মাটির টানে ফিরে চলা by ড. হারুন রশীদ
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। টিকেট কেনার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছে হাজারও মানুষ। যে করেই হোক টিকেট চাই। ঈদকে সামনে রেখে প্রতিবছর একই অবস্থা হয় লঞ্চ, বাস টার্মিনালগুলোতেও। টিকেট নেই তো কী হয়েছে। বাসের ছাদে। ট্রেনের কামরায় ভেতরে দাঁড়িয়ে, সেখানে ঠাঁই না হলে ছাদে।
লঞ্চেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফ্লোরে বসে, ডেকে দাঁড়িয়ে এমনকি ছাদের ওপর বিছানা পেতে সেখানেই গন্তব্যের জন্য বসে পড়া। যেভাবেই হোক বাড়িতে পৌঁছতেই হবে। এ টান যে বড়বেশি প্রাণের। এ টান নাড়ির। দুনিয়ার কোথাও কি মানুষ এভাবে ছোটে প্রাণের টানে, শেকড়ের সন্ধানে? কিসের এতো মায়া? কিসের জন্য মানুষের এই ঘরে ফেরার আকুতি? সেকি কেবলই প্রিয়জনের সান্নিধ্য? নাকি তারও অতিরিক্ত অন্যকিছু?
কী শোভা কী ছায়া গো, কী স্নেহ কী মায়া গো, কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে নদীর কূলে কূলে। ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় গ্রামকে দেখার জন্য আকুতি? ইট-কাঠ-পাথরের এই শহর ছেড়ে মুক্তভাবে শ্বাস নেয়ার জন্য? নাকি বনলতা সেনের মুখোমুখি বসার মতো ‘দুদ- শান্তির’ জন্য এই যাত্রা? যারা গ্রাম থেকে শহরে আসে তাদের প্রাণটা আসলে পড়ে থাকে ওখানেই। বিশেষ করে যাঁরা গ্রামে বড় হয়েছেন। এই নাগরিক জীবন হয়ত অনেক কিছু দেয়। শিক্ষা-দীক্ষা ভাত-কাপড় রুটি রোজগারের নিশ্চয়তা। অনেক উত্তেজনা। ভোগ বিলাস আনন্দ। কিন্তু জীবনের সব পাওয়া, সব তৃষ্ণা কি মেটে তাতে? কিছুই কি বাকি থাকে না?
এই শহরে তো দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ নেই, জোয়ার ভাটায় দুলে ওঠা নদী নেই, বৃক্ষের শ্যামল ছায়া নেই, ধানের ক্ষেতে রোদ ও ছায়ার লুকোচুরি খেলা নেই, ঘাসের ডগায় শিশির নেই, রাখালের বাঁশের বাঁশি নেই, গোধূলির আলো নেই, বাউকুড়ানির ডগায় ঝরাপাতার নৃত্য নেই, পাখির কলকাকলি নেই, পিঠেপুলি পাটিসাপটার আয়োজন নেই, আউল, বাউল জারি সারি, ভাটিয়ালির হৃদয় উদাস করা সুর নেই, বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ নেই, এক চিলতে উঠোন নেই। এইসব নেই-এর পাল্লা এতটাই ভারি যে তা বলে শেষ করার নয়।
সে জন্যই কি আমাদের ছুটে চলা? গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথে পায়ে ধুলো মাখিয়ে হাঁটার জন্য? নাকি আদিখ্যেতা হয়ে যাচ্ছে এসব কথা? মানুষ কী আর এত হিসাব নিকাষ করে চলে। কয়েকটা দিন ছুটি পেলাম আর কোথাও ঘুরে এলামÑএই রকম তো। আটপৌরে বাঙালী। কোথায় আর যাবে। যে মাইনে আর রোজগার তাতে সংসারের হাঁড়ি টানতেই তো সব যায়। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়াকে সামাল দিতেই তো হিমশিম খেতে হয়। সে জন্য বিদেশ বিভূঁই নয়, ‘ঘর হতেই আঙিনা বিদেশের মতো’ দেশের বাড়িতেই (নিজগ্রাম) ঈদ করা। কিন্তু সেই গ্রামও কি আর আগের মতো আছে? নাগরিক সুযোগসুবিধার অনেকখানিই পাওয়া যায় এখন গ্রামে বসেই। বিদ্যুত পৌঁছেছে বেশিরভাগ গ্রামেই। সে জন্য বাড়ি বাড়ি টেলিভিশন। এমনকি ডিশ লাইন থাকায় মুম্বাই-কলকাতা ঢাকার চেয়েও কাছের। মোবাইল ফোন অনেকের হাতে হাতে। কম্পিউটার, সাথে ইন্টারনেট সংযোগ।
মফঃস্বলে দৈনিক পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধিরা এখন হাতে লিখে, ফ্যাক্স করে খবর পাঠান না। কম্পিউটারে কম্পোজ করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইমেইলে অতিদ্রুত তারা পাঠিয়ে দেন কোন একটি ঘটনার খবর।
ব্যবসাবাণিজ্যের খবরও চলে মোবাইলে। পোল্ট্রি ফার্মের মালিক, কিংবা সবজি চাষী মোবাইলে জেনে নেন কেমন বাজার যাচ্ছে ঢাকায়। এভাবে ভার্চুয়াল একটা যোগাযোগ তো আছেই গ্রামের সঙ্গে শহরের। শহরের সঙ্গে গ্রামের। কিন্তু তাতেও তো সব হয় না। দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে?
এর জন্য তো আসল দুধই চাই। আর সেটি পেতে হলে তো ‘গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু’র দেশে যেতে হবেই। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থাটা এখনো আশানুরূপ নয়। যেখানে সড়ক মহাসড়কগুলোরই বেহাল দশা সেখানে গ্রামাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা তো আরও সঙ্গিন। এ জন্য ঘরমুখো মানুষ জনের দুর্ভোগের অন্ত নেই। কিন্তু তাতে কি? যেতে তো হবেই।
ছোট্ট বেলার স্কুলে যাওয়ার মেঠো পথের স্মৃতি, হাডুডু আর ফুটবল খেলার মাঠ, কিংবা টাকার অভাবে পড়তে না পারা স্কুলজীবনের সেই সহপাঠীর প্রিয়মুখ দেখার আনন্দ কোথায় পাওয়া যাবে এই শহরে। পাশের বাড়ির সাপের ফণার মতো বেণী দুলানো দুরন্ত সেই কিশোরীর হাসি কোথায় মিলবে এই শহরে।
এই শহরে নির্ভেজাল জীবনান্দ কোথায়?
এখানে তো মানুষ নয়, শোষক আর শোষিত, আমলা আর কামলা (মজুর), মালিক-শ্রমিক, পুঁজিপতি আর নিঃস্ব, হাইরাইজ বিল্ডিং বনাম রেললাইনের পাশের বস্তির বিস্তর ব্যবধানের মধ্যে সরকার কিংবা বিরোধী দলের শিলপাটার ঘষাঘষির মধ্যে বাস। জীবন কোথায় এখানে? চারিদিকে ঠগ, প্রবঞ্চক, প্রতারক, অজ্ঞান, পার্টি, মলম পার্টি। (রাজনৈতিক দলগুলোও তো পার্টি, না!) কী নির্মম, কী পাশবিক এই জীবনধারা। যেখানে টাকার জন্য ধৃত ব্যক্তিকে খুনীর হাতে তুলে দেয় নগর কোটাল পুলিশ। হাসপাতালগুলো পরিণত হয় কসাইখানায়। যানজট, জলজট আর জনজটে রাস্তায় চলাই দায়। ঘুষখোর কর্মকর্তা ইলিশ কেনে ৭ হাজার টাকা হালি, আর সাধারণের পুঁটি কিনতেই নাভিশ্বাস। নব্য গজিয়ে ওঠা কোটিপতি গার্মেন্টস মালিকের ড্রয়িংরুমে শোভা পায় ডোরাকাটা বাঘের চামড়া, লাখ লাখ টাকার শোপিস। অথচ গার্মেন্টসকর্মীদের তিন হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি ঠিক মতো দিতে তাঁরা গলদঘর্ম হয়ে যান। ওইসব খেটে খাওযা মানুষের জীবনেও ঈদ আসে। তারাও ঘরে ফেরে। শরীরের প্রায় শেষ শ্রমটুকু নিঙ্ড়ে দিয়ে তাদের যখন ছুটি মেলে ফেরার নিশ্চয়তাটুকু নেই। মধ্যরাত পর্যন্ত বাক্স-পেটরা হাতে রাস্তার পাশে অপেক্ষা করে লাখ লাখ গার্মেন্টস কর্মী। অথচ এদের ঘাম-শ্রমের বিনিময়েই আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। রেমিটেন্স প্রবাহ জিডিপির হার বাড়ায়। যা এই দেশকে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা দেশকে স্বাধীন করেছেন আর এখন এইসব জীবনযোদ্ধারা দেশ গড়ছেন।
আসলে এই যে এতোসব ঝক্কি-ঝামেলা সহ্য করে ঘরে ফেরা এটাও তো দেশপ্রেমেরই অংশ। আমরা তো আমাদের মায়ের কাছেই ফিরি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ফিরে চল মাটির টানে যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে।’ দেশও তো মায়ের সমতুল্যই। মা ছাড়া আর কারও জন্য কি এভাবে জীবন বাজি রাখা যায়? একাত্তরে যা করেছে বীর বাঙালী।
এবারের ঈদ এসেছে এমন এক সময়ে যখন একাত্তরের ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম অনেকটাই এগিয়ে গেছে। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর অনেকেই কারান্তরীণ। তাদের কৃতকর্মের বিচার চলছে। এ আরেক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে জিততে না পারলে আমাদের স্বাধীনতা পূর্ণতা পাবে না। যে মাটির টানে ফিরে চলা আমাদের সেই মাটিতে মিশে আছে লাখ লাখ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার রক্ত, তাদের আত্মা শান্তি পাবে না। তাই এই যুদ্ধে জিততে আমাদের হবেই। এবারের ঈদ হোক দেশকে যুদ্ধাপরাধের দায় থেকে কলঙ্কমুক্ত করার শপথ নেয়ার দিন। তবেই এই ঈদ হবে সকলের। যেখানে কোন বৈষম্য থাকবে না। মনে রাখা প্রয়োজন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ উন্নত একটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল সকলের সম অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সে জন্যই আমাদের মাটির টানে ফিরে যেতে হবে। মূলে, দেশের জন্মসূত্র একাত্তরে।
harun_press@yahoo.com
কী শোভা কী ছায়া গো, কী স্নেহ কী মায়া গো, কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে নদীর কূলে কূলে। ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় গ্রামকে দেখার জন্য আকুতি? ইট-কাঠ-পাথরের এই শহর ছেড়ে মুক্তভাবে শ্বাস নেয়ার জন্য? নাকি বনলতা সেনের মুখোমুখি বসার মতো ‘দুদ- শান্তির’ জন্য এই যাত্রা? যারা গ্রাম থেকে শহরে আসে তাদের প্রাণটা আসলে পড়ে থাকে ওখানেই। বিশেষ করে যাঁরা গ্রামে বড় হয়েছেন। এই নাগরিক জীবন হয়ত অনেক কিছু দেয়। শিক্ষা-দীক্ষা ভাত-কাপড় রুটি রোজগারের নিশ্চয়তা। অনেক উত্তেজনা। ভোগ বিলাস আনন্দ। কিন্তু জীবনের সব পাওয়া, সব তৃষ্ণা কি মেটে তাতে? কিছুই কি বাকি থাকে না?
এই শহরে তো দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ নেই, জোয়ার ভাটায় দুলে ওঠা নদী নেই, বৃক্ষের শ্যামল ছায়া নেই, ধানের ক্ষেতে রোদ ও ছায়ার লুকোচুরি খেলা নেই, ঘাসের ডগায় শিশির নেই, রাখালের বাঁশের বাঁশি নেই, গোধূলির আলো নেই, বাউকুড়ানির ডগায় ঝরাপাতার নৃত্য নেই, পাখির কলকাকলি নেই, পিঠেপুলি পাটিসাপটার আয়োজন নেই, আউল, বাউল জারি সারি, ভাটিয়ালির হৃদয় উদাস করা সুর নেই, বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ নেই, এক চিলতে উঠোন নেই। এইসব নেই-এর পাল্লা এতটাই ভারি যে তা বলে শেষ করার নয়।
সে জন্যই কি আমাদের ছুটে চলা? গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথে পায়ে ধুলো মাখিয়ে হাঁটার জন্য? নাকি আদিখ্যেতা হয়ে যাচ্ছে এসব কথা? মানুষ কী আর এত হিসাব নিকাষ করে চলে। কয়েকটা দিন ছুটি পেলাম আর কোথাও ঘুরে এলামÑএই রকম তো। আটপৌরে বাঙালী। কোথায় আর যাবে। যে মাইনে আর রোজগার তাতে সংসারের হাঁড়ি টানতেই তো সব যায়। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়াকে সামাল দিতেই তো হিমশিম খেতে হয়। সে জন্য বিদেশ বিভূঁই নয়, ‘ঘর হতেই আঙিনা বিদেশের মতো’ দেশের বাড়িতেই (নিজগ্রাম) ঈদ করা। কিন্তু সেই গ্রামও কি আর আগের মতো আছে? নাগরিক সুযোগসুবিধার অনেকখানিই পাওয়া যায় এখন গ্রামে বসেই। বিদ্যুত পৌঁছেছে বেশিরভাগ গ্রামেই। সে জন্য বাড়ি বাড়ি টেলিভিশন। এমনকি ডিশ লাইন থাকায় মুম্বাই-কলকাতা ঢাকার চেয়েও কাছের। মোবাইল ফোন অনেকের হাতে হাতে। কম্পিউটার, সাথে ইন্টারনেট সংযোগ।
মফঃস্বলে দৈনিক পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধিরা এখন হাতে লিখে, ফ্যাক্স করে খবর পাঠান না। কম্পিউটারে কম্পোজ করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইমেইলে অতিদ্রুত তারা পাঠিয়ে দেন কোন একটি ঘটনার খবর।
ব্যবসাবাণিজ্যের খবরও চলে মোবাইলে। পোল্ট্রি ফার্মের মালিক, কিংবা সবজি চাষী মোবাইলে জেনে নেন কেমন বাজার যাচ্ছে ঢাকায়। এভাবে ভার্চুয়াল একটা যোগাযোগ তো আছেই গ্রামের সঙ্গে শহরের। শহরের সঙ্গে গ্রামের। কিন্তু তাতেও তো সব হয় না। দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে?
এর জন্য তো আসল দুধই চাই। আর সেটি পেতে হলে তো ‘গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু’র দেশে যেতে হবেই। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থাটা এখনো আশানুরূপ নয়। যেখানে সড়ক মহাসড়কগুলোরই বেহাল দশা সেখানে গ্রামাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা তো আরও সঙ্গিন। এ জন্য ঘরমুখো মানুষ জনের দুর্ভোগের অন্ত নেই। কিন্তু তাতে কি? যেতে তো হবেই।
ছোট্ট বেলার স্কুলে যাওয়ার মেঠো পথের স্মৃতি, হাডুডু আর ফুটবল খেলার মাঠ, কিংবা টাকার অভাবে পড়তে না পারা স্কুলজীবনের সেই সহপাঠীর প্রিয়মুখ দেখার আনন্দ কোথায় পাওয়া যাবে এই শহরে। পাশের বাড়ির সাপের ফণার মতো বেণী দুলানো দুরন্ত সেই কিশোরীর হাসি কোথায় মিলবে এই শহরে।
এই শহরে নির্ভেজাল জীবনান্দ কোথায়?
এখানে তো মানুষ নয়, শোষক আর শোষিত, আমলা আর কামলা (মজুর), মালিক-শ্রমিক, পুঁজিপতি আর নিঃস্ব, হাইরাইজ বিল্ডিং বনাম রেললাইনের পাশের বস্তির বিস্তর ব্যবধানের মধ্যে সরকার কিংবা বিরোধী দলের শিলপাটার ঘষাঘষির মধ্যে বাস। জীবন কোথায় এখানে? চারিদিকে ঠগ, প্রবঞ্চক, প্রতারক, অজ্ঞান, পার্টি, মলম পার্টি। (রাজনৈতিক দলগুলোও তো পার্টি, না!) কী নির্মম, কী পাশবিক এই জীবনধারা। যেখানে টাকার জন্য ধৃত ব্যক্তিকে খুনীর হাতে তুলে দেয় নগর কোটাল পুলিশ। হাসপাতালগুলো পরিণত হয় কসাইখানায়। যানজট, জলজট আর জনজটে রাস্তায় চলাই দায়। ঘুষখোর কর্মকর্তা ইলিশ কেনে ৭ হাজার টাকা হালি, আর সাধারণের পুঁটি কিনতেই নাভিশ্বাস। নব্য গজিয়ে ওঠা কোটিপতি গার্মেন্টস মালিকের ড্রয়িংরুমে শোভা পায় ডোরাকাটা বাঘের চামড়া, লাখ লাখ টাকার শোপিস। অথচ গার্মেন্টসকর্মীদের তিন হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি ঠিক মতো দিতে তাঁরা গলদঘর্ম হয়ে যান। ওইসব খেটে খাওযা মানুষের জীবনেও ঈদ আসে। তারাও ঘরে ফেরে। শরীরের প্রায় শেষ শ্রমটুকু নিঙ্ড়ে দিয়ে তাদের যখন ছুটি মেলে ফেরার নিশ্চয়তাটুকু নেই। মধ্যরাত পর্যন্ত বাক্স-পেটরা হাতে রাস্তার পাশে অপেক্ষা করে লাখ লাখ গার্মেন্টস কর্মী। অথচ এদের ঘাম-শ্রমের বিনিময়েই আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। রেমিটেন্স প্রবাহ জিডিপির হার বাড়ায়। যা এই দেশকে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা দেশকে স্বাধীন করেছেন আর এখন এইসব জীবনযোদ্ধারা দেশ গড়ছেন।
আসলে এই যে এতোসব ঝক্কি-ঝামেলা সহ্য করে ঘরে ফেরা এটাও তো দেশপ্রেমেরই অংশ। আমরা তো আমাদের মায়ের কাছেই ফিরি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ফিরে চল মাটির টানে যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে।’ দেশও তো মায়ের সমতুল্যই। মা ছাড়া আর কারও জন্য কি এভাবে জীবন বাজি রাখা যায়? একাত্তরে যা করেছে বীর বাঙালী।
এবারের ঈদ এসেছে এমন এক সময়ে যখন একাত্তরের ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম অনেকটাই এগিয়ে গেছে। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর অনেকেই কারান্তরীণ। তাদের কৃতকর্মের বিচার চলছে। এ আরেক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে জিততে না পারলে আমাদের স্বাধীনতা পূর্ণতা পাবে না। যে মাটির টানে ফিরে চলা আমাদের সেই মাটিতে মিশে আছে লাখ লাখ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার রক্ত, তাদের আত্মা শান্তি পাবে না। তাই এই যুদ্ধে জিততে আমাদের হবেই। এবারের ঈদ হোক দেশকে যুদ্ধাপরাধের দায় থেকে কলঙ্কমুক্ত করার শপথ নেয়ার দিন। তবেই এই ঈদ হবে সকলের। যেখানে কোন বৈষম্য থাকবে না। মনে রাখা প্রয়োজন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ উন্নত একটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল সকলের সম অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সে জন্যই আমাদের মাটির টানে ফিরে যেতে হবে। মূলে, দেশের জন্মসূত্র একাত্তরে।
harun_press@yahoo.com
No comments