চেতনা-সংস্কৃতির শক্তি ও একুশের গ্রন্থমেলা by বিশ্বজিৎ ঘোষ

সংস্কৃতিচেতনা ও বইমেলা—দুটি আপাত স্বতন্ত্র প্রত্যয় হলেও, এ দুয়ের মধ্যে রয়েছে গভীর এক সম্পর্ক। সাধারণ অর্থে গ্রন্থমেলা বই নামক পণ্যের বেচাকেনার মেলা। কিন্তু একুশের গ্রন্থমেলা কেবল পণ্য বেচাকেনার মেলা নয়। একুশের গ্রন্থমেলা অন্য যেকোনো বইমেলা থেকে স্বতন্ত্র চারিত্র্যের অধিকারী,


একুশের বইমেলা আমাদের জাতিগত সংস্কৃতিরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু প্রশ্ন এই—বইমেলার সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্কটা তৈরি হয় কীভাবে? কেন-ই বা আমরা একুশের গ্রন্থমেলাকে আমাদের জাতিগত সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করছি? ফ্রাঙ্কফুর্ট, কলকাতা, কি এমনি সব বইমেলা থেকে আমাদের বইমেলার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কথাই বা আমরা বলছি কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে গেলেই অনুধাবন করা যাবে আমাদের বইমেলার স্বতন্ত্র চারিত্র্যের স্বরূপ।
বাংলাদেশের হাজার বছরের সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্য এর লোকায়ত চারিত্র্য। লোকমানসের সঙ্গেই ছিল আমাদের সংস্কৃতির মৌল সম্পর্ক। লোকমানসকে সংস্কৃত তথা শিক্ষিত করে তোলাই সংস্কৃতির প্রধান কাজ। সংস্কৃতির মূল আবেদন কিংবা বলি শিক্ষা—মানুষের সঙ্গে মানুষের মৈত্রীবন্ধন। বাংলাদেশের সনাতন সংস্কৃতিরও মূল প্রোথিত ছিল মানবমৈত্রীতে। কিন্তু ঔপনিবেশিককালে আমাদের সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করে সৃষ্টি করা হয়েছিল ভিন্ন এক সংস্কৃতি। সে-সংস্কৃতি শাহরিক মধ্যস্তরের বিচ্ছিন্নতা-বিভঙ্গতা-বিকৃতির সংস্কৃতি। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকেরা আমাদের সংস্কৃতির মূল শক্তিকে ধ্বংস করে সৃষ্টি করেছিল এক শিকড়হীন সত্তাহীন মেকি সংস্কৃতি।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে মূলত মধ্যস্তরের মানুষের সাধনাতেই পরিচর্যা পায় এবং বিকশিত হয় সংস্কৃতি। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে যে মধ্যস্তরের জনগোষ্ঠী বিকশিত হলো, মেকলে-চক্রের ষড়যন্ত্রে জন্মলগ্নেই তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল স্বদেশ-স্বজাতি থেকে। পাকিস্তানি আমলে এ প্রয়াসেরই ভিন্নমাত্রিক প্রবণতা আমরা লক্ষ করেছি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি, কিংবা পাকিস্তানি শাসকচক্র ধ্বংস করতে চেয়েছে আমাদের জাতিগত সংস্কৃতি, সংস্কৃতির শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছে বাংলার অবারিত লোকমানসকে—কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্র যে আমাদের সংস্কৃতির শক্তিতে ব্যর্থ হয়েছে, সে-কথা আজ ইতিহাসের সত্য।
সকল সংস্কৃতিচিন্তকই এ কথা বিশ্বাস করেন যে সদর্থক সংস্কৃতিই হচ্ছে মানবমুক্তির শ্রেষ্ঠ উপায়। সংস্কৃতি মানুষের অন্তর্গত একাকিত্বকে দূর করে, মানুষের সঙ্গে মানুষের মৈত্রীবন্ধন ঘটায়, সংস্কৃতির স্পর্শে মানুষ পবিত্র হয়। সংস্কৃতি মানুষকে মানবপ্রেমিক করে—এই-ই হচ্ছে সংস্কৃতিচিন্তকদের পরম বিশ্বাস। সংস্কৃতি বিশ্বনাগরিকতাবোধ সৃষ্টিতেও পালন করে দূরসঞ্চারী ভূমিকা। একলা-আমির বন্ধন ছিঁড়ে বহু আমির প্রাঙ্গণে যেতে মানুষকে আহ্বান করে সংস্কৃতি। এ সূত্রেই সংস্কৃতি উপনিবেশবাদের শত্রু, সাম্রাজ্যবাদের শত্রু, শত্রু ফ্যাসিবাদ কিংবা বি-মানবিক চেতনার, শত্রু সাম্প্রদায়িক চেতনার। উপনিবেশবাদ-সাম্রাজ্যবাদ-ফ্যাসিবাদ-সমরবাদ আর সাম্প্রদায়িক-ভাবনার বিরুদ্ধে বিশ্ব নাগরিকতাবোধ সম্পন্ন সংস্কৃতিই মানব প্রগতির শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার বলে মনে করেন সংস্কৃতিচিন্তকেরা।
অতীত সংস্কৃতির মূল আবেদন ছিল মিলন, এখন যা বিচ্ছিন্নতার আবাহনে মুখর। মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের মূল আবেদনটাই হারিয়ে ফেলেছে একালের সংস্কৃতি। অতীত সংস্কৃতির লোকায়ত চারিত্র্য ও গ্রামনির্ভর সজীবতা এখন শাহরিক উচ্চবিত্তের ইচ্ছা-অনিচ্ছার লীলালাস্যে বিকৃত বিধ্বস্ত ও প্রায়-নির্বাসিত। সাম্রাজ্যবাদী গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়নের সংস্কৃতিই বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার একমাত্র সংস্কৃতি। বিশ্বায়নের সংস্কৃতির রয়েছে ভয়ংকর আগ্রাসী রূপ—সে-সংস্কৃতি সাম্রাজ্যবাদের সংস্কৃতি ছাড়া অন্য কোনো সংস্কৃতিকে সহ্য করে না। বস্তুত, সকল কিছুর পণ্যায়নই বিশ্বায়ন সংস্কৃতির মূল কথা। করপোরেট পুঁজির দাপটে আমাদের লোকায়ন সংস্কৃতি এখন পণ্য-সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত। আমরা চাই, বাংলাদেশের সংস্কৃতি হোক প্রান্তজনের সংস্কৃতি, প্রতিটি নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি। কেন্দ্র আর প্রান্তের সাংস্কৃতিক ভেদ দূর করতে চাই না আমরা—আমরা চাই প্রান্তিক সংস্কৃতির উত্থান। প্রান্তিক জনসংস্কৃতি দূর করে দিক করপোরেট পুঁজিশাসিত শাহরিক সংস্কৃতি—এই-ই আমাদের কামনা।
সংস্কৃতি সম্পর্কে এই ভাবনার সঙ্গে একুশের গ্রন্থমেলার সম্পর্কের দিকে একবার চোখ ফেরানো যাক। সূচনাসূত্রেই ব্যক্ত হয়েছে যে একুশের বইমেলাকে অন্য সব বইমেলার সঙ্গে এক করে দেখার সুযোগ নেই। বাংলা একাডেমীর বইমেলার পেছনে রয়েছে বিরাট এক আদর্শ। এই আদর্শই গ্রন্থমেলাকে দিয়েছে ভিন্নতর ব্যঞ্জনা। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রেরণা এবং ভাষার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের চেতনায় ভাস্কর এই মেলা আর দশটা মেলার মতো শুধু প্রকাশক-বইক্রেতার বই বেচাকেনার মেলা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এই মেলা বইকে পণ্য হিসেবে বেচাকেনার একমাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে আয়োজিত হয় না। একুশের বইমেলা আয়োজনের অন্তঃপ্রেরণায় আছে দ্রোহ ও প্রতিবাদের ইতিহাস। আমাদের জাতীয় রাজনীতির মূল স্রোতের সঙ্গে একাত্ম এই বইমেলা। ফলে এই মেলার ধমনিতে প্রবাহিত একটি গণমুখী প্রগতিশীল জীবনচেতনার স্রোত। এই চারিত্র্যই অন্য যেকোনো মেলা থেকে একুশের গ্রন্থমেলাকে এনে দিয়েছে স্বতন্ত্র মাত্রা। মেলার এই স্বতন্ত্র মাত্রা প্রগতিশীল সংস্কৃতিচেতনা প্রসারের ক্ষেত্রে পালন করে আসছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। এই মেলার সঙ্গে সম্পর্কিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ। ফলে প্রকাশকেরা মেলা উপলক্ষে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশ করে থাকেন। স্বাধীনতার মহান আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চেতনা, একুশের অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক মূল্যচেতনা—এসব বিষয় ও অনুষঙ্গ নিয়ে সাহিত্যরচনা একুশের বইমেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। পাঠক-দর্শক-বিক্রেতা—সবাই এই মেলার প্রাঙ্গণে এসে এসব চেতনা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন।
একুশের বইমেলা উপলক্ষে যত বই প্রকাশিত হয়, সারা বছরেও তত বই প্রকাশ পায় না বলেই মনে করি। এ সময় বই বিক্রিও হয় অনেক বেশি। বইমেলা আমাদের সাংবৎসরিক কর্মকাণ্ডেরই একটা অংশ হয়ে উঠেছে। ঢাকা শহরে এই মেলা বসলেও সারা দেশেই তার উত্তাপটা ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি বিদেশিদের কাছেও এই মেলা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, অনেকে দূর থেকে এসে মেলায় উপস্থিত হচ্ছেন। এসব প্রবণতা থেকে বোঝা যায়, একুশের গ্রন্থমেলা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা, সাংস্কৃতিক জাগরণ এবং বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
বাংলা একাডেমীর বইমেলা আমাদের সাংস্কৃতিক ও জাতিগত আত্মার সঙ্গে সম্পর্কিত এক জাতীয় মেলা। এই মেলা জাতীয় সংস্কৃতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। এই মেলার রূপ-রং-চরিত্র আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক চেতনার সমার্থক। সূচনা-সূত্রে আমরা বলেছি যে আমাদের সংস্কৃতিতে ক্রমেই দেখা দিচ্ছে বিচ্ছেদ ও বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা। একুশের বইমেলা এই প্রবণতার বিরুদ্ধেও এক প্রবল প্রতিবাদ। বইমেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে যাঁরা সমবেত হন, তাঁরা কেবল বই কিনতেই আসেন না, আসেন সামাজিক যোগসূত্র রক্ষার দাবি থেকেও। লেখকদের সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় ঘটে, পরিচয় ঘটে প্রকাশকদের সঙ্গেও। বইমেলা উপলক্ষে প্রতিদিন মেলা প্রাঙ্গণে সেমিনারের আয়োজন করা হয়। এই আয়োজনও একুশের গ্রন্থমেলার স্বতন্ত্র এক বৈশিষ্ট্য। সেমিনারে যেসব বিষয় আলোচিত হয়, তাও আমাদের জাতীয় চেতনার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধে মুখর থাকে এই মেলা। আমাদের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে যে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভাব সারা বছরই লক্ষ করা যায়, একুশের বইমেলা তার বিরুদ্ধেও একটা প্রবল প্রতিবাদ। সংস্কৃতির মূল লক্ষ্য জাতীয় ভাষার বিকাশ, সংস্কৃতির মূল লক্ষ্য ঐক্য ও সমৃদ্ধি। একুশের বইমেলা এ লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
সকল বাঙালি চিন্তকই বলেছেন, জ্ঞানের সঙ্গে রয়েছে সংস্কৃতির নিবিড় সম্পর্ক। এই জ্ঞানসূত্রেই আসে শিক্ষার প্রসঙ্গ। আর জ্ঞান এবং শিক্ষা-সূত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে বই এবং বইমেলা। কিন্তু বিশ্বায়নের এই যুগ-সংক্রান্তিতে শিক্ষা, বইসহ সবকিছুই আজ পণ্যে পর্যবসিত। জ্ঞান, শিক্ষা, বই, সংস্কৃতি—সবকিছুকেই পণ্যকরণের বিরুদ্ধে একুশের গ্রন্থমেলা পালন করে আসছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক চেতনা প্রসারে পালন করে আসছে দিকনির্দেশকের দায়িত্ব। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। আমরাও মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাতে চাই না। আমরা বিশ্বাস করি, শিক্ষা ও সংস্কৃতির শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বাঙালি জাতি ইতিবাচক বোধে উপনীত হবে। সংকীর্ণকরণ আর বিচ্ছিন্নতা প্রক্রিয়ার ছোবল থেকে তারা মুক্ত করবে সংস্কৃতিকে, শিক্ষাকে মুক্ত করবে তারা পণ্যকরণ প্রক্রিয়া থেকে। সংস্কৃতির এই মুক্তির সংগ্রামে একুশের গ্রন্থমেলা হয়ে উঠুক জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার অনির্বাণ এক আলোকবর্তিকা—এই-ই আমাদের প্রত্যাশা।
বিশ্বজিৎ ঘোষ: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.