উন্নয়ন-জনপ্রতিনিধিরা সম্পৃক্ত থাকবেন না কেন? by আলতাফ পারভেজ

বাংলাদেশের 'পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি'তে এমপিদের ভূমিকা অপ্রতিরোধ্য। দুর্যোগে দেওয়া খয়রাতি সাহায্য থেকে শুরু করে নির্বাচনী এলাকার কোনো দফতরে কর্মী নিয়োগ পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে তাদের সুতীক্ষষ্ট নজরদারি। কিন্তু একটি সেক্টর দশকের পর দশক তাদের কর্তৃত্ব এড়িয়ে যেতে পেরেছে সফলতার সঙ্গে।


এনজিও উন্নয়ন ধারায় জনপ্রতিনিধিদের মতামতের প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ নেই। গণতন্ত্রে এটা কি অনুমোদনযোগ্য?
অন্যতম জনবহুল দরিদ্র দেশ হলেও এবং শাসক হিসেবে মূলধারার রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার পরও বাংলাদেশে মানুষ এখনও 'শান্ত ও সহনশীল।' বামপন্থি এবং ডানপন্থি কারোরই এখানে রাজনৈতিক অগ্রগতি নেই। বাংলাদেশিদের এই যে 'শান্তিপ্রিয় সহনশীলতা'_ তা আন্তর্জাতিকভাবে বিশেষ স্বস্তির। দরিদ্রদের এভাবে সহনশীল ও স্বস্তিতে রাখার কর্তৃত্ব অবশ্যই এনজিও সেক্টরের প্রাপ্য।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এনজিওদের বিপুল উপস্থিতি। বর্তমান লেখক টাঙ্গাইলে মধুপুর নামক ক্ষুদ্র এলাকায় ৩২টি এনজিওকে কাজ করতে দেখেছেন। নিয়মিত রক্তাক্ত ও উত্তপ্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় দেড়শ' এনজিও সক্রিয়। বিপুল সংখ্যক মানুষ এসব এনজিওর 'সুবিধাভোগী'। কিন্তু এই বেনিফিশিয়ারিদের কাছে এনজিওদের 'ইমেজ' সুখকর নয়। আবার এনজিওদের 'সার্ভিস' গ্রহণ করে। এনজিওদের তারা প্রত্যাখ্যান করেনি। প্রতিরোধও করেনি। ভালোও বাসে না, ঘৃণাও করে না। তবে এনজিওদের কার্যক্রমের ফলাফল সুস্পষ্ট। আমূল সংস্কারবাদী রাজনীতি ও আদর্শকে অসম্ভব করে দিয়েছে এনজিও মডেল।
এনজিওদের প্রধান সাফল্য, তারা 'ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ' নামক শাস্ত্রের গোড়াপত্তন করেছে এবং তাকে বিকশিত করেছে। দরিদ্র কৃষি সমাজে উন্নয়ন ভাবনার বিকাশ ও একে নানাভাবে চর্চা জরুরি ছিল; যা কেবল রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে হচ্ছিল না, হওয়া সম্ভব ছিল না।
রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ দুর্বল। বিপুল জনসংখ্যার মৌলিক চাহিদার জোগান দেওয়া এবং তাদের দেখাশোনা এই রাষ্ট্রের প্রশাসনের পক্ষে চার দশক আগে যেমন সম্ভব ছিল না_ এখনও তেমনি সম্ভব নয়। এনজিওরা সেই শূন্যতা পূরণ করেছে। প্রাথমিক শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে অগ্রগতির অন্যতম অংশীদার তারা। এনজিওরাই 'উন্নয়ন সেক্টর' নামে নতুন ও জরুরি একটি খাতের সূচনা ঘটিয়েছে এবং অপরিহার্যতা প্রমাণ করেছে। যদিও ১৯৭১ সালে এ দেশে যত মানুষ দরিদ্র ছিল এখন সে সংখ্যা আরও বেড়েছে কিন্তু এই দরিদ্ররা কোনো মাওবাদী বা মোল্লা ওমরের খপ্পরে পড়েনি। সে ক্ষেত্রে ভালো 'পাহারা' দিয়েছে এনজিওরা।
এনজিও উদ্যোগের আরেক প্রশংসনীয় দিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিসরে অন্যান্য দেশের উন্নয়ন কর্মী, গবেষক, যোগাযোগ কর্মী, মানবাধিকার কর্মীদের সঙ্গে বাংলাদেশের উন্নয়ন খাতের পেশাজীবীদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ও সংলাপের জায়গা তৈরি করা। রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র কখনোই এটা করতে পারত না। এই যোগাযোগ ও মতামত বিনিময় খুবই অপরিহার্য। কারণ এখানে জ্ঞান ও দক্ষতার ঐতিহাসিক ঘাটতি ছিল এবং আছে। এনজিও পেশাজীবীরা সেই ঘাটতি ভালোভাবে পূরণ করেছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্ব বাণিজ্য সংক্রান্ত সংলাপ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আসরে বাংলাদেশ সরকারের এখন আর কারিগরি কোনো অসহায়ত্ব নেই। কারণ এরূপ আন্তর্জাতিক সংলাপে দেশের স্বার্থ বোঝার মতো উন্নয়ন-পেশাজীবী এখন এনজিও সেক্টরে রয়েছে।
ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরের এতসব সাফল্যের পরও এনজিওদের প্রতি সামাজিক মনোভাব এত শীতল কেন? এর কারণ, হয়তো এনজিও কাজে প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা ও জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগের অভাব। যদিও জনগণের নামেই সব হচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে এখানে রাষ্ট্রীয় পরিসরে জবাবদিহিতার সংস্কৃতির তীব্র অভাব। রাজনীতিবিদদের সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব সংক্রমিত হয়েছে এখন এনজিও ব্যক্তিত্বদের মধ্যেও।
অধিকাংশ এনজিও প্রতিষ্ঠান এক ব্যক্তি-নির্ভর। যদিও প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নির্বাহী পরিচালকের কাজের তদারকির জন্য একটি করে 'উচ্চতর পরিষদ' রয়েছে, কিন্তু তা এমনভাবে গঠিত হয় যে, সেই পরিষদ কখনও নির্বাহী পরিচালকের কাজের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। একই ব্যক্তি অন্তত ৫-১০টি সংস্থার উপদেষ্টা পরিষদে রয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত এনজিওগুলোতে বিপুল। জবাবদিহিতাহীনতার সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো, এনজিওরা মাঠ পর্যায়ে পুরোপুরি জনস্বার্থে উন্নয়ন কাজে যুক্ত হলেও কোনো স্তরের জনপ্রতিনিধিদের এনজিও উদ্যোগগুলো সম্পর্কে মতামত রাখার সুযোগ নেই। অর্থাৎ ফরিদপুরে যদি কোনো এনজিও কার্যক্রম চলতে থাকে সেই বিষয়ে ফরিদপুরের কোনো উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান, এমপি বা অন্য কোনো জনপ্রতিনিধির প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মতামত রাখার সুযোগ নেই। গণতান্ত্রিক সমাজে এটা এক অবিশ্বাস্য অবস্থা।
গত এপ্রিল পর্যন্ত কেবল এ অর্থবছরে এনজিও ব্যুরো ৩৭০৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকার বিদেশি অনুদান ছাড় করেছে। ১৯৯০ সাল থেকে ২০১১-এর এপ্রিল পর্যন্ত এরূপ ছাড় হয়েছে ৩৪ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ গড় হিসাবে গত দুই দশকে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে কেবল এনজিও তরফ থেকে প্রায় ৫০ লাখ টাকা খরচ হওয়ার কথা। বিদেশি এই সাহায্য কীভাবে খরচ হলো, কে তার সুবিধাভোগী_ এসব বিষয় অবশ্যই জনগণের জানার কথা; নিদেনপক্ষে জনপ্রতিনিধিদের জানা উচিত। উপরন্তু আগামী ২০ বছরে যদি অনুরূপভাবে প্রতি গ্রামে ৫০ লাখ টাকা বিদেশি অনুদান খরচ হয় সে সম্পর্কেও জনপ্রতিনিধিদের মতামত থাকা স্বাভাবিক ও অপরিহার্য। কিন্তু তার সুযোগ নেই বর্তমান অবস্থায়।
এনজিও কাজের তদারকির জন্য এনজিও ব্যুরো নামক যে প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাও অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এ সংস্থার লোকবলের ঘাটতি রয়েছে। এত বেশি এনজিও এত ধরনের প্রকল্প পরিচালনা করছে যে, ক্ষুদ্র একটি ব্যুরোর পক্ষে তা মনিটর করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তদারকির চেয়ে তারা এনজিও নির্বাহীদের সঙ্গে 'বোঝাপড়া'র পথে চলেছেন। এ পরিস্থিতি জবাবদিহিতাহীনতার সংস্কৃতি আরও বিস্তৃত করেছে এবং যেসব ব্যক্তি প্রকৃতই সৎ অবস্থান থেকে উন্নয়ন খাতে অবদান রাখতে এসেছিলেন তারা নিরুৎসাহিত ও কোণঠাসা অবস্থায় পড়েছেন।
এ অবস্থার প্রধান এক সংস্কার হতে পারে এনজিও নির্বাহী পরিষদে জনপ্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্তির বিধান করা। এনজিওদের এজেন্ডা 'উন্নয়ন'। উন্নয়ন কাজ কোনো অবস্থাতেই জনপ্রতিনিধিদের মতামত ছাড়া হতে পারে না।

আলতাফ পারভেজ : লেখক ও গবেষক
altafparvez@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.