বিশেষ সাক্ষাৎকার-ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম একসঙ্গে যায় না by মওদুদ আহমদ
সংবিধান সংশোধন ও পুনর্মুদ্রণ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ পুনর্মুদ্রণের এখতিয়ার এমনকি রায় অনুযায়ী হয়েছে কি না, সেসব প্রশ্নও তুলেছেন। এ ব্যাপারে গতকাল শনিবার সাবেক আইনমন্ত্রী ও জাতীয় সংসদে বিশেষ কমিটির সদস্য আবদুল মতিন খসরু এবং সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। নিচে তা পত্রস্থ হলো।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ সম্পর্কে বিএনপির মত হচ্ছে, এটা করতে সরকারের এখতিয়ার ছিল না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট যা বলেননি, এমনকি নির্দিষ্টভাবে যা করতে বারণ করেছেন, সেটাও সুপ্রিম কোর্টের নামে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন ১১৬ অনুচ্ছেদ থেকে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শের বিধান ও ১৫০ অনুচ্ছেদ থেকে ৩(ক) বিলুপ্ত করা হয়েছে। আপনার মন্তব্য কী?
মওদুদ আহমদ এটা অনাচার।
প্রথম আলো এর প্রতিকার কী?
মওদুদ আহমদ প্রথম কথা হলো, এটা করতে সরকারের কোনো আইনগত এখতিয়ার নেই। তারা যেটা করেছে সেটা প্রতারণামূলকভাবে করেছে। আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তারা একটা মনগড়া ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। সবকিছু আদালতের ওপর চাপিয়ে দিয়ে কতগুলো বক্তব্য তারা সাজিয়ে দিয়েছে।
প্রথম আলো পুনর্মুদ্রিত সংবিধান সম্পর্কে আইনমন্ত্রী বলেছেন, এটাই বর্তমানে বাংলাদেশের কার্যকর সংবিধান। আর সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু বলেছেন, এটা তাঁরা খসড়া হিসেবে নিয়েছেন। এখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান বলতে আমরা কোনটিকে বুঝব?
মওদুদ আহমদ আমি সংবিধান বলতে বর্তমানে যে সংবিধান বহাল আছে, অর্থাৎ সংসদের মাধ্যমে সর্বশেষ সংশোধনী যেটা এসেছে সেটাকে বুঝব। পুনর্মুদ্রিত সংবিধান আমাদের সংবিধান নয়। আমি আগেও বলেছি, পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের কোনো ভিত্তি নেই।
প্রথম আলো আপনার কি মনে হয় না যে আপিল বিভাগের কাছ থেকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন স্থিতাদেশ নেওয়া দরকার?
মওদুদ আহমদ অবশ্যই নেওয়া উচিত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটা করবেন কে। কোনো সন্দেহ নেই, আইন মন্ত্রণালয় স্বেচ্ছাচারিতা করেছে। বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে তারা একটা ব্যভিচার করল।
প্রথম আলো এ ধরনের মন্তব্য আপনারা রাজনৈতিকভাবে করতে পারেন। নানাভাবে এর নিন্দা করতে পারেন। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আইনের কার্যকারিতা ও মর্যাদা নিয়ে এ ধরনের একটি অবস্থার আইনগত প্রতিকার কী হতে পারে?
মওদুদ আহমদ বিষয়টি অবশ্যই আদালতের নজরে নেওয়া উচিত। তবে কারা কীভাবে তা করবেন, সেটা আমার পক্ষে বলা সম্ভবপর নয়। আমরা যদি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে যাই, তাহলে বিষয়টিকে সবাই রাজনৈতিকভাবে দেখবেন। যাঁরা জনস্বার্থে মামলা দায়ের করেন, সংবিধানসংক্রান্ত বিভিন্ন মামলা-মোকদ্দমা করতে সিদ্ধহস্ত, তাঁরা এ বিষয়ে একটা উদ্যোগ নিতে পারেন। আমরা যদি এমন কিছু করি, তাহলে অনতিবিলম্বে তার একটি রাজনৈতিক ব্যাখ্যা মিলবে এবং আদালতকে প্রভাবিত করার চেষ্টাও করা হবে। সেটা আমরা চাই না।
প্রথম আলো কিন্তু সংবিধান পুনর্মুদ্রণের এই পথ তো আপনিই দেখিয়েছিলেন। অষ্টম সংশোধনীর মামলায় আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী আপনি ১০০ অনুচ্ছেদে সংশোধনী এনেছিলেন। তখন আপনারা আসলে কী ভেবে সংবিধান ছাপাখানায় পাঠিয়েছিলেন? আর এখন কেন বর্তমান সরকারের সংবিধানের পুনর্মুদ্রণের বিরোধিতা করছেন? এটা বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা কি না?
মওদুদ আহমদ না। প্রথম যুক্তি হচ্ছে, ১৯৮৯ সালে যেটা ঘটেছিল, সেটা ছিল সংবিধানের মাত্র একটা অনুচ্ছেদ নিয়ে। আপিল বিভাগ মাত্র একটি অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।
প্রথম আলো আপনার এই ব্যাখ্যা আমরা জানি। এটা একটা দুর্বল যুক্তি। শুধু এই উপমহাদেশে নয়, আপনি কি বিশ্বের কোনো সাংবিধানিক জুরিসপ্রুডেন্স থেকে দেখাতে পারবেন, এ ধরনের সংবিধান ছাপার নজির কোথাও আছে? আমরা কিন্তু জানি না।
মওদুদ আহমদ না, সেটা ঠিক। সেটা আমাদের ভুল হয়েছিল। আমাদের উচিত ছিল সংসদে সংবিধান সংশোধন বিল এনে আপিল বিভাগের রায় কার্যকর করা।
প্রথম আলো ওই সময়ের কথা একটু বলবেন যে বিষয়টি নিয়ে আপনারা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কোনো বৈঠক করেছিলেন কি না? আমরা বুঝতে চাইছি। কেন আপনারা আদালতের রায়ে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করেছিলেন?
মওদুদ আহমদ ওই সময়ে দেশে একটা বিরাট আন্দোলন চলছিল এবং আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আমরা ওই সংশোধনী সম্পর্কে সংসদে বিল না এনে আদালতের রায় মতে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করেছিলাম।
প্রথম আলো এখন যখন সংসদীয় বিশেষ কমিটি সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিচ্ছে, তখন প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আপনাদের কি সেই প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া উচিত নয়?
মওদুদ আহমদ এটা যেহেতু একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং সংবিধান তো একটা পবিত্র দলিল। সেটা নিয়ে এ রকম টানাহেঁচড়া করা ঠিক নয়। যদি সরকার মনে করে, সংবিধান সংশোধন অত্যাবশ্যকীয়, সে ক্ষেত্রে আমার সুনির্দিষ্ট মন্তব্য হলো, সরকার যদি অনেক দিনের জন্য সংশোধিত সংবিধান টিকিয়ে রাখতে চায়, তাহলে তারা যেন একটি সর্বদলীয় বিশেষ কমিটি গঠন করে। যেমন—আমরা একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনীর সময় বিশেষ কমিটি গঠন করেছিলাম। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মিলেমিশে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে এসেছিল। সে ধরনের একটা সর্বদলীয় কমিটি করা হোক। এভাবে সমঝোতার মাধ্যমে প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো যদি আনা সম্ভব হয়, তাহলে আমার মনে হয়, সংবিধান অনেক টেকসই হবে। আর একতরফাভাবে, বিতর্কিত বিষয়গুলোসহ যদি সংবিধান সংশোধন করা হয়, তাহলে তা টেকসই হবে না। ভবিষ্যতে যারা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসবে, তারা চাইলে সংবিধান উল্টে দিতে পারবে।
প্রথম আলো সরকারি দলের কাছ থেকে এ পর্যন্ত কোনো ইঙ্গিত কি আপনারা পেয়েছেন যে তারা সত্যিই আপনাদের অন্তর্ভুক্ত করে অগ্রসর হতে চায়?
মওদুদ আহমদ এখনো পাইনি। তবে সেটা করলে তারা ভালো করবে। অবশ্য যদি তারা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। আর যদি শুধুই দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করে, তাহলে তারা ভুল করবে।
প্রথম আলো পুনর্মুদ্রিত সংবিধানে বিসমিল্লাহ আছে এবং বলাও হচ্ছে, এটা টিকে থাকবে। ধর্মনিরপেক্ষতাও থাকবে। আবার বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও থাকবে। এটা কি আসলে সম্ভব?
মওদুদ আহমদ প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগের এই যে অবস্থান, সেটা গ্রহণের মধ্য দিয়ে তাদের দুর্বলতাই ধরা পড়েছে। সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ও স্ববিরোধিতা ধরা পড়বে যদি তারা ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে রাখে। আমি ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে বিসমিল্লাহ রাখার বিষয়টিকে অতটা স্ববিরোধী মনে করি না। তবে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে কোনো ধর্মকে রেখে আবার ধর্মনিরপেক্ষতা রাখা যাবে না। তাহলে তাতে তাদের আদর্শিক স্ববিরোধিতাই ফুটে উঠবে। দেশের মানুষের কাছেও সেটা পরিষ্কার হবে।
প্রথম আলো জাতির সামনে সংবিধান সংশোধনের একটা বিরাট সুযোগ এসেছে। এই সময় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে সংবিধানে ধর্ম থাকার বিষয়ে আপনার মত আমরা জানতে চাই।
মওদুদ আহমদ যদি রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা একসঙ্গে থাকে, তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শগত গুরুত্ব একেবারেই কমে যাবে। এর মূল্য থাকবে না। আমার কথা হলো, পৃথিবীর ৭৭টি রাষ্ট্রে রাষ্ট্রধর্ম আছে। কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম থাকার মানে এই নয় যে তারা ধর্মীয় রাষ্ট্র করেছে।
প্রথম আলো এটা ঠিক যে রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মরাষ্ট্র এক নয়।
মওদুদ আহমদ সুতরাং আমি বলি, এই ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে তারা একটা গোঁজামিল দেওয়ার চেষ্টা করছে। এর কোনো দরকার নেই। রাষ্ট্রধর্ম রেখেও আমরা ধর্মনিরপেক্ষ থাকতে পারি। এটা ঐতিহ্য লালন ও অনুশীলনের ওপর নির্ভরশীল।
প্রথম আলো আপনার যুক্তি মেনে নিয়েও কিন্তু বিপরীত যুক্তি গ্রহণযোগ্য হতে পারে। ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রেখেও ঐতিহ্য ও অনুশীলন দিয়ে রাষ্ট্রধর্ম রাখার যেকোনো সৎ উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব।
মওদুদ আহমদ সেটাও হতে পারে। কিন্তু মূল বিষয়টা হচ্ছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। আপনি ঠিকই বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষতা লিখুন আর না-ই লিখুন, ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম থাকুক আর না-ই থাকুক, যদি বাস্তবে অনুশীলন করেন, তাহলে ঠিক আছে।
প্রথম আলো যাঁরা রাষ্ট্রধর্ম রাখার পক্ষে মত দেন, সেখানে যদি রাজনীতি থাকে, তাহলে যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতা রেখে রাষ্ট্রধর্ম রাখার কথা বলবেন, সেখানেও তো রাজনীতিটাই প্রাধান্য পাবে বলেই মনে হবে। আপনার কী মন্তব্য?
মওদুদ আহমদ আপনি যথার্থ বলেছেন। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রধর্ম রেখে যদি ধর্মনিরপেক্ষতা রাখে, তাহলেও ধর্মকে ব্যবহার করা হবে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
মওদুদ আহমদ ধন্যবাদ।
প্রথম আলো সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ সম্পর্কে বিএনপির মত হচ্ছে, এটা করতে সরকারের এখতিয়ার ছিল না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট যা বলেননি, এমনকি নির্দিষ্টভাবে যা করতে বারণ করেছেন, সেটাও সুপ্রিম কোর্টের নামে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন ১১৬ অনুচ্ছেদ থেকে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শের বিধান ও ১৫০ অনুচ্ছেদ থেকে ৩(ক) বিলুপ্ত করা হয়েছে। আপনার মন্তব্য কী?
মওদুদ আহমদ এটা অনাচার।
প্রথম আলো এর প্রতিকার কী?
মওদুদ আহমদ প্রথম কথা হলো, এটা করতে সরকারের কোনো আইনগত এখতিয়ার নেই। তারা যেটা করেছে সেটা প্রতারণামূলকভাবে করেছে। আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তারা একটা মনগড়া ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। সবকিছু আদালতের ওপর চাপিয়ে দিয়ে কতগুলো বক্তব্য তারা সাজিয়ে দিয়েছে।
প্রথম আলো পুনর্মুদ্রিত সংবিধান সম্পর্কে আইনমন্ত্রী বলেছেন, এটাই বর্তমানে বাংলাদেশের কার্যকর সংবিধান। আর সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু বলেছেন, এটা তাঁরা খসড়া হিসেবে নিয়েছেন। এখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান বলতে আমরা কোনটিকে বুঝব?
মওদুদ আহমদ আমি সংবিধান বলতে বর্তমানে যে সংবিধান বহাল আছে, অর্থাৎ সংসদের মাধ্যমে সর্বশেষ সংশোধনী যেটা এসেছে সেটাকে বুঝব। পুনর্মুদ্রিত সংবিধান আমাদের সংবিধান নয়। আমি আগেও বলেছি, পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের কোনো ভিত্তি নেই।
প্রথম আলো আপনার কি মনে হয় না যে আপিল বিভাগের কাছ থেকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন স্থিতাদেশ নেওয়া দরকার?
মওদুদ আহমদ অবশ্যই নেওয়া উচিত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটা করবেন কে। কোনো সন্দেহ নেই, আইন মন্ত্রণালয় স্বেচ্ছাচারিতা করেছে। বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে তারা একটা ব্যভিচার করল।
প্রথম আলো এ ধরনের মন্তব্য আপনারা রাজনৈতিকভাবে করতে পারেন। নানাভাবে এর নিন্দা করতে পারেন। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আইনের কার্যকারিতা ও মর্যাদা নিয়ে এ ধরনের একটি অবস্থার আইনগত প্রতিকার কী হতে পারে?
মওদুদ আহমদ বিষয়টি অবশ্যই আদালতের নজরে নেওয়া উচিত। তবে কারা কীভাবে তা করবেন, সেটা আমার পক্ষে বলা সম্ভবপর নয়। আমরা যদি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে যাই, তাহলে বিষয়টিকে সবাই রাজনৈতিকভাবে দেখবেন। যাঁরা জনস্বার্থে মামলা দায়ের করেন, সংবিধানসংক্রান্ত বিভিন্ন মামলা-মোকদ্দমা করতে সিদ্ধহস্ত, তাঁরা এ বিষয়ে একটা উদ্যোগ নিতে পারেন। আমরা যদি এমন কিছু করি, তাহলে অনতিবিলম্বে তার একটি রাজনৈতিক ব্যাখ্যা মিলবে এবং আদালতকে প্রভাবিত করার চেষ্টাও করা হবে। সেটা আমরা চাই না।
প্রথম আলো কিন্তু সংবিধান পুনর্মুদ্রণের এই পথ তো আপনিই দেখিয়েছিলেন। অষ্টম সংশোধনীর মামলায় আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী আপনি ১০০ অনুচ্ছেদে সংশোধনী এনেছিলেন। তখন আপনারা আসলে কী ভেবে সংবিধান ছাপাখানায় পাঠিয়েছিলেন? আর এখন কেন বর্তমান সরকারের সংবিধানের পুনর্মুদ্রণের বিরোধিতা করছেন? এটা বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা কি না?
মওদুদ আহমদ না। প্রথম যুক্তি হচ্ছে, ১৯৮৯ সালে যেটা ঘটেছিল, সেটা ছিল সংবিধানের মাত্র একটা অনুচ্ছেদ নিয়ে। আপিল বিভাগ মাত্র একটি অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।
প্রথম আলো আপনার এই ব্যাখ্যা আমরা জানি। এটা একটা দুর্বল যুক্তি। শুধু এই উপমহাদেশে নয়, আপনি কি বিশ্বের কোনো সাংবিধানিক জুরিসপ্রুডেন্স থেকে দেখাতে পারবেন, এ ধরনের সংবিধান ছাপার নজির কোথাও আছে? আমরা কিন্তু জানি না।
মওদুদ আহমদ না, সেটা ঠিক। সেটা আমাদের ভুল হয়েছিল। আমাদের উচিত ছিল সংসদে সংবিধান সংশোধন বিল এনে আপিল বিভাগের রায় কার্যকর করা।
প্রথম আলো ওই সময়ের কথা একটু বলবেন যে বিষয়টি নিয়ে আপনারা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কোনো বৈঠক করেছিলেন কি না? আমরা বুঝতে চাইছি। কেন আপনারা আদালতের রায়ে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করেছিলেন?
মওদুদ আহমদ ওই সময়ে দেশে একটা বিরাট আন্দোলন চলছিল এবং আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আমরা ওই সংশোধনী সম্পর্কে সংসদে বিল না এনে আদালতের রায় মতে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করেছিলাম।
প্রথম আলো এখন যখন সংসদীয় বিশেষ কমিটি সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিচ্ছে, তখন প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আপনাদের কি সেই প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া উচিত নয়?
মওদুদ আহমদ এটা যেহেতু একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং সংবিধান তো একটা পবিত্র দলিল। সেটা নিয়ে এ রকম টানাহেঁচড়া করা ঠিক নয়। যদি সরকার মনে করে, সংবিধান সংশোধন অত্যাবশ্যকীয়, সে ক্ষেত্রে আমার সুনির্দিষ্ট মন্তব্য হলো, সরকার যদি অনেক দিনের জন্য সংশোধিত সংবিধান টিকিয়ে রাখতে চায়, তাহলে তারা যেন একটি সর্বদলীয় বিশেষ কমিটি গঠন করে। যেমন—আমরা একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনীর সময় বিশেষ কমিটি গঠন করেছিলাম। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মিলেমিশে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে এসেছিল। সে ধরনের একটা সর্বদলীয় কমিটি করা হোক। এভাবে সমঝোতার মাধ্যমে প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো যদি আনা সম্ভব হয়, তাহলে আমার মনে হয়, সংবিধান অনেক টেকসই হবে। আর একতরফাভাবে, বিতর্কিত বিষয়গুলোসহ যদি সংবিধান সংশোধন করা হয়, তাহলে তা টেকসই হবে না। ভবিষ্যতে যারা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসবে, তারা চাইলে সংবিধান উল্টে দিতে পারবে।
প্রথম আলো সরকারি দলের কাছ থেকে এ পর্যন্ত কোনো ইঙ্গিত কি আপনারা পেয়েছেন যে তারা সত্যিই আপনাদের অন্তর্ভুক্ত করে অগ্রসর হতে চায়?
মওদুদ আহমদ এখনো পাইনি। তবে সেটা করলে তারা ভালো করবে। অবশ্য যদি তারা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। আর যদি শুধুই দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করে, তাহলে তারা ভুল করবে।
প্রথম আলো পুনর্মুদ্রিত সংবিধানে বিসমিল্লাহ আছে এবং বলাও হচ্ছে, এটা টিকে থাকবে। ধর্মনিরপেক্ষতাও থাকবে। আবার বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও থাকবে। এটা কি আসলে সম্ভব?
মওদুদ আহমদ প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগের এই যে অবস্থান, সেটা গ্রহণের মধ্য দিয়ে তাদের দুর্বলতাই ধরা পড়েছে। সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ও স্ববিরোধিতা ধরা পড়বে যদি তারা ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে রাখে। আমি ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে বিসমিল্লাহ রাখার বিষয়টিকে অতটা স্ববিরোধী মনে করি না। তবে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে কোনো ধর্মকে রেখে আবার ধর্মনিরপেক্ষতা রাখা যাবে না। তাহলে তাতে তাদের আদর্শিক স্ববিরোধিতাই ফুটে উঠবে। দেশের মানুষের কাছেও সেটা পরিষ্কার হবে।
প্রথম আলো জাতির সামনে সংবিধান সংশোধনের একটা বিরাট সুযোগ এসেছে। এই সময় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে সংবিধানে ধর্ম থাকার বিষয়ে আপনার মত আমরা জানতে চাই।
মওদুদ আহমদ যদি রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা একসঙ্গে থাকে, তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শগত গুরুত্ব একেবারেই কমে যাবে। এর মূল্য থাকবে না। আমার কথা হলো, পৃথিবীর ৭৭টি রাষ্ট্রে রাষ্ট্রধর্ম আছে। কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম থাকার মানে এই নয় যে তারা ধর্মীয় রাষ্ট্র করেছে।
প্রথম আলো এটা ঠিক যে রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মরাষ্ট্র এক নয়।
মওদুদ আহমদ সুতরাং আমি বলি, এই ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে তারা একটা গোঁজামিল দেওয়ার চেষ্টা করছে। এর কোনো দরকার নেই। রাষ্ট্রধর্ম রেখেও আমরা ধর্মনিরপেক্ষ থাকতে পারি। এটা ঐতিহ্য লালন ও অনুশীলনের ওপর নির্ভরশীল।
প্রথম আলো আপনার যুক্তি মেনে নিয়েও কিন্তু বিপরীত যুক্তি গ্রহণযোগ্য হতে পারে। ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রেখেও ঐতিহ্য ও অনুশীলন দিয়ে রাষ্ট্রধর্ম রাখার যেকোনো সৎ উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব।
মওদুদ আহমদ সেটাও হতে পারে। কিন্তু মূল বিষয়টা হচ্ছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। আপনি ঠিকই বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষতা লিখুন আর না-ই লিখুন, ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম থাকুক আর না-ই থাকুক, যদি বাস্তবে অনুশীলন করেন, তাহলে ঠিক আছে।
প্রথম আলো যাঁরা রাষ্ট্রধর্ম রাখার পক্ষে মত দেন, সেখানে যদি রাজনীতি থাকে, তাহলে যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতা রেখে রাষ্ট্রধর্ম রাখার কথা বলবেন, সেখানেও তো রাজনীতিটাই প্রাধান্য পাবে বলেই মনে হবে। আপনার কী মন্তব্য?
মওদুদ আহমদ আপনি যথার্থ বলেছেন। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রধর্ম রেখে যদি ধর্মনিরপেক্ষতা রাখে, তাহলেও ধর্মকে ব্যবহার করা হবে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
মওদুদ আহমদ ধন্যবাদ।
No comments