সদরে অন্দরে-'জীবন্মৃত' বাউল গায় জীবনের জয়গান by মোস্তফা হোসেইন
'সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে/লালন কয়, জাতির কী রূপ দেখলাম না এ নজরে'। এমন অসাম্প্রদায়িক এবং সর্বজনীন চেতনায় যে মানুষ ঋদ্ধ, তাঁকে দূর ছাই বলার ইচ্ছা পোষণ করতে পারে কে? যদি কেউ করে, নিশ্চিত সে কূপমণ্ডূকতার শীর্ষে। নিশ্চিতভাবে সে মানবধর্মে বিশ্বাসী নয় এবং চরমভাবে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিযুক্ত। বলতে পারি, ধর্ম মানে সে অধর্মের সব খৰ ঘুরিয়ে।
মানুষের কাছে ধর্মের বিষয় যদি হয় ভীতিকর কিছু, মানুষ যদি মানুষের কথা বলার চেয়ে ভয়ংকর কিছুর প্রতিই হয়ে পড়ে বেশি অনুরক্ত, তাহলে ধর্ম ও মানুষ কখনো একীভূত হয় না শান্তির লক্ষ্যে। তেমনি মনে করতে হবে, যদি দেখি, কোনো লালন-অনুসারী আক্রান্ত হয় ধর্মীয় বোধের নামে কিছু ব্যক্তির কাছ থেকে, তাহলে সেই ধর্ম সম্পর্ক কোনো বিতর্ক তোলার ইচ্ছা নেই মোটেও। কিন্তু যে ব্যক্তিটি মানবপ্রেমীদের কর্মযজ্ঞে বাদ সাধেন, তা-ও ঘোষণা দিয়ে, তাঁকে তো নিশ্চিতভাবেই প্রশ্ন করা যায়_ওহে, আপনি কোন ধর্মের অনুসারী, শান্তি যখন যোজন যোজন দূরে আপনা থেকে।
এমনই তো মন্তব্য করতে পারি স্পষ্টত; এবং বলতে পারি সেই লালন-অনুসারীদের কথা, যারা রাজবাড়ীতে আক্রান্ত হয়েছেন তথাকথিত শান্তিকামী কিছু মানুষের দ্বারা। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে সেই সংবাদ। সাধাসিধা জীবনযাপনকারী বাউলদের আখড়ায় যারা হামলা চালায়, তারাও মুখে শান্তির কথা বলে! এটা কিভাবে সম্ভব? ইসলাম যে শান্তির ধর্ম, ইসলাম যে বলেছে যার যার ধর্ম নিয়ে তাকে থাকতে দাও, এদের কাজে কি তা প্রমাণিত হয়? ওখানে লালনভক্তদের জবরদস্তি করে ঢোকানো হয় আল্লাহ্র ঘর মসজিদে। তওবা পড়ানো হয় কোনো মোল্লার নেতৃত্বে নিশ্চিত। তারপর চুল কেটে দেয় নির্বিঘ্নে। বোধ করি গাজী হওয়ার আহ্লাদে আহ্লাদিত হয়েছেন সেই মোল্লা এবং তাঁর অনুসারী বা সহযোগীরা। গর্হিত এই কাজটি করার আগে তারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন, এটা ধর্মীয়-সামাজিক রীতিনীতির পাশাপাশি সভ্যতারও পরিপন্থী?
সেই লালন অনুসারীদের কথা বলি, যাঁরা সুফি-ফকিরদেরই অনুসারী, বাংলার রেনেসাঁ যাঁদের কৃতিত্বের উদাহরণ। বাংলার প্রত্যন্ত পল্লীগ্রাম পর্যন্ত তাঁরাই ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। মানবধর্মের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাতে তাঁরা ঘুরে বেড়ান। এসো মিলি মানবের গান গাই_এমনই তো কথা তাঁদের, এই বাংলায় কবিগুরু যাঁদের স্মরণ করেছেন শ্রদ্ধাভরে। কবিগুরুর কুঠিবাড়ি থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরেই সাধক পুরুষের সমাধিক্ষেত্র। সেখানেও তিনি গেছেন অন্তরের টানে। শুধু তা-ই নয়, ছেউড়িয়ার সাধু পুরুষ লালনকে শিক্ষিত সমাজের সামনেও সমাদৃত করেছেন গর্ব করে। বলা হয়ে থাকে, কবিগুরু নিজেও নাকি অনুপ্রাণিত হয়েছেন লালনের গান ও দর্শন থেকে। সেই লালনের আদর্শ সন্তানরা কি গুটিকয়েক মোল্লার ধমকি-ধমকিতেই ভেঙে পড়তে পারেন? না, তাঁরা ভেঙে পড়েননি। কারণ, যুগ যুগ ধরেই তাঁরা নানা রকম অত্যাচার-নিপীড়ন সহ্য করে এসেছেন। সাম্প্রতিককালে তাঁদের আখড়ায় আগুন দেওয়ার খবরও তো পাই সংবাদপত্রের বদৌলতে। ইংরেজদের আসারও আগে লালনের ধর্ম এসেছে। প্রথম তো তাঁদের দেখা পাওয়া যায় পারস্যে, সেই অষ্টম-নবম শতকে। 'বা'আল' নামের সুফি-সাধকদের একটি দল গড়ে উঠেছিল সেখানে প্রথম। তাঁরা ছড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন দেশে। ভারতবর্ষেও এলেন একইভাবে। ভারতবর্ষে তখন বিভিন্ন নামে একই ধরনের মতবাদ প্রচলিত ছিল। তাঁরাও মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলেন মানবতার পথে, অন্যান্য সুফি-সাধকদেরই মতো। সেই তো শুরু এ দেশে। তারও অনেক পরের কথা। চৈতন্য চরিতামৃত কিংবা ইউসুফ-জুলেখার মতো মহান সৃষ্টিতেও বাউল সম্প্রদায়ের যেমত তথ্য পাওয়া যায়, তাতে ধরে নেওয়া যায়, এ দেশে তাঁরা এসেছেন পঞ্চদশ শতকে কিংবা তারও আগে। সেই মতে অনেক পরে বাংলায় জন্ম হলো এক লালনের। সিরাজ সাঁইয়ের শিষ্য কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়া গ্রামের লালন একসময় হয়ে গেলেন বাউল সম্রাট। বোধ হয়, সর্বকালেই তিনি সম্রাট পরিচয় নিয়েই থাকবেন। সম্রাট বলেই কি নিরন্তর যুদ্ধ হয়েছে যুগের পর যুগ? হ্যাঁ, যুদ্ধ কিন্তু এখনো চলছে তাঁদের বিরুদ্ধে। যুদ্ধটা আবার একতরফা। এক পক্ষ লালন আদর্শ, অন্য পক্ষ মৌলবাদী গোষ্ঠী। শুধু মুসলিম মৌলবাদীরাই নয়, অতীতে হিন্দু মৌলবাদীদেরও আক্রমণের শিকার হয়েছেন তাঁরা।
বাউলের উৎপত্তি পার্সি 'বা'আল' শব্দ থেকে_এমনটাই বলেন অনেক গবেষক। কেউ বলেন, আরবি 'আউলিয়া' শব্দ থেকেই নাকি এসেছে বাউল শব্দ। 'আউলিয়া' মানে ভক্ত কিংবা বন্ধু যদি হয়, তাহলে তাঁদের মিল খুঁজে পাওয়া যায় বাউলের সঙ্গে। সেই ভক্ত আবার নির্বিরোধ এবং অহিংস তো অবশ্যই। বাউলদের বড় একটি অংশই আবার 'জ্যান্ত মরা' বা জীবন্মৃত ভাবেন নিজেদের। যিনি নিজেকে জীবন্মৃত ভাবেন, তাঁর আবার শত্রু থাকে কী করে! আর জাগতিক লড়াই-ই বা কিসের? আর এই আদর্শ যেন দীক্ষা গ্রহণের পর থেকেই তাঁদের জন্য প্রযোজ্য। আর তা কিন্তু প্রত্যক্ষ করা যায় সর্বসময়। এই যে মাওলানা আফসারউদ্দিন আহমেদ ব্রিটিশ আমলে বাউলদের চুল কেটে দিয়েছিলেন। প্রায় শত বছর আগে রংপুরের এক মাওলানা ফতোয়া দিয়েছিলেন বাউলদের বিরুদ্ধে। যুদ্ধ ঘোষণার মতোই হয়েছিল সেই ফতোয়া। রণে লিপ্ত হয়েছিলেন সেই মাওলানার অনুসারীরা। বলেছিলেন, বাউল দেখো তো উৎখাত করো। প্রতিরোধের কী কঠিন ভাষা। কিংবা হালে রাজবাড়ীতেও যখন বাউলদের চুল-দাঁড়ি কেটে দেওয়া হলো, তখনো তাঁরা নির্বিরোধই থেকে গেছেন।
বাউলরা সংখ্যায় কত বাংলাদেশে? নিশ্চিত নই সংখ্যা সম্পর্কে। তবে তাঁদের সংখ্যা যদি হয় ১৫ হাজারের বেশি, তাহলেই বা কম কিসে? তাঁরা যদি একযোগে রাজধানীতে একটা প্রতিবাদ মিছিল করেন, তাহলে নিশ্চিত, টনক নড়বে প্রশাসনের। কিন্তু তাঁরা যে মোটেও তেমনটি করতে পারেন না। যদিও তাঁরা একত্রিত হন বছরের কোনো না কোনো সময়। অন্তত লালনের আখড়ায় তো অবশ্যই। সুতরাং তাঁদের মধ্যে ঐক্যেরও ঘাটতি নেই। কিন্তু তাঁরা ঐক্য করেন শুধুই আদর্শের জন্য; কারো বিরুদ্ধে নয়। আর এ কারণেই তাঁরা টিকে থাকবেন_যতদিন মানবতা আছে, যতদিন মানবধর্ম আছে।
mhussain_71@yahoo.com
এমনই তো মন্তব্য করতে পারি স্পষ্টত; এবং বলতে পারি সেই লালন-অনুসারীদের কথা, যারা রাজবাড়ীতে আক্রান্ত হয়েছেন তথাকথিত শান্তিকামী কিছু মানুষের দ্বারা। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে সেই সংবাদ। সাধাসিধা জীবনযাপনকারী বাউলদের আখড়ায় যারা হামলা চালায়, তারাও মুখে শান্তির কথা বলে! এটা কিভাবে সম্ভব? ইসলাম যে শান্তির ধর্ম, ইসলাম যে বলেছে যার যার ধর্ম নিয়ে তাকে থাকতে দাও, এদের কাজে কি তা প্রমাণিত হয়? ওখানে লালনভক্তদের জবরদস্তি করে ঢোকানো হয় আল্লাহ্র ঘর মসজিদে। তওবা পড়ানো হয় কোনো মোল্লার নেতৃত্বে নিশ্চিত। তারপর চুল কেটে দেয় নির্বিঘ্নে। বোধ করি গাজী হওয়ার আহ্লাদে আহ্লাদিত হয়েছেন সেই মোল্লা এবং তাঁর অনুসারী বা সহযোগীরা। গর্হিত এই কাজটি করার আগে তারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন, এটা ধর্মীয়-সামাজিক রীতিনীতির পাশাপাশি সভ্যতারও পরিপন্থী?
সেই লালন অনুসারীদের কথা বলি, যাঁরা সুফি-ফকিরদেরই অনুসারী, বাংলার রেনেসাঁ যাঁদের কৃতিত্বের উদাহরণ। বাংলার প্রত্যন্ত পল্লীগ্রাম পর্যন্ত তাঁরাই ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। মানবধর্মের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাতে তাঁরা ঘুরে বেড়ান। এসো মিলি মানবের গান গাই_এমনই তো কথা তাঁদের, এই বাংলায় কবিগুরু যাঁদের স্মরণ করেছেন শ্রদ্ধাভরে। কবিগুরুর কুঠিবাড়ি থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরেই সাধক পুরুষের সমাধিক্ষেত্র। সেখানেও তিনি গেছেন অন্তরের টানে। শুধু তা-ই নয়, ছেউড়িয়ার সাধু পুরুষ লালনকে শিক্ষিত সমাজের সামনেও সমাদৃত করেছেন গর্ব করে। বলা হয়ে থাকে, কবিগুরু নিজেও নাকি অনুপ্রাণিত হয়েছেন লালনের গান ও দর্শন থেকে। সেই লালনের আদর্শ সন্তানরা কি গুটিকয়েক মোল্লার ধমকি-ধমকিতেই ভেঙে পড়তে পারেন? না, তাঁরা ভেঙে পড়েননি। কারণ, যুগ যুগ ধরেই তাঁরা নানা রকম অত্যাচার-নিপীড়ন সহ্য করে এসেছেন। সাম্প্রতিককালে তাঁদের আখড়ায় আগুন দেওয়ার খবরও তো পাই সংবাদপত্রের বদৌলতে। ইংরেজদের আসারও আগে লালনের ধর্ম এসেছে। প্রথম তো তাঁদের দেখা পাওয়া যায় পারস্যে, সেই অষ্টম-নবম শতকে। 'বা'আল' নামের সুফি-সাধকদের একটি দল গড়ে উঠেছিল সেখানে প্রথম। তাঁরা ছড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন দেশে। ভারতবর্ষেও এলেন একইভাবে। ভারতবর্ষে তখন বিভিন্ন নামে একই ধরনের মতবাদ প্রচলিত ছিল। তাঁরাও মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলেন মানবতার পথে, অন্যান্য সুফি-সাধকদেরই মতো। সেই তো শুরু এ দেশে। তারও অনেক পরের কথা। চৈতন্য চরিতামৃত কিংবা ইউসুফ-জুলেখার মতো মহান সৃষ্টিতেও বাউল সম্প্রদায়ের যেমত তথ্য পাওয়া যায়, তাতে ধরে নেওয়া যায়, এ দেশে তাঁরা এসেছেন পঞ্চদশ শতকে কিংবা তারও আগে। সেই মতে অনেক পরে বাংলায় জন্ম হলো এক লালনের। সিরাজ সাঁইয়ের শিষ্য কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়া গ্রামের লালন একসময় হয়ে গেলেন বাউল সম্রাট। বোধ হয়, সর্বকালেই তিনি সম্রাট পরিচয় নিয়েই থাকবেন। সম্রাট বলেই কি নিরন্তর যুদ্ধ হয়েছে যুগের পর যুগ? হ্যাঁ, যুদ্ধ কিন্তু এখনো চলছে তাঁদের বিরুদ্ধে। যুদ্ধটা আবার একতরফা। এক পক্ষ লালন আদর্শ, অন্য পক্ষ মৌলবাদী গোষ্ঠী। শুধু মুসলিম মৌলবাদীরাই নয়, অতীতে হিন্দু মৌলবাদীদেরও আক্রমণের শিকার হয়েছেন তাঁরা।
বাউলের উৎপত্তি পার্সি 'বা'আল' শব্দ থেকে_এমনটাই বলেন অনেক গবেষক। কেউ বলেন, আরবি 'আউলিয়া' শব্দ থেকেই নাকি এসেছে বাউল শব্দ। 'আউলিয়া' মানে ভক্ত কিংবা বন্ধু যদি হয়, তাহলে তাঁদের মিল খুঁজে পাওয়া যায় বাউলের সঙ্গে। সেই ভক্ত আবার নির্বিরোধ এবং অহিংস তো অবশ্যই। বাউলদের বড় একটি অংশই আবার 'জ্যান্ত মরা' বা জীবন্মৃত ভাবেন নিজেদের। যিনি নিজেকে জীবন্মৃত ভাবেন, তাঁর আবার শত্রু থাকে কী করে! আর জাগতিক লড়াই-ই বা কিসের? আর এই আদর্শ যেন দীক্ষা গ্রহণের পর থেকেই তাঁদের জন্য প্রযোজ্য। আর তা কিন্তু প্রত্যক্ষ করা যায় সর্বসময়। এই যে মাওলানা আফসারউদ্দিন আহমেদ ব্রিটিশ আমলে বাউলদের চুল কেটে দিয়েছিলেন। প্রায় শত বছর আগে রংপুরের এক মাওলানা ফতোয়া দিয়েছিলেন বাউলদের বিরুদ্ধে। যুদ্ধ ঘোষণার মতোই হয়েছিল সেই ফতোয়া। রণে লিপ্ত হয়েছিলেন সেই মাওলানার অনুসারীরা। বলেছিলেন, বাউল দেখো তো উৎখাত করো। প্রতিরোধের কী কঠিন ভাষা। কিংবা হালে রাজবাড়ীতেও যখন বাউলদের চুল-দাঁড়ি কেটে দেওয়া হলো, তখনো তাঁরা নির্বিরোধই থেকে গেছেন।
বাউলরা সংখ্যায় কত বাংলাদেশে? নিশ্চিত নই সংখ্যা সম্পর্কে। তবে তাঁদের সংখ্যা যদি হয় ১৫ হাজারের বেশি, তাহলেই বা কম কিসে? তাঁরা যদি একযোগে রাজধানীতে একটা প্রতিবাদ মিছিল করেন, তাহলে নিশ্চিত, টনক নড়বে প্রশাসনের। কিন্তু তাঁরা যে মোটেও তেমনটি করতে পারেন না। যদিও তাঁরা একত্রিত হন বছরের কোনো না কোনো সময়। অন্তত লালনের আখড়ায় তো অবশ্যই। সুতরাং তাঁদের মধ্যে ঐক্যেরও ঘাটতি নেই। কিন্তু তাঁরা ঐক্য করেন শুধুই আদর্শের জন্য; কারো বিরুদ্ধে নয়। আর এ কারণেই তাঁরা টিকে থাকবেন_যতদিন মানবতা আছে, যতদিন মানবধর্ম আছে।
mhussain_71@yahoo.com
No comments