চারদিক-কলকাতার শহীদ মিনার by অমর সাহা

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মানুষও বাংলায় কথা বলে, এটা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আর বাংলাদেশের বাঙালিরা ভাষা আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বাংলাদেশের ভাষাশহীদদের স্মরণে গড়েছে শহীদ মিনার।


পাকিস্তান আমলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের এত তোড়জোড় ছিল না। তখন বাংলাদেশের (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) সঙ্গে ভারতের ছিল অহিনকুল-সম্পর্ক। যোগাযোগ ছিল প্রায় বিচ্ছিন্ন। বাংলাদেশের দুটি প্রধান উৎসব একুশে ফেব্রুয়ারি আর বাংলা নববর্ষ পালনের ব্যাপারে ব্যাপক উৎসাহ দেখা যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর।
স্বাধীন বাংলাদেশ জন্ম নেওয়ার পর কলকাতার মানুষের সঙ্গে নৈকট্য বাড়ে বাংলাদেশের মানুষের। শুরু হয় বাংলাদেশ-ভারত—এই দুই দেশের মধ্যে সংস্কৃতি বিনিময়। আর তার ফলেই কলকাতার বিশিষ্টজনেরা এগিয়ে আসেন ঘটা করে একুশে পালনের জন্য। তাঁরা ঢাকায় গিয়ে একুশ পালনের বিশালতা দেখে কলকাতায়ও শুরু করেন একুশের নানা কর্মসূচি। এই সঙ্গে কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই চিন্তাও এসে যায়, এখানেও এই বাংলা ভাষার বীরদের স্মরণে গড়ে তুলতে হবে শহীদ মিনার বা ভাষাশহীদদের স্মারকস্তম্ভ, যেখানে প্রতিবছর বাংলা ভাষাপ্রেমীরা এসে শ্রদ্ধা জানাতে পারবেন একুশের ভাষাশহীদদের।
প্রথমে এগিয়ে আসে কলকাতার ‘ভাষা শহীদ স্মারক সমিতি’। ১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলার ভাষা উদ্যানে (কার্জন পার্ক) ভাষাশহীদদের স্মরণে একটি স্মারক নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। সেদিন এই ভাষাশহীদ স্মারক বা শহীদ স্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বাংলাদেশের ভাষাসৈনিক গাজীউল হক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এরপর বিশিষ্ট চিত্রকর বাঁধন দাসের পরিকল্পনায় তৈরি হয় এই শহীদ স্মারকস্তম্ভ। এই ভাষাশহীদ স্মারকস্তম্ভের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়। দিনটি ছিল ১৯৯৮ সালের ২৬ মে। তার পর থেকে প্রতিবছর মহান একুশে ফেব্রুয়ারিতে কলকাতার অগণিত মানুষ শ্রদ্ধা জানায় এই ভাষাশহীদ স্তম্ভে। প্রতিবছরই এখানে ‘ভাষা শহীদ স্মারক সমিতি’র উদ্যোগে একুশে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয় দিনভর নানা অনুষ্ঠান। শুধু তা-ই নয়, এই ‘ভাষা শহীদ স্মারক’কে ঘিরে এখন কার্জন পার্কের নামও বদলে গেছে। হয়েছে ভাষা উদ্যান।
এদিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে কলকাতায় কোনো শহীদ মিনার না থাকায় এই মহান শহীদ মিনারের অনুকরণে একটি শহীদ মিনার গড়ার উদ্যোগ নেয় কলকাতার বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন। প্রতিবছর উপ-হাইকমিশন সাড়ম্বরে পালন করে এই ভাষা দিবস। এই লক্ষ্যে তারা হাইকমিশনের চত্বরে অস্থায়ীভাবে তৈরিও করে একটি শহীদ মিনার, সেই ঢাকার শহীদ মিনারের আদলে। এখানেই প্রতিবছর দূতাবাসের কর্মকর্তা, কর্মী ছাড়াও উপস্থিত হয় কলকাতার বহু সংগঠন। তারা পুষ্পমাল্য অর্পণ করে, শ্রদ্ধা জানায় একুশের ভাষাশহীদদের।
এবার কলকাতায় ঢাকার মতো একটি স্থায়ী শহীদ মিনার গড়ার উদ্যোগ নেয় কলকাতা উপ-হাইকমিশন। উপ-হাইকমিশনার মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, ‘প্রতিবছর অস্থায়ী শহীদ মিনার তৈরি করতে হয় আমাদের। এবার আমরা চিন্তা করি আমাদেরই উপ-হাইকমিশনের চত্বরে একটি স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের। সেই লক্ষ্যে আমরা সম্প্রতি কাজও শুরু করি। আজ ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেল পাঁচটায় এই শহীদ মিনারের উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশের বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর। ২১ ফেব্রুয়ারি মহান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের দিনে আমরা এই শহীদ মিনারেই শ্রদ্ধা জানাতে পারব একুশের বীর শহীদদের। ২৫০ বর্গফুট জায়গাজুড়ে গড়া হয়েছে এই শহীদ মিনার। মিনারের উচ্চতা সাড়ে ১১ ফুট।’
এদিকে উত্তর কলকাতা ও মধ্য কলকাতায় দুটি শহীদ মিনার হলেও দক্ষিণ কলকাতার মানুষ যাতে একুশের ভাষাবীরদের প্রতি সম্মান জানাতে পারে, সে জন্য দক্ষিণ কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কে আরও একটি শহীদ মিনার তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে কলকাতা পুরসভা। এই শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ প্রায় শেষ। এই শহীদ মিনারটি গড়ে উঠছে বিশিষ্ট চিত্রকর শুভাপ্রসন্নের চিন্তা ও ভাবনায়। কলকাতার মেয়র শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, আজ ২০ ফেব্রুয়ারি এই শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আজ এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য ঢাকার রাজপথে যে আন্দোলন হয়েছিল, সেই আন্দোলনের মূলমন্ত্র নিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল।
কলকাতার তিনটি শহীদ মিনার এবার একুশে ফেব্রুয়ারি ভরে উঠবে ফুলে ফুলে।

No comments

Powered by Blogger.