খোলা চোখে-মিসরের মতো ঘটনা বাংলাদেশেও ঘটতে পারে? by হাসান ফেরদৌস
খবরটি নিশ্চয় আপনাদের চোখে পড়েছে। বাংলাদেশের বিরোধী দলের নেত্রী মন্তব্য করেছেন, মিসরের মতো ঘটনা বাংলাদেশেও ঘটতে পারে। অর্থাত্ গণ-অভ্যুত্থানের রুদ্ররোষে সরকারের পতন, অতঃপর তল্পিতল্পাসহ সরকারপ্রধানের পলায়ন।
কবে, কখন ও কীভাবে এ ঘটনা ঘটবে, সেসবের কোনো ব্যাখ্যা অবশ্য বিরোধী দলের নেত্রীর বক্তব্যে নেই। যে পত্রিকায় খবরটি পড়লাম, তাতে কলাম দুয়েক নিচে আরও একটি খবর রয়েছে। তাঁর দলের কোনো কোনো সদস্য আবদার ধরেছেন, নেত্রীর কনিষ্ঠ ছেলে আরাফাত রহমান কোকো এখনো দলের কোনো দায়িত্ব পাননি। জিয়াউর রহমানের ছেলে অথচ দলের দায়িত্ব নেই, এ কেমন কথা? অতএব, তাঁরা প্রস্তাব রেখেছেন, কোকো রহমানকে দলের অন্যতম ভাইস প্রেসিডেন্ট করা হোক। এই দুই খবরে আপাত কোনো যোগসূত্র নেই, আবার আছেও। সে কথায় পরে আসছি।
মিসরে যে অভাবনীয় গণ-অভ্যুত্থান ঘটে গেল, বাংলাদেশে ঠিক সেই রকম একটি ঘটনা কিন্তু অনেক আগেই ঘটে গেছে। অনেক আগে মানে, ঠিক ২১ বছর আগে, ১৯৯০ সালে। মোবারকের মতো তিন দশক ধরে না হলেও প্রায় এক দশক ক্ষমতা আঁকড়ে ছিলেন একজন সামরিক একনায়ক। তিনি রাজনীতিকদের জেলে পুরেছেন, তাঁর আমলে বিরোধী দলের মিছিলে ট্রাক তুলে দেওয়া হয়েছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের লোকেরা খুন হয়েছেন, কেউ কেউ গুম হয়েছেন। নিজের শাসন বৈধ করতে নানা ছল-ছুতো তিনিও করেছিলেন। নির্বাচন হয়েছিল, নিজের বাছাই করা লোক নিয়ে রাজনৈতিক দলও গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো কিছুতেই তিনি মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেননি, শরীর থেকে স্বৈরশাসকের দুর্গন্ধও মুছে ফেলতে পারেননি। মিসরের মতো আমাদেরও নব্বইয়ের সেই গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিলেন শহুরে যুবক শ্রেণী, ছাত্র, চাকরিজীবী ও বেকার। তাঁদের অগ্রগামী ভূমিকা মেনেই পেশাদার রাজনীতিকেরা সে আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন। তখন আমাদের হয়তো গুগলের সেই তরুণ এক্সিকিউটিভ আইল ঘানিম ছিলেন না, যাঁর ফেসবুকের বার্তা পড়ে তরুণেরা দল বেঁধে কায়রোর তাহরির স্কয়ারে জমায়েত হয়েছিল। কিন্তু আমাদের ছিলেন নূর হোসেন। আরও এক জায়গায় বাংলাদেশের ঘটনার সঙ্গে মিসরের অভ্যুত্থানের মিল রয়েছে। শেষ পর্যন্ত মোবারক যে বাক্সপেটরা নিয়ে লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য হলেন, তার কারণ সেনাবাহিনীর অনাস্থা। ৩০ বছর একই ছাতার নিচে ভালো-মন্দ তাঁরা মিলমিশ করে খেয়েছেন। কিন্তু যে মুহূর্তে বোঝা গেল, মোবারক তাদের জন্য ‘লায়্যাবিলিটি’ হয়ে উঠেছেন, তাঁকে ছুড়ে ফেলে দিল সেনা নেতৃত্ব। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল বাংলাদেশে জেনারেল এরশাদের বেলায়।
মিসরীয় ধাঁচের আরেকটি অভ্যুত্থান বাংলাদেশে ঘটার সম্ভাবনা যে নেই, তা নয়, তবে এ মুহূর্তে তা ঘটার কোনো কারণ নেই। মিসরের মানুষের দাবি, নিজেদের পছন্দমতো সরকার গঠনের অধিকার। বাংলাদেশের মানুষ অনেক রক্ত দিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নিজের পছন্দমতো রাজনৈতিক সরকার নির্বাচনের সে অধিকার অর্জন করেছে। ২১ বছর আগের সেই গণ-অভ্যুত্থানের কারণেই পরপর চারটি নির্বাচন হয়েছে বাংলাদেশে, কম-বেশি স্বচ্ছ ও সুষ্ঠুভাবে। এই দুই দশকে কোনো দল একটানা পাঁচ বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। জনগণের রায় মেনে নিয়ে তাদের সরে যেতে হয়েছে। নির্বাচনের ফল তাদের পছন্দ না হতে পারে, ক্ষমতা ছেড়ে যেতেও হয়তো তাদের মন চায়নি, কিন্তু ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে ব্যালটের মাধ্যমে যে পরিবর্তন আনা যায়, বাংলাদেশের মানুষের মনে সেই আস্থা এসেছে। এ অবস্থাকে আমরা বলতে পারি গণতান্ত্রিক স্থিতাবস্থা। এই স্থিতাবস্থা যে দেশে প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা অর্জন করে, সেখানে মিসরীয় কায়দায় অভ্যুত্থানের প্রয়োজন পড়ে না। মিসরের সঙ্গে আমাদের আরও এক জায়গায় পার্থক্য রয়েছে। মিসরের ঘটনাবলি যাঁরা অনুসরণ করেছেন, তাঁরা জানেন, বিক্ষোভকারীদের একটি প্রধান দাবি হলো, দেশের জন্য একটি গণতান্ত্রিক ও আধুনিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন। বিক্ষোভকারীদের বিশ্বাস, এই শাসনতন্ত্র হবে সেই রক্ষাকবচ, যার ফলে রোখা যাবে কোনো একনায়কের উত্থান। মোবারকের পতনের পর মিসরে সেই কাজ শুরু হয়েছে, যদিও খুব সততার সঙ্গে সেনাকর্তারা সেই কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে মনে না করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের সেই সমস্যা নেই। স্বাধীনতার পর পর যে শাসনতন্ত্র আমরা প্রণয়ন করি, অনেকের চোখে তা পৃথিবীর একটি সেরা শাসনতন্ত্র। কিছু কাটাছেঁড়া হয়েছে, কোনো কোনো সংশোধনী সংযুক্ত হয়েছে, কিন্তু সেই শাসনতন্ত্রের মোদ্দা কাঠামো এখনো অক্ষত। নিজেদের এই অর্জন নিয়ে গর্ব বোধ করার অধিকার আমরা অর্জন করেছি। মধ্যপ্রাচ্য ও বাকি আরব বিশ্বের মানুষ এখন সেই অধিকারের জন্যই লড়াইয়ে নেমেছে।
মিসরে, শুধু মিসরে কেন, পুরো আরব বিশ্বেই—চলতি রাজনৈতিক সংকটের প্রধান কারণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে নাগরিকদের অক্ষমতা। অস্ত্রের জোরে, শ্যাম চাচার ওকালতিতে, মধ্যযুগীয় নির্যাতনের মাধ্যমে এসব দেশে বছরের পর বছর মানুষের মুখ আটকে রাখা হয়েছে। দু-দশ বছর নয়, যুগ যুগ ধরে একই লোক রাজত্ব করে যাচ্ছে। নিজের সময় ফুরালে নিজের ছেলেকে বসাচ্ছে সে আসনে। রাষ্ট্র যেন মৌরসিপাট্টা নেওয়া পৈতৃক সম্পত্তি। মোবারক ক্ষমতায় ছিলেন প্রায় ৩০ বছর, তালে ছিলেন আগামী নির্বাচনে নিজে না দাঁড়িয়ে এক ছেলেকে সে জায়গায় মনোনয়ন দেবেন। এ রকম তুঘলকি কাণ্ড হতো পাঁচ হাজার বছর আগে ফারাওদের সময়, এক ফারাও মারা গেলে তাঁর জায়গায় আসন নিতেন তাঁর ছেলে বা মেয়ে। কিন্তু মজার কথা হলো, একটানা ৩০ বছর রাজত্ব করেছেন এমন ফারাও সম্ভবত একজনও নেই। মিসরের আশপাশের দেশগুলোর অবস্থা তথৈবচ। ইয়েমেনে আলী আবদুল্লাহ সালেহ ক্ষমতা আঁকড়ে আছেন ২৮ বছর। তাঁরও পরিকল্পনা নিজের পর অপোগণ্ড এক ছেলেকে সিংহাসনে বসাবেন। এঁদের তুলনায় তিউনিসিয়ার বেন আলী ক্ষমতায় ছিলেন কিঞ্চিত কম সময়, তাও প্রায় ২০ বছর। তিনিও অপেক্ষায় ছিলেন, অবসর গ্রহণের পর নিজের চেয়ারে স্ত্রী লায়লাকে বসাবেন। সময়ের দিক থেকে কম হলে কী হবে, এরই মধ্যে বেন আলী পরিবার তিউনিসিয়ার মোট সম্পদের সিংহভাগ নিজেদের পকেটস্থ করে ফেলে। এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে বেন আলী ও তাঁর স্ত্রীর পরিবারের ব্যবসায়িক স্বার্থ কোনো না কোনোভাবে জড়িত নয়। শুনেছি, বেন আলীর স্ত্রী দেশ ছেড়ে পালানোর আগে ট্রাঙ্কে করে দেড় টন সোনা নিয়ে গেছেন, যার মূল্য কম করে হলেও ৬০ মিলিয়ন ডলার। রাজত্বের দৈর্ঘ্যে অবশ্য সবাইকে টেক্কা দিয়েছেন লিবিয়ার ব্রাদার গাদ্দাফি, তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে আছেন ৪১ বছর। নিজে টেঁশে গেলে তাঁর চেয়ারটি দখলের জন্য তৈরি একজন নয়, তাঁর দু-দুজন ছেলে। এঁদের একজন আবার গেল বছর নববর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে সুরার নহর বইয়ে দিয়েছিলেন। শোনা যায়, ক্যারিবীয় দ্বীপ সেন্ট বার্টসে তাঁর নববর্ষের পার্টিতে তিনটি গান গাওয়ার জন্য পপ তারকা বিয়ঁসে নাকি ২০ লাখ ডলার কামিয়েছেন। বলাবাহুল্য, সে টাকা এসেছে লিবিয়ার নিজস্ব টাঁকশাল থেকে। নিজের যোগ্যতায় ১০ টাকা কামাবেন, সে মুরোদ যে গাদ্দাফিপুত্রের নেই, তা বলাই বাহুল্য।
ক্ষমতার এই অপব্যবহার, রাষ্ট্রের সম্পদের এই যে অপচয়, মধ্যযুগে তা ঘটত লাঠির জোরে। একুশ শতকে এসেও যদি সেই একই কাণ্ড হয়, তা হলে তেমন দেশকে সভ্য বলি কী করে? দেশগুলোর কোনোটিই কিন্তু সম্পদের দিক দিয়ে খুব গরিব নয়, কিন্তু তার পরও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ অভাবী, কর্মহীন ও নিরক্ষর। দিনের পর দিন তাদের যে অপমান ও অমর্যাদার ভেতর দিয়ে যেতে হয়, মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ তারই প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে। অন্য কথায়, আজ আরব বিশ্বে গণতন্ত্রের জন্য যে আন্দোলন দেখছি, তা আসলে সেসব দেশের মানুষের আত্মমর্যাদার জন্য লড়াই। অধিকারহীন মানুষ দিনের পর দিন স্বৈরাচার মেনে নিয়েছে, ভেবেছে, এটাই তাদের নিয়তি। কিন্তু তা মানতে রাজি নয় দেশের তরুণ প্রজন্ম। অধিকাংশ আরব দেশেই ৩০ অনূর্ধ্ব বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি। মিসর ও ইয়েমেনে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। তাদের মা-বাবা এক সময় বিনা প্রতিবাদে দমন ও নির্যাতন মেনে নিয়েছেন, কিন্তু এরা তা আর মানতে রাজি নয়। মিসরের অভ্যুত্থান শুরু সে রকম এক প্রতিবাদ থেকেই। আলেকজান্দ্রিয়া শহরে খালেদ সায়িদ নামের এক যুবক ইন্টারনেটে তাঁর ব্যক্তিগত ব্লগে একটি ভিডিও ফিল্ম সংযুক্ত করেছিলেন। সে ফিল্মের বিষয়, মিসরীয় পুলিশ কীভাবে মাদক চোরাচালানিদের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করে, তাদের সঙ্গে আঁতাত করে লাভের টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়। সে কথা জানতে পেরে শহরের এক সাইবার ক্যাফে থেকে পুলিশ দিনদুপুরে খালেদকে টেনে এনে গুলি করে হত্যা করে। তারপর সেই লাশ সেখানে ফেলে রেখে চলে যায়। পুলিশ শাসিয়ে গিয়েছিল, কেউ এ নিয়ে টুঁ-শব্দ করলে খালেদের মতো অবস্থা হবে। সেই খালেদের হত্যা যাতে কেউ ভুলে না যায়, সে লক্ষ্যে আইল ঘানিম ‘আমরা সবাই খালেদ সায়িদ’ এই নামে ফেসবুক পাতা চালু করে। এর পরের ইতিহাস তো সবারই জানা।
বাংলাদেশে নির্যাতনের সেই কালো অধ্যায় আমরা কাটিয়ে এসেছি, সে কথা আমি বিশ্বাস করি। মিসর বা ইয়েমেনের তুলনায় আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামো অধিক পোক্ত, তা নিয়েও কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তাই বলে আমরা আনন্দে বগল বাজাব, সেটাও কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আমাদের শাসনতন্ত্র আছে ঠিকই, কিন্তু সব সময় সে শাসনতন্ত্র কি মেনে চলা হয়? পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনের সুযোগ আমাদের আছে, কিন্তু গায়ের জোরে অথবা টাকার দাপটে সে নির্বাচনের ফলাফল উল্টে যাবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? দুর্নীতি এখনো ব্যাপক, স্বজনপ্রীতি, দলবাজি এসবও আছে। গণতন্ত্র মানে তো কেবল নির্ধারিত সময়ান্তর নির্বাচন নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নাগরিকের পূর্ণ অংশগ্রহণ। নাগরিক সব সময় ব্যক্তিগতভাবে এই প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় না, তা সম্ভবও নয়। কিন্তু সুশীল সমাজের মাধ্যমে নিজের মতামত সে প্রকাশ করতে পারে, কোনো সিদ্ধান্তের পক্ষে বা বিপক্ষে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি তার পক্ষে সম্ভব। যে দেশে এই সুশীল সমাজ যত সবল, তার গণতান্ত্রিক সম্ভাবনা তত বেশি। আমাদের দেশে সুশীল সমাজ এখনো দুর্বল, তাদের মধ্যে লেজুড়বৃত্তির প্রবণতাও পুরোনো কাঁথার মতো লেপ্টে আছে। তবে আমাদের জন্য একটা ভালো খবর, সরকার বা দলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে স্বাধীন বা কম-নির্ভরশীল এমন তথ্য-ব্যবস্থা গড়ে উঠছে। সরকারের ভেতর দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার তুলে ধরতে এরা আগের চেয়ে অনেক বেশি তত্পর। কার্যকর ও জনসমর্থিত সুশীল সমাজ পাশে থাকলে এই তথ্য-ব্যবস্থা আরও বেগবান হতে পারে।
কিন্তু এক জায়গায় আমাদের সঙ্গে অনেক আরব দেশের মিল রয়েই যাচ্ছে। জমিদারি প্রথা আমরা দূর করেছি বটে, কিন্তু রাজনীতিতে জমিদারির স্থায়ী বন্দোবস্ত যেন জগদ্দল পাথরের মতো বসে আছে। বাংলাদেশের বয়স এখন ৪০। এই ৪০ বছরে আমাদের রাজনীতির কেন্দ্রে থেকে গেছে দুটি পরিবার। ১৬ কোটি মানুষের দেশ অথচ নেতা-নেত্রী হাতে গোনা দু-চারজন? বুঝলাম নেত্রীর ছেলে, তাই বলে কোকো?
আমার মনে হয়, মিসরীয় কায়দায় উত্থান যদি হয়, তো তা হবে এই পরিবারতন্ত্র ঠেকাতে।
মিসরে যে অভাবনীয় গণ-অভ্যুত্থান ঘটে গেল, বাংলাদেশে ঠিক সেই রকম একটি ঘটনা কিন্তু অনেক আগেই ঘটে গেছে। অনেক আগে মানে, ঠিক ২১ বছর আগে, ১৯৯০ সালে। মোবারকের মতো তিন দশক ধরে না হলেও প্রায় এক দশক ক্ষমতা আঁকড়ে ছিলেন একজন সামরিক একনায়ক। তিনি রাজনীতিকদের জেলে পুরেছেন, তাঁর আমলে বিরোধী দলের মিছিলে ট্রাক তুলে দেওয়া হয়েছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের লোকেরা খুন হয়েছেন, কেউ কেউ গুম হয়েছেন। নিজের শাসন বৈধ করতে নানা ছল-ছুতো তিনিও করেছিলেন। নির্বাচন হয়েছিল, নিজের বাছাই করা লোক নিয়ে রাজনৈতিক দলও গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো কিছুতেই তিনি মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেননি, শরীর থেকে স্বৈরশাসকের দুর্গন্ধও মুছে ফেলতে পারেননি। মিসরের মতো আমাদেরও নব্বইয়ের সেই গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিলেন শহুরে যুবক শ্রেণী, ছাত্র, চাকরিজীবী ও বেকার। তাঁদের অগ্রগামী ভূমিকা মেনেই পেশাদার রাজনীতিকেরা সে আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন। তখন আমাদের হয়তো গুগলের সেই তরুণ এক্সিকিউটিভ আইল ঘানিম ছিলেন না, যাঁর ফেসবুকের বার্তা পড়ে তরুণেরা দল বেঁধে কায়রোর তাহরির স্কয়ারে জমায়েত হয়েছিল। কিন্তু আমাদের ছিলেন নূর হোসেন। আরও এক জায়গায় বাংলাদেশের ঘটনার সঙ্গে মিসরের অভ্যুত্থানের মিল রয়েছে। শেষ পর্যন্ত মোবারক যে বাক্সপেটরা নিয়ে লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য হলেন, তার কারণ সেনাবাহিনীর অনাস্থা। ৩০ বছর একই ছাতার নিচে ভালো-মন্দ তাঁরা মিলমিশ করে খেয়েছেন। কিন্তু যে মুহূর্তে বোঝা গেল, মোবারক তাদের জন্য ‘লায়্যাবিলিটি’ হয়ে উঠেছেন, তাঁকে ছুড়ে ফেলে দিল সেনা নেতৃত্ব। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল বাংলাদেশে জেনারেল এরশাদের বেলায়।
মিসরীয় ধাঁচের আরেকটি অভ্যুত্থান বাংলাদেশে ঘটার সম্ভাবনা যে নেই, তা নয়, তবে এ মুহূর্তে তা ঘটার কোনো কারণ নেই। মিসরের মানুষের দাবি, নিজেদের পছন্দমতো সরকার গঠনের অধিকার। বাংলাদেশের মানুষ অনেক রক্ত দিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নিজের পছন্দমতো রাজনৈতিক সরকার নির্বাচনের সে অধিকার অর্জন করেছে। ২১ বছর আগের সেই গণ-অভ্যুত্থানের কারণেই পরপর চারটি নির্বাচন হয়েছে বাংলাদেশে, কম-বেশি স্বচ্ছ ও সুষ্ঠুভাবে। এই দুই দশকে কোনো দল একটানা পাঁচ বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। জনগণের রায় মেনে নিয়ে তাদের সরে যেতে হয়েছে। নির্বাচনের ফল তাদের পছন্দ না হতে পারে, ক্ষমতা ছেড়ে যেতেও হয়তো তাদের মন চায়নি, কিন্তু ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে ব্যালটের মাধ্যমে যে পরিবর্তন আনা যায়, বাংলাদেশের মানুষের মনে সেই আস্থা এসেছে। এ অবস্থাকে আমরা বলতে পারি গণতান্ত্রিক স্থিতাবস্থা। এই স্থিতাবস্থা যে দেশে প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা অর্জন করে, সেখানে মিসরীয় কায়দায় অভ্যুত্থানের প্রয়োজন পড়ে না। মিসরের সঙ্গে আমাদের আরও এক জায়গায় পার্থক্য রয়েছে। মিসরের ঘটনাবলি যাঁরা অনুসরণ করেছেন, তাঁরা জানেন, বিক্ষোভকারীদের একটি প্রধান দাবি হলো, দেশের জন্য একটি গণতান্ত্রিক ও আধুনিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন। বিক্ষোভকারীদের বিশ্বাস, এই শাসনতন্ত্র হবে সেই রক্ষাকবচ, যার ফলে রোখা যাবে কোনো একনায়কের উত্থান। মোবারকের পতনের পর মিসরে সেই কাজ শুরু হয়েছে, যদিও খুব সততার সঙ্গে সেনাকর্তারা সেই কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে মনে না করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের সেই সমস্যা নেই। স্বাধীনতার পর পর যে শাসনতন্ত্র আমরা প্রণয়ন করি, অনেকের চোখে তা পৃথিবীর একটি সেরা শাসনতন্ত্র। কিছু কাটাছেঁড়া হয়েছে, কোনো কোনো সংশোধনী সংযুক্ত হয়েছে, কিন্তু সেই শাসনতন্ত্রের মোদ্দা কাঠামো এখনো অক্ষত। নিজেদের এই অর্জন নিয়ে গর্ব বোধ করার অধিকার আমরা অর্জন করেছি। মধ্যপ্রাচ্য ও বাকি আরব বিশ্বের মানুষ এখন সেই অধিকারের জন্যই লড়াইয়ে নেমেছে।
মিসরে, শুধু মিসরে কেন, পুরো আরব বিশ্বেই—চলতি রাজনৈতিক সংকটের প্রধান কারণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে নাগরিকদের অক্ষমতা। অস্ত্রের জোরে, শ্যাম চাচার ওকালতিতে, মধ্যযুগীয় নির্যাতনের মাধ্যমে এসব দেশে বছরের পর বছর মানুষের মুখ আটকে রাখা হয়েছে। দু-দশ বছর নয়, যুগ যুগ ধরে একই লোক রাজত্ব করে যাচ্ছে। নিজের সময় ফুরালে নিজের ছেলেকে বসাচ্ছে সে আসনে। রাষ্ট্র যেন মৌরসিপাট্টা নেওয়া পৈতৃক সম্পত্তি। মোবারক ক্ষমতায় ছিলেন প্রায় ৩০ বছর, তালে ছিলেন আগামী নির্বাচনে নিজে না দাঁড়িয়ে এক ছেলেকে সে জায়গায় মনোনয়ন দেবেন। এ রকম তুঘলকি কাণ্ড হতো পাঁচ হাজার বছর আগে ফারাওদের সময়, এক ফারাও মারা গেলে তাঁর জায়গায় আসন নিতেন তাঁর ছেলে বা মেয়ে। কিন্তু মজার কথা হলো, একটানা ৩০ বছর রাজত্ব করেছেন এমন ফারাও সম্ভবত একজনও নেই। মিসরের আশপাশের দেশগুলোর অবস্থা তথৈবচ। ইয়েমেনে আলী আবদুল্লাহ সালেহ ক্ষমতা আঁকড়ে আছেন ২৮ বছর। তাঁরও পরিকল্পনা নিজের পর অপোগণ্ড এক ছেলেকে সিংহাসনে বসাবেন। এঁদের তুলনায় তিউনিসিয়ার বেন আলী ক্ষমতায় ছিলেন কিঞ্চিত কম সময়, তাও প্রায় ২০ বছর। তিনিও অপেক্ষায় ছিলেন, অবসর গ্রহণের পর নিজের চেয়ারে স্ত্রী লায়লাকে বসাবেন। সময়ের দিক থেকে কম হলে কী হবে, এরই মধ্যে বেন আলী পরিবার তিউনিসিয়ার মোট সম্পদের সিংহভাগ নিজেদের পকেটস্থ করে ফেলে। এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে বেন আলী ও তাঁর স্ত্রীর পরিবারের ব্যবসায়িক স্বার্থ কোনো না কোনোভাবে জড়িত নয়। শুনেছি, বেন আলীর স্ত্রী দেশ ছেড়ে পালানোর আগে ট্রাঙ্কে করে দেড় টন সোনা নিয়ে গেছেন, যার মূল্য কম করে হলেও ৬০ মিলিয়ন ডলার। রাজত্বের দৈর্ঘ্যে অবশ্য সবাইকে টেক্কা দিয়েছেন লিবিয়ার ব্রাদার গাদ্দাফি, তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে আছেন ৪১ বছর। নিজে টেঁশে গেলে তাঁর চেয়ারটি দখলের জন্য তৈরি একজন নয়, তাঁর দু-দুজন ছেলে। এঁদের একজন আবার গেল বছর নববর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে সুরার নহর বইয়ে দিয়েছিলেন। শোনা যায়, ক্যারিবীয় দ্বীপ সেন্ট বার্টসে তাঁর নববর্ষের পার্টিতে তিনটি গান গাওয়ার জন্য পপ তারকা বিয়ঁসে নাকি ২০ লাখ ডলার কামিয়েছেন। বলাবাহুল্য, সে টাকা এসেছে লিবিয়ার নিজস্ব টাঁকশাল থেকে। নিজের যোগ্যতায় ১০ টাকা কামাবেন, সে মুরোদ যে গাদ্দাফিপুত্রের নেই, তা বলাই বাহুল্য।
ক্ষমতার এই অপব্যবহার, রাষ্ট্রের সম্পদের এই যে অপচয়, মধ্যযুগে তা ঘটত লাঠির জোরে। একুশ শতকে এসেও যদি সেই একই কাণ্ড হয়, তা হলে তেমন দেশকে সভ্য বলি কী করে? দেশগুলোর কোনোটিই কিন্তু সম্পদের দিক দিয়ে খুব গরিব নয়, কিন্তু তার পরও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ অভাবী, কর্মহীন ও নিরক্ষর। দিনের পর দিন তাদের যে অপমান ও অমর্যাদার ভেতর দিয়ে যেতে হয়, মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ তারই প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে। অন্য কথায়, আজ আরব বিশ্বে গণতন্ত্রের জন্য যে আন্দোলন দেখছি, তা আসলে সেসব দেশের মানুষের আত্মমর্যাদার জন্য লড়াই। অধিকারহীন মানুষ দিনের পর দিন স্বৈরাচার মেনে নিয়েছে, ভেবেছে, এটাই তাদের নিয়তি। কিন্তু তা মানতে রাজি নয় দেশের তরুণ প্রজন্ম। অধিকাংশ আরব দেশেই ৩০ অনূর্ধ্ব বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি। মিসর ও ইয়েমেনে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। তাদের মা-বাবা এক সময় বিনা প্রতিবাদে দমন ও নির্যাতন মেনে নিয়েছেন, কিন্তু এরা তা আর মানতে রাজি নয়। মিসরের অভ্যুত্থান শুরু সে রকম এক প্রতিবাদ থেকেই। আলেকজান্দ্রিয়া শহরে খালেদ সায়িদ নামের এক যুবক ইন্টারনেটে তাঁর ব্যক্তিগত ব্লগে একটি ভিডিও ফিল্ম সংযুক্ত করেছিলেন। সে ফিল্মের বিষয়, মিসরীয় পুলিশ কীভাবে মাদক চোরাচালানিদের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করে, তাদের সঙ্গে আঁতাত করে লাভের টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়। সে কথা জানতে পেরে শহরের এক সাইবার ক্যাফে থেকে পুলিশ দিনদুপুরে খালেদকে টেনে এনে গুলি করে হত্যা করে। তারপর সেই লাশ সেখানে ফেলে রেখে চলে যায়। পুলিশ শাসিয়ে গিয়েছিল, কেউ এ নিয়ে টুঁ-শব্দ করলে খালেদের মতো অবস্থা হবে। সেই খালেদের হত্যা যাতে কেউ ভুলে না যায়, সে লক্ষ্যে আইল ঘানিম ‘আমরা সবাই খালেদ সায়িদ’ এই নামে ফেসবুক পাতা চালু করে। এর পরের ইতিহাস তো সবারই জানা।
বাংলাদেশে নির্যাতনের সেই কালো অধ্যায় আমরা কাটিয়ে এসেছি, সে কথা আমি বিশ্বাস করি। মিসর বা ইয়েমেনের তুলনায় আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামো অধিক পোক্ত, তা নিয়েও কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তাই বলে আমরা আনন্দে বগল বাজাব, সেটাও কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আমাদের শাসনতন্ত্র আছে ঠিকই, কিন্তু সব সময় সে শাসনতন্ত্র কি মেনে চলা হয়? পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনের সুযোগ আমাদের আছে, কিন্তু গায়ের জোরে অথবা টাকার দাপটে সে নির্বাচনের ফলাফল উল্টে যাবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? দুর্নীতি এখনো ব্যাপক, স্বজনপ্রীতি, দলবাজি এসবও আছে। গণতন্ত্র মানে তো কেবল নির্ধারিত সময়ান্তর নির্বাচন নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নাগরিকের পূর্ণ অংশগ্রহণ। নাগরিক সব সময় ব্যক্তিগতভাবে এই প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় না, তা সম্ভবও নয়। কিন্তু সুশীল সমাজের মাধ্যমে নিজের মতামত সে প্রকাশ করতে পারে, কোনো সিদ্ধান্তের পক্ষে বা বিপক্ষে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি তার পক্ষে সম্ভব। যে দেশে এই সুশীল সমাজ যত সবল, তার গণতান্ত্রিক সম্ভাবনা তত বেশি। আমাদের দেশে সুশীল সমাজ এখনো দুর্বল, তাদের মধ্যে লেজুড়বৃত্তির প্রবণতাও পুরোনো কাঁথার মতো লেপ্টে আছে। তবে আমাদের জন্য একটা ভালো খবর, সরকার বা দলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে স্বাধীন বা কম-নির্ভরশীল এমন তথ্য-ব্যবস্থা গড়ে উঠছে। সরকারের ভেতর দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার তুলে ধরতে এরা আগের চেয়ে অনেক বেশি তত্পর। কার্যকর ও জনসমর্থিত সুশীল সমাজ পাশে থাকলে এই তথ্য-ব্যবস্থা আরও বেগবান হতে পারে।
কিন্তু এক জায়গায় আমাদের সঙ্গে অনেক আরব দেশের মিল রয়েই যাচ্ছে। জমিদারি প্রথা আমরা দূর করেছি বটে, কিন্তু রাজনীতিতে জমিদারির স্থায়ী বন্দোবস্ত যেন জগদ্দল পাথরের মতো বসে আছে। বাংলাদেশের বয়স এখন ৪০। এই ৪০ বছরে আমাদের রাজনীতির কেন্দ্রে থেকে গেছে দুটি পরিবার। ১৬ কোটি মানুষের দেশ অথচ নেতা-নেত্রী হাতে গোনা দু-চারজন? বুঝলাম নেত্রীর ছেলে, তাই বলে কোকো?
আমার মনে হয়, মিসরীয় কায়দায় উত্থান যদি হয়, তো তা হবে এই পরিবারতন্ত্র ঠেকাতে।
No comments