ফিরে দেখা-বাঙালি সেনাদের বিদ্রোহপ্রবণতা ও পিলখানা হত্যাযজ্ঞ by মুহাম্মদ লুৎফুল হক
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীতে আইন অমান্য, ক্যু ও বিদ্রোহের প্রবণতা লক্ষ করা যায়, যা আশির দশকের প্রথম দিকে এসে স্তিমিত হয়। তবে ভেতরে ভেতরে বীজ থেকেই যায়, যার প্রমাণ পাওয়া যায় ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে বিডিআর হত্যাযজ্ঞে।
এসব ক্যু বা বিদ্রোহে সাধারণভাবে দুটি ঝোঁক পরিলক্ষিত হয়—রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল ও অফিসার নিধন। স্বাধীনতার ৪০ বছরের মধ্যে সংঘটিত এ ধরনের বিদ্রোহে দুজন রাষ্ট্রপতিসহ কয়েক শ কর্মকর্তা ও সাধারণ সৈনিক নিহত হয়েছেন। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত বিডিআর হত্যাযজ্ঞ এই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ সংযোজন এবং এটির ভয়াবহতা আগের সবগুলোর চেয়ে বীভৎস ও নারকীয়। এ ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জন নিহত হন।
১৯১৬ সালে ব্রিটিশ বাহিনীতে বাঙালিদের নিয়ে প্রথম পদাতিক ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগে ব্রিটিশ বাহিনীতে কোনো বাঙালি পল্টন ছিল না। ১৯১৮ সালের ৯ জুন বাগদাদে অবস্থানকালে এই ব্যাটালিয়নের কয়েকজন সৈনিক একজন বাঙালি কর্মকর্তাকে হত্যা এবং দুজন বাঙালি কর্মকর্তাকে গুরুতরভাবে আহত করেন। ব্যাটালিয়নটি ১৯২০ সালে বাতিল করে দেওয়া হয়। এই ব্যাটালিয়ন বাতিল করে দেওয়ার অন্যতম কারণ ছিল ‘কর্মকর্তা হত্যা’। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বাঙালিদের নিয়ে একটি কোস্টাল আর্টিলারি ব্যাটরি গঠন করা হয়। প্রশিক্ষণকালে কলকাতার খিদিরপুরে ব্যাটরিতে বিদ্রোহ হয়। ফলে কোস্টাল ব্যাটরিটি ভেঙে দেওয়া হয়। এর পর থেকে আজ অবধি ব্রিটিশ ও ভারতীয় বাহিনীতে বাঙালিদের নিয়ে আর কোনো ইউনিট গঠন করা হয়নি। পাকিস্তান সময়ে ১৯৪৮ সালে ঢাকায় পুলিশ বিদ্রোহ হয়েছিল, যা শক্ত হাতে দমন করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে এবং বিমানসেনারা কোত থেকে অস্ত্র সংগ্রহের আগেই সেনাবাহিনী বিমানবাহিনীর কোত দখল করে নিলে বিদ্রোহ দমন ও কর্মকর্তা নিধন বন্ধ করা সম্ভব হয়। একই সময় বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) ও তৎকালীন রক্ষীবাহিনীর মধ্যে কলহের জের হিসেবে বিডিআর বিদ্রোহ হয়, যা বঙ্গবন্ধুকে পিলখানায় সশরীরে উপস্থিত থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল সেনার হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। ৭ নভেম্বর অনেক সেনা কর্মকর্তা নিহত হন জওয়ানদের হাতে। ১৯৭৭ সালে বিমানবাহিনী ও সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক জওয়ানের ফাঁসি হয়। এর পরও বিভিন্ন সেনানিবাসে ছোটখাটো বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিহত হন একদল বিদ্রোহী সেনার হাতে।
সৈনিক বা নিম্নপদস্থদের দ্বারা কর্মকর্তা বা ঊর্ধ্বতন সৈনিক নিধনকে সামরিক পরিভাষায় ফ্রেগিং বলা হয়। শব্দটি সত্তরের দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে প্রচলিত হলেও ইতিহাসে ফ্রেগিংয়ের অনেক ঘটনা লক্ষ করা যায়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে ফ্রেগিংয়ে ২৩০ জন আমেরিকান কর্মকর্তা নিহত হন। ওই সময়ে এক হাজার ৪০০ জন কর্মকর্তার মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। ধারণা করা যায়, এর একটা বড় অংশই ফ্রেগিংয়ের কারণে হয়েছিল। ভারতে ২০০৬ সালে এ ধরনের ঘটনায় ৪০ জন কর্মকর্তা ও ঊর্ধ্বতন সৈনিক তাঁদের অধস্তনদের দ্বারা নিহত হন। গবেষকেরা ফ্রেগিংয়ের জন্য মানসিক চাপ ও নেতৃত্বের মানকে বেশি দায়ী করেছেন। বাংলাদেশে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার বেশির ভাগ ফ্রেগিংয়ের আওতায় পড়ে না; এগুলোকে বিদ্রোহ বলা যায়। তবে এ ধরনের ঘটনাগুলোর প্রায় সব ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা বলি হয়েছেন।
বাহিনীসমূহ থেকে বিদ্রোহ বিষয়ে বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যায় না এবং এর সঠিক পরিসংখ্যানও তাদের কাছে নেই বলেই প্রতীয়মান হয়। বাহিনীর মধ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তা গোপন করার প্রবণতা দেখা যায় এবং পারতপক্ষে এর যাবতীয় প্রমাণ ও দলিল ধ্বংস করে ফেলার চেষ্টা করা হয়। বাহিনীসমূহ নিজেদের প্রশাসনিক প্রয়োজনে হয়তো ঘটনা-পরবর্তী তদন্ত করে বা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়। এগুলোও গোপনীয়তার লৌহ আবরণে ঢাকা থাকে।
বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কেন ঘটে বা এর প্রতিকার কী, তা নিয়ে বাংলাদেশে কাদা-ছোড়াছুড়ি এবং বিচার (বেশির ভাগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে) করা হলেও বিশেষ কোনো গবেষণা হয়নি। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে গবেষণা হয়। এসব গবেষণা থেকে বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডের মূল যে কারণগুলো বেরিয়ে আসে, তা অনেকটাই নিম্নরূপ:
১. ত্রুটিপূর্ণ রিক্রুটমেন্ট এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ ও মোটিভেশনের অভাব।
২. নেতৃত্বের মান এবং ঊর্ধ্বতন ও অধস্তনদের মধ্যকার সম্পর্ক।
৩. কর্মকর্তা ও অধীনস্থদের তুলনামূলক সংখ্যার অসামঞ্জস্য।
৪. বাহিনীসমূহে রাজনীতির প্রভাব এবং রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের সৃষ্টি।
৫. দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রভাব।
বাংলাদেশে সংঘটিত বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডগুলোর কারণও একই ধরনের হতে পারে। কেউ কেউ বিষয়টিকে সামাজিক ব্যাধি হিসেবে উল্লেখ করেছেন, তবে তা গবেষণার বিষয়। কারণগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব হলে অবশ্যই এর প্রতিকার করাও সম্ভব হবে।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত বিডিআর হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; আগে বর্ণিত কারণগুলোর সঙ্গে এ ঘটনার বেশ মিল আছে। হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত বিডিআর সদস্যদের একটি অংশ তরুণ এবং গত এক দশকে ভর্তিকৃত। জানা যায়, এদের অনেকেই ঘুষ বা দুর্নীতির মাধ্যমে বিডিআরে-ভর্তি হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই এদের মধ্যে অল্প সময়ে অধিক অর্থ উপার্জনের প্রবণতা ছিল। বেশ কিছুদিন থেকে বিডিআরকে নিজস্ব বা প্রচলিত দায়িত্বের বাইরে এমন কিছু দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়, যা তাদের পেশাগত মূল্যবোধ ও নৈতিকতার বিপরীত ছিল। ফলে তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ব্যাহত হয় এবং শৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের অপরাধ বা শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতি উন্মুখ হয়ে পড়ে। এ ছাড়া বিডিআরে কর্মকর্তা ও কর্মচারীর তুলনামূলক সংখ্যার মধ্যেও পার্থক্য খুব বেশি ছিল। ফলে এত বড় একটি হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা ও কার্যকর করার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ সৃষ্টি হয়নি। বিডিআর প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে এমনিতেই অধিক মাত্রায় ব্যারাকের বাইরে থাকে। ফলে কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ কম থাকে। তাই সহজেই বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যায় সংক্রমিত হয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সর্বোপরি বিডিআরে নেতৃত্বের মান নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সামরিক বাহিনী থেকে আসা বা নিজস্ব কর্মকর্তা উভয়েরই ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা ছিল, ফলে ঊর্ধ্বতন ও অধস্তনদের মধ্যকার সম্পর্ক বিদ্রোহ ও হত্যাযজ্ঞের অনুকূলে যায়।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, হত্যাকাণ্ড ও বিদ্রোহে শুধু বাহিনীসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়; কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এতে দেশেরও অপূরণীয় ক্ষতি হয়, দেশ ও জাতির ঐক্যেও ফাটল ধরিয়ে দিতে পারে। আফ্রিকার কয়েকটি দেশে এ ধরনের উপর্যুপরি বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ড গৃহযুদ্ধের জন্ম দিয়েছে। এ ধরনের বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডে দেশের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়, তা সবাই স্বীকার করেন। অথচ গত ৪০ বছরে বিভিন্ন বাহিনীতে ২০-২৫টিরও বেশি এ ধরনের ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, সামরিক গবেষক, ঐতিহাসিকদের সমন্বয়ে কোনো আন্তরিক বা গভীর গবেষণা হয়নি। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রোধের জন্য প্রয়োজনে আগের সব বিদ্রোহ এবং হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে গবেষণা করানো উচিত।
মুহাম্মদ লুৎফুল হক: গবেষক ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা।
lutful55@gmail.com
১৯১৬ সালে ব্রিটিশ বাহিনীতে বাঙালিদের নিয়ে প্রথম পদাতিক ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগে ব্রিটিশ বাহিনীতে কোনো বাঙালি পল্টন ছিল না। ১৯১৮ সালের ৯ জুন বাগদাদে অবস্থানকালে এই ব্যাটালিয়নের কয়েকজন সৈনিক একজন বাঙালি কর্মকর্তাকে হত্যা এবং দুজন বাঙালি কর্মকর্তাকে গুরুতরভাবে আহত করেন। ব্যাটালিয়নটি ১৯২০ সালে বাতিল করে দেওয়া হয়। এই ব্যাটালিয়ন বাতিল করে দেওয়ার অন্যতম কারণ ছিল ‘কর্মকর্তা হত্যা’। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বাঙালিদের নিয়ে একটি কোস্টাল আর্টিলারি ব্যাটরি গঠন করা হয়। প্রশিক্ষণকালে কলকাতার খিদিরপুরে ব্যাটরিতে বিদ্রোহ হয়। ফলে কোস্টাল ব্যাটরিটি ভেঙে দেওয়া হয়। এর পর থেকে আজ অবধি ব্রিটিশ ও ভারতীয় বাহিনীতে বাঙালিদের নিয়ে আর কোনো ইউনিট গঠন করা হয়নি। পাকিস্তান সময়ে ১৯৪৮ সালে ঢাকায় পুলিশ বিদ্রোহ হয়েছিল, যা শক্ত হাতে দমন করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে এবং বিমানসেনারা কোত থেকে অস্ত্র সংগ্রহের আগেই সেনাবাহিনী বিমানবাহিনীর কোত দখল করে নিলে বিদ্রোহ দমন ও কর্মকর্তা নিধন বন্ধ করা সম্ভব হয়। একই সময় বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) ও তৎকালীন রক্ষীবাহিনীর মধ্যে কলহের জের হিসেবে বিডিআর বিদ্রোহ হয়, যা বঙ্গবন্ধুকে পিলখানায় সশরীরে উপস্থিত থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল সেনার হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। ৭ নভেম্বর অনেক সেনা কর্মকর্তা নিহত হন জওয়ানদের হাতে। ১৯৭৭ সালে বিমানবাহিনী ও সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক জওয়ানের ফাঁসি হয়। এর পরও বিভিন্ন সেনানিবাসে ছোটখাটো বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিহত হন একদল বিদ্রোহী সেনার হাতে।
সৈনিক বা নিম্নপদস্থদের দ্বারা কর্মকর্তা বা ঊর্ধ্বতন সৈনিক নিধনকে সামরিক পরিভাষায় ফ্রেগিং বলা হয়। শব্দটি সত্তরের দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে প্রচলিত হলেও ইতিহাসে ফ্রেগিংয়ের অনেক ঘটনা লক্ষ করা যায়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে ফ্রেগিংয়ে ২৩০ জন আমেরিকান কর্মকর্তা নিহত হন। ওই সময়ে এক হাজার ৪০০ জন কর্মকর্তার মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। ধারণা করা যায়, এর একটা বড় অংশই ফ্রেগিংয়ের কারণে হয়েছিল। ভারতে ২০০৬ সালে এ ধরনের ঘটনায় ৪০ জন কর্মকর্তা ও ঊর্ধ্বতন সৈনিক তাঁদের অধস্তনদের দ্বারা নিহত হন। গবেষকেরা ফ্রেগিংয়ের জন্য মানসিক চাপ ও নেতৃত্বের মানকে বেশি দায়ী করেছেন। বাংলাদেশে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার বেশির ভাগ ফ্রেগিংয়ের আওতায় পড়ে না; এগুলোকে বিদ্রোহ বলা যায়। তবে এ ধরনের ঘটনাগুলোর প্রায় সব ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা বলি হয়েছেন।
বাহিনীসমূহ থেকে বিদ্রোহ বিষয়ে বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যায় না এবং এর সঠিক পরিসংখ্যানও তাদের কাছে নেই বলেই প্রতীয়মান হয়। বাহিনীর মধ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তা গোপন করার প্রবণতা দেখা যায় এবং পারতপক্ষে এর যাবতীয় প্রমাণ ও দলিল ধ্বংস করে ফেলার চেষ্টা করা হয়। বাহিনীসমূহ নিজেদের প্রশাসনিক প্রয়োজনে হয়তো ঘটনা-পরবর্তী তদন্ত করে বা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়। এগুলোও গোপনীয়তার লৌহ আবরণে ঢাকা থাকে।
বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কেন ঘটে বা এর প্রতিকার কী, তা নিয়ে বাংলাদেশে কাদা-ছোড়াছুড়ি এবং বিচার (বেশির ভাগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে) করা হলেও বিশেষ কোনো গবেষণা হয়নি। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে গবেষণা হয়। এসব গবেষণা থেকে বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডের মূল যে কারণগুলো বেরিয়ে আসে, তা অনেকটাই নিম্নরূপ:
১. ত্রুটিপূর্ণ রিক্রুটমেন্ট এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ ও মোটিভেশনের অভাব।
২. নেতৃত্বের মান এবং ঊর্ধ্বতন ও অধস্তনদের মধ্যকার সম্পর্ক।
৩. কর্মকর্তা ও অধীনস্থদের তুলনামূলক সংখ্যার অসামঞ্জস্য।
৪. বাহিনীসমূহে রাজনীতির প্রভাব এবং রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের সৃষ্টি।
৫. দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রভাব।
বাংলাদেশে সংঘটিত বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডগুলোর কারণও একই ধরনের হতে পারে। কেউ কেউ বিষয়টিকে সামাজিক ব্যাধি হিসেবে উল্লেখ করেছেন, তবে তা গবেষণার বিষয়। কারণগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব হলে অবশ্যই এর প্রতিকার করাও সম্ভব হবে।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত বিডিআর হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; আগে বর্ণিত কারণগুলোর সঙ্গে এ ঘটনার বেশ মিল আছে। হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত বিডিআর সদস্যদের একটি অংশ তরুণ এবং গত এক দশকে ভর্তিকৃত। জানা যায়, এদের অনেকেই ঘুষ বা দুর্নীতির মাধ্যমে বিডিআরে-ভর্তি হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই এদের মধ্যে অল্প সময়ে অধিক অর্থ উপার্জনের প্রবণতা ছিল। বেশ কিছুদিন থেকে বিডিআরকে নিজস্ব বা প্রচলিত দায়িত্বের বাইরে এমন কিছু দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়, যা তাদের পেশাগত মূল্যবোধ ও নৈতিকতার বিপরীত ছিল। ফলে তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ব্যাহত হয় এবং শৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের অপরাধ বা শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতি উন্মুখ হয়ে পড়ে। এ ছাড়া বিডিআরে কর্মকর্তা ও কর্মচারীর তুলনামূলক সংখ্যার মধ্যেও পার্থক্য খুব বেশি ছিল। ফলে এত বড় একটি হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা ও কার্যকর করার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ সৃষ্টি হয়নি। বিডিআর প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে এমনিতেই অধিক মাত্রায় ব্যারাকের বাইরে থাকে। ফলে কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ কম থাকে। তাই সহজেই বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যায় সংক্রমিত হয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সর্বোপরি বিডিআরে নেতৃত্বের মান নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সামরিক বাহিনী থেকে আসা বা নিজস্ব কর্মকর্তা উভয়েরই ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা ছিল, ফলে ঊর্ধ্বতন ও অধস্তনদের মধ্যকার সম্পর্ক বিদ্রোহ ও হত্যাযজ্ঞের অনুকূলে যায়।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, হত্যাকাণ্ড ও বিদ্রোহে শুধু বাহিনীসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়; কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এতে দেশেরও অপূরণীয় ক্ষতি হয়, দেশ ও জাতির ঐক্যেও ফাটল ধরিয়ে দিতে পারে। আফ্রিকার কয়েকটি দেশে এ ধরনের উপর্যুপরি বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ড গৃহযুদ্ধের জন্ম দিয়েছে। এ ধরনের বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডে দেশের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়, তা সবাই স্বীকার করেন। অথচ গত ৪০ বছরে বিভিন্ন বাহিনীতে ২০-২৫টিরও বেশি এ ধরনের ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, সামরিক গবেষক, ঐতিহাসিকদের সমন্বয়ে কোনো আন্তরিক বা গভীর গবেষণা হয়নি। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রোধের জন্য প্রয়োজনে আগের সব বিদ্রোহ এবং হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে গবেষণা করানো উচিত।
মুহাম্মদ লুৎফুল হক: গবেষক ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা।
lutful55@gmail.com
No comments