পথেঘাটে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ফরম মেলে এক টাকায় by ওমর ফারুক
হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ফরম। এসব ফরম ব্যবহার করে প্রতারক চক্র তৈরি করছে ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। এই নকল পরোয়ানাই চলে যাচ্ছে ডিসি-এসপির অফিস হয়ে থানায়। এরপর পরোয়ানার যাচাই-বাছাই না করে এর ভিত্তিতে আসামিও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
পরোয়ানা ভুয়া- এটা প্রমাণিত হতে হতেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বিনা দোষে কারাভোগ করে আসতে হচ্ছে। ভুয়া পরোয়ানার বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে রাজধানীর জজকোর্ট এলাকায় এমন ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে।
ভুয়া পরোয়ানার ভোগান্তির শিকার হন সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আইনজীবীরাও। এমনই একজন ভুক্তভোগী অ্যাডভোকেট মফিজুল ইসলাম। ভুয়া পরোয়ানায় তাঁকে ১৭ দিন জেল খাটতে হয়। মফিজুল ইসলাম গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, একটি মিথ্যা মামলায় তিনি ২০০৯ সালে খুলনা কারাগারে ছিলেন। ওই মামলায় জামিন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার ডেমরা থানার একটি হত্যা মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা যায় কারাগারে। পরে তাঁর নিয়োজিত আইনজীবী নিশ্চিত হন, তাঁর বিরুদ্ধে যে মামলায় পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে, সেই মামলারই কোনো অস্তিত্ব নেই। ওই ভুয়া পরোয়ানার কারণে তাঁকে বাড়তি ১৭ দিন জেলে থাকতে হয়। মফিজুল ইসলাম বলেন, '২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ডেমরা থানায় ১৫ নম্বরের একটি হত্যা মামলা দেখানো হয়। ওই মাসে ডেমরা থানায় মামলাই হয়েছিল ৯টি। এর পরও ভুয়া ওয়ারেন্টের কারণে আমাকে ১৭ দিন জেল খেটে আসতে হলো।'
ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার ফুলবাড়িয়া গ্রামের শহীদ মোল্লা, আসাদ মোল্লা ও মোদাচ্ছের মোল্লা জানান, তাঁদের নামে কোথাও মামলা থাকতে পারে- এ ভাবনা মাথায়ও ছিল না। এরই মধ্যে গত ১৩ জুলাই বোয়ালমারী থানা পুলিশ গিয়ে গ্রাম থেকে ওই তিনজনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসে। পুলিশ জানায়, ঢাকা সিএমএম কোর্ট থেকে একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এসেছে এই থানায়। তার ভিত্তিতেই তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এরপর ফরিদপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করার পর আদালত তাঁদের কারাগারে পাঠান। স্বজনরা আইনজীবী নিয়োগ করে জানতে পারেন, আসলে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাটিই ভুয়া।
গত ২০ মার্চ দুপুরে খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ার ১৯২/এ নম্বর ভবনের নিচতলায় 'শাহ মিরান জেনারেল স্টোর' নামের মুদি দোকান থেকে বেলায়েত হোসেন ভূঁইয়া এবং মামুনকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। বেলায়েত ও মামুন থানায় গিয়ে জানতে পারেন, তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ দেখায় তাঁদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। পরে তাঁদের নিয়োগকৃত আইনজীবী নিশ্চিত হন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানাটি জাল। চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার যে মামলায় তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এসেছে সেটি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে এক বছর আগে। এ ছাড়া ওই মামলার এজাহারে তাঁদের নামও নেই। অথচ দুই ভাইকে ভুয়া ওয়ারেন্টের কারণে ৯ দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দুর্বিষহ জীবনযাপন করে আসতে হয়েছে।
খিলগাঁওয়ের ঘটনার শিকার বেলায়েত হোসেন ও তাঁর ভাই গত ২৯ মার্চ কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন। বেলায়েত হোসেন আইজিপির কাছে পুরো বিষয়টি জানিয়ে একটি দরখাস্ত দেন। ওই আবেদনের ভিত্তিতে আইজিপির অফিস থেকে বিষয়টি তদন্তের জন্য পুলিশের মতিঝিল বিভাগের ডিসি আনোয়ার হোসেনকে নির্দেশ দেওয়া হয়। আনোয়ার হোসেন তদন্তের জন্য চিঠি পাঠান সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) সাইফুল ইসলামের কাছে।
সাইফুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দুই ভাইয়ের গ্রেপ্তারি পরোয়ানাটি ভুয়া ছিল- এটি ঠিক। কারা এই ভুয়া পরোয়ানা সৃজন করেছেন সেটি আসলে বের করা যায়নি।' তিনি বলেন, 'আমি এখনো তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি।' এক প্রশ্নের জবাবে এসি বলেন, 'কোথা থেকে কারা ডাকযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠাচ্ছে সেটা খুঁজে বের করা সত্যিই কঠিন। যখন কোনো চিঠি রিসিভ করা হয়, তখন আসল-নকল যাচাই-বাছাই করা কঠিন কাজ।'
বেলায়েত হোসেন জানান, গত বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ থানায় পৃথক দুটি মামলা দেখিয়ে তাঁদের চার ভাইয়ের বিরুদ্ধে ফের ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা গিয়েছে। এর মধ্যে বেলায়েত ও তাঁর ছোট ভাই মামুন ভূঁইয়ার নামে একটি সিআর মামলার কথা বলে ঢাকার সিএমএম কোর্ট থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সৃজন করা হয়েছে। বেলায়েত হোসেনের আইনজীবী মো. দেলোয়ার হোসেন গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ওয়ারেন্ট দেখেই বোঝা গেছে, এগুলো ভুয়া।' তিনি বলেন, যে ধারায় সিআর মামলা দেখানো হয়েছে আসলে সে ধরায় আদালতে নয়, থানায় জিআর মামলা হয়। এতেই ধরে নেওয়া যায় ওয়ারেন্টগুলো ভুয়া।'
বেলায়েত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ভুয়া ওয়ারেন্টের কারণে একবার জেল খেটে এলাম, এবার আবারও ভুয়া ওয়ারেন্ট এলো। এ অবস্থায় অসহায় হয়ে পড়েছি। আমি সরকারের কাছে দাবি জানাই আমাদের পরিবারটাকে রক্ষা করার জন্য।'
দেশের বিভিন্ন আদালত থেকে এ ধরনের ভুয়া পরোয়ানা জারির ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। ঢাকার আইনজীবীরা জানান, প্রায় প্রতিদিনই ঢাকার বিভিন্ন আদালতে এ ধরনের ভুয়া পরোয়ানায় গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তির দাবি করে বিভিন্ন মামলায় শুনানি হয়। ভুয়া পরোয়ানা জারির সংখ্যা মাসে কতটি- সে হিসাব কোথাও নেই। তবে এর সংখ্যা অনেক বলে মনে করেন আইনজীবীরা। এ ধরনের ভুয়া পরোয়ানায় নিরীহ ও নিরপরাধ লোকজন হয়রানির শিকার হচ্ছে।
ঢাকার আদালতের আইনজীবী মো. ইদ্রিস আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ভুয়া পরোয়ানামূলে অনেক আসামিকে গ্রেপ্তার করে ঢাকার আদালতে হাজির করা হয়। তিনি বলেন, ঢাকার আদালত এলাকায় একটি চক্র রয়েছে। দালাল শ্রেণীর চক্রটি মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রস্তুত করে থাকে। এ চক্রের সঙ্গে অসাধু কিছু আইনজীবীও জড়িত থাকতে পারেন বলে তিনি মনে করেন। আইনজীবী মো. হাফিজ জানান, শত্রুতার কারণে বিরোধী পক্ষকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে এ ধরনের হয়রানিমূলক পরোয়ানা সৃষ্টি করে পাঠানো হয়।
উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) প্রসিকিউশন আনিসুর রহমানও স্বীকার করেন এ ধরনের ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কথা। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মাঝেমধ্যেই ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কথা জানা যাচ্ছে। সাধারণত পুলিশের দায়িত্ব নয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা। তবে পুলিশ যদি বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে যে থানা বা আদালতের মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানাটি গিয়েছে, সেখানে যোগাযোগ করে সত্যতা জেনে নেয় তাহলে ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা-বলে গ্রেপ্তার এড়ানো সম্ভব হবে।'
একজন আইনজীবী জানান, সিআরপিসি (ফৌজদারি কার্যবিধির) ৮৩(১) ধারায় বলা আছে, পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের মাধ্যমে এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল করা হয়ে থাকে।
ফরম বিক্রি হয় বাইরে : গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু করার জন্য ছাপানো নির্দিষ্ট ফরম কিনতে পাওয়া যায় বাইরে। যে কেউ চাইলেই সে ফরম পুরান ঢাকার জজকোর্ট এলাকা থেকে কিনতে পারেন। আইনজীবীরা জানান, ফলে প্রতারকদের জন্য খুবই সহজ হয় পরোনায়া সৃষ্টিতে। কারো বিরুদ্ধে সত্যিকারভাবে ওয়ারেন্ট ইস্যু হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেই ফরম বাইরে থেকে কিনে এনে দেওয়া হয়। পরে সেটিতে সিল বসিয়ে ওয়ারেন্ট পাঠানো হয়। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, জজকোর্ট এলাকায় ভেণ্ডারের দোকানে এই ফরম বিক্রি করা হচ্ছে। এক টাকা করে এই ফরম কিনতে পাওয়া যায়। অ্যাডভোকেট মো. জামাল উদ্দিন খন্দকার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ভুয়া পরোয়ানা রোধ করতে হলে বাইরে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ফরম বিক্রি বন্ধ করতে হবে।'
যেভাবে করা হচ্ছে : অনেক আগে থেকেই ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সৃষ্টি হয়ে আসছে। শত শত মানুষ জেলও খেটে এসেছে। কিন্তু এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। গত বছর ১০ ডিসেম্বর পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ থানা পুলিশ জলিল মাস্টার নামের এক প্রতারককে গ্রেপ্তার করে। জলিল মাস্টারকে ভুয়া পরোয়ানা তৈরির কারিগর বলেও অনেকে চেনেন। ঢাকার আদালত এলাকায় জলিল মাস্টার ভুয়া পরোয়ানা তৈরির ব্যবসা করে থাকেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। জলিল মাস্টারের কাছ থেকে ভুয়া পরোয়ানা সৃষ্টির ফরম, চারটি আদালতের সিলমোহর উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তারের পরে তিনি স্বীকার করেন, কেউ প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে চাইলে তিনি ভুয়া পরোয়ানা তৈরি করে ডাকযোগে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেন। এতে তিনি মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে থাকেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, জামান নামের একজন ভুয়া আইনজীবীর নেতৃত্বে জজকোর্ট এলাকায় একটি চক্র এই ভুয়া পরোয়ানা সৃজনের সঙ্গে যুক্ত। চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছে অসাধু পুলিশ, পেশকার, পিয়নসহ কিছু অসাধু ব্যক্তিও। আদালতের ভুয়া সিল দিয়ে ভুয়া ওয়ারেন্ট তৈরি করে সেটি ডাক বিভাগের মাধ্যমে মেট্রোপলিটন এলাকায় ডিসি অফিস ও জেলায় এসপি অফিসে পাঠানো হয়। সেখান থেকে সংশ্লিষ্ট থানায় চলে যাওয়ার পর থানা পুলিশ যাচাই-বাছাই না করেই ভুক্তভোগীদের গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায়। আর ওয়ারেন্টটি ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার আগেই বেশ কদিন জেলে থাকতে হয় ভুক্তভোগীকে।
ভুয়া পরোয়ানার ভোগান্তির শিকার হন সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আইনজীবীরাও। এমনই একজন ভুক্তভোগী অ্যাডভোকেট মফিজুল ইসলাম। ভুয়া পরোয়ানায় তাঁকে ১৭ দিন জেল খাটতে হয়। মফিজুল ইসলাম গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, একটি মিথ্যা মামলায় তিনি ২০০৯ সালে খুলনা কারাগারে ছিলেন। ওই মামলায় জামিন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার ডেমরা থানার একটি হত্যা মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা যায় কারাগারে। পরে তাঁর নিয়োজিত আইনজীবী নিশ্চিত হন, তাঁর বিরুদ্ধে যে মামলায় পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে, সেই মামলারই কোনো অস্তিত্ব নেই। ওই ভুয়া পরোয়ানার কারণে তাঁকে বাড়তি ১৭ দিন জেলে থাকতে হয়। মফিজুল ইসলাম বলেন, '২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ডেমরা থানায় ১৫ নম্বরের একটি হত্যা মামলা দেখানো হয়। ওই মাসে ডেমরা থানায় মামলাই হয়েছিল ৯টি। এর পরও ভুয়া ওয়ারেন্টের কারণে আমাকে ১৭ দিন জেল খেটে আসতে হলো।'
ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার ফুলবাড়িয়া গ্রামের শহীদ মোল্লা, আসাদ মোল্লা ও মোদাচ্ছের মোল্লা জানান, তাঁদের নামে কোথাও মামলা থাকতে পারে- এ ভাবনা মাথায়ও ছিল না। এরই মধ্যে গত ১৩ জুলাই বোয়ালমারী থানা পুলিশ গিয়ে গ্রাম থেকে ওই তিনজনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসে। পুলিশ জানায়, ঢাকা সিএমএম কোর্ট থেকে একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এসেছে এই থানায়। তার ভিত্তিতেই তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এরপর ফরিদপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করার পর আদালত তাঁদের কারাগারে পাঠান। স্বজনরা আইনজীবী নিয়োগ করে জানতে পারেন, আসলে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাটিই ভুয়া।
গত ২০ মার্চ দুপুরে খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ার ১৯২/এ নম্বর ভবনের নিচতলায় 'শাহ মিরান জেনারেল স্টোর' নামের মুদি দোকান থেকে বেলায়েত হোসেন ভূঁইয়া এবং মামুনকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। বেলায়েত ও মামুন থানায় গিয়ে জানতে পারেন, তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ দেখায় তাঁদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। পরে তাঁদের নিয়োগকৃত আইনজীবী নিশ্চিত হন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানাটি জাল। চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার যে মামলায় তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এসেছে সেটি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে এক বছর আগে। এ ছাড়া ওই মামলার এজাহারে তাঁদের নামও নেই। অথচ দুই ভাইকে ভুয়া ওয়ারেন্টের কারণে ৯ দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দুর্বিষহ জীবনযাপন করে আসতে হয়েছে।
খিলগাঁওয়ের ঘটনার শিকার বেলায়েত হোসেন ও তাঁর ভাই গত ২৯ মার্চ কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন। বেলায়েত হোসেন আইজিপির কাছে পুরো বিষয়টি জানিয়ে একটি দরখাস্ত দেন। ওই আবেদনের ভিত্তিতে আইজিপির অফিস থেকে বিষয়টি তদন্তের জন্য পুলিশের মতিঝিল বিভাগের ডিসি আনোয়ার হোসেনকে নির্দেশ দেওয়া হয়। আনোয়ার হোসেন তদন্তের জন্য চিঠি পাঠান সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) সাইফুল ইসলামের কাছে।
সাইফুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দুই ভাইয়ের গ্রেপ্তারি পরোয়ানাটি ভুয়া ছিল- এটি ঠিক। কারা এই ভুয়া পরোয়ানা সৃজন করেছেন সেটি আসলে বের করা যায়নি।' তিনি বলেন, 'আমি এখনো তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি।' এক প্রশ্নের জবাবে এসি বলেন, 'কোথা থেকে কারা ডাকযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠাচ্ছে সেটা খুঁজে বের করা সত্যিই কঠিন। যখন কোনো চিঠি রিসিভ করা হয়, তখন আসল-নকল যাচাই-বাছাই করা কঠিন কাজ।'
বেলায়েত হোসেন জানান, গত বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ থানায় পৃথক দুটি মামলা দেখিয়ে তাঁদের চার ভাইয়ের বিরুদ্ধে ফের ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা গিয়েছে। এর মধ্যে বেলায়েত ও তাঁর ছোট ভাই মামুন ভূঁইয়ার নামে একটি সিআর মামলার কথা বলে ঢাকার সিএমএম কোর্ট থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সৃজন করা হয়েছে। বেলায়েত হোসেনের আইনজীবী মো. দেলোয়ার হোসেন গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ওয়ারেন্ট দেখেই বোঝা গেছে, এগুলো ভুয়া।' তিনি বলেন, যে ধারায় সিআর মামলা দেখানো হয়েছে আসলে সে ধরায় আদালতে নয়, থানায় জিআর মামলা হয়। এতেই ধরে নেওয়া যায় ওয়ারেন্টগুলো ভুয়া।'
বেলায়েত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ভুয়া ওয়ারেন্টের কারণে একবার জেল খেটে এলাম, এবার আবারও ভুয়া ওয়ারেন্ট এলো। এ অবস্থায় অসহায় হয়ে পড়েছি। আমি সরকারের কাছে দাবি জানাই আমাদের পরিবারটাকে রক্ষা করার জন্য।'
দেশের বিভিন্ন আদালত থেকে এ ধরনের ভুয়া পরোয়ানা জারির ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। ঢাকার আইনজীবীরা জানান, প্রায় প্রতিদিনই ঢাকার বিভিন্ন আদালতে এ ধরনের ভুয়া পরোয়ানায় গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তির দাবি করে বিভিন্ন মামলায় শুনানি হয়। ভুয়া পরোয়ানা জারির সংখ্যা মাসে কতটি- সে হিসাব কোথাও নেই। তবে এর সংখ্যা অনেক বলে মনে করেন আইনজীবীরা। এ ধরনের ভুয়া পরোয়ানায় নিরীহ ও নিরপরাধ লোকজন হয়রানির শিকার হচ্ছে।
ঢাকার আদালতের আইনজীবী মো. ইদ্রিস আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ভুয়া পরোয়ানামূলে অনেক আসামিকে গ্রেপ্তার করে ঢাকার আদালতে হাজির করা হয়। তিনি বলেন, ঢাকার আদালত এলাকায় একটি চক্র রয়েছে। দালাল শ্রেণীর চক্রটি মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রস্তুত করে থাকে। এ চক্রের সঙ্গে অসাধু কিছু আইনজীবীও জড়িত থাকতে পারেন বলে তিনি মনে করেন। আইনজীবী মো. হাফিজ জানান, শত্রুতার কারণে বিরোধী পক্ষকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে এ ধরনের হয়রানিমূলক পরোয়ানা সৃষ্টি করে পাঠানো হয়।
উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) প্রসিকিউশন আনিসুর রহমানও স্বীকার করেন এ ধরনের ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কথা। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মাঝেমধ্যেই ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কথা জানা যাচ্ছে। সাধারণত পুলিশের দায়িত্ব নয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা। তবে পুলিশ যদি বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে যে থানা বা আদালতের মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানাটি গিয়েছে, সেখানে যোগাযোগ করে সত্যতা জেনে নেয় তাহলে ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা-বলে গ্রেপ্তার এড়ানো সম্ভব হবে।'
একজন আইনজীবী জানান, সিআরপিসি (ফৌজদারি কার্যবিধির) ৮৩(১) ধারায় বলা আছে, পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের মাধ্যমে এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল করা হয়ে থাকে।
ফরম বিক্রি হয় বাইরে : গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু করার জন্য ছাপানো নির্দিষ্ট ফরম কিনতে পাওয়া যায় বাইরে। যে কেউ চাইলেই সে ফরম পুরান ঢাকার জজকোর্ট এলাকা থেকে কিনতে পারেন। আইনজীবীরা জানান, ফলে প্রতারকদের জন্য খুবই সহজ হয় পরোনায়া সৃষ্টিতে। কারো বিরুদ্ধে সত্যিকারভাবে ওয়ারেন্ট ইস্যু হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেই ফরম বাইরে থেকে কিনে এনে দেওয়া হয়। পরে সেটিতে সিল বসিয়ে ওয়ারেন্ট পাঠানো হয়। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, জজকোর্ট এলাকায় ভেণ্ডারের দোকানে এই ফরম বিক্রি করা হচ্ছে। এক টাকা করে এই ফরম কিনতে পাওয়া যায়। অ্যাডভোকেট মো. জামাল উদ্দিন খন্দকার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ভুয়া পরোয়ানা রোধ করতে হলে বাইরে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ফরম বিক্রি বন্ধ করতে হবে।'
যেভাবে করা হচ্ছে : অনেক আগে থেকেই ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সৃষ্টি হয়ে আসছে। শত শত মানুষ জেলও খেটে এসেছে। কিন্তু এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। গত বছর ১০ ডিসেম্বর পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ থানা পুলিশ জলিল মাস্টার নামের এক প্রতারককে গ্রেপ্তার করে। জলিল মাস্টারকে ভুয়া পরোয়ানা তৈরির কারিগর বলেও অনেকে চেনেন। ঢাকার আদালত এলাকায় জলিল মাস্টার ভুয়া পরোয়ানা তৈরির ব্যবসা করে থাকেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। জলিল মাস্টারের কাছ থেকে ভুয়া পরোয়ানা সৃষ্টির ফরম, চারটি আদালতের সিলমোহর উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তারের পরে তিনি স্বীকার করেন, কেউ প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে চাইলে তিনি ভুয়া পরোয়ানা তৈরি করে ডাকযোগে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেন। এতে তিনি মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে থাকেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, জামান নামের একজন ভুয়া আইনজীবীর নেতৃত্বে জজকোর্ট এলাকায় একটি চক্র এই ভুয়া পরোয়ানা সৃজনের সঙ্গে যুক্ত। চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছে অসাধু পুলিশ, পেশকার, পিয়নসহ কিছু অসাধু ব্যক্তিও। আদালতের ভুয়া সিল দিয়ে ভুয়া ওয়ারেন্ট তৈরি করে সেটি ডাক বিভাগের মাধ্যমে মেট্রোপলিটন এলাকায় ডিসি অফিস ও জেলায় এসপি অফিসে পাঠানো হয়। সেখান থেকে সংশ্লিষ্ট থানায় চলে যাওয়ার পর থানা পুলিশ যাচাই-বাছাই না করেই ভুক্তভোগীদের গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায়। আর ওয়ারেন্টটি ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার আগেই বেশ কদিন জেলে থাকতে হয় ভুক্তভোগীকে।
No comments