যুক্তি তর্ক গল্প-দল নয়, আদর্শের ঐক্যকে গুরুত্ব দিন by আবুল মোমেন
ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। মানুষ নানা রকম আলামত দেখে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে রীতিমতো চিন্তিত হয়ে উঠছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শেয়ারবাজারের অধোগতির ধারাবাহিকতায় সরকারের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। হঠাৎ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিও ঘটেছে চোখে পড়ার মতো।
তাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকারের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তব চিত্রের মধ্যকার অসামঞ্জস্য কমেনি। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ থেকে যাচ্ছে। এর ওপর বিরোধী দলের জন্য সংসদে ও জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ সংকুচিত করে বিরোধিতার রাজনীতির পুরোনো সংস্কৃতিই জাগিয়ে রাখছে সরকার। এ বিষয়ে হয়তো তাদের কৌশলী চিন্তা এই হতে পারে যে, ক্ষুব্ধ বিরোধী দল বাড়াবাড়ি করে বর্তমানে ফিরে-পেতে-থাকা সহানুভূতি ও সমর্থন আবার হারাতে থাকবে। সরকারের সামনে থাকা দুটি বিকল্পের মধ্যে একটি ছিল সমালোচনায়-নিন্দায় ও পরাজয়ে বিপর্যস্ত দলটিকে কিছু ঔদার্য দেখিয়ে নিজেদের প্রতি জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন ধরে রেখে এই ঔদার্যের জন্য বাড়তি কৃতিত্ব অর্জন। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে বিশাল বিজয়ে অর্জিত শক্তির প্রকাশ ঘটিয়ে বিরোধীদের রাজনৈতিক ক্রীড়ায় অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ না দেওয়া। প্রথমটি হতে পারত দূরদর্শী ও বিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপ আর দ্বিতীয়টি বেপরোয়া ও হঠকারী পদক্ষেপ বলেই প্রমাণিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কিন্তু এই দ্বিতীয় পথটি ধরে সরকার চলছে বলে প্রায় পায়ের তলার মাটি হারিয়ে ফেলা বিএনপির আবার মাঠে নামার শক্তি সঞ্চয়ের আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তাতে সত্যিই বিরোধী দল সরকারবিরোধী সর্বাত্মক আন্দোলনেই মনোযোগী হয়ে পড়তে পারে। এ রকম হুমকি ধীরে ধীরে বিপর্যয় কাটিয়ে চাঙা হয়ে ওঠা খালেদা জিয়া এখনই দিয়ে রেখেছেন, আর তাতেই মানুষের দুশ্চিন্তা বাড়ছে।
নানা দিক থেকে এবারের নির্বাচনী বিজয় ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বহুদিন পর এবারই নির্বাচনে ক্ষমতায় দলবদলের পাশাপাশি, এমনকি বলা যায়, পরিবর্তনের, আদর্শের পালাবদলের উপাদানটি যুক্ত হয়েছিল। মানুষ যুদ্ধাপরাধী, একাত্তরের ঘাতক-দালাল, জঙ্গি ইসলামি গোষ্ঠী এবং পাকিস্তানপন্থী রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে একাত্তরের চেতনায় আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রতি সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ-নেতৃত্বের বোঝা উচিত ছিল, এখনো সময় চলে যায়নি, বিষয়টি ঠিকঠাকভাবে বুঝে নেওয়ার যে, মানুষের এই সমর্থন শতভাগ আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন নয়, একটি আদর্শের প্রতি সমর্থন। আওয়ামী লীগ মোটা দাগে এ আদর্শের প্রধান দল, তাই তাদেরই নেতৃত্ব, তাদেরই ক্ষমতা বেশি, কিন্তু দল আর আদর্শকে এক করে দেখা ভুল হবে। প্রথমত, দলের বাইরেও এই আদর্শের অনেক সমর্থক ছিলেন এবং আছেন, মহাজোটের ক্ষুদ্র শরিকেরা ছাড়াও জনগণের ভেতরে, বিশেষত তরুণসমাজের মধ্যে অধিকাংশই দলনিরপেক্ষভাবে এ আদর্শে বিশ্বাসী। দ্বিতীয়ত, মনে রাখা দরকার, দলে এমন অনেক নেতা-কর্মী আছেন ও থাকেন, যাঁদের নিয়ে বিতর্ক আছে, যাঁরা বিতর্কিত, দলনেত্রী শেখ হাসিনা নিজেই তো দলের অনেক পুরোনো নেতা-কর্মীকেও এখন পছন্দ করছেন না, তাঁদের নিষ্ক্রিয় করে রেখেছেন। এ থেকে এটুকু অন্তত বোঝা উচিত, দলের ক্ষেত্রে নেতা-কর্মী অর্থাৎ ব্যক্তির এবং ভুলভ্রান্তি অর্থাৎ বিভিন্ন কাজের বিচার করা হয়, কিন্তু আদর্শ সেভাবে খণ্ডিত বা নিন্দিত হয় না। শেখ হাসিনা যদি আদর্শের চেয়ে দলকেই বড় করে দেখেন, তাহলে ভুল করছেন। তাতে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি ব্যক্ত অখণ্ড সমর্থন খণ্ডিত হয়ে যাবে। আমি বলব, এটি আসলে ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে। কারণ, একাত্তরে বিজয়ের পরেও আওয়ামী লীগ ঊনসত্তর থেকে একাত্তরে রচিত হওয়া বাঙালির ঐতিহাসিক আদর্শিক ঐক্যকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীনসহ বড় নেতারা চেষ্টা করেও দলীয় নেতা-কর্মীদের এ রকম ভাবনায় আনতে পারেননি।
গত চল্লিশ বছরে, বিশেষত পঁচাত্তরের পর থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বহু উত্থান-পতন দেখেছে বাংলাদেশ। কিন্তু ভয় হচ্ছে, অতীতের ব্যর্থতা ও ভুল থেকে আমরা বোধ হয় শিক্ষা নিচ্ছি না। যে আদর্শিক ঐক্যের প্রতিফলন ঘটেছিল ২০০৮-এর সাধারণ নির্বাচনে, তাকে কেবল দলীয় বিজয় ভাবলে মস্ত বড় ভুল করবে আওয়ামী লীগ। বরং বিজয়ের পর আওয়ামী লীগের উচিত ছিল, এই ঐক্যের বাতাবরণকে কার্যকরভাবে আরও বিস্তৃত ও দৃঢ় করা। মনে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের দল হিসেবেই আওয়ামী লীগ বিএনপির সঙ্গে তুলনীয় দল নয়, তাদের মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ বলতে আপত্তি জানাই। কিন্তু যদি মানুষ দেখে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ মুখের বুলি ও রাজনৈতিক বোলচালে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে, কাজের কাজ হচ্ছে না, টেন্ডারবাজি, কোন্দল, ক্ষমতার অপব্যবহার চলছেই, তখন মানুষ তো দুই দলে কোনো পার্থক্য দেখতে পাবে না। কেবল যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রক্রিয়া চালিয়ে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধারণ ও লালনের প্রমাণ দেওয়া যাবে না। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে না, এ দিয়ে ১৯৭১-এর অপরাধীদের শাস্তি হবে মাত্র। কিন্তু আসল কাজ তো হলো সমাজ থেকে ধর্মান্ধতা (যা ফতোয়াবাজির উদ্বেগজনক ব্যাপকতা থেকে বোঝা যায় কত গভীর), কুসংস্কার, অশিক্ষা, দারিদ্র্য ও বৈষম্য দূর করে একটি যুক্তিবাদী আধুনিক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। সেটা কেবল শিক্ষানীতির মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হবে ভাবলে ভুল হবে। মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রগুলোকে কার্যকর করতে হবে। সমাজে সাংস্কৃতিক মুক্তির জোয়ার আনতে হবে। সে কাজে অতীতের মতো রাজনীতিক ও শিল্পী-সাহিত্যিকদের একযোগে কাজ করতে হবে। প্রগতির ছাতার নিচে অনেক রকম মত-পথ যুগপৎ কাজ করে যাবে। আর তাতে ভ্রান্তি, বিভ্রান্তি, এমনকি বিপক্ষতার মনোভাবও স্তিমিত হয়ে ইতিবাচক বাতাবরণ তৈরি হবে সমাজে। কারণ মানুষ, বিশেষত তরুণসমাজ, সহজাতভাবে জাগরণ, সৃজন ও আনন্দময় যাপনের পক্ষে।
এবারে জনগণ বহুদিনে গড়ে ওঠা ক্ষমতার রাজনীতির অবক্ষয় ও অচলায়তন থেকে মুক্তি চেয়েছিল, চেয়েছিল ক্ষয়িষ্ণু বিভ্রান্ত স্থবির হয়ে আসা সমাজের জাগরণ ঘটুক। তাই মানুষ দল বিচার করেনি, আদর্শের বিচার করেছে, শেখ হাসিনাকে সেই আদর্শের পতাকা বইবার দায়িত্ব দিয়েছে।
মানুষ প্রাণ খুলে সমর্থন জানিয়েছে, হাত খুলে ভোট দিয়েছে। তিন শ আসনের মধ্যে দুই শরও বেশি আসনে বিজয় মানুষের বিশাল প্রত্যাশার অভিব্যক্তি বলা যায়। বিপরীতে প্রধান বিরোধী দলকে সংসদে একেবারেই কোণঠাসা করে পাঠিয়েছিলেন ভোটাররা। এই বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ অত্যন্ত স্বস্তির সঙ্গে কাজ করতে সক্ষম হতো। সংসদে তার প্রাধান্য এতই ছিল যে বিএনপিকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী একটি ডেপুটি স্পিকারের পদ এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদে, অনানুপাতিকভাবে হলেও বেশি পদ দিয়েও নিজের শক্ত অবস্থান ধরে রেখেই ঔদার্য ও সৌহার্দ্যের গণতান্ত্রিক আচরণের মাধ্যমে সমর্থক জনগোষ্ঠীর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে বিরোধিতার রাজনীতির পুরোনো সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিতে পারত।
২০০৭-০৮ থেকে বিএনপি এবং দলের মূল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো উঠেছিল, তা জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছিল। এর ফলে নির্বাচনে তাদের শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল। তাহলে বাস্তবতা দাঁড়াচ্ছে, ২০০৯-এ যখন বিশাল বিজয় নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেছে, তখন একদিকে বিএনপির সংসদে আসনসংকট আর বাইরে ভাবমূর্তির সংকট। আর অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ওপর মানুষের বিশাল প্রত্যাশা।
মানুষ চেয়েছিল, মহাজোট সরকার কাজের মাধ্যমে তাদের আস্থার প্রতিদান দিতে থাকবে। কাজ যে হয়নি তা নয়, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা পর্যাপ্ত নয়। আরও আশঙ্কার বিষয় হলো, সরকার দিনে দিনে দলীয় গণ্ডির মধ্যে বাঁধা পড়ছে, এমনকি দলের মধ্যেও আবার বিশেষ এলিট গোষ্ঠীর ভেতরে আটকে যাচ্ছে। দল ক্ষমতার ভাগ ও ভোগ নিয়ে ব্যস্ত হচ্ছে, সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, সংসদ অকার্যকর হয়ে থাকছে, রাজপথে পুরোনো প্রত্যাখ্যাত বিরোধিতার রাজনীতির সূচনা হতে চলেছে, আর দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলার মতো সমস্যাগুলো বেড়েই চলেছে।
পাশাপাশি বৃহত্তর আদর্শিক ঐক্যকে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হয় না, বরং দলের একটি এলিট অংশের মধ্যেই ক্ষমতাকে পুঞ্জীভূত করে তুলছে বলে মনে হয়। এ রকম ঘটনা থেকেই সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির পতন হয়েছিল। নানা বাহ্য ষড়যন্ত্রের কথা বলা যাবে, কিন্তু নিজেদের ত্রুটি ও দোষ স্বীকার করতে হবে। তবে সংশোধন সম্ভব এবং সঠিক পথে ফিরে আসা যায়।
বিজয়ের পরে নেতৃত্বের উচিত ছিল এবং যা এখনো করা যায়:
১. মহাজোটের ঐক্যকে দৃঢ় করা ও সক্রিয় রাখা।
২. সমাজে সৃষ্ট আদর্শিক ঐক্য ও সমর্থনের জোয়ারটিকে ধরে রাখা ও কাজে লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ (মনে রাখা দরকার, একাত্তরের গৌরবময় বিজয় এসেছিল এ রকম ঐক্যেরই ফলে।)
৩. নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের সরবরাহ ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত রাখা।
৪. সুশাসনের পথে অগ্রযাত্রার সুস্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ, যা আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন, যা গতিশীল ও প্রজাহিতৈষী আমলাতন্ত্র এবং বিচার বিভাগের নিরপেক্ষ দক্ষতায় প্রমাণিত হতো।
৫. সংসদকে সত্যিই কার্যকর রাখা—বিরোধী দলের অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনে কিছু ঔদার্য প্রদর্শনের মাধ্যমে।
৬. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে মুক্তচিন্তা, সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা ও উন্নত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা—দলীয় উপাচার্য নিয়োগ বন্ধ করা হতো এ ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ।
৭. সংসদে, রাজনৈতিক অঙ্গনে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, সমাজের সর্বত্র আলোচনা ও সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টি করা ও বজায় রাখা।
৮. সমাজ ও সরকারের অংশীদারি কার্যকর করা এবং ক্রমে সরকারের ভূমিকা হ্রাস করে সামাজিক ভূমিকাকে প্রধান করে তোলা।
কিন্তু সরকার পুরোনো পথে চললে হিমশিম খাওয়া, হোঁচট খাওয়া বাড়বে এবং পরিণতি ভালো হবে না। তরুণসমাজ আবার রাজনীতিবিমুখ হয়ে উঠবে, মেধাবীরা দেশ ছাড়তে শুরু করবে। স্বপ্ন এবং আশাবাদ না থাকলে যেকোনো সমাজে ব্যক্তিস্বার্থ মাথাচাড়া দেয়, তখন দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার অবক্ষয় রোখা যায় না।
স্বপ্ন ও আশাবাদের ভিত্তি হলো আদর্শ। দোহাই শেখ হাসিনা, দল নয়, আদর্শের ঐক্যকে গুরুত্ব দিন।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
নানা দিক থেকে এবারের নির্বাচনী বিজয় ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বহুদিন পর এবারই নির্বাচনে ক্ষমতায় দলবদলের পাশাপাশি, এমনকি বলা যায়, পরিবর্তনের, আদর্শের পালাবদলের উপাদানটি যুক্ত হয়েছিল। মানুষ যুদ্ধাপরাধী, একাত্তরের ঘাতক-দালাল, জঙ্গি ইসলামি গোষ্ঠী এবং পাকিস্তানপন্থী রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে একাত্তরের চেতনায় আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রতি সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ-নেতৃত্বের বোঝা উচিত ছিল, এখনো সময় চলে যায়নি, বিষয়টি ঠিকঠাকভাবে বুঝে নেওয়ার যে, মানুষের এই সমর্থন শতভাগ আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন নয়, একটি আদর্শের প্রতি সমর্থন। আওয়ামী লীগ মোটা দাগে এ আদর্শের প্রধান দল, তাই তাদেরই নেতৃত্ব, তাদেরই ক্ষমতা বেশি, কিন্তু দল আর আদর্শকে এক করে দেখা ভুল হবে। প্রথমত, দলের বাইরেও এই আদর্শের অনেক সমর্থক ছিলেন এবং আছেন, মহাজোটের ক্ষুদ্র শরিকেরা ছাড়াও জনগণের ভেতরে, বিশেষত তরুণসমাজের মধ্যে অধিকাংশই দলনিরপেক্ষভাবে এ আদর্শে বিশ্বাসী। দ্বিতীয়ত, মনে রাখা দরকার, দলে এমন অনেক নেতা-কর্মী আছেন ও থাকেন, যাঁদের নিয়ে বিতর্ক আছে, যাঁরা বিতর্কিত, দলনেত্রী শেখ হাসিনা নিজেই তো দলের অনেক পুরোনো নেতা-কর্মীকেও এখন পছন্দ করছেন না, তাঁদের নিষ্ক্রিয় করে রেখেছেন। এ থেকে এটুকু অন্তত বোঝা উচিত, দলের ক্ষেত্রে নেতা-কর্মী অর্থাৎ ব্যক্তির এবং ভুলভ্রান্তি অর্থাৎ বিভিন্ন কাজের বিচার করা হয়, কিন্তু আদর্শ সেভাবে খণ্ডিত বা নিন্দিত হয় না। শেখ হাসিনা যদি আদর্শের চেয়ে দলকেই বড় করে দেখেন, তাহলে ভুল করছেন। তাতে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি ব্যক্ত অখণ্ড সমর্থন খণ্ডিত হয়ে যাবে। আমি বলব, এটি আসলে ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে। কারণ, একাত্তরে বিজয়ের পরেও আওয়ামী লীগ ঊনসত্তর থেকে একাত্তরে রচিত হওয়া বাঙালির ঐতিহাসিক আদর্শিক ঐক্যকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীনসহ বড় নেতারা চেষ্টা করেও দলীয় নেতা-কর্মীদের এ রকম ভাবনায় আনতে পারেননি।
গত চল্লিশ বছরে, বিশেষত পঁচাত্তরের পর থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বহু উত্থান-পতন দেখেছে বাংলাদেশ। কিন্তু ভয় হচ্ছে, অতীতের ব্যর্থতা ও ভুল থেকে আমরা বোধ হয় শিক্ষা নিচ্ছি না। যে আদর্শিক ঐক্যের প্রতিফলন ঘটেছিল ২০০৮-এর সাধারণ নির্বাচনে, তাকে কেবল দলীয় বিজয় ভাবলে মস্ত বড় ভুল করবে আওয়ামী লীগ। বরং বিজয়ের পর আওয়ামী লীগের উচিত ছিল, এই ঐক্যের বাতাবরণকে কার্যকরভাবে আরও বিস্তৃত ও দৃঢ় করা। মনে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের দল হিসেবেই আওয়ামী লীগ বিএনপির সঙ্গে তুলনীয় দল নয়, তাদের মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ বলতে আপত্তি জানাই। কিন্তু যদি মানুষ দেখে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ মুখের বুলি ও রাজনৈতিক বোলচালে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে, কাজের কাজ হচ্ছে না, টেন্ডারবাজি, কোন্দল, ক্ষমতার অপব্যবহার চলছেই, তখন মানুষ তো দুই দলে কোনো পার্থক্য দেখতে পাবে না। কেবল যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রক্রিয়া চালিয়ে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধারণ ও লালনের প্রমাণ দেওয়া যাবে না। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে না, এ দিয়ে ১৯৭১-এর অপরাধীদের শাস্তি হবে মাত্র। কিন্তু আসল কাজ তো হলো সমাজ থেকে ধর্মান্ধতা (যা ফতোয়াবাজির উদ্বেগজনক ব্যাপকতা থেকে বোঝা যায় কত গভীর), কুসংস্কার, অশিক্ষা, দারিদ্র্য ও বৈষম্য দূর করে একটি যুক্তিবাদী আধুনিক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। সেটা কেবল শিক্ষানীতির মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হবে ভাবলে ভুল হবে। মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রগুলোকে কার্যকর করতে হবে। সমাজে সাংস্কৃতিক মুক্তির জোয়ার আনতে হবে। সে কাজে অতীতের মতো রাজনীতিক ও শিল্পী-সাহিত্যিকদের একযোগে কাজ করতে হবে। প্রগতির ছাতার নিচে অনেক রকম মত-পথ যুগপৎ কাজ করে যাবে। আর তাতে ভ্রান্তি, বিভ্রান্তি, এমনকি বিপক্ষতার মনোভাবও স্তিমিত হয়ে ইতিবাচক বাতাবরণ তৈরি হবে সমাজে। কারণ মানুষ, বিশেষত তরুণসমাজ, সহজাতভাবে জাগরণ, সৃজন ও আনন্দময় যাপনের পক্ষে।
এবারে জনগণ বহুদিনে গড়ে ওঠা ক্ষমতার রাজনীতির অবক্ষয় ও অচলায়তন থেকে মুক্তি চেয়েছিল, চেয়েছিল ক্ষয়িষ্ণু বিভ্রান্ত স্থবির হয়ে আসা সমাজের জাগরণ ঘটুক। তাই মানুষ দল বিচার করেনি, আদর্শের বিচার করেছে, শেখ হাসিনাকে সেই আদর্শের পতাকা বইবার দায়িত্ব দিয়েছে।
মানুষ প্রাণ খুলে সমর্থন জানিয়েছে, হাত খুলে ভোট দিয়েছে। তিন শ আসনের মধ্যে দুই শরও বেশি আসনে বিজয় মানুষের বিশাল প্রত্যাশার অভিব্যক্তি বলা যায়। বিপরীতে প্রধান বিরোধী দলকে সংসদে একেবারেই কোণঠাসা করে পাঠিয়েছিলেন ভোটাররা। এই বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ অত্যন্ত স্বস্তির সঙ্গে কাজ করতে সক্ষম হতো। সংসদে তার প্রাধান্য এতই ছিল যে বিএনপিকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী একটি ডেপুটি স্পিকারের পদ এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদে, অনানুপাতিকভাবে হলেও বেশি পদ দিয়েও নিজের শক্ত অবস্থান ধরে রেখেই ঔদার্য ও সৌহার্দ্যের গণতান্ত্রিক আচরণের মাধ্যমে সমর্থক জনগোষ্ঠীর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে বিরোধিতার রাজনীতির পুরোনো সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিতে পারত।
২০০৭-০৮ থেকে বিএনপি এবং দলের মূল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো উঠেছিল, তা জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছিল। এর ফলে নির্বাচনে তাদের শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল। তাহলে বাস্তবতা দাঁড়াচ্ছে, ২০০৯-এ যখন বিশাল বিজয় নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেছে, তখন একদিকে বিএনপির সংসদে আসনসংকট আর বাইরে ভাবমূর্তির সংকট। আর অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ওপর মানুষের বিশাল প্রত্যাশা।
মানুষ চেয়েছিল, মহাজোট সরকার কাজের মাধ্যমে তাদের আস্থার প্রতিদান দিতে থাকবে। কাজ যে হয়নি তা নয়, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা পর্যাপ্ত নয়। আরও আশঙ্কার বিষয় হলো, সরকার দিনে দিনে দলীয় গণ্ডির মধ্যে বাঁধা পড়ছে, এমনকি দলের মধ্যেও আবার বিশেষ এলিট গোষ্ঠীর ভেতরে আটকে যাচ্ছে। দল ক্ষমতার ভাগ ও ভোগ নিয়ে ব্যস্ত হচ্ছে, সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, সংসদ অকার্যকর হয়ে থাকছে, রাজপথে পুরোনো প্রত্যাখ্যাত বিরোধিতার রাজনীতির সূচনা হতে চলেছে, আর দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলার মতো সমস্যাগুলো বেড়েই চলেছে।
পাশাপাশি বৃহত্তর আদর্শিক ঐক্যকে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হয় না, বরং দলের একটি এলিট অংশের মধ্যেই ক্ষমতাকে পুঞ্জীভূত করে তুলছে বলে মনে হয়। এ রকম ঘটনা থেকেই সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির পতন হয়েছিল। নানা বাহ্য ষড়যন্ত্রের কথা বলা যাবে, কিন্তু নিজেদের ত্রুটি ও দোষ স্বীকার করতে হবে। তবে সংশোধন সম্ভব এবং সঠিক পথে ফিরে আসা যায়।
বিজয়ের পরে নেতৃত্বের উচিত ছিল এবং যা এখনো করা যায়:
১. মহাজোটের ঐক্যকে দৃঢ় করা ও সক্রিয় রাখা।
২. সমাজে সৃষ্ট আদর্শিক ঐক্য ও সমর্থনের জোয়ারটিকে ধরে রাখা ও কাজে লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ (মনে রাখা দরকার, একাত্তরের গৌরবময় বিজয় এসেছিল এ রকম ঐক্যেরই ফলে।)
৩. নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের সরবরাহ ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত রাখা।
৪. সুশাসনের পথে অগ্রযাত্রার সুস্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ, যা আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন, যা গতিশীল ও প্রজাহিতৈষী আমলাতন্ত্র এবং বিচার বিভাগের নিরপেক্ষ দক্ষতায় প্রমাণিত হতো।
৫. সংসদকে সত্যিই কার্যকর রাখা—বিরোধী দলের অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনে কিছু ঔদার্য প্রদর্শনের মাধ্যমে।
৬. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে মুক্তচিন্তা, সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা ও উন্নত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা—দলীয় উপাচার্য নিয়োগ বন্ধ করা হতো এ ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ।
৭. সংসদে, রাজনৈতিক অঙ্গনে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, সমাজের সর্বত্র আলোচনা ও সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টি করা ও বজায় রাখা।
৮. সমাজ ও সরকারের অংশীদারি কার্যকর করা এবং ক্রমে সরকারের ভূমিকা হ্রাস করে সামাজিক ভূমিকাকে প্রধান করে তোলা।
কিন্তু সরকার পুরোনো পথে চললে হিমশিম খাওয়া, হোঁচট খাওয়া বাড়বে এবং পরিণতি ভালো হবে না। তরুণসমাজ আবার রাজনীতিবিমুখ হয়ে উঠবে, মেধাবীরা দেশ ছাড়তে শুরু করবে। স্বপ্ন এবং আশাবাদ না থাকলে যেকোনো সমাজে ব্যক্তিস্বার্থ মাথাচাড়া দেয়, তখন দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার অবক্ষয় রোখা যায় না।
স্বপ্ন ও আশাবাদের ভিত্তি হলো আদর্শ। দোহাই শেখ হাসিনা, দল নয়, আদর্শের ঐক্যকে গুরুত্ব দিন।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments