বাঘা তেঁতুল-জিডিপি ও জিডিএইচ by সৈয়দ আবুল মকসুদ
কোনো কোনো দেশের মানুষ টিভির খবর দেখে ও পত্রিকা পড়ে আনন্দের বন্যায় ভাসে। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা। কোনো কোনো দেশের টিভির দর্শক ও কাগজের পাঠক চোখের পানিতে ভাসে। যুগে যুগে আনন্দ ও সুখ শুধু শাসকদের জন্য বরাদ্দ। তাঁরা সুখ-শান্তিতে হাসেন হা হা করে। হাহাকার করে কাঁদে শাসিতরা।
এই দুঃখময় ও শোক-সন্তাপদগ্ধ পৃথিবীতে কোনো কোনো জাতির মধ্যে এখনো কিছু প্রথা প্রচলিত রয়েছে, যা বড়ই চমৎকার। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, ইতালির পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বেরলুসকোনি, আইএমএফের চাকরিচ্যুত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডোমিনিক স্ট্রস-কান প্রমুখের পরামর্শে কিছু প্রথা জাতিসংঘের উদ্যোগে সদস্যদেশগুলোতে প্রবর্তনের ব্যবস্থা করা উচিত। এবং তা করা হলে পৃথিবীর পনেরো আনা পুরুষের সমর্থন পাবে।
নেলসন ম্যান্ডেলার দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। বর্ণবৈষম্যের দেশ হিসেবে একসময় তাদের হানাহানির খবর প্রতিদিন পত্রিকায় থাকত। ম্যান্ডেলার উঁচু রাজনৈতিক আদর্শ বাস্তবায়নের ফলে সে হানাহানি ও হিংসা বন্ধ হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনেকেই বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকা হতে পারে বহু দেশের রাজনীতির মডেল। সেখানকার শাসকেরা সমঝোতা ও সহিষ্ণুতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সেই দৃষ্টান্ত অনুকরণীয়। কিন্তু সেখানকার শাসকদের বিশেষ করে পুরুষ শাসকদের, সব দৃষ্টান্ত অনুকরণের কথা তুললে নারীবাদীরা লাঠিমিছিল বের করবেন।
রাজনৈতিক ও সামাজিক নিষ্ঠুরতায় আজ বাঙালির জীবন চরম নিরানন্দ। অধিকাংশ ছাপোষা বাঙালি পুরুষের জীবন নীরসও বটে। আড়ালে-আবডালে বঙ্গীয় পুরুষ যা-ই করুক, ঘরে এক বউ থাকতে দুটোর দরকার হয় না, দেড়খানা বিয়ে করলেই বাসরঘরের বদলে সোজা শ্রীঘর। সেখানে অন্তত ৬০ দিনের আতিথ্য। অথচ যে দেশের সাত-আট বছরের শিশুদের ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়, সেখানে বাল্যবিবাহ পুনঃপ্রবর্তন শুধু নয়, শিশুবিবাহ চালু করার জন্য মানববন্ধন করার সময় এসেছে। বঙ্গীয় পুরুষদের যে স্বভাব দাঁড়িয়েছে, তাতে বহুবিবাহ শুধু নয়, যত খুশি তত বিবাহ আইন চালু করতে বেলা ১০টা থেকে চারটা পর্যন্ত আমরণ অনশনে যাওয়াও এখন সময়ের দাবি।
উইনির সঙ্গে আদর্শগত ও ব্যক্তিগত কারণে বনিবনা না হওয়ায় ছাড়াছাড়ির পর ম্যান্ডেলা দ্বিতীয়বার পাণি গ্রহণ করেন। ম্যান্ডেলা জীবনবাদী। নারী ছাড়া যত খ্যাতি প্রতিপত্তি সম্মানই আসুক, পুরুষের জীবন মরুভূমির মতো শুষ্ক ও প্রাণহীন। ম্যান্ডেলার এক উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা জীবনবাদী নারীবাদী না হলেও, রমণীবাদী।
প্রেসিডেন্ট জুমার প্রাসাদে আগে ছিলেন মাত্র তিন স্ত্রী। আসলে থাকার কথা পাঁচজনের। একজন কেট মান্টশো চার সতিনের সঙ্গে থাকার আনন্দে ২০০০ সালে আত্মহত্যা করেন। আরেকজন তালাক নিয়ে চলে গেছেন এবং ভালো আছেন।
গত শুক্রবার এক শুভলগ্নে প্রেসিডেন্ট জুমা ষষ্ঠবারের মতো বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। বয়স তাঁর মাত্র ৭০। তবে বিয়ের আসরে নববধূ বঙ্গি এনগেমার সঙ্গে ফুর্তিরত অবস্থায় তাঁর যে ছবি দেখলাম, তাতে মনে হলো, ছয় বিয়ে তাঁর জন্য যথেষ্ট নয়। ভবিষ্যতে তাঁর দেশবাসীর জন্য আরও খুশির খবর অপেক্ষা করছে। পেশি ও পরিমিত মেদবহুল জুমার শরীরে চিতাবাঘের চামড়ার সামান্য আচ্ছাদন। চিতাবাঘের মতোই শক্তি এখনো তাঁর শরীরে। তাঁর তিন স্ত্রী—দিজাকেলে, নমপুমেলেলো ও মাদিবা—বিয়ের আনন্দঘন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মনেও আনন্দ। স্বামীর কৃতিত্বে তাঁরা গর্বিতা। সর্বংসহা নারী!
বঙ্গির সঙ্গে যে বাসরঘরেই জুমার প্রথম মোলাকাত হবে, তা নয়। তাঁদের দুজনের একটি তিন বছরের ফুটফুটে বাবুও আছে। তা ছাড়া জুমার ছেলেমেয়ের সংখ্যা অন্তত ২০ জন।
নারীর অতল রহস্যময় অন্তর জয় করা সমুদ্রজয়ের চেয়ে বেশি কঠিন। এবং বেশি গৌরবের। রমণীমোহন জুমা বহু নারীর হূদয় জয় করায় সে দেশের ছাত্রযুবকেরা তাঁকে সংবর্ধনা দেবেন কি না জানি না, তাঁরা যে তাঁর আদর্শ নিজেদের জীবনে বাস্তবায়নে দৃঢ় সংকল্প—তাতে সন্দেহ নেই।
মাননীয় জুমার বিয়েটা তাঁর জুলু সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য অনুযায়ী তাঁর খামারবাড়িতে নাচগানের ভেতর দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। যদি পানচিনি, গায়েহলুদ, মূল বিবাহবাসর ও বউভাতের ব্যবস্থা থাকত এবং বিদেশি রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের দাওয়াত দেওয়া হতো, তা হলে অনেক দেশ থেকেই কবি-সাহিত্যিক-কাম-দলীয় ক্যাডারদের নিয়ে যেত এক বিশাল সরকারি প্রতিনিধিদল।
দেশের মানুষ সুখে আছে কি না সেটাই বড় কথা। হিংসা-প্রতিহিংসায় ছারখার হওয়া বড় দুঃখের। অবিচার, অত্যাচার, অপহরণ, গুম, হত্যা, গুপ্তহত্যা, ক্রসফায়ার, হরতাল, গাড়ি ও মানুষ পোড়ানোর চেয়ে কারও ছয় নম্বর বিয়ের আনন্দে বাজি পোড়ানো ভালো।
ভুটানের গত নির্বাচনের সময় নেতারা ঘোষণা দেন, তাঁরা জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে ভাবছেন না। তাঁদের লক্ষ্য জিডিএইচ (গ্রস ডোমেস্টিক হ্যাপিনেস)। আমরা জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে ভাবছি—বিসর্জন দিয়েছি জাতির সামগ্রিক সুখ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments