কোথায় চলেছে বাংলাদেশের রাজনীতি? by শহিদুল ইসলাম
এক. বাংলাদেশের সন্ত্রাসী অর্থনীতি ও রাজনীতি অবশেষে বাংলাদেশকে ধ্বংসের দোরগোড়ায় এনে দাঁড় করিয়েছে। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর হারিয়ে যাওয়া তার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত। ইলিয়াস আলীর রহস্যজনক হারিয়ে যাওয়ার প্রকৃত কারণ জানা গেলে হয়তো এ বিষয়ে সর্বশেষ মন্তব্য করা যাবে।
আপাতত এটুকু বলা যায়, বাংলাদেশের মানুষ সবাই আজ আতঙ্কগ্রস্ত। বাংলাদেশ এমন একটা রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে যে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের কোনো কূলকিনারা করতে পারল না আজও। বাংলাদেশ এমন একটা রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে যে পুলিশের চোখের ওপর দিয়ে একাত্তরের বাচ্চু রাজাকার পালিয়ে পাকিস্তানের উদ্দেশে ভারতে চলে গেল। ইলিয়াস আলীর হারিয়ে যাওয়ার প্রতিবাদে বিএনপির আহ্বানে গত ২২ ও ২৩ এপ্রিল সারা দেশে ধর্মঘট পর্যন্ত হয়ে গেল। বাংলাদেশ এমন একটা রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, সেই হরতালের সাফল্যের জন্য আগের দিন রাজনৈতিক উন্মাদনার শিকার হয়ে ড্রাইভার বদর আলী ঘুমন্ত অবস্থায় পুড়ে ছাইয়ে পরিণত হন। বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে যে মন্ত্রীর গাড়িতে টাকার বস্তা উদ্ধারের পর মন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মন্ত্রিত্বের পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয় এবং পরদিনই তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রীর গদিতে বসানো হয়। বাংলাদেশ এমন একটা দেশে পরিণত হয়েছে যে পেশাজীবী খুনি-চাঁদাবাজ-পুলিশ-র্যাবের ছোট-বড় কর্মকর্তারাও এ অর্থনীতি ও রাজনীতিতে সমানভাবে অংশ নেওয়ার জন্য ময়দানে নেমে পড়েছে। গুলশানের ফাহিমা সুলতানা নিহত হন তাঁর গাড়ির ড্রাইভারের হাতে। ফাহিমা সুলতানার গহনার প্রতি আকর্ষণই সে হত্যার কারণ। বাংলাদেশে 'ঘুষের' নাম বদলে হয়েছে 'বকশিশ'। বকশিশ না পেলে বাসার নষ্ট হওয়া টেলিফোন সচল হয় না, গাড়ির ফিটনেস হয় না। অফিসের ফাইল ওঠানামা করে 'বকশিশের' মাহাত্ম্যে। ঘুষ দেওয়া আর নেওয়া যদি সমান অপরাধ হয়ে থাকে, ঢাকায় এসে আমিও নিজের চরিত্র হারিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, যাঁর হাতে বিন্দুমাত্র ক্ষমতা নেই, তাঁকে কেউ ঘুষ দিতে আসবে না। কিন্তু বিভিন্ন কাজে 'বখশিশ' দিয়ে আমি আমার চরিত্র কলঙ্কিত করেছি। এ দেশের কোনো শহরে বসবাস করে চরিত্র শুদ্ধ রাখা যায় না। প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির জন্য টাকার বস্তা দরকার। সরকারি-বেসরকারি অফিসে একজন দারোয়ান ও পিয়নের চাকরির জন্য কয়েক লাখ টাকা বখশিশ দিতে হয়। এ দেশে ক্ষমতাহীন-নিরীহ মানুষের কোনো স্থান নেই। যার যত টাকা, সে টাকা কে কোথা থেকে কিভাবে অর্জন করেছে, তা কেউ দেখতে যায় না, এ দেশে তার সম্মান তত বেশি। তবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য গুম-খুনের রাজনীতি আজ সবাইকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।
দুই. রাজনীতির সন্ত্রাসীকরণ এমন জায়গায় চলে গেছে যে প্রতিপক্ষের প্রতি কোনো সম্মান দেখানোর বিষয়টিও এ দেশের রাজনীতিবিদরা ভুলে গেছেন। সমগ্র জাতির সামনে যে অসাংবিধানিক সন্ত্রাসী ভাষায় তাঁরা পরস্পরকে গালাগাল করেন যে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ে, শিশু-কিশোরদের চরিত্র ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। তারা যখন দেখে তাদের মা-বাবারা শুদ্ধ ও ভদ্র ভাষায় কথা বলতে পারেন না, তখন তারা সেটাই শেখে। কদিন আগে জাতীয় সংসদে তার ফাইনাল রাউন্ডের খেলা সমগ্র দেশবাসী লক্ষ করে লজ্জায় মুখ ঢেকেছে। তাদের শিক্ষা ও বংশপরিচয় সম্পর্কে দেশবাসীর ধারণা সুস্পষ্ট হয়েছে। এ দেশের রাজনীতিবিদদের কথাবার্তা, কাজকর্ম বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতার প্রমাণ। পুঁজিবাদী বুর্জোয়া গণতন্ত্রেও মানবসভ্যতার অনেক অগ্রগতি হয়েছে। উন্নত পুঁজিবাদী দেশে গেলে সবাই তা টের পায়। ট্রাফিক আইন ভঙ্গের জন্য সেসব দেশে প্রধানমন্ত্রীকেও জরিমানা দিতে হয়। আইনের চোখে সবাই সমান, বাহ্যিকভাবে তা সবার চোখে পড়ে। আমাদের দেশের মন্ত্রী মহোদয়রা সে কথা চিন্তাও করতে পারেন না। তাঁরা যখন যে রাস্তায় চলেন, তখন সে রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া চলাচল বন্ধ রেখে মানুষের জীবনে ভোগান্তি বৃদ্ধি করেন। এ দেশের 'সুশীল সমাজভুক্ত' রাজনীতিবিদরা সুশীল সমাজের ভাবমূর্তি ধ্বংস করেছেন।
তিন. ইলিয়াস আলীর হারিয়ে যাওয়া নিয়ে গত রবিবার ধর্মঘট হয়ে গেল। ইলিয়াস আলীর সঙ্গে আরো একজন হারিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ইলিয়াস আলীর গাড়ির ড্রাইভার আনসার আলী। তাঁর কথা আমাদের কারো মনে পড়ে না। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা যেমন তাঁকে ফেরত চান- তাঁর জন্য আশঙ্কায় পাথর হয়ে আছেন, আনসার আলীর স্ত্রী মুক্তা বেগমও তেমনি শোকে পাথর। কিন্তু আমাদের কারো তাঁকে নিয়ে মাথাব্যথা নেই। বদর আলী-আনসার আলীরা না থাকলে দেশের কোনো ক্ষতি নেই। অবশেষে বাংলাদেশ মোটর চালক দল গত শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আনসার আলীর স্ত্রী মুক্তা বেগম ও তাঁদের দুই বছরের কন্যা চাঁদনী, ইলিয়াস আলীর বড় ছেলে আবরার ইলিয়াস ও বোন দিনার শারমিন। সেখানে কান্নায় ভেঙে পড়েন মুক্তা বেগম। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন করেন, 'আমার স্বামীকে যেকোনো মূল্যে ফেরত দিন।' তাঁর স্বামী আনসার আলী কোনো রাজনীতি করতেন না। কিন্তু দেশের মানুষ কজন ইলিয়াসের পাশাপাশি আনসারের কথা বলছেন? হারিয়ে যাওয়ার চার দিন পর যখন ওই প্রেস কনফারেন্সে আনসারকে ফিরে পাওয়ার জন্য আকুল আবেদন করছিলেন মুক্তা বেগম, সেদিনই ইলিয়াস আলীর হারিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে বিএনপির হরতালে আরেক বাসের ড্রাইভার বদর আলী বেগকে হারালেন তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা। শোকের মাতম উঠেছে বদর আলী বেগের খুলনার বাড়িতে। সে খবর ছবিসহ প্রকাশিত হয়েছে কালের কণ্ঠে (২২-৪-২০১২)। বাংলাদেশের জনগণ এ রাজনীতির কবর চায়। দেশবাসী জানে বদর আলী হত্যার বিচার হবে না। দেশবাসী দেখছে ইলিয়াস আলীর সঙ্গে কারো মুখে আনসার আলীর নাম নেই। এখানেই বাংলাদেশের রাজনীতির শ্রেণীবিন্যাস স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। সেই শ্রেণীবিন্যাসের জন্য বিনা নোটিশে বস্তি উচ্ছেদে হাজার হাজার নর-নারী, শিশু-বৃদ্ধ রাতারাতি এক টুকরো ছাদের আড়াল হারায়। রাজধানীকে তিলোত্তমা নগরীতে পরিণত করতে হবে- বস্তি থাকলে তা হয় কী করে। আমরা দেখেছি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সময় মিরপুর স্টেডিয়ামের আশপাশে রাস্তাঘাট, দোকানপাট, বাড়িঘরকে যেন নববধূর সাজে সাজানো হয়েছিল। বিদেশি খেলোয়াড়দের তো আমাদের আসল চেহারা দেখানো যায় না। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে আমরা দেখেছি কোনো বিদেশি কর্তাব্যক্তির আগমনে স্কুলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভিযান চলত। তাঁর 'শুভ আগমনের' দিন স্কুলের শিশু ছেলেমেয়েদের তাদের সবচেয়ে ভালো জামাকাপড় পরে আসতে হতো- সে রকমই নির্দেশ দেওয়া হতো স্কুল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। সেই একই ঔপনিবেশিক রীতি আজও এ দেশের, স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়নি। সাবেক দখলদার ঔপনিবেশিক শক্তির কোনো প্রতিভূ যদি আজও বাংলাদেশে আসেন, তাঁকে নিয়ে সবার মাঝে ধুম পড়ে যায়। সরকার, বিরোধী দল, সিভিল সমাজ, সংবাদপত্র-টেলিভিশন যেন স্বর্গ হাতে পেয়ে গেছে। সেই আদিখ্যেতা দেখে বোঝা যায়, তারা যখন এ দেশ শাসন করতেন, তখন কী অবস্থা হতো। আজ যেকোনো আলোচনায় একজন সাদা চামড়ার মানুষকে উপস্থিত করাটা যেন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপনিবেশ আমলে আমাদের সাম্রাজ্যবাদ-প্রীতি বোধ হয় এতটা ছিল না। ১২ জন ব্রিটিশ ভদ্রলোক ও মহিলার যখন এ দেশে একটি স্কুল তৈরির ছবি প্রকাশিত হতে দেখি, তখন আমার লজ্জা লাগে। আমার স্যার টমাস রো'র কথা মনে পড়ে যায়। এভাবেই মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের মন ভুলিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি এ দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকার আদায় করে নিয়েছিল। তারই উত্তরসূরি লর্ড ক্লাইভ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এ দেশের স্বাধীনতা হরণ করেন। সে কথা আজকের বাঙালি শাসকবর্গ নিশ্চয়ই ভুলে গেছেন। ব্রিটিশ হাইকমিশনার সিলেটে জন্মগ্রহণকারী আনোয়ার চৌধুরীর বক্তব্যের কেউ-ই সেদিন প্রতিবাদ করেননি। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের ইতিহাস আজ আমেরিকা-কানাডা ও দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার মানুষ নতুনভাবে লিখছেন। আজ এ দেশে সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তির আনাগোনা নতুন প্রশ্নের জন্ম দেয়। 'কী তাঁদের উদ্দেশ্য?' মিশনারিদের ছদ্মবেশে তাঁরা এ দেশে এসেছিলেন এ দেশটি দখল করার জন্য। তাঁরা চলে গেছেন। কিন্তু রেখে গেছেন ঔপনিবেশিক শক্তির দালাল শ্রেণীকে। তাঁরাই এ দেশে নয়া সাম্রাজ্যবাদী শক্তির স্বার্থ রক্ষাকারী শক্তি। রাষ্ট্র আজ সেই দালাল শ্রেণীর স্বার্থকেই পাহারা দিচ্ছে। রাষ্ট্রের এই শ্রেণী-বৈষম্যের চেহারা আজ স্পষ্ট।
চার. সেই স্বার্থের গাঁটছড়ায় বাঁধা এ দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি-শিক্ষানীতি-আমলাতন্ত্র-সিভিল সোসাইটি। সেখানে আনসার আলী-বদর আলী বেগের কোনো স্থান নেই। তাঁরা এ দেশের শাসকশ্রেণীর খেদমত করবে- তাঁদের জ্বালানো আগুনে পুড়ে মরবে- এটাই স্বাভাবিক। তিন হাজার টাকা বেতনের গার্মেন্ট শ্রমিকের মূল্য কেবল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা। এর বেশি নয়। সেই বৈদেশিক মুদ্রার মালিকের এক বোতল বিদেশি মদের মূল্য ২০-২৫ হাজার টাকা। বস্তিবাসীর জীবন এ দেশের শাসকশ্রেণীর কাছে মূল্যহীন। এভাবে বাংলাদেশ বিগত ৪০ বছরে এক ভাগ ধনিক শ্রেণীর দখলে চলে গেছে। রাষ্ট্রটি তাঁদেরই। পুলিশ-র্যাব-সেনাবাহিনী সব তাঁদের। ৯৯ ভাগ মানুষের একটাই কাজ, তা হলো ভোটের মাধ্যমে তাদের শোষক শ্রেণী বাছাই করা। আর তাদের ভোটে নির্বাচিত শাসকশ্রেণীর কাজ হলো অন্তত পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত জনগণের কথা ভুলে যাওয়া। নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে এলে এ দেশের রাজনীতিবিদদের মুখে জনগণের জন্য দরদ উথলে ওঠে। দেশের ৯৯ ভাগ মানুষ যেদিন এ সত্যটা বুঝতে শিখবে, সেদিনই কেবল বাংলাদেশ এই অপরাজনীতি, 'গণবিরোধী' গণতন্ত্রের অবসান ঘটাতে বিপ্লবে অংশগ্রহণ করতে এগিয়ে আসবে।
২৩.৪.২০১২
লেখক : শিক্ষাবিদ
দুই. রাজনীতির সন্ত্রাসীকরণ এমন জায়গায় চলে গেছে যে প্রতিপক্ষের প্রতি কোনো সম্মান দেখানোর বিষয়টিও এ দেশের রাজনীতিবিদরা ভুলে গেছেন। সমগ্র জাতির সামনে যে অসাংবিধানিক সন্ত্রাসী ভাষায় তাঁরা পরস্পরকে গালাগাল করেন যে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ে, শিশু-কিশোরদের চরিত্র ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। তারা যখন দেখে তাদের মা-বাবারা শুদ্ধ ও ভদ্র ভাষায় কথা বলতে পারেন না, তখন তারা সেটাই শেখে। কদিন আগে জাতীয় সংসদে তার ফাইনাল রাউন্ডের খেলা সমগ্র দেশবাসী লক্ষ করে লজ্জায় মুখ ঢেকেছে। তাদের শিক্ষা ও বংশপরিচয় সম্পর্কে দেশবাসীর ধারণা সুস্পষ্ট হয়েছে। এ দেশের রাজনীতিবিদদের কথাবার্তা, কাজকর্ম বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতার প্রমাণ। পুঁজিবাদী বুর্জোয়া গণতন্ত্রেও মানবসভ্যতার অনেক অগ্রগতি হয়েছে। উন্নত পুঁজিবাদী দেশে গেলে সবাই তা টের পায়। ট্রাফিক আইন ভঙ্গের জন্য সেসব দেশে প্রধানমন্ত্রীকেও জরিমানা দিতে হয়। আইনের চোখে সবাই সমান, বাহ্যিকভাবে তা সবার চোখে পড়ে। আমাদের দেশের মন্ত্রী মহোদয়রা সে কথা চিন্তাও করতে পারেন না। তাঁরা যখন যে রাস্তায় চলেন, তখন সে রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া চলাচল বন্ধ রেখে মানুষের জীবনে ভোগান্তি বৃদ্ধি করেন। এ দেশের 'সুশীল সমাজভুক্ত' রাজনীতিবিদরা সুশীল সমাজের ভাবমূর্তি ধ্বংস করেছেন।
তিন. ইলিয়াস আলীর হারিয়ে যাওয়া নিয়ে গত রবিবার ধর্মঘট হয়ে গেল। ইলিয়াস আলীর সঙ্গে আরো একজন হারিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ইলিয়াস আলীর গাড়ির ড্রাইভার আনসার আলী। তাঁর কথা আমাদের কারো মনে পড়ে না। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা যেমন তাঁকে ফেরত চান- তাঁর জন্য আশঙ্কায় পাথর হয়ে আছেন, আনসার আলীর স্ত্রী মুক্তা বেগমও তেমনি শোকে পাথর। কিন্তু আমাদের কারো তাঁকে নিয়ে মাথাব্যথা নেই। বদর আলী-আনসার আলীরা না থাকলে দেশের কোনো ক্ষতি নেই। অবশেষে বাংলাদেশ মোটর চালক দল গত শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আনসার আলীর স্ত্রী মুক্তা বেগম ও তাঁদের দুই বছরের কন্যা চাঁদনী, ইলিয়াস আলীর বড় ছেলে আবরার ইলিয়াস ও বোন দিনার শারমিন। সেখানে কান্নায় ভেঙে পড়েন মুক্তা বেগম। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন করেন, 'আমার স্বামীকে যেকোনো মূল্যে ফেরত দিন।' তাঁর স্বামী আনসার আলী কোনো রাজনীতি করতেন না। কিন্তু দেশের মানুষ কজন ইলিয়াসের পাশাপাশি আনসারের কথা বলছেন? হারিয়ে যাওয়ার চার দিন পর যখন ওই প্রেস কনফারেন্সে আনসারকে ফিরে পাওয়ার জন্য আকুল আবেদন করছিলেন মুক্তা বেগম, সেদিনই ইলিয়াস আলীর হারিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে বিএনপির হরতালে আরেক বাসের ড্রাইভার বদর আলী বেগকে হারালেন তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা। শোকের মাতম উঠেছে বদর আলী বেগের খুলনার বাড়িতে। সে খবর ছবিসহ প্রকাশিত হয়েছে কালের কণ্ঠে (২২-৪-২০১২)। বাংলাদেশের জনগণ এ রাজনীতির কবর চায়। দেশবাসী জানে বদর আলী হত্যার বিচার হবে না। দেশবাসী দেখছে ইলিয়াস আলীর সঙ্গে কারো মুখে আনসার আলীর নাম নেই। এখানেই বাংলাদেশের রাজনীতির শ্রেণীবিন্যাস স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। সেই শ্রেণীবিন্যাসের জন্য বিনা নোটিশে বস্তি উচ্ছেদে হাজার হাজার নর-নারী, শিশু-বৃদ্ধ রাতারাতি এক টুকরো ছাদের আড়াল হারায়। রাজধানীকে তিলোত্তমা নগরীতে পরিণত করতে হবে- বস্তি থাকলে তা হয় কী করে। আমরা দেখেছি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সময় মিরপুর স্টেডিয়ামের আশপাশে রাস্তাঘাট, দোকানপাট, বাড়িঘরকে যেন নববধূর সাজে সাজানো হয়েছিল। বিদেশি খেলোয়াড়দের তো আমাদের আসল চেহারা দেখানো যায় না। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে আমরা দেখেছি কোনো বিদেশি কর্তাব্যক্তির আগমনে স্কুলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভিযান চলত। তাঁর 'শুভ আগমনের' দিন স্কুলের শিশু ছেলেমেয়েদের তাদের সবচেয়ে ভালো জামাকাপড় পরে আসতে হতো- সে রকমই নির্দেশ দেওয়া হতো স্কুল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। সেই একই ঔপনিবেশিক রীতি আজও এ দেশের, স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়নি। সাবেক দখলদার ঔপনিবেশিক শক্তির কোনো প্রতিভূ যদি আজও বাংলাদেশে আসেন, তাঁকে নিয়ে সবার মাঝে ধুম পড়ে যায়। সরকার, বিরোধী দল, সিভিল সমাজ, সংবাদপত্র-টেলিভিশন যেন স্বর্গ হাতে পেয়ে গেছে। সেই আদিখ্যেতা দেখে বোঝা যায়, তারা যখন এ দেশ শাসন করতেন, তখন কী অবস্থা হতো। আজ যেকোনো আলোচনায় একজন সাদা চামড়ার মানুষকে উপস্থিত করাটা যেন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপনিবেশ আমলে আমাদের সাম্রাজ্যবাদ-প্রীতি বোধ হয় এতটা ছিল না। ১২ জন ব্রিটিশ ভদ্রলোক ও মহিলার যখন এ দেশে একটি স্কুল তৈরির ছবি প্রকাশিত হতে দেখি, তখন আমার লজ্জা লাগে। আমার স্যার টমাস রো'র কথা মনে পড়ে যায়। এভাবেই মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের মন ভুলিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি এ দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকার আদায় করে নিয়েছিল। তারই উত্তরসূরি লর্ড ক্লাইভ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এ দেশের স্বাধীনতা হরণ করেন। সে কথা আজকের বাঙালি শাসকবর্গ নিশ্চয়ই ভুলে গেছেন। ব্রিটিশ হাইকমিশনার সিলেটে জন্মগ্রহণকারী আনোয়ার চৌধুরীর বক্তব্যের কেউ-ই সেদিন প্রতিবাদ করেননি। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের ইতিহাস আজ আমেরিকা-কানাডা ও দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার মানুষ নতুনভাবে লিখছেন। আজ এ দেশে সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তির আনাগোনা নতুন প্রশ্নের জন্ম দেয়। 'কী তাঁদের উদ্দেশ্য?' মিশনারিদের ছদ্মবেশে তাঁরা এ দেশে এসেছিলেন এ দেশটি দখল করার জন্য। তাঁরা চলে গেছেন। কিন্তু রেখে গেছেন ঔপনিবেশিক শক্তির দালাল শ্রেণীকে। তাঁরাই এ দেশে নয়া সাম্রাজ্যবাদী শক্তির স্বার্থ রক্ষাকারী শক্তি। রাষ্ট্র আজ সেই দালাল শ্রেণীর স্বার্থকেই পাহারা দিচ্ছে। রাষ্ট্রের এই শ্রেণী-বৈষম্যের চেহারা আজ স্পষ্ট।
চার. সেই স্বার্থের গাঁটছড়ায় বাঁধা এ দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি-শিক্ষানীতি-আমলাতন্ত্র-সিভিল সোসাইটি। সেখানে আনসার আলী-বদর আলী বেগের কোনো স্থান নেই। তাঁরা এ দেশের শাসকশ্রেণীর খেদমত করবে- তাঁদের জ্বালানো আগুনে পুড়ে মরবে- এটাই স্বাভাবিক। তিন হাজার টাকা বেতনের গার্মেন্ট শ্রমিকের মূল্য কেবল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা। এর বেশি নয়। সেই বৈদেশিক মুদ্রার মালিকের এক বোতল বিদেশি মদের মূল্য ২০-২৫ হাজার টাকা। বস্তিবাসীর জীবন এ দেশের শাসকশ্রেণীর কাছে মূল্যহীন। এভাবে বাংলাদেশ বিগত ৪০ বছরে এক ভাগ ধনিক শ্রেণীর দখলে চলে গেছে। রাষ্ট্রটি তাঁদেরই। পুলিশ-র্যাব-সেনাবাহিনী সব তাঁদের। ৯৯ ভাগ মানুষের একটাই কাজ, তা হলো ভোটের মাধ্যমে তাদের শোষক শ্রেণী বাছাই করা। আর তাদের ভোটে নির্বাচিত শাসকশ্রেণীর কাজ হলো অন্তত পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত জনগণের কথা ভুলে যাওয়া। নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে এলে এ দেশের রাজনীতিবিদদের মুখে জনগণের জন্য দরদ উথলে ওঠে। দেশের ৯৯ ভাগ মানুষ যেদিন এ সত্যটা বুঝতে শিখবে, সেদিনই কেবল বাংলাদেশ এই অপরাজনীতি, 'গণবিরোধী' গণতন্ত্রের অবসান ঘটাতে বিপ্লবে অংশগ্রহণ করতে এগিয়ে আসবে।
২৩.৪.২০১২
লেখক : শিক্ষাবিদ
No comments