বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩৭৫ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ মোহাম্মদ সাহাব উদ্দীন, বীর বিক্রম মুখোমুখি যুদ্ধে শহীদ হন তিনি ১৯৭১ সালে মোহাম্মদ সাহাব উদ্দীনের বয়স ছিল ১৭ বা ১৮। স্কুলের ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারেননি।


বাড়িতে মা-বাবা, কাউকে কিছু না বলে চলে যান ভারতে। যোগ দেন মুক্তিবাহিনীতে। ভারতের নরসিংহগড়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেন ৪ নম্বর সেক্টরে। সেপ্টেম্বর মাসে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার লুবাছড়া চা-বাগানে এক যুদ্ধে তিনি শহীদ হন।
এই যুদ্ধের বিবরণ আছে ৪ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর জেনারেল (অব.) চিত্তরঞ্জন দত্তের (বীর উত্তম, তখন মেজর) বয়ানে। তিনি বলেন, ‘খবর পাওয়া গেল লাতুতে প্রায় এক কোম্পানি শত্রু সৈন্য (পাকিস্তান সেনাবাহিনী) পরিখা খনন করেছে। তারা বড়লেখা পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। লাতু এমন এক জায়গা, সেটা দখল করা আমাদের জন্য খুবই দরকার ছিল। কারণ, লাতু দখল করলে শত্রুদের কুলাউড়া-শ্রীহট্ট চলাচলে অনেক অসুবিধা হবে। তাই ৩০০ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে লাতু দখলের পরিকল্পনা করলাম।
‘আগস্টের শেষের দিকে ভোর চারটায় আক্রমণ শুরু হলো। বেলা প্রায় দুটোয় আমাদের ওপর শুরু হলো শত্রু সৈন্যদের গোলাবর্ষণ। তিন ইঞ্চি এমজির গোলাগুলি আসতে লাগল। বিকেল প্রায় সাড়ে পাঁচটায় শত্রুদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা টিকতে না পেরে পেছনে চলে আসতে শুরু করল। মনটা খারাপ হয়ে গেল। যুদ্ধে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিল।
‘সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সেখানে আবার আক্রমণ চালানো হয়। সারোপার ও লাতু—এ দুটো জায়গা আবার দখলের প্রচেষ্টা চালানো হলো। তুমুল যুদ্ধের পর সারোপার আমাদের হস্তগত হয়। পুরো সেপ্টেম্বর মাসটা লাতু, বড়লেখা এমনকি ফেঞ্চুগঞ্জ পর্যন্ত আমাদের আক্রমণ চলতে লাগল।
‘ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সাদী (মাহবুবুর রহমান সাদী বীর প্রতীক) তাঁর যোদ্ধাদের নিয়ে লুবাছড়া চা-বাগানে আক্রমণ চালায়। দুই দিন যুদ্ধের পর পুরো লুবাছড়া-কারবালা আমাদের হস্তগত হয়। লুবাছড়া মুক্ত হওয়ার পর পাকিস্তানিরা বারবার চেষ্টা চালিয়েছে তা পুনর্দখল করার জন্য। কিন্তু লুবাছড়া তারা পুনরায় দখল করতে সমর্থ হয়নি। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা খাজা নিজামউদ্দীন, মোহাম্মদ সাহাব উদ্দীনসহ নয়জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
‘এইসব মুক্তিযোদ্ধাকে বীরত্বসূচক অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার জন্য আমি সিএনসির কাছে অনুরোধ করেছিলাম। তাঁরা হলেন ১. খাজা নিজামউদ্দীন বীরশ্রেষ্ঠ ২. মোহাম্মদ সাহাব উদ্দীন বীরশ্রেষ্ঠ ৩. রফিকউদ্দীন বীর উত্তম ৪. আশরাফুল হক বীর উত্তম ৫. মাহমুদুর রব বীর উত্তম এবং ৬. মো. বশির আহম্মদ ৭. মো. মইজুল ইসলাম ৮. মোহাম্মদ হোসেন ও ৯. আতিকুল ইসলাম বীর প্রতীক।’
লুবাছড়া চা-বাগানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালালে বিপুল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনারাও পাল্টা আক্রমণ করে। তারা তিন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালায়। দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ মোহাম্মদ সাহাব উদ্দীনসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিহত করেন। মুখোমুখি যুদ্ধে মোহাম্মদ সাহাব উদ্দীন শহীদ হন। তাঁর এবং অন্যদের জীবনের বিনিময়ে মুক্ত হয় লুবাছড়া।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মোহাম্মদ সাহাব উদ্দীনকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৫১।
শহীদ মোহাম্মদ সাহাব উদ্দীনের পৈতৃক বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার আদিয়াবাদ (বাইদ পাড়া) গ্রামে। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম কামাল উদ্দীন আহমেদ, মা নূরজাহান বেগম। শহীদ মোহাম্মদ সাহাব উদ্দীনের ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড এবং নরসিংদী জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.