বাংলা-ভাষা ও দেশপ্রেম by মোহীত উল আলম
গত বছর অমর একুশে উপলক্ষে ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। ভাষার প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, ইংরেজি অবশ্যই শিখতে হবে কার্যকর ভাষা হিসেবে, কিন্তু জোরটা দিতে হবে বাংলা ভাষার চর্চার ওপর। কারণ, মনের ভাব ও চিন্তা প্রকাশের ভাষা হচ্ছে মাতৃভাষা।
একই ধরনের অনুষ্ঠানে ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বছর প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য বিশিষ্ট ভাষাবিদ অধ্যাপক পবিত্র সরকার। তিনি ইংরেজি ভাষার নাম উল্লেখ না করে বললেন, বাংলা ভাষার বিকল্প হিসেবে নয়, কিন্তু বাংলা ভাষার পাশাপাশি বিদেশি ভাষার চর্চা হতে পারে। বাংলা ভাষার সুদীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য উল্লেখ করে তিনি আরও বললেন, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাই প্রমাণ করে, বাংলা ভাষা কেন একটি শক্তিশালী ভাষা। আর ২১ ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমীর মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত অনুবাদ-সংক্রান্ত একটি আবৃত্তি অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান অনুবাদের গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, বাংলা সাহিত্যে শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন, ঠিকমতো অনূদিত হলে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়সহ আরও অনেকে নোবেল পুরস্কার পেতেন।
ভাষার প্রশ্নে ওপরের তিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তির অনুধাবন হলো, মাতৃভাষা হিসেবে বাংলার চর্চা যেমন হবে, পাশাপাশি বিদেশি ভাষা তথা ইংরেজির চর্চা হতে হবে অনুবাদসহ ইত্যাদি কার্যক্রম সম্পাদন করার জন্য। এই ‘পাশাপাশি চর্চার’ ধারণাটা বিস্তৃত করে কিছুটা এর যৌক্তিকতা এবং বহুলাংশে এর অযৌক্তিকতা তুলে ধরার মানসে আজকের লেখাটা তৈরি করছি।
সেদিন ক্রিকেট বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ড তথা ইংরেজ ও ডাচ্ বা দিনেমারদের মধ্যে ক্রিকেটযুদ্ধ দেখতে দেখতে একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধের কথা মনে পড়ল, যেটা হয়েছিল হল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের মধ্যে সমুদ্রের একটা জলাংশের অধিকার নিয়ে। ইতিহাসে ‘অ্যাংলো-ডাচ্ ওয়ার’ (১৬৫২-৫৪) নামে পরিচিত এই যুদ্ধে ইংরেজরা বিজয়ী হয়, যেভাবে ক্রিকেটেও তারা ম্যাচটা জিতে নিল। কিন্তু এই যুদ্ধজয় ইংরেজি সাহিত্যের জন্য একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তৈরি করে। ইংরেজি সমালোচনা সাহিত্যের পিতা হিসেবে আদৃত জন ড্রাইডেন (১৬৩১-১৭০০) ‘অব ড্রামাটিক পোয়েজি’ শিরোনামে একটি সংলাপনির্ভর প্রবন্ধ লেখেন ১৬৬৮ সালে। তাতে রচনাটির আলেখ্য শুরু হয়, যেদিন টেমস নদীর মুখে ইংরেজ নৌবাহিনী ডাচ্ নৌবাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেছিল। প্রবন্ধে চারজন তার্কিকের মধ্যে একজন (ক্রাইটিস) প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্যের পক্ষে কথা বলে, আরেকজন (ইউজিনিয়াস) ফরাসি সাহিত্যের গুণাবলির কথা বলে, আরেকজন (লিসিডিয়াস) মিত্রাক্ষরে রচিত কাব্যের প্রশংসা করে, কিন্তু শেষেরজন (নিয়েন্ডার বা নতুন মানুষ বা ড্রাইডেন নিজে) ইংরেজি সাহিত্যকে পূর্বাপর সব সাহিত্যের চেয়ে উৎকৃষ্ট বলে প্রমাণ করেন। এবং বলেন, ইংরেজ কবি উইলিয়াম শেক্সপিয়ার অমিত্রাক্ষর ছন্দে কাব্যনাট্য রচনা করে ইংরেজি সাহিত্যের সর্বোৎকৃষ্টতার প্রমাণ রেখে গেছেন।
ড্রাইডেনের সময় ইংরেজি সাহিত্যের পক্ষে এমন জোর ওকালতির দরকার ছিল কেন না ধ্রুপদি প্রাচীন সাহিত্য (গ্রিক ও লাতিন) এবং ফরাসি সাহিত্যের আধুনিকতার চাপে ইংরেজির প্রাণ ছিল ওষ্ঠাগত। এই ড্রাইডেনই ‘প্রেফিস টু ফেইবলস’ শীর্ষক প্রবন্ধে যাচাই করে দেখিয়েছেন, কেন ইংরেজ কবি চসার লাতিন কবি ভার্জিল ও ওভিদের চেয়ে বড় কবি ছিলেন।
আমরা আজকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পৃথিবীর অন্য সব কবির চেয়ে বড় কবি বলে যদি যুদ্ধটা এগিয়ে নিয়ে যাই, তাহলে যে ধরনের সেনসেশন তৈরি হবে, তেমনি ড্রাইডেনের সময় শেক্সপিয়ারকে তৎকালীন ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় কবি বলা ছিল সে রকমেরই একটি যুদ্ধ।
কিন্তু ইংরেজ কবি ড্রাইডেন সে যুদ্ধটা করে গিয়েছিলেন। ড্রাইডেনের রচনাটির শ খানেক বছর আগে থেকে রেনেসাঁ যুগের ইংরেজ মনীষীরা ব্যাপৃত ছিলেন একটি অসম যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য। তখন আইনসহ দাপ্তরিক ভাষা ছিল লাতিন খোদ ইংল্যান্ডেই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভাষাও ছিল লাতিন, আর রাজা-রানিসহ রাজন্যবর্গ ও অভিজাত শ্রেণী ফরাসি ভাষায় কথোপকথন চালাতে পছন্দ করতেন। কিন্তু লন্ডনের রাস্তাঘাটসহ পুরো ইংল্যান্ডের জনজীবনে মাতৃভাষা ইংরেজির হচ্ছিল ব্যাপক ব্যবহার। রেনেসাঁ যুগের অন্যতম কর্মকাণ্ড ছিল অনুবাদকর্ম। ফলে ইংরেজি ভাষার কৌলীন্য না থাকলেও সর্বজন ব্যবহারের জন্য এটিকে একটি প্রকৃষ্ট ব্যাকরণনির্ভর রূপ দেওয়ার জন্য রেনেসাঁর দ্বিভাষিক ও ত্রিভাষিক ইংরেজ পণ্ডিতেরা প্রচেষ্টায় নামলেন। ইংরেজির সৃজন, ভাষারীতি ও গঠনপ্রণালি নির্দিষ্ট করার পেছনে এসব ইংরেজ মনীষীর ছিল নিজ মাতৃভাষার প্রতি অমর প্রেম। এই ইংরেজ ভাষাসৈনিকেরা ছিলেন এলিয়ট, আসকাম, উইলসন, পুটেনহ্যাম, মালক্যাস্টার প্রমুখ। শেষেরজন ছিলেন মার্চেন্ট টেইলরস স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি ১৫৮২ সালে ‘এলিমেন্টারি’ শীর্ষক রচনায় লিখলেন (তর্জমা করছি): ‘কিন্তু সবকিছু ইংরেজিতে নয় কেন? যে ভাষাটি খুব সড়গড় এবং বলতে সহজ। আমার মনে হয় না, আমাদের জন্য আর কোনো ভাষা, সেটা যত ঋদ্ধ ভাষাই হোক না কেন, মনের সব চিন্তা প্রকাশ করার জন্য এত সহজিয়া হবে।... কারণ, এটা কি একটি বিরাট দাসত্ব নয় যে আমাদের নিজের কাজ সমাধান করার জন্য আমরা এত সময় ক্ষয় করে একটি বিদেশি ভাষা শিখছি, যখন আমরা ওই কাজগুলো অনেক কম সময় ব্যয় করে নিজের মাতৃভাষায় সমাধান করতে পারতাম। আমাদের ভাষা আমাদের স্বাধীনতা আর স্বাধিকারের কথা মনে করিয়ে দেয় আর লাতিন ভাষা আমাদের পরাধীনতা আর দাসত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমি রোমকে ভালোবাসি, কিন্তু আমি লন্ডনকে আরও বেশি ভালোবাসি। আমি ইতালিকে পছন্দ করি, কিন্তু ইংল্যান্ডকে আরও বেশি পছন্দ করি। লাতিন ভাষাকে আমি সম্মান করি, কিন্তু ইংরেজি ভাষাকে আমি পূজা করি।’
মালক্যাস্টারের কথা গেল। এবার দেখুন শেক্সপিয়ার কী করছেন। তাঁর নাটক রাজা পঞ্চম হেনরির ঘটনা হলো বিখ্যাত এজিনকোর্ট যুদ্ধে (১৪১৫) ফরাসি বাহিনীর ওপর ইংরেজ বাহিনীর চূড়ান্ত বিজয় লাভ। তারপর ইংরেজ রাজা হেনরি ফরাসি রাজা চার্লসের মেয়ে ক্যাথারিনকে বিয়ে করবেন। হেনরি কিছুটা ফরাসি জানলেও ক্যাথারিন ইংরেজি এক বর্ণও জানেন না। দোভাষীর মাধ্যমে কিছুদিন প্রেম চলল। কিন্তু রাজার আশ মেটে না মাতৃভাষায় প্রেম নিবেদন করতে না পারলে। শেষে ক্যাথারিন বা কেইটও কিছু কিছু ইংরেজি বুঝতে শুরু করলেন। তারপর রাজা একসময় ধৈর্যহারা হয়ে বললেন, কেইট, ফরাসি ভাষায় কথা বলার চেয়ে আমার পক্ষে রাজ্য বিজয় অনেক সহজ।
শেক্সপিয়ারের উদ্দেশ্য এখানে পরিষ্কার। শুধু রাজনৈতিকভাবে যে ইংল্যান্ড ফ্রান্সকে পরাজিত করল তা নয়, ভাষাগতভাবেও—তাও একান্ত প্রেমঘন দৃশ্যে—ইংল্যান্ডের ভবিষ্যৎ রানি বাধ্য হলেন ইংরেজি ভাষা গ্রহণ করতে।
তাহলে ইংরেজদের মধ্যে ৪০০ বা ৫০০ বছর আগে তাদের মাতৃভাষা নিয়ে যে প্রবল সচেতনতা জন্ম লাভ করেছিল, তার ফলেই তো ইংরেজি আজ বিশ্বভাষা হয়ে পড়েছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হওয়ায় তারা এ কথাও আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে যে আমাদের নিজেদের মাতৃভাষা যেন আমাদের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়।
আজকে যদি আমাদের মাতৃভাষার জন্য আমরা সমান সচেতনতা দেখাই, তাহলে একদিন কি আমাদের ভাষাও শক্তিশালী হয়ে উঠবে না। ভবিষ্যৎকে দেখার সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বর্তমানের প্রয়োজন ও তাগিদের কারণে চারপাশে যে দেয়াল ওঠে, মনে হয় সে দেয়াল যেন দুর্ভেদ্য। অথচ চোখের সামনে বিপরীত দৃষ্টান্তগুলো বরং হাজির। আমরা কোনো দিন ভাবিনি যে আমরা টেস্ট খেলুড়ে দেশ হতে পারব। আমাদের দেশের কেউ নোবেল পাবেন, সেটাও আমরা কোনো দিন ভাবিনি। ঠিক সে কারণে আমরা হয়তো ভাবতে পারছি না ওয়াল স্ট্রিটের স্টক মার্কেটে কেন বাংলা ভাষার ব্যবহার হবে। বা ৩৬ হাজার টনি সামুদ্রিক জাহাজে কেন ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ বা ‘বাংলাদেশে প্রস্তুত’ কথাটি লেখা থাকবে?
বিদেশি ভাষা—সেটা ইংরেজি হোক, আরবি হোক, কিংবা হিন্দি হোক—যত প্রবলভাবেই আসুক না, এটা কখনো মাতৃভাষার প্রয়োজন মেটাতে পারবে না। ১৬ কোটি লোকের কথা চিন্তা করলে এটি আরও পরিষ্কার হয় যে যত দিন আমরা মাতৃভাষাকে প্রান্তিক ভাষা হিসেবে দেখব, তত দিন আমাদের কাছে মনে হবে যেন ভাষাটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়।
তাহলে কি আমি বলছি, অন্য ভাষা শেখা পরিহার করে শুধু বাংলা ভাষা শিখতে হবে? না, আমি তা বলছি না। আমি বলছি, এখন সময় হয়েছে ১৬ কোটি লোকের মুখ ফোটানোর, তাদের চিন্তা ফোটানোর জন্য মাতৃভাষায় তাদের আগমন অবাধ করে দেওয়া। রেনেসাঁ যুগে ইংরেজরা যেমন করেছিল তাদের মাতৃভাষার জন্য। তারা কখনো লাতিন বা ফরাসি শিক্ষা বন্ধ করেনি, কিন্তু ইংরেজিতে সাহিত্য, রাজনীতি, বাণিজ্য ও শিল্প এত অধিক পরিমাণে বাড়িয়ে দিয়েছিল যে বিকল্প হিসেবে অন্য ভাষাগুলো ধোপেই টিকল না।
আমরাও গ্রামের শিশুদের মাদ্রাসায় গিয়ে আরবি পড়া বন্ধ করতে পারব না বা শহুরে শিশুদের স্কুলে গিয়ে ইংরেজি না শিখে ইংরেজিপনা শেখা বা বিয়েবাড়িতে বা টিভিতে হিন্দি গান শোনা বন্ধ করতে পারব না, সেগুলো বন্ধ করার কথাও বলছি না, কিন্তু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক চর্চা অব্যাহত রাখলে মানুষ অন্য ভাষার মধ্যে বিকল্প খুঁজবেই না। চিনির রাজ্যে যেমন কেউ আর গুড় খোঁজে না।
অমর্ত্য সেন তাঁর দি আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান (২০০৫) গ্রন্থে ‘টেগোর অ্যান্ড হিজ ইন্ডিয়া’ পরিচ্ছেদে রবীন্দ্রনাথের পশ্চিমা বিশ্বে প্রাথমিক গ্রহণ এবং পরে বর্জনের বিষাদময় চিত্রটি তুলে ধরে মন্তব্য করছেন, আসলে ইয়েটস, পাউন্ড প্রমুখ টেগোরকে নিয়ে তত দিন নাচানাচি করেছিলেন, যত দিন টেগোর তাঁদের ‘ন্যারো বক্স’ বা ছোট বাক্সটির প্রয়োজন মিটিয়েছিলেন। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথকে তাঁরা যেভাবে দেখতে চেয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলিকেন্দ্রিক সাহিত্যে তাঁরা তা-ই খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু গীতাঞ্জলির বাইরেও রবীন্দ্রসাহিত্যের যে বিরাট চৌহদ্দি, সেটা অনুধাবন করার মানসিক স্থৈর্য তাঁদের ছিল না।
সে জন্য বলছি, বাংলা এবং বিদেশি ভাষা শেখার আঙ্গিকে ‘পাশাপাশি’ শব্দটি আরোপ করলে আমরা ওই ‘ন্যারো বক্সের’ ধাঁধায় পড়ে যাব। মনে হবে যেন আমাদের মাতৃভাষা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, পাশাপাশি যেন আরেকটি ভাষার সাহায্য দরকার হবে। আমাদের মাতৃভাষা চর্চা ও শিক্ষার পেছনে যে বিশাল প্রেক্ষাপট, অমর একুশেসহ যে অপরিমেয় শক্তি, যেটা ১৬ কোটি মানুষের কাছ থেকে আসছে, শস্যখেত থেকে আসছে, নদী থেকে আসছে, সমুদ্র থেকে আসছে, সেখানে ভাষা শেখার ব্যাপারে কোনো পাশাপাশি চলতে পারে না। এমন শক্তিশালী ভাষা বাংলা যে অন্য ভাষাগুলো কেবল ‘অপ্রয়োজনীয়, অনাবশ্যক, আত্মাভিমানজাত’ বিকল্প ভাষা হিসেবে কাজ করবে।
আবার শেক্সপিয়ারের রাজা হেনরির উল্লেখ করে শেষ করি। হেনরি বলছেন, কেইট, ফরাসি ভাষা আমার কাছে হচ্ছে তুমি যখন আমার গলা ধরে ঝুলবে, সে রকম একটা কিছু। অর্থাৎ পলকা।
ঠিক সে রকম বাংলা ভাষার পাশাপাশি নয়, অন্য ভাষাগুলো বাংলা ভাষার গলা ধরে ঝুলবে কেবল।
ড. মোহীত উল আলম, অধ্যাপক, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahho.com
ভাষার প্রশ্নে ওপরের তিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তির অনুধাবন হলো, মাতৃভাষা হিসেবে বাংলার চর্চা যেমন হবে, পাশাপাশি বিদেশি ভাষা তথা ইংরেজির চর্চা হতে হবে অনুবাদসহ ইত্যাদি কার্যক্রম সম্পাদন করার জন্য। এই ‘পাশাপাশি চর্চার’ ধারণাটা বিস্তৃত করে কিছুটা এর যৌক্তিকতা এবং বহুলাংশে এর অযৌক্তিকতা তুলে ধরার মানসে আজকের লেখাটা তৈরি করছি।
সেদিন ক্রিকেট বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ড তথা ইংরেজ ও ডাচ্ বা দিনেমারদের মধ্যে ক্রিকেটযুদ্ধ দেখতে দেখতে একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধের কথা মনে পড়ল, যেটা হয়েছিল হল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের মধ্যে সমুদ্রের একটা জলাংশের অধিকার নিয়ে। ইতিহাসে ‘অ্যাংলো-ডাচ্ ওয়ার’ (১৬৫২-৫৪) নামে পরিচিত এই যুদ্ধে ইংরেজরা বিজয়ী হয়, যেভাবে ক্রিকেটেও তারা ম্যাচটা জিতে নিল। কিন্তু এই যুদ্ধজয় ইংরেজি সাহিত্যের জন্য একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তৈরি করে। ইংরেজি সমালোচনা সাহিত্যের পিতা হিসেবে আদৃত জন ড্রাইডেন (১৬৩১-১৭০০) ‘অব ড্রামাটিক পোয়েজি’ শিরোনামে একটি সংলাপনির্ভর প্রবন্ধ লেখেন ১৬৬৮ সালে। তাতে রচনাটির আলেখ্য শুরু হয়, যেদিন টেমস নদীর মুখে ইংরেজ নৌবাহিনী ডাচ্ নৌবাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেছিল। প্রবন্ধে চারজন তার্কিকের মধ্যে একজন (ক্রাইটিস) প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্যের পক্ষে কথা বলে, আরেকজন (ইউজিনিয়াস) ফরাসি সাহিত্যের গুণাবলির কথা বলে, আরেকজন (লিসিডিয়াস) মিত্রাক্ষরে রচিত কাব্যের প্রশংসা করে, কিন্তু শেষেরজন (নিয়েন্ডার বা নতুন মানুষ বা ড্রাইডেন নিজে) ইংরেজি সাহিত্যকে পূর্বাপর সব সাহিত্যের চেয়ে উৎকৃষ্ট বলে প্রমাণ করেন। এবং বলেন, ইংরেজ কবি উইলিয়াম শেক্সপিয়ার অমিত্রাক্ষর ছন্দে কাব্যনাট্য রচনা করে ইংরেজি সাহিত্যের সর্বোৎকৃষ্টতার প্রমাণ রেখে গেছেন।
ড্রাইডেনের সময় ইংরেজি সাহিত্যের পক্ষে এমন জোর ওকালতির দরকার ছিল কেন না ধ্রুপদি প্রাচীন সাহিত্য (গ্রিক ও লাতিন) এবং ফরাসি সাহিত্যের আধুনিকতার চাপে ইংরেজির প্রাণ ছিল ওষ্ঠাগত। এই ড্রাইডেনই ‘প্রেফিস টু ফেইবলস’ শীর্ষক প্রবন্ধে যাচাই করে দেখিয়েছেন, কেন ইংরেজ কবি চসার লাতিন কবি ভার্জিল ও ওভিদের চেয়ে বড় কবি ছিলেন।
আমরা আজকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পৃথিবীর অন্য সব কবির চেয়ে বড় কবি বলে যদি যুদ্ধটা এগিয়ে নিয়ে যাই, তাহলে যে ধরনের সেনসেশন তৈরি হবে, তেমনি ড্রাইডেনের সময় শেক্সপিয়ারকে তৎকালীন ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় কবি বলা ছিল সে রকমেরই একটি যুদ্ধ।
কিন্তু ইংরেজ কবি ড্রাইডেন সে যুদ্ধটা করে গিয়েছিলেন। ড্রাইডেনের রচনাটির শ খানেক বছর আগে থেকে রেনেসাঁ যুগের ইংরেজ মনীষীরা ব্যাপৃত ছিলেন একটি অসম যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য। তখন আইনসহ দাপ্তরিক ভাষা ছিল লাতিন খোদ ইংল্যান্ডেই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভাষাও ছিল লাতিন, আর রাজা-রানিসহ রাজন্যবর্গ ও অভিজাত শ্রেণী ফরাসি ভাষায় কথোপকথন চালাতে পছন্দ করতেন। কিন্তু লন্ডনের রাস্তাঘাটসহ পুরো ইংল্যান্ডের জনজীবনে মাতৃভাষা ইংরেজির হচ্ছিল ব্যাপক ব্যবহার। রেনেসাঁ যুগের অন্যতম কর্মকাণ্ড ছিল অনুবাদকর্ম। ফলে ইংরেজি ভাষার কৌলীন্য না থাকলেও সর্বজন ব্যবহারের জন্য এটিকে একটি প্রকৃষ্ট ব্যাকরণনির্ভর রূপ দেওয়ার জন্য রেনেসাঁর দ্বিভাষিক ও ত্রিভাষিক ইংরেজ পণ্ডিতেরা প্রচেষ্টায় নামলেন। ইংরেজির সৃজন, ভাষারীতি ও গঠনপ্রণালি নির্দিষ্ট করার পেছনে এসব ইংরেজ মনীষীর ছিল নিজ মাতৃভাষার প্রতি অমর প্রেম। এই ইংরেজ ভাষাসৈনিকেরা ছিলেন এলিয়ট, আসকাম, উইলসন, পুটেনহ্যাম, মালক্যাস্টার প্রমুখ। শেষেরজন ছিলেন মার্চেন্ট টেইলরস স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি ১৫৮২ সালে ‘এলিমেন্টারি’ শীর্ষক রচনায় লিখলেন (তর্জমা করছি): ‘কিন্তু সবকিছু ইংরেজিতে নয় কেন? যে ভাষাটি খুব সড়গড় এবং বলতে সহজ। আমার মনে হয় না, আমাদের জন্য আর কোনো ভাষা, সেটা যত ঋদ্ধ ভাষাই হোক না কেন, মনের সব চিন্তা প্রকাশ করার জন্য এত সহজিয়া হবে।... কারণ, এটা কি একটি বিরাট দাসত্ব নয় যে আমাদের নিজের কাজ সমাধান করার জন্য আমরা এত সময় ক্ষয় করে একটি বিদেশি ভাষা শিখছি, যখন আমরা ওই কাজগুলো অনেক কম সময় ব্যয় করে নিজের মাতৃভাষায় সমাধান করতে পারতাম। আমাদের ভাষা আমাদের স্বাধীনতা আর স্বাধিকারের কথা মনে করিয়ে দেয় আর লাতিন ভাষা আমাদের পরাধীনতা আর দাসত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমি রোমকে ভালোবাসি, কিন্তু আমি লন্ডনকে আরও বেশি ভালোবাসি। আমি ইতালিকে পছন্দ করি, কিন্তু ইংল্যান্ডকে আরও বেশি পছন্দ করি। লাতিন ভাষাকে আমি সম্মান করি, কিন্তু ইংরেজি ভাষাকে আমি পূজা করি।’
মালক্যাস্টারের কথা গেল। এবার দেখুন শেক্সপিয়ার কী করছেন। তাঁর নাটক রাজা পঞ্চম হেনরির ঘটনা হলো বিখ্যাত এজিনকোর্ট যুদ্ধে (১৪১৫) ফরাসি বাহিনীর ওপর ইংরেজ বাহিনীর চূড়ান্ত বিজয় লাভ। তারপর ইংরেজ রাজা হেনরি ফরাসি রাজা চার্লসের মেয়ে ক্যাথারিনকে বিয়ে করবেন। হেনরি কিছুটা ফরাসি জানলেও ক্যাথারিন ইংরেজি এক বর্ণও জানেন না। দোভাষীর মাধ্যমে কিছুদিন প্রেম চলল। কিন্তু রাজার আশ মেটে না মাতৃভাষায় প্রেম নিবেদন করতে না পারলে। শেষে ক্যাথারিন বা কেইটও কিছু কিছু ইংরেজি বুঝতে শুরু করলেন। তারপর রাজা একসময় ধৈর্যহারা হয়ে বললেন, কেইট, ফরাসি ভাষায় কথা বলার চেয়ে আমার পক্ষে রাজ্য বিজয় অনেক সহজ।
শেক্সপিয়ারের উদ্দেশ্য এখানে পরিষ্কার। শুধু রাজনৈতিকভাবে যে ইংল্যান্ড ফ্রান্সকে পরাজিত করল তা নয়, ভাষাগতভাবেও—তাও একান্ত প্রেমঘন দৃশ্যে—ইংল্যান্ডের ভবিষ্যৎ রানি বাধ্য হলেন ইংরেজি ভাষা গ্রহণ করতে।
তাহলে ইংরেজদের মধ্যে ৪০০ বা ৫০০ বছর আগে তাদের মাতৃভাষা নিয়ে যে প্রবল সচেতনতা জন্ম লাভ করেছিল, তার ফলেই তো ইংরেজি আজ বিশ্বভাষা হয়ে পড়েছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হওয়ায় তারা এ কথাও আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে যে আমাদের নিজেদের মাতৃভাষা যেন আমাদের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়।
আজকে যদি আমাদের মাতৃভাষার জন্য আমরা সমান সচেতনতা দেখাই, তাহলে একদিন কি আমাদের ভাষাও শক্তিশালী হয়ে উঠবে না। ভবিষ্যৎকে দেখার সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বর্তমানের প্রয়োজন ও তাগিদের কারণে চারপাশে যে দেয়াল ওঠে, মনে হয় সে দেয়াল যেন দুর্ভেদ্য। অথচ চোখের সামনে বিপরীত দৃষ্টান্তগুলো বরং হাজির। আমরা কোনো দিন ভাবিনি যে আমরা টেস্ট খেলুড়ে দেশ হতে পারব। আমাদের দেশের কেউ নোবেল পাবেন, সেটাও আমরা কোনো দিন ভাবিনি। ঠিক সে কারণে আমরা হয়তো ভাবতে পারছি না ওয়াল স্ট্রিটের স্টক মার্কেটে কেন বাংলা ভাষার ব্যবহার হবে। বা ৩৬ হাজার টনি সামুদ্রিক জাহাজে কেন ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ বা ‘বাংলাদেশে প্রস্তুত’ কথাটি লেখা থাকবে?
বিদেশি ভাষা—সেটা ইংরেজি হোক, আরবি হোক, কিংবা হিন্দি হোক—যত প্রবলভাবেই আসুক না, এটা কখনো মাতৃভাষার প্রয়োজন মেটাতে পারবে না। ১৬ কোটি লোকের কথা চিন্তা করলে এটি আরও পরিষ্কার হয় যে যত দিন আমরা মাতৃভাষাকে প্রান্তিক ভাষা হিসেবে দেখব, তত দিন আমাদের কাছে মনে হবে যেন ভাষাটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়।
তাহলে কি আমি বলছি, অন্য ভাষা শেখা পরিহার করে শুধু বাংলা ভাষা শিখতে হবে? না, আমি তা বলছি না। আমি বলছি, এখন সময় হয়েছে ১৬ কোটি লোকের মুখ ফোটানোর, তাদের চিন্তা ফোটানোর জন্য মাতৃভাষায় তাদের আগমন অবাধ করে দেওয়া। রেনেসাঁ যুগে ইংরেজরা যেমন করেছিল তাদের মাতৃভাষার জন্য। তারা কখনো লাতিন বা ফরাসি শিক্ষা বন্ধ করেনি, কিন্তু ইংরেজিতে সাহিত্য, রাজনীতি, বাণিজ্য ও শিল্প এত অধিক পরিমাণে বাড়িয়ে দিয়েছিল যে বিকল্প হিসেবে অন্য ভাষাগুলো ধোপেই টিকল না।
আমরাও গ্রামের শিশুদের মাদ্রাসায় গিয়ে আরবি পড়া বন্ধ করতে পারব না বা শহুরে শিশুদের স্কুলে গিয়ে ইংরেজি না শিখে ইংরেজিপনা শেখা বা বিয়েবাড়িতে বা টিভিতে হিন্দি গান শোনা বন্ধ করতে পারব না, সেগুলো বন্ধ করার কথাও বলছি না, কিন্তু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক চর্চা অব্যাহত রাখলে মানুষ অন্য ভাষার মধ্যে বিকল্প খুঁজবেই না। চিনির রাজ্যে যেমন কেউ আর গুড় খোঁজে না।
অমর্ত্য সেন তাঁর দি আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান (২০০৫) গ্রন্থে ‘টেগোর অ্যান্ড হিজ ইন্ডিয়া’ পরিচ্ছেদে রবীন্দ্রনাথের পশ্চিমা বিশ্বে প্রাথমিক গ্রহণ এবং পরে বর্জনের বিষাদময় চিত্রটি তুলে ধরে মন্তব্য করছেন, আসলে ইয়েটস, পাউন্ড প্রমুখ টেগোরকে নিয়ে তত দিন নাচানাচি করেছিলেন, যত দিন টেগোর তাঁদের ‘ন্যারো বক্স’ বা ছোট বাক্সটির প্রয়োজন মিটিয়েছিলেন। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথকে তাঁরা যেভাবে দেখতে চেয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলিকেন্দ্রিক সাহিত্যে তাঁরা তা-ই খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু গীতাঞ্জলির বাইরেও রবীন্দ্রসাহিত্যের যে বিরাট চৌহদ্দি, সেটা অনুধাবন করার মানসিক স্থৈর্য তাঁদের ছিল না।
সে জন্য বলছি, বাংলা এবং বিদেশি ভাষা শেখার আঙ্গিকে ‘পাশাপাশি’ শব্দটি আরোপ করলে আমরা ওই ‘ন্যারো বক্সের’ ধাঁধায় পড়ে যাব। মনে হবে যেন আমাদের মাতৃভাষা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, পাশাপাশি যেন আরেকটি ভাষার সাহায্য দরকার হবে। আমাদের মাতৃভাষা চর্চা ও শিক্ষার পেছনে যে বিশাল প্রেক্ষাপট, অমর একুশেসহ যে অপরিমেয় শক্তি, যেটা ১৬ কোটি মানুষের কাছ থেকে আসছে, শস্যখেত থেকে আসছে, নদী থেকে আসছে, সমুদ্র থেকে আসছে, সেখানে ভাষা শেখার ব্যাপারে কোনো পাশাপাশি চলতে পারে না। এমন শক্তিশালী ভাষা বাংলা যে অন্য ভাষাগুলো কেবল ‘অপ্রয়োজনীয়, অনাবশ্যক, আত্মাভিমানজাত’ বিকল্প ভাষা হিসেবে কাজ করবে।
আবার শেক্সপিয়ারের রাজা হেনরির উল্লেখ করে শেষ করি। হেনরি বলছেন, কেইট, ফরাসি ভাষা আমার কাছে হচ্ছে তুমি যখন আমার গলা ধরে ঝুলবে, সে রকম একটা কিছু। অর্থাৎ পলকা।
ঠিক সে রকম বাংলা ভাষার পাশাপাশি নয়, অন্য ভাষাগুলো বাংলা ভাষার গলা ধরে ঝুলবে কেবল।
ড. মোহীত উল আলম, অধ্যাপক, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahho.com
No comments