অরণ্যে রোদন-এই চাওয়া কি খুব বেশি কিছু ছিল? by আনিসুল হক
গলির মধ্যে নিচতলার ঘরটা অন্ধকার, তবু জানালা দিয়ে নিমগাছ দেখা যায়। এক পা বেরোলে ফুটপাতের পাশে আমগাছে দেখা যায়, ছোট ছোট আম দুলছে বৈশাখী বাতাসে। কান পাতলে এই ঢাকা শহরেও শোনা যায় চড়ুই পাখির কিচিরমিচির।
এই দেশ ছেড়ে আমি কোথায় যাব?
নিখিল বাবু বিড়বিড় করেন।
এই দেশের ১৬ কোটি মানুষ কোথায় যাবে? কোথায় যাবেন স্কুলশিক্ষক আবদুর রহিম, যিনি এই তপ্ত দুপুরে ছাতা এক হাতে মেলে ধরে আরেক হাতে সাইকেলের হাতল ধরে রোজ স্কুলে যান? কোথায় যাবেন গার্মেন্টসকর্মী সুলতানা, যিনি টাকা জমাচ্ছেন সন্তানকে স্কুলে পাঠাবেন বলে? বাংলাবাজারের প্রুফরিডার নিখিল বাবু রোদতপ্ত পথে হাঁটেন, কপালের ঘাম মোছেন আর বিড়বিড় করেন, এ দেশটায় থেকে গিয়ে কি ভুল করলাম?
আবদুর রহিম, সুলতানা, নিখিল বাবু তো বেশি কিছু চাননি। খুব বেশি নয় তাঁদের চাওয়া। তাঁরা প্লট চাননি। তাঁরা বিনা ট্যাক্সে গাড়ি চাননি, যা বিক্রি করে কোটি টাকা লাভ করবেন। তাঁরা তাঁদের সন্তান আপন যোগ্যতায় ঢাকার কোনো নামী স্কুলে ভর্তি হতে পারবে, এই আশাও তো করেন না।
নিখিল বাবু মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। ১৯৭১-এর সেই দুঃসময়ও তিনি আশা হারাননি। ভেবেছেন, দেশ স্বাধীন হবে। শত্রুরা বিদায় নেবে। সোনার বাংলায় তার সন্তানেরা ভালো থাকবে। ভালো থাকার সেই দিন আর কোনো দিনও আসেনি। তবু তিনি আশা ছাড়েননি। কত চড়াই-উতরাই, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়েছেন। ভেবেছেন গণতন্ত্র আসবে। দুই মুঠো ভাত, মোটা কাপড় জুটবে সবার। আর থাকবে নিরাপত্তা। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের দিনগুলোয় তাই তো তিনি যোগ দিয়েছেন মিছিলে মিছিলে। গণতন্ত্র এল। কিন্তু নিরাপত্তা তো এল না।
এক-এগারোর পরে তিনি আশা করেছেন, পরিবর্তন আসবে। ভোট এল। তিনি ভেবেছিলেন, সুদিন এবার আসন্ন। এত সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করল পরিবর্তনের স্লোগান উচ্চারণকারী দলটি। নির্বাচিত হওয়ার পরও কত সুন্দর সুন্দর কথা বললেন নেতা-নেত্রীরা। মনে হলো, এই তো বাংলাদেশ আবার ফিরে আসছে বাংলাদেশে। ফিরে আসছে বাংলার শাপলা-শালুক, হিজল-তমাল, ফিরে আসছে রূপশালী ধান, কচি দূর্বা। ফিরে আসছে আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, ফিরে আসছে অঘ্রানে ভরা খেতে মধুর হাসি।
বেশি কিছু চাননি তিনি। চাননি যে কেউ তাঁকে চলাচলের জন্য বাসের পা-দানির বদলে একটা মোটরসাইকেল কিনে দিক। এই স্বপ্ন তিনি দেখেননি যে, রোগাক্রান্ত হয়ে সরকারি হাসপাতালে গেলেই তিনি ভালো একটা বিছানা আর সুচিকিৎসা পাবেন আপনা-আপনিই।
খুব সামান্যই ছিল তাঁর চাওয়া। তিনি চেয়েছেন, দেশটা ভালো চলুক। আইনের শাসন বজায় থাকুক। মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারুক।
কিন্তু তার কোনো আশাই পূর্ণ হয় না। তিনি সন্তানদের সঙ্গে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করেছেন। তাঁর এক ছেলে এক মেয়ে। দুজনই আমেরিকায় থাকেন। ওপি ওয়ানের মাধ্যমে ছেলে গেলেন। পরে মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেল আমেরিকা প্রবাসীর সঙ্গে। তাঁরা তাঁকে বললেন, দেশের কোনো ফিউচার নেই। আমেরিকায় চলে এসো। নিখিল বাবু হাসেন। বামপন্থী পত্রিকায় দীর্ঘদিন প্রুফ দেখেছেন। তিনি জানেন, পলায়ন কোনো সমস্যার সমাধান নয়। বিদেশে গিয়ে তিনি কী করবেন? এই বয়সে আমেরিকায় গিয়ে দোকানদারি করা সম্ভব নয়। দেশে তাঁর কত নামডাক! তাঁর মতো প্রুফ দেখতে কেউ পারে না এই শহরে। বড় বড় অধ্যাপক বলেন, নিখিল বাবু প্রুফ দেখেছেন, তাহলে আর চিন্তা নেই। আপনারা নিশ্চিন্তে বই ছাপাতে পারেন।
এখন তিনি কোনো আশা দেখেন না। এই রকমের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় আসার পর দেশে এসব কী হচ্ছে! দুর্ঘটনা ঘটলে তিনি দুঃখ পান। কিন্তু তা-ও তিনি মেনে নিতে প্রস্তুত আছেন। তারেক মাসুদ মারা গেলেন, আশফাক মুনির মারা গেলেন। একটা সান্ত্বনা আছে। দুর্ঘটনা তো যেকোনো কারোরই জীবনে আসতে পারে। কিন্তু যখন মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, তখন তিনি আর কোনো সান্ত্বনা পান না। আর যখন সাগর-রুনির মতো চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের কোনো কিনারা হয় না, তখন তাঁর মনে হয়, মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলেন। কিন্তু যখন একজন এমপি গুম হয়ে যান, আর কেউ তাঁর কোনো হদিস দিতে পারে না, তখন তিনি বোঝেন, এই দেশ আর বসবাসের উপযোগী নেই।
নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের সময় নিখিল বাবু মিছিলে যেতেন। সমাবেশে যেতেন। একটা কবিতা খুব আবৃত্তি হতো। নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতা।
এই মৃত্যু-উপত্যকা আমার দেশ না
যে পিতা সন্তানের লাশ শনাক্ত করতে ভয় পায়
আমি তাকে ঘৃণা করি—
যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে
আমি তাকে ঘৃণা করি—
যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানি
প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না
আমি তাকে ঘৃণা করি—
আটজন মৃতদেহ
চেতনার পথজুড়ে শুয়ে আছে
আমি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছি
আটজোড়া খোলা চোখ আমাকে ঘুমের মধ্যে দেখে
আমি চিৎকার করে উঠি
আমাকে তারা ডাকছে অবেলায় উদ্যানে সকল সময়
আমি উন্মাদ হয়ে যাব
আত্মহত্যা করব
যা ইচ্ছা চায় তাই করব।
নিখিল বাবুর মনে হয়, তিনি উন্মাদ হয়ে যাবেন। তিনি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছেন। তিনি কি আত্মহত্যা করবেন! তিনি কি কাপড়চোপড় খুলে রাস্তায় চলে যাবেন?
যদি সরকার জানেই যে বিরোধী দল সরকারকে বিব্রত করার জন্য নিজেদের লোককে নিজেরাই লুকিয়ে রেখেছে, তাহলে তারা তাকে উদ্ধার করে বিরোধীদের চক্রান্ত ফাঁস করে দিক, তাদের মুখোশ উন্মোচন করুক। যদি তারা না জানে, তাহলে তারা কথা বলছে কেন? দেশের মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের।
মানুষ খুন হচ্ছে শয়নকক্ষে। মানুষ খুন হচ্ছে রাস্তায়। ডাকাতেরা ডাকাতি করে আট মাসের শিশুকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে জিম্মি করে, পণ আদায়ের জন্য। মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে রাজপথ থেকে। এই মৃত্যু-উপত্যকা আমার দেশ!
ভাতের থালা সামনে। সাদা রঙের ভাত নাড়তে নাড়তে নিখিল বাবু চোখের জল মোছেন। এত কষ্ট করে পাওয়া দেশটা আমার নয়?
মুক্তিযুদ্ধে তিনি গিয়েছিলেন বাবা-মায়ের নিষেধ উপেক্ষা করে। তাঁর মনে আছে নারায়ণগঞ্জের অনিমেষের কথা। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন অনিমেষ। নারায়ণগঞ্জেই এক গেরিলা অপারেশনে আসার পর অনিমেষ শহীদ হন। আগরতলার ক্যাম্পে কমান্ডার ডেকে পাঠান অনিমেষের বাবাকে। অনিমেষের রক্তাক্ত জামা আনতে পেরেছিলেন তাঁর সহযোদ্ধারা। সেটা অনিমেষের বাবার হাতে তুলে দেওয়া হয়। বাবা কাঁদতে থাকেন। তিনি বলেন, আমি এ জন্য কাঁদছি না যে আমার ছেলে কেন মারা গেল। আমি কাঁদছি, আমার কেন মাত্র একটা ছেলে। আজ যদি আমার আরেকটা ছেলে থাকত, আমি তাকে তো যুদ্ধ করতে পাঠাতে পারতাম।
এত ত্যাগের মাধ্যমে পাওয়া এই দেশটাকে নিয়ে তাঁকে বলতে হচ্ছে, এই মৃত্যু-উপত্যকা আমার দেশ না।
তিনি আকাশের দিকে তাকান। আকাশ নীল। কতগুলো সাদা মেঘ। নিমগাছের পাতারা খুব সবুজ। কদিন খুব বৃষ্টি হয়েছে। তিনি বিড়বিড় করে বলেন, ও নিমগাছের পাতা, তোমরা বলো, আমি কি খুব বেশি চেয়েছিলাম? একটু শান্তি একটু আইনের শাসন কি খুব বেশি চাওয়া?
তিনি রাজপথে হাঁটেন। ভবনের কার্নিশে কতগুলো পায়রা বাক-বাকুম বলে ডাকছে। তিনি বলেন, হরতালের দিনে গাড়ি বের করলে পোড়ানো হবে, এটাও তো আমরা মেনে নিয়েছিলাম। হরতালের আগের দিনে গাড়িতে আগুন দিয়ে মানুষকে কেন পুড়িয়ে মারা হয়?
এই দেশ ছেড়ে আমি কোথায় যাব? গলির মোড়ে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে সাজানো কুলা ডালা পাখার তোরণটার দিকে তাকিয়ে তিনি বিড়বিড় করেন।
আমি কি খুব বেশি কিছু চেয়েছিলাম, ও শহীদ মিনার, ও রমনার লেক? আমার চাওয়া কি খুব বেশি ছিল? আমি তো চাইনি কেউ আমাকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দিক। কেউ আমাকে পাঁচতারা হোটেলে এক বেলা খাওয়াক। আমি একটু শান্তি চেয়েছিলাম। বিপন্ন দিনগুলোয় একটু আশ্বাসের বাণী শুনতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম, কেউ এসে বলুক, এ রকম আর ঘটবে না। আমরা চেষ্টা করছি।
এই সামান্য প্রবোধটাও তো কোথাও নেই।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
নিখিল বাবু বিড়বিড় করেন।
এই দেশের ১৬ কোটি মানুষ কোথায় যাবে? কোথায় যাবেন স্কুলশিক্ষক আবদুর রহিম, যিনি এই তপ্ত দুপুরে ছাতা এক হাতে মেলে ধরে আরেক হাতে সাইকেলের হাতল ধরে রোজ স্কুলে যান? কোথায় যাবেন গার্মেন্টসকর্মী সুলতানা, যিনি টাকা জমাচ্ছেন সন্তানকে স্কুলে পাঠাবেন বলে? বাংলাবাজারের প্রুফরিডার নিখিল বাবু রোদতপ্ত পথে হাঁটেন, কপালের ঘাম মোছেন আর বিড়বিড় করেন, এ দেশটায় থেকে গিয়ে কি ভুল করলাম?
আবদুর রহিম, সুলতানা, নিখিল বাবু তো বেশি কিছু চাননি। খুব বেশি নয় তাঁদের চাওয়া। তাঁরা প্লট চাননি। তাঁরা বিনা ট্যাক্সে গাড়ি চাননি, যা বিক্রি করে কোটি টাকা লাভ করবেন। তাঁরা তাঁদের সন্তান আপন যোগ্যতায় ঢাকার কোনো নামী স্কুলে ভর্তি হতে পারবে, এই আশাও তো করেন না।
নিখিল বাবু মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। ১৯৭১-এর সেই দুঃসময়ও তিনি আশা হারাননি। ভেবেছেন, দেশ স্বাধীন হবে। শত্রুরা বিদায় নেবে। সোনার বাংলায় তার সন্তানেরা ভালো থাকবে। ভালো থাকার সেই দিন আর কোনো দিনও আসেনি। তবু তিনি আশা ছাড়েননি। কত চড়াই-উতরাই, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়েছেন। ভেবেছেন গণতন্ত্র আসবে। দুই মুঠো ভাত, মোটা কাপড় জুটবে সবার। আর থাকবে নিরাপত্তা। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের দিনগুলোয় তাই তো তিনি যোগ দিয়েছেন মিছিলে মিছিলে। গণতন্ত্র এল। কিন্তু নিরাপত্তা তো এল না।
এক-এগারোর পরে তিনি আশা করেছেন, পরিবর্তন আসবে। ভোট এল। তিনি ভেবেছিলেন, সুদিন এবার আসন্ন। এত সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করল পরিবর্তনের স্লোগান উচ্চারণকারী দলটি। নির্বাচিত হওয়ার পরও কত সুন্দর সুন্দর কথা বললেন নেতা-নেত্রীরা। মনে হলো, এই তো বাংলাদেশ আবার ফিরে আসছে বাংলাদেশে। ফিরে আসছে বাংলার শাপলা-শালুক, হিজল-তমাল, ফিরে আসছে রূপশালী ধান, কচি দূর্বা। ফিরে আসছে আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, ফিরে আসছে অঘ্রানে ভরা খেতে মধুর হাসি।
বেশি কিছু চাননি তিনি। চাননি যে কেউ তাঁকে চলাচলের জন্য বাসের পা-দানির বদলে একটা মোটরসাইকেল কিনে দিক। এই স্বপ্ন তিনি দেখেননি যে, রোগাক্রান্ত হয়ে সরকারি হাসপাতালে গেলেই তিনি ভালো একটা বিছানা আর সুচিকিৎসা পাবেন আপনা-আপনিই।
খুব সামান্যই ছিল তাঁর চাওয়া। তিনি চেয়েছেন, দেশটা ভালো চলুক। আইনের শাসন বজায় থাকুক। মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারুক।
কিন্তু তার কোনো আশাই পূর্ণ হয় না। তিনি সন্তানদের সঙ্গে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করেছেন। তাঁর এক ছেলে এক মেয়ে। দুজনই আমেরিকায় থাকেন। ওপি ওয়ানের মাধ্যমে ছেলে গেলেন। পরে মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেল আমেরিকা প্রবাসীর সঙ্গে। তাঁরা তাঁকে বললেন, দেশের কোনো ফিউচার নেই। আমেরিকায় চলে এসো। নিখিল বাবু হাসেন। বামপন্থী পত্রিকায় দীর্ঘদিন প্রুফ দেখেছেন। তিনি জানেন, পলায়ন কোনো সমস্যার সমাধান নয়। বিদেশে গিয়ে তিনি কী করবেন? এই বয়সে আমেরিকায় গিয়ে দোকানদারি করা সম্ভব নয়। দেশে তাঁর কত নামডাক! তাঁর মতো প্রুফ দেখতে কেউ পারে না এই শহরে। বড় বড় অধ্যাপক বলেন, নিখিল বাবু প্রুফ দেখেছেন, তাহলে আর চিন্তা নেই। আপনারা নিশ্চিন্তে বই ছাপাতে পারেন।
এখন তিনি কোনো আশা দেখেন না। এই রকমের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় আসার পর দেশে এসব কী হচ্ছে! দুর্ঘটনা ঘটলে তিনি দুঃখ পান। কিন্তু তা-ও তিনি মেনে নিতে প্রস্তুত আছেন। তারেক মাসুদ মারা গেলেন, আশফাক মুনির মারা গেলেন। একটা সান্ত্বনা আছে। দুর্ঘটনা তো যেকোনো কারোরই জীবনে আসতে পারে। কিন্তু যখন মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, তখন তিনি আর কোনো সান্ত্বনা পান না। আর যখন সাগর-রুনির মতো চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের কোনো কিনারা হয় না, তখন তাঁর মনে হয়, মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলেন। কিন্তু যখন একজন এমপি গুম হয়ে যান, আর কেউ তাঁর কোনো হদিস দিতে পারে না, তখন তিনি বোঝেন, এই দেশ আর বসবাসের উপযোগী নেই।
নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের সময় নিখিল বাবু মিছিলে যেতেন। সমাবেশে যেতেন। একটা কবিতা খুব আবৃত্তি হতো। নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতা।
এই মৃত্যু-উপত্যকা আমার দেশ না
যে পিতা সন্তানের লাশ শনাক্ত করতে ভয় পায়
আমি তাকে ঘৃণা করি—
যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে
আমি তাকে ঘৃণা করি—
যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানি
প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না
আমি তাকে ঘৃণা করি—
আটজন মৃতদেহ
চেতনার পথজুড়ে শুয়ে আছে
আমি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছি
আটজোড়া খোলা চোখ আমাকে ঘুমের মধ্যে দেখে
আমি চিৎকার করে উঠি
আমাকে তারা ডাকছে অবেলায় উদ্যানে সকল সময়
আমি উন্মাদ হয়ে যাব
আত্মহত্যা করব
যা ইচ্ছা চায় তাই করব।
নিখিল বাবুর মনে হয়, তিনি উন্মাদ হয়ে যাবেন। তিনি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছেন। তিনি কি আত্মহত্যা করবেন! তিনি কি কাপড়চোপড় খুলে রাস্তায় চলে যাবেন?
যদি সরকার জানেই যে বিরোধী দল সরকারকে বিব্রত করার জন্য নিজেদের লোককে নিজেরাই লুকিয়ে রেখেছে, তাহলে তারা তাকে উদ্ধার করে বিরোধীদের চক্রান্ত ফাঁস করে দিক, তাদের মুখোশ উন্মোচন করুক। যদি তারা না জানে, তাহলে তারা কথা বলছে কেন? দেশের মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের।
মানুষ খুন হচ্ছে শয়নকক্ষে। মানুষ খুন হচ্ছে রাস্তায়। ডাকাতেরা ডাকাতি করে আট মাসের শিশুকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে জিম্মি করে, পণ আদায়ের জন্য। মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে রাজপথ থেকে। এই মৃত্যু-উপত্যকা আমার দেশ!
ভাতের থালা সামনে। সাদা রঙের ভাত নাড়তে নাড়তে নিখিল বাবু চোখের জল মোছেন। এত কষ্ট করে পাওয়া দেশটা আমার নয়?
মুক্তিযুদ্ধে তিনি গিয়েছিলেন বাবা-মায়ের নিষেধ উপেক্ষা করে। তাঁর মনে আছে নারায়ণগঞ্জের অনিমেষের কথা। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন অনিমেষ। নারায়ণগঞ্জেই এক গেরিলা অপারেশনে আসার পর অনিমেষ শহীদ হন। আগরতলার ক্যাম্পে কমান্ডার ডেকে পাঠান অনিমেষের বাবাকে। অনিমেষের রক্তাক্ত জামা আনতে পেরেছিলেন তাঁর সহযোদ্ধারা। সেটা অনিমেষের বাবার হাতে তুলে দেওয়া হয়। বাবা কাঁদতে থাকেন। তিনি বলেন, আমি এ জন্য কাঁদছি না যে আমার ছেলে কেন মারা গেল। আমি কাঁদছি, আমার কেন মাত্র একটা ছেলে। আজ যদি আমার আরেকটা ছেলে থাকত, আমি তাকে তো যুদ্ধ করতে পাঠাতে পারতাম।
এত ত্যাগের মাধ্যমে পাওয়া এই দেশটাকে নিয়ে তাঁকে বলতে হচ্ছে, এই মৃত্যু-উপত্যকা আমার দেশ না।
তিনি আকাশের দিকে তাকান। আকাশ নীল। কতগুলো সাদা মেঘ। নিমগাছের পাতারা খুব সবুজ। কদিন খুব বৃষ্টি হয়েছে। তিনি বিড়বিড় করে বলেন, ও নিমগাছের পাতা, তোমরা বলো, আমি কি খুব বেশি চেয়েছিলাম? একটু শান্তি একটু আইনের শাসন কি খুব বেশি চাওয়া?
তিনি রাজপথে হাঁটেন। ভবনের কার্নিশে কতগুলো পায়রা বাক-বাকুম বলে ডাকছে। তিনি বলেন, হরতালের দিনে গাড়ি বের করলে পোড়ানো হবে, এটাও তো আমরা মেনে নিয়েছিলাম। হরতালের আগের দিনে গাড়িতে আগুন দিয়ে মানুষকে কেন পুড়িয়ে মারা হয়?
এই দেশ ছেড়ে আমি কোথায় যাব? গলির মোড়ে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে সাজানো কুলা ডালা পাখার তোরণটার দিকে তাকিয়ে তিনি বিড়বিড় করেন।
আমি কি খুব বেশি কিছু চেয়েছিলাম, ও শহীদ মিনার, ও রমনার লেক? আমার চাওয়া কি খুব বেশি ছিল? আমি তো চাইনি কেউ আমাকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দিক। কেউ আমাকে পাঁচতারা হোটেলে এক বেলা খাওয়াক। আমি একটু শান্তি চেয়েছিলাম। বিপন্ন দিনগুলোয় একটু আশ্বাসের বাণী শুনতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম, কেউ এসে বলুক, এ রকম আর ঘটবে না। আমরা চেষ্টা করছি।
এই সামান্য প্রবোধটাও তো কোথাও নেই।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments