দ্রুত বিচার আদালত পাঁচের কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ- ৪৬ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে গাড়ি পোড়ানো মামলার বিচার চলছিল

হরতালে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় এলাকায় গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১৮ দলীয় জোটের ৪৬ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বিচার কাজ যে আদালতে চলছিল, ঢাকার সেই দ্রুত বিচার আদালত ৫-এর কার্যক্রমের ওপর ৮ সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।


একইসঙ্গে ঢাকা মহানগর ৫ নম্বর দ্রুত বিচার আদালত গঠন এবং এ আদালতের বিচারক হিসেবে মহানগর হাকিম হারুন অর রশিদকে দায়িত্ব দেয়া কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে নাÑ তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করেছে আদালত। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে আইন সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, আইজিপি, সিএমএম ও হারুন অর রশিদকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
সোমবার বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। এর আগে গত ২৯ জুলাই বিএনপির যুগ্মমহাসচিব ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ওই মামলার আসামি হিসেবে রিট আবেদনটি দায়ের করেন। হাইকোর্টের এ আদেশের ফলে আজ মঙ্গলবার ৫ নম্বর দ্রুত বিচার আদালতে ওই মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছে না বলে জানা গেছে। সোমবার শুনানিতে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, আইন শৃঙ্খলা বিঘœকারী (দ্রুত বিচার) আইন-২০০২ (সংশোধন-২০১০) -এ ৮ ধারা অনুযায়ী সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দেশের যে কোন জেলায় এক বা একাধিক দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে। একই আইনে সরকার সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের বিচারক নিয়োগ করবে ও বিচারকের বিচারিক অধিক্ষেত্র নির্ধারণ করবে। কিন্তু ঢাকার ৫ ও ৭ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠনের ক্ষেত্রে সরকার কোন গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করেনি। এটা সিএমএম একটি আদেশ দিয়ে আদালত গঠন ও এর বিচার নিয়োগ করেছে। যা বেআইনী। আর একারণেই রিট আবেদনটি করা হয়েছে। রিট আবেদনে ওই আদালত গঠন ও বিচারক নিয়োগ কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না সেজন্য রুল চাওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে ওই আদালতে মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত রাখার আবেদন করা হয়েছে। এরপর আদালত রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য জানতে চান। এ সময় সংশ্লিষ্ট আদালতে সহকারী এ্যাটর্নি জেনারেল ড. বশিরউল্লাহ বলেন, এ রিট আবেদনের ওপর এ্যাটর্নি জেনারেল শুনানি করবেন। তিনি আসছেন। কিন্তু আদালতে এ্যাটর্নি জেনারেল, অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল বা ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল হাজির না থাকায় আদালত ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আদালত বলে, দুই ঘণ্টা আগে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। কেউ নেই। আমরা কি সব কাজ ফেলে রেখে তাদের জন্য বসে থাকব? এর কয়েক মিনিট পর এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতে হাজির হন।
এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানিতে বলেন, আইনের ৮ ধারা অনুযায়ী সরকার ট্রাইব্যুনাল গঠন করবে ও বিচারক নিয়োগ করবে। ২০০২ সালের ১০ এপ্রিল প্রথম আইন করা হয়। এ আইনে একই বছরের ৮ মে ঢাকায় চারটি আদালত গঠন করা হয়। এ সময় তিনি এ সংক্রান্ত গেজেটের কপি আদালতে দাখিল করেন। এরপর তিনি বলেন, ২০০৮ সালে সিএমএম এনামুল হক দ্রুত বিচার আইনের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিচারকদের (ম্যাজিস্ট্রেট) নাম উল্লেখ করে তাদের জন্য দ্রুত বিচার আদালত গঠনের অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে। এরপর সরকার সুপ্রীমকোর্টের অনুমতি সাপেক্ষে তা অনুমোদন করে। এটা গেজেট আকারে প্রকাশের জন্য বিজি প্রেসে পাঠায়।
এ সময় আদালত বলে, সরকার কি গেজেট জারি করেছে? কারণ তাদের মামলাই এখানে। জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, না। ছাপানোর জন্য পাঠানো হয়েছে। এ সময় আদালত বলে, ২০০৮ সালে পাঠানো হলো। এখনও ছাপা হয়নি? এতে তো সরকারই বিপদে পড়বে। জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সরকার অনুমতি দিয়েছে। এরপর বিজি প্রেসে গেছে। সেখানে হাজার হাজার সার্কুলেশন, নোটিস, গেজেট ইত্যাদি ছাপানোর জন্য পাঠানো হয়। পর্যায়ক্রমে সব ছাপা হয়। তিনি এ সময় ২০০৯ সালের একটি প্রজ্ঞাপন দেখিয়ে বলেন, সরকার দ্রুত বিচার আইনের মামলা বিচার করার জন্য বিচারক নিয়োগের জন্য সিএমএম বা তার মনোনীত কোন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে ক্ষমতা দিয়েছে। এতে সুপ্রীমকোর্টের অনুমোদন আছে। তিনি বলেন, এখানে রুল জারির আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই মামলার বিচার কাজ স্থগিত রাখার আবেদন করতে পারেন না। মালার বিচার বন্ধ থাকতে পারে না। মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। তাই এ পর্যায়ে তারা ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১-এ ধারায় কোয়াশমেন্ট আবেদন করতে পারেন। অন্য কোনভাবে আদালতে আসতে পারে না। তাই মামলার কার্যক্রম স্থগিত রাখার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয়।
এরপর রিট আবেদনের পক্ষে শুনানিতে এ্যাডভোকেট আহসানুল করিম বলেন, এ মামলায় খুবই সাধারণ একটি প্রশ্ন জড়িত। আলোচিত ট্রাইব্যুনালের বিচার করার এখতিয়ার আছে কিনা। যদি এ ট্রাইব্যুনালের বিচার করার এখতিয়ার না থাকে তবে মামলার সকল বিচার কার্যক্রম অবৈধ হবে। তিনি বলেন, আইন শৃঙ্খলা বিঘœকারী (দ্রুত বিচার) আইন, ২০০২ (সংশোধিত ২০১০) এর ৮(১) ধারা অনুযায়ী গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করে দ্রুত বিচার আদালত গঠন এবং অধিক্ষেত্র নির্ধারণ করবে সরকার। একইসঙ্গে ৮(২) অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট আদালতে একজন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেবে সরকার। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আইনের এ ধারা লঙ্ঘন করে মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) বিকাশ কুমার সাহা গত ৯ মে এক আদেশ দিয়ে মহানগর হাকিম মোহাম্মদ এরফান উল্লাহকে দ্রুত বিচার আদালতের বিচারক নিয়োগ দিয়েছেন। একইসঙ্গে তার অধিক্ষেত্র নির্ধারণ করেছেন। যা বেআইনী। এসময় এ্যাটর্নি জেনারেল দাঁড়িয়ে বলেন, ২০০৮ সালে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জবাবে আদালত বলে, মামলাও তো এখানেই। এরপর আহসানুল করিম বলেন, মামলায় কাল (মঙ্গলবার) সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে যাচ্ছে। তাই শুধু রুল জারি করলে তার আর কার্যকারিতা থাকবে না। এ সময় এ্যাটর্নি জেনারেল উত্তেজিত হয়ে বলেন, মামলায় কি কালই শাস্তি হয়ে যাচ্ছে? জবাবে আহসানুল করিম বলেন, সাক্ষী শুরু হলে রুলের কার্যকারিতা থাকবে না। তাই রুল জারির পাশাপাশি মামলার কার্যক্রম স্থগিত রাখার আদেশ প্রার্থনা করছি। এরপর আদালত বেলা দুটায় আদেশের জন্য সময় নির্ধারণ করেন। বেলা দুটায় আদালত বসার পর আদেশ দেন। পরে বেলা দুটার পর আদালত আদেশ দেয়।
এর আগে সোমবার সকালে বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি কাজী মোঃ ইজারুল হক আকন্দের বেঞ্চে রিট আবেদনটির ওপর শুনানির জন্য ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, রফিকুল ইসলাম মিয়া, এজে মোহাম্মদ আলী, আহসানুল করিমসহ আইনজীবীরা উপস্থিত হন। তখন সংশ্লিষ্ট আদালতের ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল আলামীন সরকার বলেন, এ মামলায় এ্যাটর্নি জেনারেল শুনানি করবেন। বেলা ১২টায় শুনানির জন্য সময় নির্ধারণ করার জন্য আবেদন করছি। এ সময় ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বিরোধিতা করে বলেন, কয়েকদিন আগেই আদালত এ রিট আবেদনের ওপর শুনানির দিন ও সময় নির্ধারণ করে। তাই এখন সময় চাওয়া গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এরপর আদালত বলে, আমাদের একজন শুনানিতে বিব্রতবোধ করছেন। আমরা এটা প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এ সময় রফিক-উল হক বলেন, আমরা অন্য বেঞ্চে নিতে চাই। এরপর আদালত মামলাটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেয়ার আদেশ দিয়ে বলেন, অন্য কোন বেঞ্চে নেয়ার স্বাধীনতা পাবেন রিট আবেদনকারী। এরপর রিট আবেদনটি বিচারপতি নাঈমা হায়দারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে নেয়া হয়।
আদেশের পর রিট আবেদনকারীর আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সাংবাদিকদের বলেন, আদালতের এ আদেশের পর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরদের বিরুদ্ধে মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। রিট আবেদনকারীপক্ষে আরেক আইনজীবী এ্যাডভোকেট আহসানুল করিম বলেন, ৫ নম্বর দ্রুত বিচার আদালতের কার্যক্রম স্থগিত করেছে আদালত। একারণে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরদের বিরুদ্ধে ওই আদালতে বিচারাধীন মামলার কার্যক্রম স্থগিত থাকবে।
এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, হাইকোর্ট ৫ নম্বর দ্রুত বিচার আদালতের বিচার কার্যক্রম স্থগিত করেছেন। ফলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরদের মামলা কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। তিনি বলেন, এ আদেশের কারণে মঙ্গলবার ওই মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ হবে না।
গত ২৯ জুলাই ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনের দায়ের করা রিট আবেদনে সরকার গেজেট জারির পরিবর্তে গত ৯ মে মুখ্য মহানগর হাকিমের দেয়া আদেশের মাধ্যমে বিচারকের বিচারিক এখতিয়ার নির্ধারণ করে দ্রুত বিচার আদালত-৫ গঠন কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং ওই আদালতে বিচারাধীন বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় দায়ের করা মামলার চলমান কার্যক্রম কেন বেআইনী ঘোষণা করা হবে না, এ মর্মে রুল জারির আবেদন করা হয়। একইসঙ্গে রিট আবেদনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে ১৮ দলীয় জোটের নেতাকর্মীসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে করা মামলার কার্যক্রম স্থগিত চাওয়া হয়। এছাড়াও ওই মামলার যাবতীয় নথি হাইকোর্টে তলবেরও আবেদন করা হয়। বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি কাজী মোঃ ইজারুল হক আকন্দের বেঞ্চ শুনানির জন্য ৬ আগস্ট দিন ধার্য করেন।

No comments

Powered by Blogger.