লোকগণনা প্রতিবেদন-ভুল থাকলে সংশোধনে বদনাম হয় না by একেএম নূর-উন-নবী
পঞ্চম লোকগণনা বা আদমশুমারির প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের লোকসংখ্যা ১৪ কোটি ২৩ লাখ ১৯ হাজার। এর মধ্যে ৭ কোটি ১২ লাখ ৫৫ হাজার পুরুষ এবং ৭ কোটি ১০ লাখ ৬৪ হাজার নারী। এটা প্রাথমিক প্রতিবেদন এবং চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ভুলভ্রান্তি থাকলে তা দূর করে পরিবর্তন আনা হবে, এটা অবধারিত।
আমরা এখন ধরে নিতে পারি যে, ১৪ কোটি ১৩ লাখ নিছকই একটি সংখ্যা, যা নিয়ে বেশি আলোচনায় যাওয়া যায় না। তবে পারসেপশন বলে একটা কথা রয়েছে এবং সে কারণে অনেকের কাছে বিষয়টিতে খটকা লাগতে পারে। সমকালে কিছুদিন আগে ইউএনডিপির একটি প্রতিবেদনের সূত্র উল্লেখ করে 'জনসংখ্যার চাপ : শুধু খাদ্যে নয়, সমস্যা দেখা দেবে জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও' শিরোনামে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। ইউএনডিপির প্রতিবেদনে সে সময়ে (অক্টোবর, ২০১০) বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের লোকসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৪ লাখ। তবে সে সময়েই কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলতে চেয়েছেন, দেশের লোকসংখ্যা ১৫ কোটির বেশি হবে না। এ ধরনের হিসাব নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা হওয়ায় ১৪ কোটি ২৩ লাখ সংখ্যাটি একটু ধাক্কা তো দেয়ই। কেউ কেউ হয়তো একটু বেশিই ধাক্কা খেয়েছেন। ১৬ থেকে ১৪ কোটিতে লোকসংখ্যা নেমে এলে তো খুশির খবর, কিন্তু সেটা গ্রহণযোগ্য হতে হবে বৈকি।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সার্বিক তত্ত্বাবধানে বিপুলসংখ্যক কর্মী ঘরে ঘরে গিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের তথ্য সংগ্রহ করেছেন। প্রতিবেদন প্রকাশ করে তারা বলছেন, আমরা যা জানতে পেরেছি সেভাবেই প্রকাশ করেছি। এতে কোনো লুকোচুরির সুযোগ নেই। প্রকৃতই তারা যা পেয়েছেন, সেটাই দিয়েছেন। যেটা পাননি, কিংবা বলা যায় যদি কেউ কেউ গণনা থেকে বাদ পড়ে থাকেন, তাদের তথ্য দেওয়া পরিসংখ্যান ব্যুরোর পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আমরা সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে দেখছি_ কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলতে চাইছেন যে অনেকে গণনা থেকে বাদ পড়েছেন। ব্যক্তিগতভাবেও অনেকের অভিযোগ যে তাদের ঘরে গণনাকর্মী যাননি। এমন ধরনের অভিযোগ বিশ্বের সব দেশে শোনা যায়। আর এ কারণেই রয়েছে দ্বিতীয় পর্যায়ে নমুনা জরিপ পরিচালনা করে ত্রুটি সংশোধনের ব্যবস্থা। এ দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বা বিআইডিএসকে। এটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত। তাদের ওপর আস্থা রাখা যায়। তাদের কর্মীরা নির্ধারিত এলাকায় বাড়ি বাড়ি যাবেন। আশা করব যে, তারা ভুলত্রুটি থাকলে সেটা চিহ্নিত করে প্রকৃত লোকসংখ্যার হিসাব দিতে পারবেন।
আমাদের স্বাধীন দেশে প্রথম সেনসাস হয় ১৯৭৪ সালে। তখন প্রথম গণনায় ৬.৯ শতাংশের মতো লোক বাদ পড়েছিল। দ্বিতীয় গণনা হয় ১৯৮১ সালে_ তখন বাদ পড়েছিল ৩.২ শতাংশ। ১৯৯১ সালে তৃতীয় গণনায় বাদ পড়ে ৪.৭ শতাংশ। ২০০১ সালেও প্রথম গণনা সংশোধন করে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ৫ শতাংশ লোক বেশি দেখানো হয়। এবার কি গণনা থেকে বাদ পড়া লোকের সংখ্যা বেশি হবে? এ জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
তবে আপাতত যে সমস্যা তার কথা বলি। যদি লোকসংখ্যা ১৬ কোটি না হয়ে ১৪ কোটি হয়, তাহলে কিছু সুবিধা ও কিছু অসুবিধা তাৎক্ষণিক অনুভব করার কথা। যেমন_ দুই কোটির বেশি লোক কমে গেলে বাজারে চাল-ডালের মতো পণ্যের জোগানে তা অনুভব হতে পারে। লোক যা ধারণা করা হয়েছিল তার তুলনায় কম_ এটা নিশ্চিত হলে সরবরাহ যা ছিল তা বেশি হওয়ার কথা। এ অবস্থায় পণ্যের দাম কিছুটা কমার কথা। কিন্তু প্রাথমিক হিসাব প্রকাশের পর তেমনটি ঘটেনি। রাস্তায় যানজটও রয়েছে আগের মতোই। বাস্তবে প্রাথমিক প্রতিবেদনের আগে যেসব সমস্যা ছিল, পরেও তাই রয়েছে। এমন অবস্থার অর্থ হচ্ছে, ১৬ কোটিই হোক আর ১২ কোটিই হোক আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তার প্রভাব পড়ছে না। আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ_ আমাদের যা অবকাঠামো এবং সম্পদ তাতে বর্তমান লোকসংখ্যা যাই হোক তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। আমাদের রাজপথে সমস্যা, বাজারে সমস্যা, স্কুল ও হাসপাতালে সমস্যা। সর্বত্রই বলা হচ্ছে, মানুষ বেশি বলেই এটা ঘটছে।
আমাদের দেশের লোক আমাদেরই। তারা কেউ দেশে রয়েছেন, কেউবা দেশের বাইরে। প্রবাসে যারা থাকেন, তারা মাঝে মধ্যে আসেন। লোকগণনার হিসাবে তাদের অন্তর্ভুক্ত করার একটি পদ্ধতি রয়েছে। অনেকে বলেন, প্রবাসে থাকা লোকের সংখ্যা ৭৫-৮০ লাখ হবে। গণনায় তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ বাদ পড়ে থাকতে পারে। তাদের হিসাবে ঠিকভাবে না নেওয়া হলে বিভিন্ন বিষয়ে পরিকল্পনা প্রণয়নে সমস্যা দেখা দেয়।
লোকগণনা শুধু মাথা গোনার বিষয় নয়। এখন নতুন একটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলছে। আরও রয়েছে ভিশন ২০২১। দেশের লোকসংখ্যার সঠিক হিসাব জানা না থাকলে দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজে ভুল থাকবে। ভুল পরিকল্পনা প্রণয়নের ফলে তার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও সম্পদের জোগানসহ অন্যান্য পদক্ষেপে ভুল হতে থাকবে।
পরিসংখ্যান ব্যুরো যে কাজটি করেছে তা একেবারে মূলে গিয়ে_ তাদের কর্মীদের যেতে হয়েছে ঘরে ঘরে। এ কারণে এটা একেবারে নির্ভুল না হলেও কাছাকাছি হবে, সেটাই প্রত্যাশা। অন্যরা নানা সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। অর্থাৎ সেকেন্ডারি সূত্র। আগামী ১০ বছর আমাদের মূল ভরসা থাকবে এবারের লোকগণনা। এটা ঠিক যে, প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর বেশ কিছু মহল থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এমনকি কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীও বলেছেন, লোকসংখ্যা ১৪ কোটি হলে দেশ খাদ্যে উদ্বৃত্ত হওয়ার কথা। কিন্তু গত অর্থবছরে দেশকে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়েছে এবং তার পেছনে প্রচুর ব্যয় পড়েছে সরকারের। এখন আমাদের ভরসা বিআইডিএস। তারা আরেক দফা লোকগণনা করবে। এ জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এলাকা নির্ধারণ করা হবে। তাদের কাজ নিখুঁত হবে এবং স্বাধীনভাবে কাজ পরিচালনা করবেন, এটাই প্রত্যাশা থাকবে। তারা যদি বের করেন যে, ৭ শতাংশ লোক প্রাথমিক গণনায় বাদ পড়েছিল, তাহলে পরিসংখ্যান ব্যুরোকে সেটাই গ্রহণ করতে হবে। যদি বলে যে হিসাবে ১ শতাংশ লোক বেশি গণনা করা হয়েছিল, তাহলে সেটাই চূড়ান্ত। মূল কথা হচ্ছে, বিআইডিএস যেন চূড়ান্ত পেশাদারিত্বের পরিচয় দেয় এবং তাদের কাজে ও প্রতিবেদন প্রকাশের প্রক্রিয়ায় কোনোভাবেই যেন কোনো হস্তক্ষেপের ঘটনা না ঘটে। গত মার্চ মাসের গণনায় ভুল যদি হয়ে থাকে এবং তা চিহ্নিত হয় তাতে পরিসংখ্যান ব্যুরোর বদনাম হবে, এমন ভাবার কারণ নেই। আমরা চাই নির্ভুল একটি হিসাব। নইলে পদে পদে তার খেসারত দিতে হবে। প্রথম গণনার সঙ্গে বিআইডিএসের কাজের মিল থাকার কোনো দরকার নেই। ভুল হলে তার নানা কারণ থাকতে পারে। যেমন কর্মীরা বাড়ি বাড়ি যাননি। প্রচারের কাজ যথাযথভাবে হয়নি বলে অভিযোগ ছিল এবং তা অমূলক নয়। লোকগণনা এবং বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ঢাকা আসর একই সময়ে ছিল। বিশ্বকাপের এ আয়োজন ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। ফলে চাপা পড়েছে সেনসাসের মতো একটি অপরিহার্য বিষয়। মনিটরিংয়েও ত্রুটি থাকতে পারে। কারণ যাই হোক সে জন্য গণনায় ভুল থাকতে পারে না। বিআইডিএস যেন আমাদের সবাইকে আশ্বস্ত করার মতো প্রতিবেদন দেয়, সেটাই চাইব। তারা যদি স্বাধীনভাবে কাজের মাধ্যমে বলতে পারে যে, ১৪ কোটি ২৩ লাখই সঠিক সংখ্যা, তার চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না। তবে এ কাজ অবশ্যই হতে হবে ত্রুটিমুক্ত।
প্রাথমিক হিসাবে শহর ও গ্রামের লোকসংখ্যার অনুপাত দেওয়া যেত। আরও কিছু তথ্য যোগ হতে পারত। পুরুষরা নারীদের তুলনায় বেশি বাদ পড়েছে গণনা থেকে, এমন কথা বলা হচ্ছে। তবে আবারও বলছি, আমি সংখ্যা নিয়ে পড়ে থাকতে রাজি নই। আমাদের লোকসংখ্যা বেশি এবং সে কারণে অনেক সমস্যা প্রকট হয়ে পড়েছে। এর সমাধানে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। তা হবে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি। আমরা চাই প্রতিটি মানুষ যেন সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনে যেতে পারে। ১৪ না ১৬ কোটি সেটা বড় কথা নয়। যারা দেশের নাগরিক তাদের সমস্যার সমাধানে আমাদের অনেক কিছু করার রয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, তারা যা পেয়েছে তা প্রাথমিক প্রতিবেদনে দিয়েছে। অবশ্যই যা পাওয়া যায়নি, তা দেওয়া যাবে না। বিআইডিএসও যেন যা পায় ঠিক সেটাই দেয়। আমরা যেন দ্বিতীয়বার ভুল না করি। ভবিষ্যতেও যেন আফসোস করতে না হয়। বদনাম যদি হয়েও থাকে সেটা যেন একবারেই শেষ হয়ে যায়।
ড. একেএম নূর-উন-নবী : অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সার্বিক তত্ত্বাবধানে বিপুলসংখ্যক কর্মী ঘরে ঘরে গিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের তথ্য সংগ্রহ করেছেন। প্রতিবেদন প্রকাশ করে তারা বলছেন, আমরা যা জানতে পেরেছি সেভাবেই প্রকাশ করেছি। এতে কোনো লুকোচুরির সুযোগ নেই। প্রকৃতই তারা যা পেয়েছেন, সেটাই দিয়েছেন। যেটা পাননি, কিংবা বলা যায় যদি কেউ কেউ গণনা থেকে বাদ পড়ে থাকেন, তাদের তথ্য দেওয়া পরিসংখ্যান ব্যুরোর পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আমরা সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে দেখছি_ কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলতে চাইছেন যে অনেকে গণনা থেকে বাদ পড়েছেন। ব্যক্তিগতভাবেও অনেকের অভিযোগ যে তাদের ঘরে গণনাকর্মী যাননি। এমন ধরনের অভিযোগ বিশ্বের সব দেশে শোনা যায়। আর এ কারণেই রয়েছে দ্বিতীয় পর্যায়ে নমুনা জরিপ পরিচালনা করে ত্রুটি সংশোধনের ব্যবস্থা। এ দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বা বিআইডিএসকে। এটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত। তাদের ওপর আস্থা রাখা যায়। তাদের কর্মীরা নির্ধারিত এলাকায় বাড়ি বাড়ি যাবেন। আশা করব যে, তারা ভুলত্রুটি থাকলে সেটা চিহ্নিত করে প্রকৃত লোকসংখ্যার হিসাব দিতে পারবেন।
আমাদের স্বাধীন দেশে প্রথম সেনসাস হয় ১৯৭৪ সালে। তখন প্রথম গণনায় ৬.৯ শতাংশের মতো লোক বাদ পড়েছিল। দ্বিতীয় গণনা হয় ১৯৮১ সালে_ তখন বাদ পড়েছিল ৩.২ শতাংশ। ১৯৯১ সালে তৃতীয় গণনায় বাদ পড়ে ৪.৭ শতাংশ। ২০০১ সালেও প্রথম গণনা সংশোধন করে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ৫ শতাংশ লোক বেশি দেখানো হয়। এবার কি গণনা থেকে বাদ পড়া লোকের সংখ্যা বেশি হবে? এ জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
তবে আপাতত যে সমস্যা তার কথা বলি। যদি লোকসংখ্যা ১৬ কোটি না হয়ে ১৪ কোটি হয়, তাহলে কিছু সুবিধা ও কিছু অসুবিধা তাৎক্ষণিক অনুভব করার কথা। যেমন_ দুই কোটির বেশি লোক কমে গেলে বাজারে চাল-ডালের মতো পণ্যের জোগানে তা অনুভব হতে পারে। লোক যা ধারণা করা হয়েছিল তার তুলনায় কম_ এটা নিশ্চিত হলে সরবরাহ যা ছিল তা বেশি হওয়ার কথা। এ অবস্থায় পণ্যের দাম কিছুটা কমার কথা। কিন্তু প্রাথমিক হিসাব প্রকাশের পর তেমনটি ঘটেনি। রাস্তায় যানজটও রয়েছে আগের মতোই। বাস্তবে প্রাথমিক প্রতিবেদনের আগে যেসব সমস্যা ছিল, পরেও তাই রয়েছে। এমন অবস্থার অর্থ হচ্ছে, ১৬ কোটিই হোক আর ১২ কোটিই হোক আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তার প্রভাব পড়ছে না। আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ_ আমাদের যা অবকাঠামো এবং সম্পদ তাতে বর্তমান লোকসংখ্যা যাই হোক তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। আমাদের রাজপথে সমস্যা, বাজারে সমস্যা, স্কুল ও হাসপাতালে সমস্যা। সর্বত্রই বলা হচ্ছে, মানুষ বেশি বলেই এটা ঘটছে।
আমাদের দেশের লোক আমাদেরই। তারা কেউ দেশে রয়েছেন, কেউবা দেশের বাইরে। প্রবাসে যারা থাকেন, তারা মাঝে মধ্যে আসেন। লোকগণনার হিসাবে তাদের অন্তর্ভুক্ত করার একটি পদ্ধতি রয়েছে। অনেকে বলেন, প্রবাসে থাকা লোকের সংখ্যা ৭৫-৮০ লাখ হবে। গণনায় তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ বাদ পড়ে থাকতে পারে। তাদের হিসাবে ঠিকভাবে না নেওয়া হলে বিভিন্ন বিষয়ে পরিকল্পনা প্রণয়নে সমস্যা দেখা দেয়।
লোকগণনা শুধু মাথা গোনার বিষয় নয়। এখন নতুন একটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলছে। আরও রয়েছে ভিশন ২০২১। দেশের লোকসংখ্যার সঠিক হিসাব জানা না থাকলে দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজে ভুল থাকবে। ভুল পরিকল্পনা প্রণয়নের ফলে তার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও সম্পদের জোগানসহ অন্যান্য পদক্ষেপে ভুল হতে থাকবে।
পরিসংখ্যান ব্যুরো যে কাজটি করেছে তা একেবারে মূলে গিয়ে_ তাদের কর্মীদের যেতে হয়েছে ঘরে ঘরে। এ কারণে এটা একেবারে নির্ভুল না হলেও কাছাকাছি হবে, সেটাই প্রত্যাশা। অন্যরা নানা সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। অর্থাৎ সেকেন্ডারি সূত্র। আগামী ১০ বছর আমাদের মূল ভরসা থাকবে এবারের লোকগণনা। এটা ঠিক যে, প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর বেশ কিছু মহল থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এমনকি কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীও বলেছেন, লোকসংখ্যা ১৪ কোটি হলে দেশ খাদ্যে উদ্বৃত্ত হওয়ার কথা। কিন্তু গত অর্থবছরে দেশকে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়েছে এবং তার পেছনে প্রচুর ব্যয় পড়েছে সরকারের। এখন আমাদের ভরসা বিআইডিএস। তারা আরেক দফা লোকগণনা করবে। এ জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এলাকা নির্ধারণ করা হবে। তাদের কাজ নিখুঁত হবে এবং স্বাধীনভাবে কাজ পরিচালনা করবেন, এটাই প্রত্যাশা থাকবে। তারা যদি বের করেন যে, ৭ শতাংশ লোক প্রাথমিক গণনায় বাদ পড়েছিল, তাহলে পরিসংখ্যান ব্যুরোকে সেটাই গ্রহণ করতে হবে। যদি বলে যে হিসাবে ১ শতাংশ লোক বেশি গণনা করা হয়েছিল, তাহলে সেটাই চূড়ান্ত। মূল কথা হচ্ছে, বিআইডিএস যেন চূড়ান্ত পেশাদারিত্বের পরিচয় দেয় এবং তাদের কাজে ও প্রতিবেদন প্রকাশের প্রক্রিয়ায় কোনোভাবেই যেন কোনো হস্তক্ষেপের ঘটনা না ঘটে। গত মার্চ মাসের গণনায় ভুল যদি হয়ে থাকে এবং তা চিহ্নিত হয় তাতে পরিসংখ্যান ব্যুরোর বদনাম হবে, এমন ভাবার কারণ নেই। আমরা চাই নির্ভুল একটি হিসাব। নইলে পদে পদে তার খেসারত দিতে হবে। প্রথম গণনার সঙ্গে বিআইডিএসের কাজের মিল থাকার কোনো দরকার নেই। ভুল হলে তার নানা কারণ থাকতে পারে। যেমন কর্মীরা বাড়ি বাড়ি যাননি। প্রচারের কাজ যথাযথভাবে হয়নি বলে অভিযোগ ছিল এবং তা অমূলক নয়। লোকগণনা এবং বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ঢাকা আসর একই সময়ে ছিল। বিশ্বকাপের এ আয়োজন ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। ফলে চাপা পড়েছে সেনসাসের মতো একটি অপরিহার্য বিষয়। মনিটরিংয়েও ত্রুটি থাকতে পারে। কারণ যাই হোক সে জন্য গণনায় ভুল থাকতে পারে না। বিআইডিএস যেন আমাদের সবাইকে আশ্বস্ত করার মতো প্রতিবেদন দেয়, সেটাই চাইব। তারা যদি স্বাধীনভাবে কাজের মাধ্যমে বলতে পারে যে, ১৪ কোটি ২৩ লাখই সঠিক সংখ্যা, তার চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না। তবে এ কাজ অবশ্যই হতে হবে ত্রুটিমুক্ত।
প্রাথমিক হিসাবে শহর ও গ্রামের লোকসংখ্যার অনুপাত দেওয়া যেত। আরও কিছু তথ্য যোগ হতে পারত। পুরুষরা নারীদের তুলনায় বেশি বাদ পড়েছে গণনা থেকে, এমন কথা বলা হচ্ছে। তবে আবারও বলছি, আমি সংখ্যা নিয়ে পড়ে থাকতে রাজি নই। আমাদের লোকসংখ্যা বেশি এবং সে কারণে অনেক সমস্যা প্রকট হয়ে পড়েছে। এর সমাধানে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। তা হবে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি। আমরা চাই প্রতিটি মানুষ যেন সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনে যেতে পারে। ১৪ না ১৬ কোটি সেটা বড় কথা নয়। যারা দেশের নাগরিক তাদের সমস্যার সমাধানে আমাদের অনেক কিছু করার রয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, তারা যা পেয়েছে তা প্রাথমিক প্রতিবেদনে দিয়েছে। অবশ্যই যা পাওয়া যায়নি, তা দেওয়া যাবে না। বিআইডিএসও যেন যা পায় ঠিক সেটাই দেয়। আমরা যেন দ্বিতীয়বার ভুল না করি। ভবিষ্যতেও যেন আফসোস করতে না হয়। বদনাম যদি হয়েও থাকে সেটা যেন একবারেই শেষ হয়ে যায়।
ড. একেএম নূর-উন-নবী : অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ
No comments