অযুক্তির দুর্গ by কবীর সুমন

আমি নিশ্চিত, এমন ঘটনা ইতিহাসে ঘটেছে; কিন্তু ২০১২ সালে আমাদেরই শহর কলকাতায় একই ঘটনা ঘটছে, আমরা তা হজম করে নিচ্ছি। এমন ঘটনা ভারতে কমই ঘটে থাকে। প্রথমত এই বিতর্কের কেন্দ্রে যে তুচ্ছ বিষয় রয়েছে, তা এমনকি একটি কার্টুনবিষয়কও নয়। এটি একটি তুচ্ছ রসাত্মক বিষয়। একটি ছোট চিত্রকর্ম। জনপ্রিয় ধারার চিত্রকর্ম।


আপনি এমন ধরনের চিত্রকর্ম রিকশা, বাস বা ট্রাকের পেছনে প্রচুর দেখতে পাবেন। যদি বাংলাদেশে যান, সেখানে দেখবেন এমন অসংখ্য চিত্রকর্ম। ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও এটা দেখতে পাওয়া যায়। যেমন- ভগত সিং মুম্বাইয়ের কিছু বিনোদনমূলক আইডলের সঙ্গে। এর মানে এ রকম নয় যে তারা ভগত সিংকে তিরস্কার করছে, অথবা ভগত সিংয়ের জন্য অবমাননাকর। এটি শুধু জনতাকে শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে আনন্দ দেওয়া, শুধুই বাস্তবতার নিরিখে অবাস্তব কল্পকথা। এটি কল্পনাকে তৈরি করে মাত্র।
আমার দিকে তাকিয়ে দেখুন। আমিও এর সম্মুখীন হয়েছি। আমি যখন ১৯৯২ সালে একটুখানি জনপ্রিয়তা অর্জন করলাম এবং কিছু মানুষ একজন গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আমাকে অনুসরণ করতে থাকল, তখন নানা ধরনের কার্টুন বের হতে থাকল। সত্যিকারের সুপরিচিত বাংলা পত্রিকাগুলো সেই কার্টুন ছাপতে থাকল। একটি প্রো-সিপিআই (এম) পত্রিকা নিয়মিত নিষ্ঠার সঙ্গে কার্টুনগুলো ছাপল। একটি দুষ্ট পত্রিকাও আমাকে খাটো করার চেষ্টা করেছে; কিন্তু সেগুলো আর যা-ই হোক, কার্টুনই। এই অন্যায় বৈষম্যের পৃথিবীতে যেখানে আমাদের ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠা প্রয়োজন, সেখানে একটি কার্টুনের মতো জিনিস একজনের গায়ের জামাটি খসিয়ে নিতে পারে না। আমাদের রসবোধ কোথায়? কেন আমরা নিজেদের দিকে তাকিয়ে নিজেরা হাসতে পারি না?
তার চেয়েও ভয়ানক যে বিষয়টি তা হলো, ওই 'আক্রমণাত্মক' কার্টুন সামনে আনার পরপরই অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। কিছু মানুষ তাঁর হাউজিং এস্টেটে প্রবেশ করে তাঁকে প্রহার করে। তাঁকে দিয়ে জোর করে স্বীকারোক্তি লিখিয়ে নেওয়া হয় এবং এই স্বীকারোক্তি আদায়ের পরই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী সুব্রত সেনগুপ্তকে। পুলিশ সেসব দুষ্কৃতকারীকে গ্রেপ্তার করেনি, যারা অধ্যাপককে আঘাত করেছে এবং ওই দুজনকে অপমান করেছে।
বিবেচনা করে দেখুন, ওই কার্টুনের মধ্যে একটিও অপমানজনক শব্দ ছিল না। অথচ ব্যঙ্গতে ক্ষিপ্ত হওয়া সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দুজন মন্ত্রী দাবি করেছেন যে পুলিশ যা করেছে, তা সঠিক। তাঁদের এ উক্তি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
অন্য আরো উদ্ধত ঘটনার সঙ্গে এই ঘটনাও সংবাদপত্র নিষেধ করা এবং মার্কসিস্ট পাঠ্যপুস্তক নিষিদ্ধ করারই শামিল। এসব কী কারণে? শুধু প্রভাব-প্রতিপত্তির জন্য। অথচ একই কর্তৃত্বপরায়ণতার বিরুদ্ধেই আমরা লড়াই করেছিলাম। মমতা ব্যানার্জি সেই কর্তৃত্বপরায়ণতার বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। কোনো সন্দেহ নেই যে তিনি সিপিআই (এম)-এর পতন ঘটিয়েছিলেন। তিনি সব সময় দাবি করেছেন গণতন্ত্রের প্রতি এবং বাকস্বাধীনতার প্রতি তাঁর আনুগত্যের কথা। তাই আমরা বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলাম। হাতে হাত মিলিয়েছিলাম এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই শুরু করেছিলাম।
কিন্তু সেটা ছিল ভিন্ন এক মমতা। সেই মমতার সঙ্গে আমি কমিউনিকেট করতে পারতাম। তিনি প্রায়ই ধৈর্য নিয়ে আমার কথা শুনতেন। যদিও তখনই আমি তাঁকে প্রচণ্ড অসহিষ্ণু দেখেছি। প্রায় আমার মতোই। তিনি কখনো কখনো শৈল্পিকও বটে। তিনি একজন খুবই ভালো পেইন্টার। আমি মমতাকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছি; আমরা ছিলাম খুবই কাছাকাছি। পরস্পরের প্রতি যথেষ্ট সম্মানবোধ ছিল। এর মানে এই নয় যে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যান, আমি সেটা চাইছি। যেমন কিছু লোক তাঁর বিদায়ের জন্য হৈচৈ শুরু করেছেন। কিন্তু তাঁর যে বর্তমান পথ, সেখান থেকে সরে আসা উচিত।
আমি এখন এমন একটি বিষয় প্রকাশ করব, যে ব্যাপারে আমি খুব কম কথাই বলেছি। এক বছরের বেশি সময় ধরে তিনি আক্ষরিক অর্থেই আমাকে ভাঁওতা দিয়ে ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হতে রাজি করিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, আমার নির্বাচনী এলাকা যাদবপুরে প্রতিটি বুথে সিআরপিএফ (সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স) সদস্যরা পাহারায় থাকবে। যদি সিআরপিএফ থাকে, তাহলে এক রকম বিষয়, আর যদি ঘরের ভেতরে সিপিআই (এম)-এর অধীন প্রহরা থাকে, তাহলে আরেক রকম বিষয়। তিনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, 'দুশ্চিন্তার কিছু নেই, কবীরদা, আপনি প্রতিটি বুথে সিআরপিএফ সদস্য পাবেন।' কিন্তু না, একজন সিআরপিএফ সদস্যও আমার নির্বাচনী এলাকার কোনো বুথে পাওয়া যায়নি। হয়তো তারা আমাকে পরাজিত দেখতে চেয়েছিল। আমি কোনো সাহায্য ছাড়াই যাদবপুরের আসনে জয়ী হয়েছি। এখনো আমি ভাবি, মমতা আমাকে যোগদানের ব্যাপারে কেন এত উৎসাহিত করেছিলেন। শুধু বিশ্বকে দেখাতে যে একজন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী, সমাজকর্মী, সাংবাদিক কবীর সুমন তাঁর অভিযাত্রার সঙ্গে রয়েছেন?

লেখক : দুই বাংলার জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার
ভারতের আউটলুক পত্রিকা থেকে ভাষান্তর : মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.