চিরঞ্জীব হেনা দাস by জয়নুল আবেদীন

চুনারুঘাটের জমিদারকন্যা মনোরমা দত্ত ও প্রখ্যাত উকিল রায় বাহাদুর সতীশ চন্দ্র দত্তের ছেলেমেয়েদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ বিপ্লবী হেনা দাস ১৯২৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সুরমা ভ্যালির অপূর্ব লীলা নিকেতন সিলেট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। হেনা দাস সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা পেয়েছেন মেজদা বারীন দত্তের কাছ থেকে।


এ ছাড়াও দত্ত পরিবারের সবাই ছিলেন সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে দৃঢ়সংকল্প। ক্রমান্বয়ে হেনা দাসদের পরিবারটি শহরে লাল পরিবার নামে খ্যাতি লাভ করে। তিনি সরকারি স্কুলে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী থাকাকালে ছাত্রীদের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে সংগঠিত করেন। তিনি সবসময় ভালো ছাত্রী ছিলেন এবং ভালো ছাত্রীদের দলে ভিড়িয়েছেন। গার্লস গাইডের ট্রেনিং শেষে প্রথা অনুযায়ী ইউনিয়ন জ্যাকের সামনে দাঁড়িয়ে স্যালুট করতে হবে এবং শপথবাক্য হচ্ছে ও ংযধষষ নব ষড়ুধষ ঃড় ঃযব শরহম. প্রধান শিক্ষিকা ও ইংরেজ ডেপুটি কমিশনারের স্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে হেনা দাস পাঁচ বন্ধুকে নিয়ে সদর্পে বললেন, 'আমরা ইউনিয়ন জ্যাককে স্যালুট ও রাজার নামে শপথ করতে অক্ষম।' এটাই তার কৈশোরের প্রথম ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ। ১৯৪০ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করার পর সুরমা ভ্যালি ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃত্ব লাভ করেন। ছাত্র ফেডারেশনের কাউন্সিলর হিসেবে ট্রেনিংয়ের জন্য বোম্বে যান এবং পিসি যোশীর সানি্নধ্যে আসেন। ছাত্র ফেডারেশনের সম্মেলন ভণ্ডুল করতে তৎকালীন আঞ্চলিক মোরারজি দেশাই সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। পুলিশি আক্রমণে ও টিয়ার শেলে অনেক নেতাকর্মী আহত হন। হেনা দাস প্রচণ্ড মার খেয়ে আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হন। ১৯৪২ সালে পার্টির সক্রিয় কর্মকাণ্ডের মধ্যেও প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন এবং ওই বছরই পার্টির পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ লাভ করেন। কৃষক-শ্রমিকের মুক্তি আন্দোলনে সার্বক্ষণিক কাজ শুরু করেন এবং গণনাট্য সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯৪৬ সালে নেত্রকোনার সর্বভারতীয় কৃষক সম্মেলনে ছিচলি্লশের দুর্ভিক্ষপীড়িত কৃষাণ-কিষাণীর গণনাট্য অভিনীত হয়। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের রচিত চিত্রনাট্যে কৃষাণীর ভূমিকার হেনা দাস ও কৃষকের ভূমিকায় নির্মলেন্দু চৌধুরী অভিনয় করেন। তাদের অভিনয় ও গানে লাখো কৃষকের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়। ১৯৪৮ সালে সুনামগঞ্জের কৃষক আন্দোলনের সংগঠক কঠোর পরিশ্রমী নেতা রোহিনী দাসের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ১৯৫১ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত তিনি সিলেট জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক ছিলেন।
হেনা দাস সিলেটের কুখ্যাত নানকার প্রথাবিরোধী আন্দোলন ও হাজং আন্দোলনেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। হেনা দাসকে আত্মগোপনে কখনও চা বাগানের কুলি রমণী, কখনও চাষী বউ ইত্যাদি বিভিন্ন ছদ্মবেশে থাকতে হতো। যৌবনে বৈবাহিক অবস্থায় নারী জীবনের সুখ তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি। প্রথম পুত্রসন্তানটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাতপাতালে ডাক্তারদের অবহেলায় মারা যায়। মুসলিম লীগের প্রচণ্ড নির্যাতন-নিপীড়নে হেনা দাসের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। গোপনে ছদ্মবেশে কলকাতায় চিকিৎসা নিয়ে আবার ফিরে আসেন দেশে। দ্বিতীয় সন্তান দীপার চার বছর বয়সের সময় ১৯৫৮ সালে তিনি পার্টির সিদ্ধান্তে নারায়ণগঞ্জ গার্লস হাইস্কুলে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন। নারায়ণগঞ্জ গার্লস স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি কমিউনিস্ট পরিচয় গোপন রেখে মহিলা সংগঠন ও শিক্ষক সংগঠনে জড়িয়ে পড়েন। তিনি সাধারণ কর্মী হিসেবে শিক্ষক সংগঠনে এসে নিজ গুণ ও কর্মদক্ষতার বলে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদিকা ও সহ-সভানেত্রী ছিলেন দীর্ঘদিন। তিনি আন্তর্জাতিক শিক্ষক সংগঠনের আমন্ত্রণে প্যারিস, ব্রাসেলস, মালয়েশিয়া, নেপাল এবং ভারতের দিলি্ল, ভুবনেশ্বর, বোম্বে, কলকাতাসহ দেশ-বিদেশের বহু শিক্ষা সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। হেনাদির সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশকিছু সম্মেলনে যোগ দিয়ে দেখেছি, দক্ষতার মানদণ্ডে তিনি সবার ওপরে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মেঘালয় ও আসামের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে রাতদিন অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থেকেছেন। তিনি ছিলেন একাধারে নিপীড়িত কৃষাণ ও শ্রমিক শ্রেণীর বন্ধু এবং একজন বিশিষ্ট লেখক ও শিক্ষাবিদ। জীবনের প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় আত্মগোপন এবং ব্রিটিশ ও মুসলিম লীগ সরকারের নির্যাতন-নিপীড়ন ও জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে স্মৃতিময় দিনগুলো, স্মৃতিময় ৭১, চার পুরুষের কামিনী, নির্বাচিত প্রবন্ধ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। শেষ জীবনে তাকে মহিলা পরিষদের সভানেত্রী নির্বাচন করা হয়। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার সমাজসেবায় তার অমূল্য অবদানের জন্য তাকে রোকেয়া স্বর্ণপদকে ভূষিত করে। হেনা দাসের মতো সর্বগুণের অধিকারী ক্ষণজন্মা মহীয়সী নারী কদাচিৎ জন্মায়। আমাদের প্রিয় হেনাদি ৮৫ বছর বয়সে ২০০৯ সালের ২০ জুলাই মহাপ্রয়াণ করেন।

জয়নুল আবেদীন :সাবেক অধ্যক্ষ, আবদুল আজিজ কলেজ
 

No comments

Powered by Blogger.