বিদায় বঙ্গীয় ব-দ্বীপ by শেখ রোকন

আলাদা রাজ্য হলো না; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের তিনটি জেলা_ দার্জিলিং, কালিম্পং ও কার্সিয়াং নিয়ে গোর্খাল্যান্ড টেরিটরিয়াল অথরিটি (জিটিএ) নামে যে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গঠিত হলো, তাতে পনেরো আনাই পাওয়া যাচ্ছে। তবে হ্যাঁ, স্বীকার করতে হবে যে নতুন ব্যবস্থায় দু'পক্ষেরই লাভ হয়েছে।


'গুর্খাল্যান্ড' রাজ্য প্রতিষ্ঠার সাপও মরেছে, আবার বাংলা নামের লাঠিও ভাঙেনি। দাবি আদায়ে একের পর এক বন্ধ-অবরোধে দার্জিলিংয়ের মূল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পর্যটন শিল্প মার খাওয়ায় দিনে দিনে ওই আন্দোলন জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিল। ফলে চরম ও দাবি থেকে বের হওয়ার 'সম্মানজনক পথ' খুঁজছিলেন পাহাড়িদের নেতা বিমল গুরুং। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ স্টাবলিশমেন্টও বুঝতে পেরেছিল যে, অন্তত স্বায়ত্তশাসন ছাড়া দার্জিলিং শান্ত হবে না। মহাকরণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিষেক দুই পক্ষের মাঝখানে বিভেদের ছোট্ট খালটিতে সেতু তৈরি করে ফেলেছে।
আসলে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন কেবল রাজনৈতিক নয়, জাতিগত। উনিশ শতকের গোড়ায় ব্রিটিশ সরকার ওই এলাকা সিকিম রাজার কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকায় কিনে নিয়েছিল। উদ্দেশ্য চা চাষাবাদ ও অবকাশযাপন। চা বাগানের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ইংরেজদের অবকাশ কর্তা, গোর্খা রেজিমেন্টের সদস্য, নিদেনপক্ষে অভিবাসী হয়ে দার্জিলিং ও ডুয়ার্স অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে নেপালিরা। দার্জিলিং এলাকার পর্যটনমূল্য বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও নানা উপলক্ষে পাহাড় ও সমতলের অধিবাসীরা দার্জিলিংয়ে ভিড় করতে থাকে।
দেশ বিভাগের পর থেকে ওই অঞ্চলকে জুড়ে দেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে। তখনই গোর্খাদের একটি অংশ চেয়েছিল পাকিস্তানে যোগ দিতে। দেশ বিভাগের টালমাটাল দিনে সে দাবি চাপা পড়তে সময় লাগেনি। ২০০৮ সালের গোড়ায় গোর্খা নেতা এবং ডিজিএইচসি (দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল) চেয়ারম্যান সুভাষ ঘিসিং ওই 'পুরান কথা' তুলে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তাদের চেয়ে বাংলাদেশের পাবর্ত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ভালো আছে। সুতরাং 'বাংলাদেশের সঙ্গে যোগ দিলেই' ভালো করত গোর্খারা। তার এ বক্তব্যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রশাসন তো বটেই, নয়াদিলি্লর নীতিনির্ধারকরাও নাখোশ হয়েছিল। উগ্র বাঙালিরা 'রাষ্ট্রদ্রোহী' সুভাষের বিচারের দাবিও তুলেছিল।
এখন, তিস্তা দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে যাওয়ার পর, গোর্খাল্যান্ড স্বায়ত্তশাসিত কর্তৃপক্ষ গঠনের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে পাহাড়ি-বাঙালির আড়াই দশকের মনোমালিন্যের অবসান হলো বলে ধরে নেওয়া যায়। কেউ কেউ নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে, একই সঙ্গে অবসান হলো বঙ্গীয় ব-দ্বীপ টার্মটিরও। আলাদা রাজ্য বা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল_ যাই হোক, বৃহত্তর দার্জিলিং আর বাংলা থেকে আলাদাই হয়ে গেল।
কাগজে-কলমে আমরা যে 'বঙ্গীয় ব-দ্বীপ' বলে থাকি, ভৌগোলিকভাবে তার তিনটি কোনা বা প্রান্ত রয়েছে। হিমালয় থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত পলল সমভূমির রেখায়িত করলে ত্রিভুজাকৃতির একটি ভূখণ্ডই রচিত হয়। কিন্তু গত ছয় দশকে হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত গ্রিক ডেল্টা বা বাংলা ব-আকৃতির সমতল ভূখণ্ডটি রাজনৈতিকভাবে এতটাই বদলে গেছে যে, এখন আর মানচিত্র দেখে এটাকে চিহ্নিত করা যায় না। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পূর্বাংশ কিংবা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ বলে পরিচিত পশ্চিমাংশ_ ঐতিহাসিক বাংলার কোনো অংশের মানচিত্রকেই এখন আর যাই হোক, ব-দ্বীপ বলা যাবে না। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মানচিত্র একত্রে দেখলেও বোঝার উপায় নেই। ব-দ্বীপের পূর্বাঞ্চলীয় কোণে সিলেট ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় যেমন বদলে গেছে; তেমনি উড়িষ্যা-পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠন প্রক্রিয়ায় হারিয়ে গেছে পশ্চিমাঞ্চলীয় কোণ। উত্তরাঞ্চলীয় যে কোণটি 'চিকেন নেক' হয়ে টিকে (বা ঝুলে) ছিল, গোর্খাল্যান্ড স্বায়ত্তশাসিত কর্তৃপক্ষ গঠনের মধ্য দিয়ে সেটাও ভোঁতা হয়ে গেল।
skrokon@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.