সাক্ষাৎকার-সংবিধান সংশোধন হবে মতৈক্যের ভিত্তিতেই by আবদুল মতিন খসরু

বিশেষসংবিধান সংশোধন ও পুনর্মুদ্রণ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ পুনর্মুদ্রণের এখতিয়ার এমনকি রায় অনুযায়ী হয়েছে কি না, সেসব প্রশ্নও তুলেছেন। এ ব্যাপারে গতকাল শনিবার সাবেক আইনমন্ত্রী ও জাতীয় সংসদে বিশেষ কমিটির সদস্য আবদুল মতিন খসরু এবং সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। নিচে তা পত্রস্থ হলো।


 সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো  পুনর্মুদ্রিত সংবিধান বাংলাদেশের কার্যকর সংবিধান কি না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, ‘এটাকে আমরা খসড়া ধরে অগ্রসর হব।’ আপনার মন্তব্য কী?
আবদুল মতিন খসরু  আমাদের সংসদীয় বিশেষ কমিটির কার্যক্রম এখনো চলমান। আমরা কোনো কিছুই চূড়ান্ত করিনি। আমরা মতৈক্যের ভিত্তিতে সর্বজনীনভাবে করতে চাই। এই সংবিধান হবে ১৬ কোটি মানুষের জন্য।
প্রথম আলো  পুনর্মুদ্রিত সংবিধান এখন কার্যকর কি না?
আবদুল মতিন খসরু  আমাদের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন, সেটিই চূড়ান্ত সংবিধান। এখন আমাদের কাছে সংবিধানের যে কপি দেওয়া হয়েছে, সেটা খসড়া হিসেবে দেওয়া হয়েছে। আমরা এখন এর ওপর কাজ করছি। আমাদের যে সিদ্ধান্ত হবে, সেটা আমরা সংসদে উপস্থাপন করব। সংসদ খুঁটিনাটি বিবেচনা করে যে সিদ্ধান্ত নেবে, সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সেটাই কার্যকর সংবিধান হিসেবে গণ্য হবে।
প্রথম আলো  আপনার কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে সংবিধান নিয়ে আমরা এখন যেমনটা বলছি যে এটি একটি সাংঘর্ষিক অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, সেটা তো দুর্বল হয়ে যায়।
আবদুল মতিন খসরু  দেখুন, সংবিধান একটি সর্বজনীন বিষয়। এতে প্রতিটি মানুষের অংশীদারি রয়েছে। আমরা কোনো অবস্থাতেই কোনো বিতর্কিত বিষয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করছি না। আপিল বিভাগ একটি মাইলফলক রায় দিয়েছেন। তাঁরা আমাদের আলো দেখাচ্ছেন। কিন্তু সংবিধান সংশোধনের একমাত্র এখতিয়ার হলো ৬৫ অনুচ্ছেদের আওতায় গঠিত এককভাবে সংসদের। আমরা যদি সংবিধানবহির্ভূতভাবে কোনো বিধান করি, তাহলে সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করার এখতিয়ার রাখেন।
প্রথম আলো  কিন্তু সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ থেকে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শের বিধান তারা তুলে দিয়েছে। এর ফলে মাসদার হোসেনের মামলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
আবদুল মতিন খসরু  এ রকম করার এখতিয়ার আইন মন্ত্রণালয়ের নেই। তাদের দায়িত্ব হলো শুধু ছাপানোর। বিগত বিএনপির আমলে যখন মওদুদ সাহেব আইনমন্ত্রী ছিলেন, তখন অষ্টম সংশোধনী মামলায় ১০০ অনুচ্ছেদের ওপর যে রায় দেওয়া হয়েছিল, তার আলোকে তাঁরা সংবিধান ছেপেছিলেন। আমরা সেটাকেই সংবিধানের সংশোধন হিসেবে ধরে নিয়েছি। এবারেও আইন মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল আপিল বিভাগ যেভাবে রায় দিয়েছেন, সেভাবেই ছাপানোর। যদি তার ব্যত্যয় কিছু থেকে থাকে, তাহলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। সংসদের কাছে নয়, দেশবাসীর কাছে নয়, সংসদীয় কমিটির কাছেও নয়।
প্রথম আলো  কিন্তু আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী কোন অনুচ্ছেদের পরিবর্তে কোন অনুচ্ছেদ বসবে, সে বিষয়ে একটি দফাওয়ারি খসড়া আপনাদের কমিটির কাছে পেশ করেছিল। কমিটি সেটি আইন কমিশনে পাঠিয়েছিল। কিন্তু সেখানে আমরা দেখেছিলাম, আদালত যা বলেননি, তাঁর নাম করে অনেক কিছুই চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন আমরা দেখছি, সেই সুপারিশমালার চেয়েও তারা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। যেমন—তারা দালাল আইন পুনর্বহাল করেছে, ১৪৫(ক) অনুচ্ছেদ বিলোপ করেছে।
আবদুল মতিন খসরু  এ ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো, সংবিধান সংশোধন, বিয়োজন, পরিবর্তন করার কোনো এখতিয়ার আইন মন্ত্রণালয়ের নেই। সংসদ যেভাবে সংবিধান সংশোধন করবে কিংবা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যেভাবে নির্দেশনা দেবেন, তার একচুল বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ আইন মন্ত্রণালয়ের নেই। আইন মন্ত্রণালয় যে খসড়া সংবিধান আমাদের দিয়েছে, পঞ্চম সংশোধনীর মামলার আলোকে এখন আমরা তা খতিয়ে দেখছি। আপিল বিভাগের নির্দেশনার বাইরে তা যতটুকুই যাবে, ততটুকু বাতিল বলে গণ্য হবে। সংসদই তার আপন এখতিয়ারবলে সংবিধানের যেকোনো অনুচ্ছেদে পরিবর্তন বা সংশোধন আনতে পারে। সেটাই চূড়ান্ত হবে। আইন মন্ত্রণালয়ের কাজ শুধু মুদ্রণ।
প্রথম আলো  তাহলে বলুন, আপনারা উপযুক্ত সংশোধনী এনে যে নতুন সংবিধান উপহার দেবেন, তাতে কতটা সময় লাগবে?
আবদুল মতিন খসরু  সংসদনেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের একটি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, যত অল্প সময়ের মধ্যে সম্ভব কাজ সারতে হবে।
প্রথম আলো  কমিটি যখন বৈঠকে বসল, তখন কার্যবিবরণী থেকে দেখলাম, সাজেদা চৌধুরী বলেছেন, দুই মাসের মধ্যে করতে হবে। এখন মুদ্রণ করতে অনেক সময় কেটে গেল।
আবদুল মতিন খসরু  আমরা ইনশা আল্লাহ এক থেকে দুই মাসের মধ্যে সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে পারব। আমরা কোনো অবস্থাতেই কোনো ভুলত্রুটি সংবিধানে রাখব না। আমরা কতগুলো মৌলিক নীতিমালা গ্রহণ করেছি। প্রথমত, সাংবিধানিক উপায় ছাড়া অন্য কোনো পেশিশক্তি বা সামরিক আইন, ফরমান ইত্যাদি দ্বারা সংবিধানের যত পরিবর্তন এসেছে, তা বাতিল। দ্বিতীয়ত, সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর যত ধরনের পরিবর্তন হয়েছে, তা যখন যারাই করুক না কেন, তা আমরা বাতিল করব। তৃতীয়ত, আমাদের সংবিধানের মূল নীতি ও লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা, তার ভেতর আমরা থাকব।
প্রথম আলো  ধর্মনিরপেক্ষতা পুনর্বহাল এবং কোনো ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা তথা রাজনৈতিক মর্যাদা দেওয়া কি সামঞ্জস্যপূর্ণ?
আবদুল মতিন খসরু  এককভাবে কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দেওয়া সংবিধানের মৌল নীতির পরিপন্থী। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের একটি দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন, সেটা হলো ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা এবং আমাদের সংবিধানের অন্যতম মৌলিক কাঠামো। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। সব ধর্মের প্রতি আমরা শ্রদ্ধা প্রদর্শন করব। যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে। কোনো ধর্মকেই আমরা খাটো করে দেখব না। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে আমরা তা-ই বুঝি।
প্রথম আলো  কিন্তু একটা পশ্চাৎপদতা সম্ভবত ঘটতে চলেছে। সেটা হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কোনো দল নিষিদ্ধ হবে না।
আবদুল মতিন খসরু  পৃথিবীর কোনো দেশেই যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা আছে, সেখানে ধর্মকে নিষিদ্ধ করা হয়নি।
প্রথম আলো  না, ধর্মের প্রশ্ন তো নয়। পুনর্মুদ্রিত সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে আমরা বুঝতে পারছি...
আবদুল মতিন খসরু  ৩৮ অনুচ্ছেদের মূল কথা হলো ধর্মকে যাতে রাষ্ট্রীয়, ব্যক্তিগত বা দলীয়ভাবে কেউ অপব্যবহার করতে না পারে। সেটাকে প্রতিরোধ করার জন্য সংবিধানে ৩৮ ও ১২ অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হয়েছিল। আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হলো, ‘সকল ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা’।
প্রথম আলো  কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগে ধর্মের নাম ব্যবহার করে কোনো দল বা সংঘ বাংলাদেশে তৎপরতা চালায়নি—এবং তা নিয়ে তেমন বিতর্ক ছিল না। তিয়াত্তর সালে সাধারণ মানুষ সেটা মেনে নিয়েই ভোট দিয়েছে। আপনারা সেখান থেকে এখন কি সরে আসবেন?
আবদুল মতিন খসরু  না। আমরা এক ইঞ্চিও সরে আসছি না। একবিংশ শতাব্দীর রাজনীতির বাস্তবতা, জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন এবং সংবিধানের মৌলিক কাঠামো থেকে আমরা একটু হলেও পিছিয়ে আসতে পারব না। সেই ক্ষমতা সংসদেরও নেই। যদি আজ যাই, তাহলে সুপ্রিম কোর্ট কাল তা বাতিল করবেন।
প্রথম আলো  সংবিধান সংশোধনে নিতান্ত রাজনৈতিক দিক নিয়ে খুব বেশি কথা হয়। আপনারা কিন্তু বলেন না যে শাসনগত উৎকর্ষ সাধনে কী ধরনের সংস্কারের কথা ভাবছেন। আপনারা সংবিধানে ক্ষমতার ভারসাম্য, বিচারপতি নিয়োগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে কী করবেন?
আবদুল মতিন খসরু  এ বিষয়েও আমাদের চিন্তা আছে। এটি একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া। আমরা বিচারক নিয়োগ ও অপসারণে অভিশংসনের প্রথা ফিরিয়ে আনার কথাও ভাবছি। কিন্তু আমরা কোনো একটি বিষয়েও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাইনি। সুশাসন, স্বচ্ছতা হলো গণতন্ত্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। সে জন্য যা করতে হয়, আমরা তা করব।
প্রথম আলো  বিচারপতিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার বিধানটাও বিলুপ্ত করবেন কি না? বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক রেখেও এটা করতে রাজি।
আবদুল মতিন খসরু  আমরা এমন কিছু করব না, যাতে প্রতিক্রিয়াশীল অথবা গণতন্ত্রের বিরোধী শক্তি কোনো অস্ত্র পেয়ে যায়।
প্রথম আলো  আপনাকে ধন্যবাদ।
আবদুল মতিন খসরু: ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.