সলিল ভাণ্ডার-উচ্ছিষ্ট বিতরণ! by অমিত বসু
আকাশ, রেল, সড়ক থেকে নদী পরিবহনে বাংলাদেশে গুরুত্ব এখনও বেশি। পরিবহনের তিন-চতুর্থাংশ নদীপথে পরিচালিত হয়। সারা বছর নদীপথের পরিমাণ থাকে ৫,৬৩২ কিলোমিটার। বর্ষাকালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৮,০৪৫ কিলোমিটার। বাংলাদেশের ৫৪টি নদী প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে ভারতের সঙ্গে যুক্ত।
ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢোকার মুখে অধিকাংশ নদীর স্রোত শীর্ণ হচ্ছে। ভারত বাঁধ দিয়ে স্বাভাবিক
গতি আটকাচ্ছে
তেল খুঁড়তে বাঁধন ছাড়া ফল্গুধারা লিবিয়ায়। তরল সোনার পরিবর্তে প্রাণবন্ত নদী। লাভ-ক্ষতির অঙ্কে অপরিসীম বিহ্বলতা। তেলের জায়গায় বারিধারা কেন? ১৯৫৩ থেকে নিরন্তর খনন। না, তেল কোথাও নেই। খুঁড়তে খুঁড়তে লিবিয়া থেকে শাদ, মিসর, সুদান। চার দেশেই মিলল শিলীভূত বিশাল সলিল ভাণ্ডার। নাম হলো 'ন্যুবিয়ন স্যান্ডস্টোন অ্যাকুইফার।' গবেষণায় জানা গেল, এর জন্ম তুষার যুগে। তখন যা ছিল এখনও তাই। বাড়েনি, কমেনি। অবিরাম ব্যবহারেও ফুরনোর নয়। হাজার বছর নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে চারটি দেশ। তেষ্টায় কষ্ট পেতে হবে না। এই ভূখণ্ডের বাইরেও আফ্রিকার একটা বড় অংশকে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলও রাখা যাবে।
লিবিয়ার নিহত নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি ১৯৮৩তে বিস্তৃত নদী প্রকল্প শুরু করেন। কুফ্রা, সিরতে, মরজুক, হামাদা আর এই ন্যুবিয়ন স্যান্ডস্টোন অ্যাকুইফারের সঞ্চিত নীর সরবরাহ শুরু করেন লিবিয়ার তটবর্তী শহরগুলোতে। প্রায় তিন হাজার কোটি ডলার খরচ করে ৫০০ মিটার নিচ থেকে হারানো অপপ্রবাহ পাইপলাইনে তুলে এনে পাঁচ হাজার কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। চমকে ওঠে ইউরোপ। কোনো দেশের গোপন ভূগর্ভে যে এমন নদী থাকতে পারে কল্পনাও করেনি। আমেরিকা চমকাল, আবার চটল। লিবিয়া তেল বেচার টাকায় এমন উদক সম্পদের মালিক হলে তো বিপদ। তাদের ওপর নির্ভরতা কমবে। ক্যালিফোর্নিয়ার মতো মরু অঞ্চলে সেচের ব্যবস্থা করে খাদ্য ও তুলা উৎপাদনে আমেরিকার যেমন সাফল্য এসেছে, লিবিয়াও কি সে রকম কিছু করতে চাইছে? ইউরোপের সুপার মার্কেটে ইসরায়েল, মিসর যেভাবে খাবার জোগান দিচ্ছে, লিবিয়াও সেই সুযোগ নেবে তাহলে।
আমেরিক এতদিন লিবিয়ার তেলকে ভয় পাচ্ছিল। এবার তাদের সলিল সম্পদ শঙ্কার কারণ হলো। আমেরিকার মিডিয়া লিবিয়াকে আক্রমণ শুরু করল। গল্পের গরুকে টেনে গাছে তুলল। ১৯৯৭-এর ২ ডিসেম্বর 'নিউইয়র্ক টাইমস' মন্তব্য করল, 'লিবিয়ার রহস্যজনক পাইপলাইন সেনা পরিবহনের জন্য নির্মিত। মিসর থেকে তিউনিসিয়াজুড়ে এই সুড়ঙ্গ দিয়ে সেনা, জৈব অস্ত্র, সামরিক সামগ্রী সরবরাহ করা হবে।' তথ্য সংগ্রাহক সাংবাদিক রেমন্ড বলার গর্বের সঙ্গে জানালেন, পাইপ নির্মাণের ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি তিনি জানতে পেরেছেন। এই সংবাদ পরিবেশনের পরিণতি হয়েছিল ভয়ঙ্কর। ন্যাটো সেই পাইপলাইনের ওপর বোমাবর্ষণ করেছিল।
বিশ্ব বিতর্কের জ্যান্ত উদাহরণ উদক। অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ স্থাণু। যেমন আফ্রিকার হীরে খনিকে নড়ানো যায় না। বারিধারা কিন্তু বেগবান। এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছুটে যায় পাসপোর্ট-ভিসার তোয়াক্কা না করে। এক নদীর মালিক একাধিক। যারা উজানে থাকে, নিঃশেষে শুষে নেয় নদী। নিচে থাকা দেশ পায় সলিল-কঙ্কাল। সমান ভাগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল, জাতিপুঞ্জের জেনেভা চুক্তিতে। ভারত সেই চুক্তিতে স্বাক্ষরও করেছিল। তবু মানছে না। মানতে গিয়ে রাজনীতির জালে আটকাচ্ছে। নদী চুক্তির কথা উঠলেই বলা হচ্ছে, দেব কী করে? যা আছে তাতে আমাদেরই চলে না। কথনে অসৌজন্যের চূড়ান্ত প্রকাশ। কোনো দেশ এ কথা বলতে পারে না। যা আছে সমানভাবে ভাগ করে নেওয়াটাই মৈত্রীর রীতি। খাবার সময় ঘরে বন্ধু এলে কী বলব, দাঁড়াও ভাই আগে খেয়ে আমার পেট ভরুক, এরপর উচ্ছিষ্ট থাকলে তোমায় দেব।
জাতিপুঞ্জের সমস্যা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির চাপে তারা পেরে ওঠে না। নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়। শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অক্ষম। যে দেশের যত ক্ষমতা তেল ও নদীর ওপর তাদের তত নিয়ন্ত্রণ। নদী ভাবনা সব দেশেই। না ভেবে উপায় নেই। মানুষের মরা-বাঁচা যে তার ওপর। দরিয়া শীর্ণ হলে দেশ দুর্বল মরুদেশে যতই তেল থাক, একবিন্দু বারির জন্য কী হাহাকার। পৃথিবীর মাত্র একাংশ স্থল, তিন ভাগ সলিল। বিশাল সমুদ্রের এক ফোঁটাও তেষ্টা মেটানোর জন্য নয়। গাছপালাও তা গ্রহণে অপারগ। পান করলেই নোনা ধরবে, মরবে। সাগরের ঢেউ চাষের জমিতে আছড়ে পড়লে সর্বনাশ। লবণাক্তকে মিষ্টিতে রূপান্তরিত করা যায় ঠিকই, কিন্তু সেটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাছাড়া সমুদ্রের স্যালাইন ওয়াটারও জরুরি। প্রাকৃতিক পরিবেশকে শুদ্ধ রাখতে দরকারি।
নদী কিন্তু মিষ্টি। তার সঙ্গী খাল-বিল। নদী যদি দুর্বল হয় সাগরের পোয়াবারো। বিপুল বেগে নদীতে ঢুকে নদীতে লবণ মিশিয়ে দেয়। মরণের ছায়া পড়ে সবুজ বনানীতে। বাংলাদেশের সুন্দরবন বিপন্ন সে কারণেই। হেঁতাল, গরানের জঙ্গল লুপ্তপ্রায়। অতীতের আরণ্যক সৌন্দর্য উধাও। হাড় জিরজিরে চেহারায় অত্যাচারের চিহ্ন।
নদীর গুরুত্বের আরও দুটি দিক আছে। এক. বিদ্যুৎ উৎপাদনে; দুই. পরিবহন। বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে নদী যথেষ্ট সাহায্য করতে পারে। বাংলাদেশ সেই সুযোগ পাচ্ছে না। উদ্দাম বেগ ছাড়া বিদ্যুৎ হয় না। বাংলাদেশের নদী অনেক দুর্বল। তেজ কম। ভারত উজানে থাকায় বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারছে। বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। আলোচনায় ঠিক হয়েছে, ভারত নদী-বিদ্যুতের ভাগ দেবে বাংলাদেশকে। কোন প্রকল্প থেকে কতটা পাবে ঠিক হয়নি। কয়েকটি বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে অর্ধেক দেওয়ার কথা হয়েছে। সেটা কার্যকর হলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সমস্যার অনেকটা সুরাহা হবে।
আকাশ, রেল, সড়ক থেকে নদী পরিবহনে বাংলাদেশে গুরুত্ব এখনও বেশি। পরিবহনের তিন-চতুর্থাংশ নদীপথে পরিচালিত হয়। সারা বছর নদীপথের পরিমাণ থাকে ৫,৬৩২ কিলোমিটার। বর্ষাকালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৮,০৪৫ কিলোমিটার। বাংলাদেশের ৫৪টি নদী প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে ভারতের সঙ্গে যুক্ত। ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢোকার মুখে অধিকাংশ নদীর স্রোত শীর্ণ হচ্ছে। ভারত বাঁধ দিয়ে স্বাভাবিক গতি আটকাচ্ছে।
ভারত সমস্যা বুঝেই ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সুষম নদী বণ্টনের প্রস্তাব দিয়ে রাখতে পারছেন না। কারণ তার একার ইচ্ছার কোনো দাম নেই। তাকে মানতে হচ্ছে সরকারের অন্য শরিকদের কথা। না মানলে সরকার পড়বে। রাজনৈতিক সংকট দেখা দেবে। মনমোহন এখন পাখির চোখে তাকিয়ে আছেন জুনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দিকে। জুলাইতে বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিলের মেয়াদ ফুরাচ্ছে। মনমোহনের কংগ্রেস একা কোনো প্রার্থীকে জেতাতে পারবে না। দরকার শরিকি সমর্থন। বিরোধী দল বিজেপির সাহায্য পেতেও তিনি অধীর। সর্বজনগ্রাহ্য প্রার্থীর খোঁজ চলছে। পাওয়া দুষ্কর। তবুও চেষ্টার কসুর নেই। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হওয়ার পর বাংলাদেশের সঙ্গে যেভাবেই হোক তিস্তা চুক্তিটা সেরে ফেলতে তিনি আগ্রহী। অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি সেই বার্তা পেঁৗছে দিতেই মে মাসে ঢাকা সফর করবেন।
অমিত বসু :ভারতীয় সাংবাদিক
No comments