কল্পকথার গল্প-জনতা-জনার্দন অবাক হবেন শুনে by আলী হাবিব

আবিষ্কার ব্যাপারটা মানুষের সহজাত। আবিষ্কার করতে পারলে আনন্দিত হয়। আর্কিমিডিসের 'ইউরেকা' জাতীয় গল্প তো আমাদের জানাই আছে। কোনো একসময় আবিষ্কার ব্যাপারটা হুট করেই হয়ে যেত। এখন আর তেমনটি হয় না। এখন আবিষ্কারের জন্য নানা কসরত করতে হয়। কী আবিষ্কার করা যেতে পারে, সেটা নিয়ে আগে ভাবতে হয়।


এরপর বিষয়টি নিয়ে গবেষণা। সেই গবেষণার ফল নিয়ে নানা ধরনের তাত্তি্বক আলোচনা। তারপর একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। তবেই না আবিষ্কার!
জি না, মোটেও থিওরি কপচাচ্ছি না। ফ্ল্যাশ ব্যাক, মানে একটু পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করছি। কত কিছু কতভাবে আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে। একদা গুহায় বাস করা মানুষকে আজ তুলে এনেছে অ্যাপার্টমেন্টের খুপরিতে। মানুষের কথাই বলছি। হেঁটে চলা ছাড়া এক সময় যার উপায় ছিল না, সে কি না আজ পেল্লাই বিমানে চড়ে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে! এই সব কিছুর নেপথ্যের ব্যাপারটা হচ্ছে আবিষ্কার। স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কারের পর রেললাইন এসেছে, এসেছে রেলগাড়ি। রেললাইন বিস্তৃত হয়েছে, রেল মন্ত্রণালয় হয়েছে। এ রকম অনেক কিছু হয়েছে।
আবিষ্কারের নানা গল্প আমাদের জানা। আবার আবিষ্কার নিয়ে একটি কবিতাও আমাদের কাছে খুব পরিচিত। হ্যাঁ ভাই, রবীন্দ্রনাথের 'জুতা আবিষ্কার' কবিতাটির কথাই বলছি। আবার কথায় কথায় আমরা তো বলেও ফেলি, 'কেমনে ব্যাটা পেরেছে সেটা জানতে...'। তো ব্যাপারটা কেউ জানুক আর না-ই জানুক, কবিতাটি পড়তে আমাদের ভালো লাগে। 'মলিন ধুলা লাগবে কেন পায়'- সে বিড়ম্বনা থেকে রাজা হবুচন্দ্রকে রক্ষা করতে গিয়ে মন্ত্রী গবুচন্দ আরো কত বিড়ম্বনার জন্ম দিয়েছিলেন, সেটা আমাদের জানা। শেষে কোত্থেকে এক চর্মকার এসে এক জোড়া জুতা বানিয়ে রাজার পায়ে লাগিয়ে দিতেই সব সমস্যার সমাধান। সেদিন থেকেই কি জুতা পরা শুরু হলো? না। জুতার ইতিহাস বলছে, খ্রিস্টের জন্মের সাত-আট হাজার বছর আগেও জুতার প্রচলন ছিল। ওই সময়ের এক জোড়া জুতার সন্ধানও নাকি মিলেছে। তবে যেটুকু তথ্য পাওয়া যায়, তা থেকে এটা জানা যাচ্ছে, সে সময় যেটা জুতা, এখন সেটাই স্যান্ডেল। তা সে স্যান্ডেলই হোক আর জুতাই হোক, পায়ের এই জুতসই আবরণ কিংবা আভরণ- যা-ই বলি না কেন, সেটা এলো কেমন করে?
জুতার পাশাপাশি আরেকটা দরকারি জিনিস হচ্ছে ছাতা। আজকাল প্রচণ্ড গরম পড়ছে। পড়াটাই তো স্বাভাবিক। বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে যে! ওদিকে আবার যখন-তখন বৃষ্টি হচ্ছে। কাজেই ছাতা ছাড়া আর চলছে না। ছাতার আরেক ধরনের ব্যবহার আছে। সেটা হচ্ছে বাতাস বুঝে ছাতা ধরা। বাতাস বুঝে ছাতা ধরতে পারলে প্রাপ্তিযোগের ব্যাপারটি নিশ্চিত হওয়া যায়। আজকের দিনে অনেকেই বাতাস বুঝে ছাতা ধরে নিজেদের অবস্থা ও অবস্থান বদলে নিয়েছেন। এই ছাতা ও জুতা কেমন করে এলো? আপাতত পুরাণ ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, সেই পৌরাণিক যুগেই ছাতা ও জুতার ব্যবহার শুরু। আর এই শুরুটা কেমন করে হয়েছিল সে কাহিনীও মজার।
গল্প বলার আগে বলতেই হবে, অনেক অ-নে-ক দিন আগের কথা। তখন অবসরে মুনিগণ নানা ধরনের ক্রীড়া করতেন। আজকের দিনের মতো ক্রিকেট-ফুটবল-টেনিস তো আর তখন ছিল না! আজকের গল্প জমদগ্নি মুনি ও তাঁর স্ত্রী রেণুকাকে নিয়ে। জমদগ্নি মুনি তীর ছুড়ছিলেন, সেই তীর কুড়িয়ে আনছিলেন রেণুকা। ওদিকে সময়টা তখন জ্যৈষ্ঠ মাস। কাঠফাটা রোদ আর গরম। মুনি তো এক জায়গাতে বসে তীর ছুড়ছিলেন, কিন্তু সেটা আনতে গিয়ে রেণুকার অবস্থা খারাপ। তাঁর পায়ে ফোসকা পড়ে গেছে। মাথা তখন ঝিম ঝিম করছে। এটাই তো স্বাভাবিক। তীর কুড়িয়ে আনতে দেরি হওয়ায় তিনি রেণুকাকে তাড়া দিচ্ছিলেন। একটু দেরি হচ্ছে দেখে মুনি রেগে এর কারণ জানতে চাইলেন। রেণুকা তখন রোদ ও গরমের কথা বললেন। তাঁর পায়ে যে ফোসকা পড়ে গেছে, সেটাও জানালেন। মুনি বুঝতেই চৈতন্য হলো যেন। কিন্তু মুনির কোপ বলে কথা! তিনি সূর্যের দিকে তীর ছুড়তে যাবেন, তখন সূর্য এক ব্রাহ্মণের বেশ ধরে তাঁর সামনে এসে হাজির। তিনি মুনিকে বললেন, সূর্যের তেজ না থাকলে তো শস্য ফলবে না, গাছে ফল ধরবে না। মুনি ওসব মানতে নারাজ। প্রিয়তমা স্ত্রী রেণুকা কষ্ট পেয়েছেন। এতে তিনি ক্রুদ্ধ। সূর্যের কোনো কথা শুনতে তিনি নারাজ। তিনি বললেন সূর্যের তেজে যাতে তাঁর স্ত্রী কষ্ট না পান সে উপায় বের করতে। এ কথা শুনে ব্রাহ্মণরূপী সূর্য তাঁর চাদরের ভেতর থেকে একটা জুতা ও একটা ছাতা বের করে দিলেন। সেই থেকে জুতা ও ছাতার ব্যবহার শুরু হলো।
কথা হচ্ছিল আবিষ্কার নিয়ে, সেখানেই আবার ফেরা যাক। সম্প্রতি স্কটল্যান্ডের স্টারলিং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা নতুন এক তথ্য দিয়েছেন। তাঁরা জানাচ্ছেন, নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করলে বিষাদ দূর হয়। মনের অস্থিরতা কিছুটা হলেও কমে। এখানে বিষয় হচ্ছে দুটো, মন বিষাদগ্রস্ত ও অস্থির হওয়া এবং হাঁটাহাঁটি। সোজা হিসেবে হাঁটাহাঁটি করলে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। তো এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, মন কেন বিষাদগ্রস্ত হয়, কেন অস্থির হয়?
মন বিষাদগ্রস্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। মানুষের মনে স্বপ্ন থাকে। সেই স্বপ্ন যখন ভেঙে যায়, তখন মন বিষাদগ্রস্ত হবে। মানুষের স্বপ্নভঙ্গের নানা কারণ আছে। ধরুন, আপনি স্বপ্ন দেখছেন কম ভাড়ায় একটি ভালো বাড়িতে থাকবেন। কিন্তু বাস্তবে সেটা হচ্ছে না। আপনাকে বেশি ভাড়ায় অপেক্ষাকৃত ছোট বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। এটা আপনার স্বপ্নভঙ্গের কারণ। আপনি যে চাকরি করেন, সেই উপার্জনে আপনার সংসার চালানো দায়। সামাজিকতা করা তো দূরের কথা। আপনার স্বপ্নভঙ্গ হওয়াটাই স্বাভাবিক। বাজার করতে গেছেন, পকেটের সঙ্গে থলের মিল হচ্ছে না। স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে। খবরের কাগজটা নিয়ে বসবেন, রুক্ষমূর্তি ঘরের কর্ত্রী সামনে এসে হাজির। থলের বাজারের সঙ্গে তাঁর ফর্দ মিলছে না। তাঁকে এড়াতে অফিসের পথ ধরলেন। কিন্তু রাতে তো বাড়িতে আসতেই হবে। বাড়িতে ফিরে যে একটু আরাম করে টিভির সামনে বসবেন, সে উপায় নেই। সুইচ অন করতেই দেখলেন, বিদ্যুৎ নেই। কী করবেন আপনি? আপনার মন বিষাদগ্রস্ত হবে, অস্থির হবে। হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। এই বিষাদ ও মানসিক অস্থিরতা কাটাতে হাঁটাহাঁটি করাটাই উত্তম- গবেষকরা তেমনটিই বলছেন।
হাঁটাহাঁটি ব্যাপারটা আজকাল বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। চিকিৎসকরাও আজকাল তাঁদের ব্যবস্থাপত্রের একপাশে হাঁটাহাঁটি করার উপদেশ লিখতে ভুল করেন না। প্রতিদিন নিয়ম করে একটানা হাঁটলে শরীর ভালো থাকে- অনেক রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়। রাজধানীর পার্ক ও ফাঁকা জায়গায় সকালে ও বিকেলে হন্টনরত মানুষ দেখা যায়। এসব হাঁটাহাঁটি করা মানুষের আবার দল আছে। নিজেদের মতো করে সংগঠিত হয়েছেন তাঁরা। নানা বয়সের, নানা পেশার মানুষ সকালে ও বিকেলে হাঁটেন। নিয়ম করে যাঁরা হাঁটতে যান, তাঁদের নিয়ে গবেষণা করলে আরেকটা জিনিস বের হয়ে আসতে পারে। নিয়মিত হাঁটতে গেলে তো ঘরের বাইরে যেতেই হয়। ঘরে বসে স্ত্রীর গঞ্জনা সইতে হয় না। মশার কামড় নেই। বিদ্যুতের অভাবে ফ্যান ঘুরছে না, কানের কাছেও কেউ ঘ্যান ঘ্যান করছে না। রোগমুক্তির পাশাপাশি যন্ত্রণামুক্তি। সাংসারিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আশায় অনেকেই হাঁটেন, যদিও প্রকাশ্যে এটা কেউই বলতে চান না। অর্থাৎ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে হাঁটাহাঁটির মধ্যেই নিহিত আছে সুখ।
অতএব, আসুন হাঁটি। হাঁটতে হাঁটতে আওড়াতে থাকি নতুন এক শ্লোক-
জনতা-জনার্দন অবাক হবেন শুনে
সংসার সুখের হয় হাঁটাহাঁটির গুণে!
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.