চারদিক-ঘুড়ি উৎ সবের নিমন্ত্রণ by শর্মিলা সিনড্রেলা

বলা হয়, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। কথাটা নেহাত মিথ্যে নয়। আর প্রতিটা পার্বণেই রয়েছে মানুষের আবেগ ও ভালোবাসার প্রকাশ। পয়লা বৈশাখ, নবান্ন উৎ সব বা বসন্তবরণ—সব ক্ষেত্রেই বাঙালির আনন্দ-উৎ সব দেখে বিশ্ববাসী।


তাহলে ঘুড়ি উৎ সব বাদ যাবে কেন? এই উৎ সব তো আনন্দ আয়োজনের মধ্য দিয়ে এখন হয়ে উঠেছে বাঙালির প্রাণের উৎ সব। সামনে এগিয়ে আসছে বাঙালির এই আনন্দ আয়োজনের দিনটি। তাই সব খানেই চলছে একধরনের সাজ সাজ রব। বসে নেই ছবির হাটের হাটুরেরাও। বিভিন্ন ধরনের পসরা সাজিয়ে তাঁরা এখনই ঘুড়ি উৎ সবে নিমন্ত্রণ দেওয়া শুরু করেছেন সবাইকে।
বছর ঘুরে দিনটি একবারই আসবে। উৎ সব একটা হবে বটে, তার জন্য তো প্রয়োজন আয়োজন। আর প্রয়োজন অনেক অর্থেরও। অন্যের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কাজ চলতে পারে, কিন্তু তাতে আনন্দটায় অনেক কমতি থেকে যাবে। নিজেরাই যদি টাকা আয় করে তা দিয়ে আনন্দ করা হয়, তবে তার আনন্দটা কি দ্বিগুণ হয়ে যাবে না? তাই তো ছবির হাটের হাটুরেরা এই বিশাল ঘুড়ি উৎ সব করার জন্য কারও কাছে টাকা নেননি বরং নিজেরা কাজ করে যে টাকা আয় করবেন, তা দিয়েই আনন্দ লুটবেন ঘুড়ি উৎ সবে।
আগামী ২ থেকে ৪ মার্চ চলবে এই উৎ সব। এবার সপ্তম ঘুড়ি উৎ সবের আসর বসবে কক্সবাজারের ইনানি সৈকতে। আর এই ঘুড়ি উৎ সবের জন্য যে টাকার প্রয়োজন, তা পেতেই এক কর্মশালা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন ছবির হাটের হাটুরেরা। চারুকলার ঠিক উল্টোদিকে বসে ছবির হাট। প্রতিনিয়ত অসংখ্য শিল্পী হাটে আসেন। আর এখন এখানে বসে হাটুরেরা তৈরি করছেন বিভিন্ন ধরনের ছবি এবং সরাচিত্র। বিক্রির জন্যই এগুলো করেন তাঁরা। ঘুড়ি উৎ সবের জন্য টাকা আয় করতে হবে না? তা না হলে যে অনেক আয়োজন অপূর্ণ থেকে যাবে। তাই প্রতিদিনই বিকেল থেকে রাত অবধি কাজ করে চলেন হাটুরেরা। আর পথ দিয়ে ফেরার পথে পথিক থমকে দাঁড়ায়, তারপর পছন্দ হলে অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে ঘরে নিয়ে যায় শিল্পকর্মটি।
ছবির হাটের হাটুরে বিপুল শাহ্ বলেন, ‘ঐতিহ্য ধরে রাখা দেশপ্রেমেরই একটা অংশ। আমাদের কাছ থেকে আমাদের অনেক ঐতিহ্যই হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা এগুলোকে ধরে রাখতে চাই। তাই আয়োজন করা এই ঘুড়ি উৎ সবের। আমরা চাই, প্রত্যেকে এই উৎ সবের সঙ্গে মিশে যাক। আমরা এখানে যেসব শিল্পকর্ম তৈরি করছি তা বিক্রি করা হবে এবং এর সম্পূর্ণ অর্থই ঘুড়ি উৎ সবে ব্যয় করা হবে। তাই একজন যখন এর কোনো একটি জিনিস কিনবে, তখন তার মনে হবে আমিও এই উৎ সবে শামিল হলাম। আর এভাবে প্রত্যেকের কিছু না কিছু অংশগ্রহণ থাকবে এই আনন্দ আয়োজনে।’
পেছনের দেয়ালজুড়ে সার সার রাখা সরাচিত্র আর বিভিন্ন ধরনের ছবি। এর সামনে বসেই কাজ করে চলেছেন শিল্পীরা। কিছু লোক মুগ্ধ হয়ে তা দেখছেন। নিলুফার ইয়াসমিন মিতুলের হাতের সরাটি রংতুলির ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে হয়ে উঠছিল আরও আকর্ষণীয়। ছবির হাটের এই হাটুরে বলেন, ‘এর আগের বারও আমি ঘুড়ি উৎ সবে কাজ করেছি। অনেক মজা হয়েছে। আর কাজ করে টাকা আয় করে তারপর আনন্দ করি তো, তাই অনেক খুশি লাগে।’
আরেক হাটুরে নাসির আহমেদ বলেন, ‘এখন বাচ্চারা ঘুড়ি বানানো তো দূরের কথা, ঘুড়ি ওড়ানোর সুযোগই পায় না। আমরা চাই, মানুষ একটু মুক্তি পাক। আমরা এখানে এই যে ছবি আর সরাচিত্র আঁকছি, কোনো বাচ্চা এটা দেখে যদি আঁকতে চায়, তবে আমরা তাকেও আঁকার সুযোগ দিই এবং সম্ভব হলে সেটা বিক্রিও করি। এভাবে তার প্রতিভা প্রকাশিত হয় আর আমাদের বন্দী মনটাও যেন তাদের মুক্তি দেখে মুক্তি পায়।’
মোরগ, গরুর গাড়ি, মানুষ, মৎ স্যকন্যা ইত্যাদি ধরনের ঘুড়ি তৈরি করা হয় ঘুড়ি উৎ সবে। আর প্রতিবারই আলাদা আলাদা ধারণা থেকে এসব তৈরি করা হয়। কিছু মানুষ ভিড় জমিয়েছে হাটুরেদের কাজের পাশে আর কিছু মানুষ ঘুরে ঘুরে দেখছিল প্রদর্শনী। অবশ্য কেউ চাইলে কিনতেও পারবে এই প্রদর্শনীর ছবিগুলো। তার থেকে আয়েরও একটা অংশ ব্যয় হবে ঘুড়ি উৎ সবে। এখানে সরাচিত্র এবং সুন্দর সুন্দর কিছু ছবি পাওয়া যাবে খুব কম দামে, যা কোনো শিল্পীর গ্যালারিতে কিনতে গেলে প্রায় দ্বিগুণ দাম দিয়ে কিনতে হবে। অবশ্য এর একটা লক্ষ্যও আছে, তা হলো মধ্যবিত্তদের কাছে রুচিশীল শিল্পকর্ম পৌঁছে দেওয়া। তাই ঘুড়ি উৎ সবে যাওয়ার সময় ও সুযোগ যাঁদের মিলবে না, তাঁরা খুব সহজেই এখান থেকে কিছু জিনিস কিনে শামিল হতে পারেন এই আনন্দ মিছিলে। ফেব্রুয়ারির শেষ দিন পর্যন্ত চলতে থাকবে এই কার্যক্রম। তাই ছবির হাটে নিমন্ত্রণ সবার।

No comments

Powered by Blogger.