বাঘা তেঁতুল-কার্টুনের কথা by সৈয়দ আবুল মকসুদ
বার্লিন দেয়াল চূর্ণ করার আগে বন ছিল পুঁজিবাদী পশ্চিম জার্মানির রাজধানী। সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানির রাজধানী ছিল খণ্ডিত বার্লিনের এক অংশে। বন প্রেসক্লাবে গিয়েছিলাম দুপুরে খেতে। ঢুকেই দেখি এক নামজাদা আধুনিক শিল্পীর আঁকা কার্টুনের প্রদর্শনী।
প্রতিটি কার্টুনই কোনো না কোনো রাজনৈতিক নেতার—ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের। কার্টুনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ও চ্যান্সেলর আছেন, মন্ত্রী এবং নেতারাও আছেন। প্রত্যেক নেতার চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে কার্টুনগুলোতে।
প্রতিটি কার্টুনের মুখটি একজন নেতার, কিন্তু তাঁর শরীরটি বিভিন্ন পশু ও পাখির। একেকটি প্রাণীর সঙ্গে একেকজন নেতাকে তুলনা করা হয়েছে। পশুপাখির মধ্যে ছিল কুকুর, শূকর, বিড়াল, গাধা, ঘোড়া, কাঠবিড়ালি, খচ্চর, খেঁকশিয়াল, পাঁঠা, হরিণ, বেজি, মোরগ, বাজপাখি প্রভৃতি।
আমাদের দেশের পরম শ্রদ্ধেয় ও ফুলের মতো নির্মল চরিত্রের অধিকারী নেতাদের নিয়ে পশুর কার্টুন আঁকলে তুলকালাম হয়ে যেত। আর্ট কলেজ উড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা আসত। ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা ‘অমুকের চামড়া তুলে নেব আমরা’—ধ্বনি দিয়ে রাজপথ উত্তাল করে তুলতেন। তাঁদের কারও কারও হাতে থাকত লোহার রড, ইট বা পাথরের টুকরা। গাড়ি ভাঙচুর হতো গোটা পঞ্চাশ। শিল্পীর বাড়িতে ছোঁয়ানো হতো আগুনের পরশমণি। শিল্পীর জীবন পুণ্য হতো দহন-দানে। এবং শিল্পীকে মকবুল ফিদা হুসেনের নিয়তি বরণ করতে হতো অন্তত আর একটি নির্বাচনে অন্য দলের সরকার ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত। সকাল-সন্ধ্যা হরতাল তো হতোই। তাতে লাভবান হতো বড় হাসপাতালগুলো। বিশেষ করে অর্থোপেডিক সার্জনরা।
বন প্রেসক্লাবের এক কর্তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই সব কার্টুনে যেসব নেতা কুকুর, গাধা, খচ্চর হিসেবে চিত্রিত হয়েছেন, তাঁরা—
তিনি বললেন, এ তো শিল্প—আর্ট। আমাদের সংবিধানে, যার নাম ‘বেসিক ল’—, বলা হয়েছে ‘আর্ট ইজ ফ্রি’—শিল্প ও শিল্পী স্বাধীন। চিন্তা ও কল্পনা করার পূর্ণ স্বাধীনতা তাঁদের দেওয়া হয়েছে।
আমাদের প্রজাতন্ত্রে আর্ট ফ্রি নয়। আর্টিস্ট তো ফ্রি ননই। যাঁরা ক্ষমতা ভোগ করেন, তাঁদের সম্পর্কে ‘আপত্তিকর’ কার্টুন আঁকেন এমন সাধ্য কার? তাঁদের কর্মদক্ষতার ফলে রাস্তাঘাট চাঁদের পিঠের মতো এবড়োখেবড়ো হোক, রিপোর্টও করা যাবে না, কার্টুন তো কদাচ নয়। হপ্তায় তিন দিন তিন-চারটি পত্রিকার পাতাজুড়ে প্রশংসা করা যাবে, সংগত কারণে সমালোচনা করা যাবে না। বাংলার মাটিতে কার্টুন আঁকা বেয়াদবি।
দেশের রাস্তাঘাট সড়ক-সেতুর অবস্থা অতি চমৎ কার। কোনো কোনো রাস্তায় এক দিন গাড়িতে গেলে আমাদের বয়সী মানুষের কোমরের হাড় সব আলগা হয়ে যায়। রাস্তাঘাটের দশা নিজের চোখে যা দেখেছেন, সংসদে তা-ই বলেছেন সাবেক মন্ত্রী ও জননেতা তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেছেন, দুই বছরে দেশের সড়ক উন্নয়নে তেমন কাজ হয়নি। তাঁর বক্তব্য টেবিল চাপড়ে মহাজোটের সদস্যরাই সমর্থন করেন। ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী ছিলেন চেয়ারে। তিনি বলেন, ‘এ বক্তব্য শুধু তোফায়েল আহমেদের নয়, গোটা সংসদের।’
প্রত্যুত্তরে যোগাযোগমন্ত্রী বলতে পারতেন, রাস্তাঘাটে বেশি ঘোরাঘুরি ও গাড়ি হাঁকানোর দরকার কী? কিন্তু তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেছেন: ‘তোফায়েল আহমেদ যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রতি তাঁর তীব্র ক্ষোভ ও ঈর্ষার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।’
তোফায়েল আহমেদ যদি কোনো কালে একজন ব্যর্থ যোগাযোগমন্ত্রী হতেন, তাহলে বর্তমান মন্ত্রীর সাফল্যে আলবত ঈর্ষা করতেন। তা ছাড়া তিনি একা ঈর্ষান্বিত হতেই পারেন, সংসদের সব সদস্য ঈর্ষাকাতর হলেন কীভাবে? তোফায়েল আহমেদকে আমরা চিনি ষাটের দশক থেকে। তাঁর সঙ্গে পরিচয় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে নয়—পিচঢালা তপ্ত রাজপথে। সড়ক ও রাজপথ সম্পর্কে তাঁর ধারণা অতি স্বচ্ছ।
যোগাযোগব্যবস্থার অবস্থা নিয়ে সংসদে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কাগজে প্রতিবেদন হয়েছে। প্রতিবেদক অপরাধ করেছেন এইটুকু যে, তিনি লিখতে পারতেন: বাংলাদেশের বর্তমান যোগাযোগব্যবস্থা শের শাহ ও নাজমুল হুদার সময়ের চেয়ে উত্তম। কার্টুনশিল্পী তাঁর ছবির নায়ককে বলতে পারতেন ‘প্রাসাদের সম্রাট’। তা না বলে তিনি বলেছেন ‘তালপাতার সেপাই’। মাননীয় মন্ত্রী সেই ‘বিকৃত ও অনৈতিক কার্টুন’ এবং ‘খবর ও রাস্তার ছবি দেখে’ ‘হতবাক’ হয়ে যান।
কার্টুন যে কারও মর্মমূলে আঘাত হানতে পারে বিষাক্ত শেলের মতো, তা এই প্রথম জানলাম। কার্টুনকে বাংলায় আমরা বলি ব্যঙ্গচিত্র বা রঙ্গচিত্র। তা শিল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। উপভোগের জিনিস।
কার্টুন হলো একধরনের আঁকিবুঁকি। কার্টুনের ছবিগুলোর হাত-পা আছে, কিন্তু সে হাত-পা নড়াচড়া করতে পারে না। কাউকে আঘাত করার জোর কার্টুনের হাতে নেই। সেই হাত ঘুষি দিতে পারে না। লাঠি ধরতে পারে না যে কারও মাথায় বাড়ি দেবে। ছুরি চালাতে পারে না যে কারও বুকে বসাবে। পিস্তলের ঘোড়া তো টিপতেই পারে না। সেই প্রাণহীন কার্টুনকে যখন কেউ ভয় করে, তখন বোঝা যায় তারা কতটা দুর্বল।
আজ এমন এক বাংলার মাটিতে আমরা বাস করছি, যেখানে কোনো নেতার নিজ এলাকায় শুভ আগমন উপলক্ষে লাখ লাখ টাকা খরচ করে তোরণ বানালে দোষ নেই। রংতুলি দিয়ে কাগজে একটি রঙ্গচিত্র আঁকলে মহা অপরাধ। বিকৃত কার্টুনের চেয়ে বিকৃত মন সমাজ ও জাতির জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
প্রতিটি কার্টুনের মুখটি একজন নেতার, কিন্তু তাঁর শরীরটি বিভিন্ন পশু ও পাখির। একেকটি প্রাণীর সঙ্গে একেকজন নেতাকে তুলনা করা হয়েছে। পশুপাখির মধ্যে ছিল কুকুর, শূকর, বিড়াল, গাধা, ঘোড়া, কাঠবিড়ালি, খচ্চর, খেঁকশিয়াল, পাঁঠা, হরিণ, বেজি, মোরগ, বাজপাখি প্রভৃতি।
আমাদের দেশের পরম শ্রদ্ধেয় ও ফুলের মতো নির্মল চরিত্রের অধিকারী নেতাদের নিয়ে পশুর কার্টুন আঁকলে তুলকালাম হয়ে যেত। আর্ট কলেজ উড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা আসত। ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা ‘অমুকের চামড়া তুলে নেব আমরা’—ধ্বনি দিয়ে রাজপথ উত্তাল করে তুলতেন। তাঁদের কারও কারও হাতে থাকত লোহার রড, ইট বা পাথরের টুকরা। গাড়ি ভাঙচুর হতো গোটা পঞ্চাশ। শিল্পীর বাড়িতে ছোঁয়ানো হতো আগুনের পরশমণি। শিল্পীর জীবন পুণ্য হতো দহন-দানে। এবং শিল্পীকে মকবুল ফিদা হুসেনের নিয়তি বরণ করতে হতো অন্তত আর একটি নির্বাচনে অন্য দলের সরকার ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত। সকাল-সন্ধ্যা হরতাল তো হতোই। তাতে লাভবান হতো বড় হাসপাতালগুলো। বিশেষ করে অর্থোপেডিক সার্জনরা।
বন প্রেসক্লাবের এক কর্তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই সব কার্টুনে যেসব নেতা কুকুর, গাধা, খচ্চর হিসেবে চিত্রিত হয়েছেন, তাঁরা—
তিনি বললেন, এ তো শিল্প—আর্ট। আমাদের সংবিধানে, যার নাম ‘বেসিক ল’—, বলা হয়েছে ‘আর্ট ইজ ফ্রি’—শিল্প ও শিল্পী স্বাধীন। চিন্তা ও কল্পনা করার পূর্ণ স্বাধীনতা তাঁদের দেওয়া হয়েছে।
আমাদের প্রজাতন্ত্রে আর্ট ফ্রি নয়। আর্টিস্ট তো ফ্রি ননই। যাঁরা ক্ষমতা ভোগ করেন, তাঁদের সম্পর্কে ‘আপত্তিকর’ কার্টুন আঁকেন এমন সাধ্য কার? তাঁদের কর্মদক্ষতার ফলে রাস্তাঘাট চাঁদের পিঠের মতো এবড়োখেবড়ো হোক, রিপোর্টও করা যাবে না, কার্টুন তো কদাচ নয়। হপ্তায় তিন দিন তিন-চারটি পত্রিকার পাতাজুড়ে প্রশংসা করা যাবে, সংগত কারণে সমালোচনা করা যাবে না। বাংলার মাটিতে কার্টুন আঁকা বেয়াদবি।
দেশের রাস্তাঘাট সড়ক-সেতুর অবস্থা অতি চমৎ কার। কোনো কোনো রাস্তায় এক দিন গাড়িতে গেলে আমাদের বয়সী মানুষের কোমরের হাড় সব আলগা হয়ে যায়। রাস্তাঘাটের দশা নিজের চোখে যা দেখেছেন, সংসদে তা-ই বলেছেন সাবেক মন্ত্রী ও জননেতা তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেছেন, দুই বছরে দেশের সড়ক উন্নয়নে তেমন কাজ হয়নি। তাঁর বক্তব্য টেবিল চাপড়ে মহাজোটের সদস্যরাই সমর্থন করেন। ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী ছিলেন চেয়ারে। তিনি বলেন, ‘এ বক্তব্য শুধু তোফায়েল আহমেদের নয়, গোটা সংসদের।’
প্রত্যুত্তরে যোগাযোগমন্ত্রী বলতে পারতেন, রাস্তাঘাটে বেশি ঘোরাঘুরি ও গাড়ি হাঁকানোর দরকার কী? কিন্তু তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেছেন: ‘তোফায়েল আহমেদ যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রতি তাঁর তীব্র ক্ষোভ ও ঈর্ষার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।’
তোফায়েল আহমেদ যদি কোনো কালে একজন ব্যর্থ যোগাযোগমন্ত্রী হতেন, তাহলে বর্তমান মন্ত্রীর সাফল্যে আলবত ঈর্ষা করতেন। তা ছাড়া তিনি একা ঈর্ষান্বিত হতেই পারেন, সংসদের সব সদস্য ঈর্ষাকাতর হলেন কীভাবে? তোফায়েল আহমেদকে আমরা চিনি ষাটের দশক থেকে। তাঁর সঙ্গে পরিচয় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে নয়—পিচঢালা তপ্ত রাজপথে। সড়ক ও রাজপথ সম্পর্কে তাঁর ধারণা অতি স্বচ্ছ।
যোগাযোগব্যবস্থার অবস্থা নিয়ে সংসদে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কাগজে প্রতিবেদন হয়েছে। প্রতিবেদক অপরাধ করেছেন এইটুকু যে, তিনি লিখতে পারতেন: বাংলাদেশের বর্তমান যোগাযোগব্যবস্থা শের শাহ ও নাজমুল হুদার সময়ের চেয়ে উত্তম। কার্টুনশিল্পী তাঁর ছবির নায়ককে বলতে পারতেন ‘প্রাসাদের সম্রাট’। তা না বলে তিনি বলেছেন ‘তালপাতার সেপাই’। মাননীয় মন্ত্রী সেই ‘বিকৃত ও অনৈতিক কার্টুন’ এবং ‘খবর ও রাস্তার ছবি দেখে’ ‘হতবাক’ হয়ে যান।
কার্টুন যে কারও মর্মমূলে আঘাত হানতে পারে বিষাক্ত শেলের মতো, তা এই প্রথম জানলাম। কার্টুনকে বাংলায় আমরা বলি ব্যঙ্গচিত্র বা রঙ্গচিত্র। তা শিল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। উপভোগের জিনিস।
কার্টুন হলো একধরনের আঁকিবুঁকি। কার্টুনের ছবিগুলোর হাত-পা আছে, কিন্তু সে হাত-পা নড়াচড়া করতে পারে না। কাউকে আঘাত করার জোর কার্টুনের হাতে নেই। সেই হাত ঘুষি দিতে পারে না। লাঠি ধরতে পারে না যে কারও মাথায় বাড়ি দেবে। ছুরি চালাতে পারে না যে কারও বুকে বসাবে। পিস্তলের ঘোড়া তো টিপতেই পারে না। সেই প্রাণহীন কার্টুনকে যখন কেউ ভয় করে, তখন বোঝা যায় তারা কতটা দুর্বল।
আজ এমন এক বাংলার মাটিতে আমরা বাস করছি, যেখানে কোনো নেতার নিজ এলাকায় শুভ আগমন উপলক্ষে লাখ লাখ টাকা খরচ করে তোরণ বানালে দোষ নেই। রংতুলি দিয়ে কাগজে একটি রঙ্গচিত্র আঁকলে মহা অপরাধ। বিকৃত কার্টুনের চেয়ে বিকৃত মন সমাজ ও জাতির জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments