে সহায়তার কারণ হলেও মনোযোগ ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে মৃত্যুর সঠিক কারণ ময়নাতদন্তে উল্লেখ থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল।
সর্বোপরি তাঁরা দাবি করেছেন, হেনাকে সুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। অথচ তার ৩৪ ঘণ্টার মধ্যেই অন্য কোনো কারণ ছাড়াই হেনা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। সে ক্ষেত্রে বিচারকের মন্তব্যই যথার্থ যে, ‘তাহলে কি কোনো ভূত এসে হেনাকে মেরে গেছে? শারীরিক নির্যাতনের জন্য বাহ্যিক আঘাত ছাড়াও শরীরের অভ্যন্তরে জখম হতে পারে, রক্তপাত হতে পারে। যা-ই হয়ে থাকুক না কেন, হেনার মৃত্যু ওই দোররা মারার কারণে হয়েছে, এটি অস্বীকার করার কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি কি আমাদের হাতে রয়েছে? চিকিৎ সক হিসেবে আমাদের অনেক ব্যস্ততা থাকে, সেটি সত্য। অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের পার্থক্যও মেনে নিচ্ছি। কিন্তু ৭০-৮০টি দোররা মারার কোনো শারীরিক আঘাতের চিহ্ন থাকবে না এবং ‘সুস্থ’ হয়ে বাড়ি ফেরার ৩৪ ঘণ্টার মধ্যে রোগী অন্য কোনো কারণ ছাড়া মারা যাবে, এর সদুত্তর দেওয়া কিছুটা কঠিনই বটে।
কিছু দায়িত্বরত পুলিশ বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ হয়ে অনেক ক্ষেত্রে সুরতহাল প্রতিবেদন ভিন্নভাবে লিখে যায় বলে লোকশ্রুতি রয়েছে। কিন্তু উচ্চশিক্ষিত, বিবেকসম্পন্ন চিকিৎ সকেরা কোনো রকম পেশাগত অবহেলা বা ভুল করবেন আমরা তেমনটি আশা করি না, বিশ্বাসও করতে চাই না। জাতি গভীর মর্মবেদনা ও উৎ কণ্ঠার সঙ্গে হেনার করুণ মৃত্যুর পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অপেক্ষায় রয়েছে। যে মেয়ে নিজে ধর্ষিত হয়েছে, কোথায় তার প্রতি অন্যায়কারীদের শাস্তি হবে, তা না, তাকেই উল্টো পেতে হলো শাস্তি ও অপমান। নির্যাতিতাকে যাঁরা বিচারের নামে দোররা মারার আদেশ দিয়েছেন, তাঁরা শুধু অপরাধী, অমানবিক নয়, তাঁরা ধর্মবিরোধী ও অধার্মিকও।
আদালত তাঁদের কী ধরনের শাস্তি দেবে, তা জানি না। হেনার মৃত্যুর পর যেই সামাজিক সচেতনতা দেখা দিয়েছে, তা বহাল থাকলে হয়তো অপরাধীরা শাস্তি পাবে। এর পাশাপাশি যে সামাজিক বৈষম্য, অন্যায় ও অবিচারের জন্য এভাবে হেনাদের মরতে হয়, সমাজ থেকে সেই অন্যায় ও অবিচার দূর করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে ফতোয়াবাজি চিরদিনের জন্য বন্ধ করতে হবে।
হেনার প্রতি অবজ্ঞা আমাদের অভিশাপ দেবে, যত দিন না সমাজ, রাষ্ট্র-আদালত-প্রশাসনে ন্যূনতম ন্যায্যতা, মানবিকতা ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা পায়। আমরা চিকিৎ সকেরা সে রকম সুবিচার নিশ্চিতে অনেকভাবে সহায়তা করতে পারি। তা না হলে এর দায়ভার কিছুটা হলেও আমাদের নিতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে আর কোনো নারী বা মেয়েশিশুকে ফতোয়ার শিকার হয়ে এভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়।
মো. তাজুল ইসলাম: সোশ্যাল সাইকিয়াট্রিস্ট; সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.