আশার বসন্ত, নৈরাশ্যের শীত by শুভ রহমান
বাংলাদেশ রঙ্গমঞ্চে একের পর এক রুদ্ধশ্বাস নাটক অভিনীত হয়ে চলেছে, মানুষ নীরব দর্শক। জনদুর্ভোগ সীমাহীন, অন্তহীন। প্রথমে মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা সুরঞ্জিত এপিসোড, তারপর বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী এপিসোড, তারপর হরতাল, আর মানুষ জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ।
জানি না, ইতিহাস শিউরে উঠছে কি না। কোনো পরিবর্তন কি আসছে এসবের ভেতর দিয়ে? যেন থমকে থেমে আছে একটা পরিবর্তন। বড় রকম ধস নামছে কি ভেতরে ভেতরে? দেশ, রাষ্ট্র কি কোনো চমকপ্রদ পটপরিবর্তনের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে? পরিবর্তনকে রুখতেই কি প্রাণপণে প্রতিক্রিয়ার শক্তি একাট্টা? আরব বসন্ত তো এ নয়। আগামী কোনো বসন্তকেই মরিয়া হয়ে রোখার পাঁয়তারা। এত ক্ষুব্ধ, ক্ষতবিক্ষত, আগ্নেয়গিরির মতো ভেতরে গুমরে মরা লাভার স্রোতের মতো মানুষ পথ খুঁজছে, অপেক্ষা করছে একটা জ্বালামুখের জন্য! বুকের জ্বালা চেপে রেখেছে রুদ্ধশ্বাস মানুষ।
একি ভয়ংকর দিন এসে গেল, মানুষ কিছুই করতে পারবে না, শুধু অবরুদ্ধ থাকবে মহাকালের বিশাল এক বেড়ের মধ্যে! চোখের ওপর মানুষের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটবে, মানুষ কিছুই বলতে পারবে না! চারদিকে খুনখারাবি, ছিনতাই, ধর্ষণ, গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটতে থাকবে চোখের ওপর, মানুষ কিছুই বলতে পারবে না। এমন নিশ্চল, থেমে থাকা সময় অতীতে কখনোই ছিল না। এই স্তব্ধতা তবে কি কোনো ঝড়ের পূর্বাভাসমাত্র!
এটা স্পষ্ট যে একটা থেমে থাকা অবস্থান থেকে সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতির উল্লম্ফনের পূর্বমুহূর্ত এটা। যুদ্ধাপরাধ, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত নরপিশাচ স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচারের শেষ পর্ব ও রায়ের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন একটা পটপরিবর্তন ঘটে যাবে এ দেশের। ভয়ংকর উন্মত্ত হয়ে উঠেছে তাই হিংস্র সব স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি। তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে চোর, ডাকাত, লুটেরা, দুর্নীতিবাজ- নানা কিসিমের অন্তর্ঘাতী শক্তি। সবাই মিলে কিছু একটা কিছু ঘটাতে ষড়যন্ত্রের পর ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে। ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ মানুষ বস্তুত একরকম অন্ধকারেই।
কোথা দিয়ে কী হলো, কারা মধ্যরাতে বস্তাবোঝাই টাকা নিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ল, চাকরি থেকে বরখাস্ত হলো, অভিযোগের তীর মন্ত্রীর দিকে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত মন্ত্রী ঐতিহাসিক পদত্যাগের যেন নাটকই করলেন, বলা হলো পদত্যাগ নয়, আসলে পদচ্যুতি, আবার মন্ত্রিত্বে বহালও হলেন। গণতন্ত্রের কী যে নিদারুণ সংকট! যেন একটা বলির পাঁঠা প্রতিবাদী চিৎকার জুড়েছে তারস্বরে!
সব ঘটে চলেছে রাতের অন্ধকারেই। হঠাৎ করে ইলিয়াস আলীর আবির্ভাব রঙ্গমঞ্চে। সবই রাতদুপুরের কারবার। রাতের আঁধারেই রূপসী বাংলায় মিটিং। তাঁর বনানীর বাসায় কারা এসেছিল, মুখগুলো অন্ধকারেই ঢাকা পড়ে থাকছে। কারা রাস্তা থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে গুম করে ফেলল। সবই একটা থ্রিলারের মতো ঘটে চলেছে। সাধারণ মানুষের কোনো স্বার্থ নেই, কোনো হাত নেই এসবের মধ্যে। অথচ তাদের ভাগ্য বিড়ম্বিত হচ্ছে এসবের জন্যই। বলা হলো, সরকার, সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, র্যাব- তারাই তুলে নিয়ে গুম করেছে। তাজ্জব ব্যাপার! কেউ প্রশ্ন করল না, সরকারের স্বার্থটা কী! সরকারের কী লাভ হবে এতে, ক্ষতি ছাড়া! দেশ অস্থিতিশীল, মানুষের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে- আর সেই কাজটি জেনেশুনে সরকারকেই করতে হবে! গুজবের ডালপালা বেড়ে চলল। হরতালের পর হরতাল করে আরো বাড়িয়েই দেওয়া হলো অস্থিতিশীলতা, নৈরাজ্য। বাসচালক বদর আলীকে ঘুমন্ত অবস্থায় জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হলো। বদর আলীর পরিবারের কান্না-হাহাকার কারো কানে যাবে না। হরতালের এ-জাতীয় ঘটনা মানুষের সবই বহুবার দেখা। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। দেশজুড়ে পিকেটিং, বাস জ্বালানো, ভাঙচুর, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, গ্রেপ্তার, আর এত কিছুর ভেতর সাধারণ মানুষ ঘরের ভেতর শুধু অবরুদ্ধ হয়েই হাত কামড়াতে থাকে।
এই ঘৃণ্য রাজনীতি মানুষ চায় না, মনেপ্রাণে গণতন্ত্রই চায়, আইনের শাসনই চায়। কিন্তু এ কেমন গণতন্ত্রের দাবিতে, আইনের শাসনের দাবিতে আইন লঙ্ঘন, সম্পদ ধ্বংস করা, মানুষ হত্যা করা! এসব কি গণতন্ত্র নিয়ে আসার পথ! সচেতন মানুষ বুঝছে, সব কিছুই যেন একটা অবস্থাকে ঠেকানোর জন্য। একাত্তরে এ দেশে যে হত্যা, ধর্ষণ, ফসল-ঘরবাড়ি ধ্বংস, হানাদার পাকিস্তানিদের প্রত্যক্ষ মদদ জোগানো- সেই ভয়ংকর অপরাধের এবার যবনিকা তোলা ও চিরতরে তার যবনিকা পতনের ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ হতে চলেছে। পৃথিবীর বহু দেশেই স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়ে গেছে, সেসব দেশে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা সুপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, নিরঙ্কুশ হচ্ছে। আমাদের দেশে ৪০ বছরেও তা এখনো করা যায়নি। যত শ্লথই হোক, বিচার যে শেষ হবেই, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই অপরাধীদের অনিবার্যভাবে পেতে হবে, এখন আর তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে উন্মত্ত নৈরাজ্যের শক্তিকে, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার অন্তর্ঘাতী কার্যকলাপকে, একাত্তরের ঘৃণ্য, পরাজিত শক্তির পুনরুত্থানের অপচেষ্টা ও কৌশলকে সাধারণ মানুষ কিছুতেই সমর্থন করবে না। সাধারণ মানুষই চরম দুর্ভোগ সয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় ত্যাগ স্বীকার করে এ দেশে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে।
মাথার ওপর ঝুলন্ত ডেমোক্লিসের তরবারি
রাজনীতি ছাড়া দেশ চলে না। রাজনীতি যদি নিন্দিত, দায়িত্বজ্ঞানহীন, ধিক্কৃত, দূষিত, কলুষিত ও কার্যত পরিত্যাজ্য হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়েই চিন্তা করতে হয়। চলতি সময়ে দেশে এমন সব ঘটনা ঘটে চলছে, যাতে মানুষ রাজনীতি ও রাজনীতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিদারুণ বিতৃষ্ণ, হতাশ, এমনকি আতঙ্কিতও। মানুষের মনের এই অবস্থাটা যদি সর্বব্যাপী হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে দেশের জন্য তা সত্যিই বিপজ্জনক।
এখন ক্রমাগত নেতিবাচক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনীতি মানুষকে সেই অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মানুষ দেশের জন্য ভালো ও কল্যাণকর কিছু আশা করতে পারছে না।
মানুষকে ক্রমেই এ অবস্থায় নিয়ে আসছে প্রথমত. ব্যাপক দুর্নীতি, দ্বিতীয়ত. চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, তৃতীয়ত. অন্তঃকোন্দল ও নেপথ্য ষড়যন্ত্র, চতুর্থত. রাজনৈতিক সংস্কৃতির অধোগতি। দীর্ঘদিন ধরেই এসব ব্যাধির প্রকোপ ও প্রকাশ ঘটছে এবং তা পুঞ্জীভূত হতে হতে সমাজে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে।
আমরা সাধারণ মানুষ এই রাজনীতি চাই না। রাজনীতির সঙ্গে দায়িত্বজ্ঞানের নিবিড় সম্পর্ক বোঝাতেই বহুলপ্রচলিত সোর্ড অব ডেমোক্লিস প্রবাদবাক্যটির জন্ম। পুরো প্রবাদটি হলো, সোর্ড অব ডেমোক্লিস ইজ হ্যাংগিং ওভার হেড। মাথার ওপর ঝুলছে ডেমোক্লিসের উদ্যত তরবারি। ডেমোক্লিস একজন সাধারণ মানুষের প্রতীক। তাঁর ক্ষমতার মসনদে বসার খায়েশ মেটাতে একদা তাঁকে একটিবার সিংহাসনে উপবেশনের সুযোগ দেওয়া হলো। ডেমোক্লিস হৃষ্টচিত্তে সিংহাসনে বসে রাজকার্যে মনোনিবেশ করতে যাবেন, অকস্মাৎ একি! তাঁর দৃষ্টিতে পড়ে গেল সোজাসুজি ঠিক মাথার ওপর একেবারে খাড়াভাবে ঝুলছে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতের মতোই তীক্ষ্নধার তরবারি। অমনি ডেমোক্লিসের রাজ্যশাসন মাথায় উঠল। দরদর করে ঘামতে লাগলেন তিনি এবং কোনো কাজেই আর মনোনিবেশ করতে পারলেন না। একসময় মসনদ ছেড়ে, সব রাজপোশাক, দণ্ড ঝেড়ে ফেলে বাঁচলেন হাঁফ ছেড়ে। এই নাকি রাজ্যশাসন? ক্ষমতার রাজনীতিতে সেই দায়িত্ববোধ কোথায়! ক্ষমতার আসন যে অন্ধ আত্মসুখের নয়, কণ্টকসমমাত্র- এই চৈতন্যোদয় ঘটুক।
সুসময় দুঃসময়
এই একটা সময় চলে যাচ্ছে। এমন সুসময় যেমন ছিল না, এমন দুঃসময়ও আসেনি। সময়কে চিনতে হবে, সময়কে কাজে লাগাতে হবে। একটা সফল, অর্থবহ, সুফলদায়ক, সুখবহ, তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনই চায় মানুষ। শুধু নৈরাজ্যবাদীদের উন্মত্ত তাণ্ডবের, অথর্ব প্রশাসনের গাফিলতি, নিষ্ক্রিয়তার আর অসহায় শিকার হতে চায় না। 'ইট ওয়াজ দ্য বেস্ট অব টাইমস, ইট ওয়াজ দ্য ওয়ার্স্ট অব টাইমস, ইট ওয়াজ দি এজ অব উইসডম, ইট ওয়াজ দি এজ অব ফুলিশনেস, ইট ওয়াজ দি ইপক অব বিলিফ, ইট ওয়াজ দি ইপক অব ইনক্রেডুইলিটি, ইট ওয়াজ দ্য সিজন অব লাইট, ইট ওয়াজ দ্য সিজন অব ডার্কনেস, ইট ওয়াজ দ্য স্প্রিং অব হোপ, ইট ওয়াজ দ্য উইন্টার অব ডেসপেয়ার, উই হ্যাড এভরিথিং বিফোর আস, উই হ্যাড নাথিং বিফোর আস, উই ওয়্যার অল গোয়িং ডাইরেক্ট টু হেভেন, উই ওয়্যার অল গোয়িং ডাইরেক্ট দি আদারওয়ে- এটা ছিল সবচেয়ে সুসময়, এটা ছিল মহাদুঃসময়, এটা ছিল জ্ঞানের সময়, এটা ছিল নির্বুদ্ধিতার কাল, এটা ছিল বিশ্বাসের যুগ, এটা ছিল অবিশ্বাসের যুগ, এটা ছিল আলোর মৌসুম, এটা ছিল অন্ধকারের মৌসুম, এটা ছিল আশার বসন্ত, এটা ছিল নৈরাশ্যের শীত, তখন আমাদের সামনে ছিল সব কিছুই, তখন আমাদের সামনে কিছুই ছিল না, সবাই আমরা সরাসরি স্বর্গের পানে যাচ্ছিলাম, সবাই আমরা উল্টো দিকে চলছিলাম।' ['এ টেল অব টু সিটিজ', চার্লস ডিকেন্স।]
২৩.৪.২০১২
একি ভয়ংকর দিন এসে গেল, মানুষ কিছুই করতে পারবে না, শুধু অবরুদ্ধ থাকবে মহাকালের বিশাল এক বেড়ের মধ্যে! চোখের ওপর মানুষের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটবে, মানুষ কিছুই বলতে পারবে না! চারদিকে খুনখারাবি, ছিনতাই, ধর্ষণ, গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটতে থাকবে চোখের ওপর, মানুষ কিছুই বলতে পারবে না। এমন নিশ্চল, থেমে থাকা সময় অতীতে কখনোই ছিল না। এই স্তব্ধতা তবে কি কোনো ঝড়ের পূর্বাভাসমাত্র!
এটা স্পষ্ট যে একটা থেমে থাকা অবস্থান থেকে সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতির উল্লম্ফনের পূর্বমুহূর্ত এটা। যুদ্ধাপরাধ, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত নরপিশাচ স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচারের শেষ পর্ব ও রায়ের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন একটা পটপরিবর্তন ঘটে যাবে এ দেশের। ভয়ংকর উন্মত্ত হয়ে উঠেছে তাই হিংস্র সব স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি। তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে চোর, ডাকাত, লুটেরা, দুর্নীতিবাজ- নানা কিসিমের অন্তর্ঘাতী শক্তি। সবাই মিলে কিছু একটা কিছু ঘটাতে ষড়যন্ত্রের পর ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে। ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ মানুষ বস্তুত একরকম অন্ধকারেই।
কোথা দিয়ে কী হলো, কারা মধ্যরাতে বস্তাবোঝাই টাকা নিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ল, চাকরি থেকে বরখাস্ত হলো, অভিযোগের তীর মন্ত্রীর দিকে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত মন্ত্রী ঐতিহাসিক পদত্যাগের যেন নাটকই করলেন, বলা হলো পদত্যাগ নয়, আসলে পদচ্যুতি, আবার মন্ত্রিত্বে বহালও হলেন। গণতন্ত্রের কী যে নিদারুণ সংকট! যেন একটা বলির পাঁঠা প্রতিবাদী চিৎকার জুড়েছে তারস্বরে!
সব ঘটে চলেছে রাতের অন্ধকারেই। হঠাৎ করে ইলিয়াস আলীর আবির্ভাব রঙ্গমঞ্চে। সবই রাতদুপুরের কারবার। রাতের আঁধারেই রূপসী বাংলায় মিটিং। তাঁর বনানীর বাসায় কারা এসেছিল, মুখগুলো অন্ধকারেই ঢাকা পড়ে থাকছে। কারা রাস্তা থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে গুম করে ফেলল। সবই একটা থ্রিলারের মতো ঘটে চলেছে। সাধারণ মানুষের কোনো স্বার্থ নেই, কোনো হাত নেই এসবের মধ্যে। অথচ তাদের ভাগ্য বিড়ম্বিত হচ্ছে এসবের জন্যই। বলা হলো, সরকার, সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, র্যাব- তারাই তুলে নিয়ে গুম করেছে। তাজ্জব ব্যাপার! কেউ প্রশ্ন করল না, সরকারের স্বার্থটা কী! সরকারের কী লাভ হবে এতে, ক্ষতি ছাড়া! দেশ অস্থিতিশীল, মানুষের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে- আর সেই কাজটি জেনেশুনে সরকারকেই করতে হবে! গুজবের ডালপালা বেড়ে চলল। হরতালের পর হরতাল করে আরো বাড়িয়েই দেওয়া হলো অস্থিতিশীলতা, নৈরাজ্য। বাসচালক বদর আলীকে ঘুমন্ত অবস্থায় জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হলো। বদর আলীর পরিবারের কান্না-হাহাকার কারো কানে যাবে না। হরতালের এ-জাতীয় ঘটনা মানুষের সবই বহুবার দেখা। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। দেশজুড়ে পিকেটিং, বাস জ্বালানো, ভাঙচুর, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, গ্রেপ্তার, আর এত কিছুর ভেতর সাধারণ মানুষ ঘরের ভেতর শুধু অবরুদ্ধ হয়েই হাত কামড়াতে থাকে।
এই ঘৃণ্য রাজনীতি মানুষ চায় না, মনেপ্রাণে গণতন্ত্রই চায়, আইনের শাসনই চায়। কিন্তু এ কেমন গণতন্ত্রের দাবিতে, আইনের শাসনের দাবিতে আইন লঙ্ঘন, সম্পদ ধ্বংস করা, মানুষ হত্যা করা! এসব কি গণতন্ত্র নিয়ে আসার পথ! সচেতন মানুষ বুঝছে, সব কিছুই যেন একটা অবস্থাকে ঠেকানোর জন্য। একাত্তরে এ দেশে যে হত্যা, ধর্ষণ, ফসল-ঘরবাড়ি ধ্বংস, হানাদার পাকিস্তানিদের প্রত্যক্ষ মদদ জোগানো- সেই ভয়ংকর অপরাধের এবার যবনিকা তোলা ও চিরতরে তার যবনিকা পতনের ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ হতে চলেছে। পৃথিবীর বহু দেশেই স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়ে গেছে, সেসব দেশে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা সুপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, নিরঙ্কুশ হচ্ছে। আমাদের দেশে ৪০ বছরেও তা এখনো করা যায়নি। যত শ্লথই হোক, বিচার যে শেষ হবেই, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই অপরাধীদের অনিবার্যভাবে পেতে হবে, এখন আর তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে উন্মত্ত নৈরাজ্যের শক্তিকে, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার অন্তর্ঘাতী কার্যকলাপকে, একাত্তরের ঘৃণ্য, পরাজিত শক্তির পুনরুত্থানের অপচেষ্টা ও কৌশলকে সাধারণ মানুষ কিছুতেই সমর্থন করবে না। সাধারণ মানুষই চরম দুর্ভোগ সয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় ত্যাগ স্বীকার করে এ দেশে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে।
মাথার ওপর ঝুলন্ত ডেমোক্লিসের তরবারি
রাজনীতি ছাড়া দেশ চলে না। রাজনীতি যদি নিন্দিত, দায়িত্বজ্ঞানহীন, ধিক্কৃত, দূষিত, কলুষিত ও কার্যত পরিত্যাজ্য হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়েই চিন্তা করতে হয়। চলতি সময়ে দেশে এমন সব ঘটনা ঘটে চলছে, যাতে মানুষ রাজনীতি ও রাজনীতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিদারুণ বিতৃষ্ণ, হতাশ, এমনকি আতঙ্কিতও। মানুষের মনের এই অবস্থাটা যদি সর্বব্যাপী হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে দেশের জন্য তা সত্যিই বিপজ্জনক।
এখন ক্রমাগত নেতিবাচক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনীতি মানুষকে সেই অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মানুষ দেশের জন্য ভালো ও কল্যাণকর কিছু আশা করতে পারছে না।
মানুষকে ক্রমেই এ অবস্থায় নিয়ে আসছে প্রথমত. ব্যাপক দুর্নীতি, দ্বিতীয়ত. চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, তৃতীয়ত. অন্তঃকোন্দল ও নেপথ্য ষড়যন্ত্র, চতুর্থত. রাজনৈতিক সংস্কৃতির অধোগতি। দীর্ঘদিন ধরেই এসব ব্যাধির প্রকোপ ও প্রকাশ ঘটছে এবং তা পুঞ্জীভূত হতে হতে সমাজে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে।
আমরা সাধারণ মানুষ এই রাজনীতি চাই না। রাজনীতির সঙ্গে দায়িত্বজ্ঞানের নিবিড় সম্পর্ক বোঝাতেই বহুলপ্রচলিত সোর্ড অব ডেমোক্লিস প্রবাদবাক্যটির জন্ম। পুরো প্রবাদটি হলো, সোর্ড অব ডেমোক্লিস ইজ হ্যাংগিং ওভার হেড। মাথার ওপর ঝুলছে ডেমোক্লিসের উদ্যত তরবারি। ডেমোক্লিস একজন সাধারণ মানুষের প্রতীক। তাঁর ক্ষমতার মসনদে বসার খায়েশ মেটাতে একদা তাঁকে একটিবার সিংহাসনে উপবেশনের সুযোগ দেওয়া হলো। ডেমোক্লিস হৃষ্টচিত্তে সিংহাসনে বসে রাজকার্যে মনোনিবেশ করতে যাবেন, অকস্মাৎ একি! তাঁর দৃষ্টিতে পড়ে গেল সোজাসুজি ঠিক মাথার ওপর একেবারে খাড়াভাবে ঝুলছে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতের মতোই তীক্ষ্নধার তরবারি। অমনি ডেমোক্লিসের রাজ্যশাসন মাথায় উঠল। দরদর করে ঘামতে লাগলেন তিনি এবং কোনো কাজেই আর মনোনিবেশ করতে পারলেন না। একসময় মসনদ ছেড়ে, সব রাজপোশাক, দণ্ড ঝেড়ে ফেলে বাঁচলেন হাঁফ ছেড়ে। এই নাকি রাজ্যশাসন? ক্ষমতার রাজনীতিতে সেই দায়িত্ববোধ কোথায়! ক্ষমতার আসন যে অন্ধ আত্মসুখের নয়, কণ্টকসমমাত্র- এই চৈতন্যোদয় ঘটুক।
সুসময় দুঃসময়
এই একটা সময় চলে যাচ্ছে। এমন সুসময় যেমন ছিল না, এমন দুঃসময়ও আসেনি। সময়কে চিনতে হবে, সময়কে কাজে লাগাতে হবে। একটা সফল, অর্থবহ, সুফলদায়ক, সুখবহ, তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনই চায় মানুষ। শুধু নৈরাজ্যবাদীদের উন্মত্ত তাণ্ডবের, অথর্ব প্রশাসনের গাফিলতি, নিষ্ক্রিয়তার আর অসহায় শিকার হতে চায় না। 'ইট ওয়াজ দ্য বেস্ট অব টাইমস, ইট ওয়াজ দ্য ওয়ার্স্ট অব টাইমস, ইট ওয়াজ দি এজ অব উইসডম, ইট ওয়াজ দি এজ অব ফুলিশনেস, ইট ওয়াজ দি ইপক অব বিলিফ, ইট ওয়াজ দি ইপক অব ইনক্রেডুইলিটি, ইট ওয়াজ দ্য সিজন অব লাইট, ইট ওয়াজ দ্য সিজন অব ডার্কনেস, ইট ওয়াজ দ্য স্প্রিং অব হোপ, ইট ওয়াজ দ্য উইন্টার অব ডেসপেয়ার, উই হ্যাড এভরিথিং বিফোর আস, উই হ্যাড নাথিং বিফোর আস, উই ওয়্যার অল গোয়িং ডাইরেক্ট টু হেভেন, উই ওয়্যার অল গোয়িং ডাইরেক্ট দি আদারওয়ে- এটা ছিল সবচেয়ে সুসময়, এটা ছিল মহাদুঃসময়, এটা ছিল জ্ঞানের সময়, এটা ছিল নির্বুদ্ধিতার কাল, এটা ছিল বিশ্বাসের যুগ, এটা ছিল অবিশ্বাসের যুগ, এটা ছিল আলোর মৌসুম, এটা ছিল অন্ধকারের মৌসুম, এটা ছিল আশার বসন্ত, এটা ছিল নৈরাশ্যের শীত, তখন আমাদের সামনে ছিল সব কিছুই, তখন আমাদের সামনে কিছুই ছিল না, সবাই আমরা সরাসরি স্বর্গের পানে যাচ্ছিলাম, সবাই আমরা উল্টো দিকে চলছিলাম।' ['এ টেল অব টু সিটিজ', চার্লস ডিকেন্স।]
২৩.৪.২০১২
No comments