নারীর সুস্বাস্থ্য ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে পুষ্টির ভূমিকা
আলোচনা আব্দুল কাইয়ুম আমাদের দেশে পরিবারের মধ্যে নারী-পুরুষে বৈষম্য দেখা যায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, বিনোদন—সর্বক্ষেত্রে পুরুষের অগ্রাধিকার থাকে। বিশ্বে অনেক আগেই নারীর পুষ্টির বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। আমাদের দেশে পুষ্টিতে নারীরা পিছিয়ে আছে। নারীর পুষ্টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
একজন সুস্থ নারী একটি সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে পারেন। তাই নারীর পুষ্টির ওপর দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে।
মুহম্মদ হুমায়ুন কবির
আজকের আলোচ্য বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টির ওপর আগেই অনেক বেশি জোর দেওয়া উচিত ছিল। মানুষ এখন পুষ্টির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পুষ্টির বিষয়টিতে বিতর্ক রয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে কথা বলতে হয়েছে। পুষ্টির ক্ষেত্রে আমরা কোন ধারায় যাচ্ছি, এ নিয়ে একধরনের পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একসময় বিআইএনপি ও এনএনপি (বাংলাদেশ ইনটিগ্রেটেড নিউট্রিশন প্রোগ্রাম ও ন্যাশনাল নিউট্রিশন প্রজেক্ট) কর্মসূচি করেছে। ভার্টিকাল কর্মসূচি: প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব করা হয়েছে। ৪৮৩টি উপজেলার মধ্যে প্রায় ১৬৭টিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পুষ্টি কার্যক্রম চলছে।
শহরাঞ্চলে পুষ্টির কোনো কার্যক্রম নেই। কাজেই দেশের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে পুষ্টির ক্ষেত্রে যে অর্জন, সেটা খুবই সামান্য। এর কোনো প্রভাব লক্ষ করা যায় না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পুষ্টিকে পৃথক কার্যক্রম হিসেবে পরিচালনা করেছে। পুষ্টির বিষয়টি মূলধারায় ছিল না। আমরা এটিকে মূল স্রোতে নিয়ে আসার কথা বলেছি। পুষ্টি কোনো একক মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। এর সঙ্গে কয়েকটি মন্ত্রণালয় জড়িত। বিশেষ করে খাদ্য, কৃষি ও মৎস্য মন্ত্রণালয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কাজটি করে, তখন অনেকের ধারণা হয় যে কাজটি শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। এখন সবার দায়িত্ব ঠিক করে নিতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যদি নেতৃত্বে থাকে, তাহলে তার দায়িত্ব কতটুকু, অন্যদের কতটুকু। আমাদের অতীত কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা কী, এসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। পুষ্টির ক্ষেত্রে পাঁচ বছর মেয়াদি হেল্থ পপুলেশন অ্যান্ড নিউট্রিশন সেক্টর ডেভেলপমেন্ট কর্মসূচির আওতায় নারী-শিশু সবার পুষ্টির বিষয় বিবেচনা করা হয়েছে।
আব্দুল কাইয়ুম
আমাদের আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হলো নারীর পুষ্টির দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ দিকগুলো যেন সামনে আসে এবং সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এবার বলবেন তাসকীন চৌধুরী।
তাসকীন চৌধুরী
স্বাস্থ্য ও পুষ্টি একে অন্যের সঙ্গে জড়িত। স্বাস্থ্যে ছাড়াও অপুষ্টির প্রভাব পড়ে অর্থনীতি, শিক্ষা ও বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রে। গত চার দশকে বাংলাদেশে, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যার কিছু সূচকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। তথাপি অপুষ্টি বাংলাদেশের জন্য এখনো একটি বড় সমস্যা, আর এর প্রধান শিকার আমাদের নারী ও শিশুরা। এক হিসাবমতে, দেশের ৩০ শতাংশ নারী মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছেন, ১৫ শতাংশ খর্বকায়ত্বের শিকার। প্রতি ১০ জন নারীর চারজনই রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন। ৩৯ শতাংশ নারীর মধ্যে আয়োডিনের ঘাটতি রয়েছে। আবার অন্যদিকে অতিপুষ্টি আমাদের দেশে ধীরে ধীরে বাড়ছে। এক তথ্য থেকে জানা যায়, এশিয়ান কাটঅফ ব্যবহার করে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ নারীর বিএমআই ২৩-এর ওপরে। অপুষ্টির এই চিত্র সত্যি ভয়াবহ। বাংলাদেশের মতো ‘স্বল্প আয়ের’ দেশকে এর জন্য মূল্য দিতে হয় প্রতিবছর প্রায় ৭০০ কোটি টাকা।
একজন অপুষ্টিতে আক্রান্ত নারী কেবল নিজেই ভুক্তভোগী হন না; তিনি জন্ম দেন কম ওজনের শিশুর, যাদের সঠিক শারীরিক বৃদ্ধি হয় না, ঘন ঘন রোগাক্রান্ত হয় আর সারা জীবন রোগ বা মৃত্যুঝুঁকির সঙ্গে বসবাস করে। এভাবেই অপুষ্টির দুষ্টচক্র এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে যায় আর চাপ সৃষ্টি করে দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবার ওপর।
গত দুই দশকে পোশাকশিল্প আর ক্ষুদ্র ঋণ প্রণীত ব্যবসায় বাংলাদেশের নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। এই বিশাল জনসম্পদ যদি অপুষ্টির শিকার হয়, তাহলে আর্থিক অসচ্ছলতায় পড়েন তিনি নিজে, তাঁর পরিবার এবং সর্বোপরি জাতি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, অপুষ্টির কারণে কর্মক্ষমতা ১০-১৫ শতাংশ আর জাতীয় উৎপাদন ৫-১০ শতাংশ কমে যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, খর্বকায় শিশুরা দেরিতে স্কুলে যায়, নিয়মিত স্কুলে যেতে পারে না আর একই ক্লাসে বারবার অধ্যয়ন করে। ভিটামিন এ-র অভাবে শিশু ঘন ঘন অসুখে ভোগে আর তাই ঘন ঘন স্কুল কামাই করে।
বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই বরাদ্দ খুবই কম। তবে পুষ্টির মতো বা নারী পুষ্টির মতো জরুরি বিষয়টি শুধু স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত নয়। নারীরা যেহেতু জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখতে পারেন, তাই পুষ্টিকে অন্যান্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরেরও বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া উচিত। এর জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় সাধন।
আনোয়ার হোসেন শিকদার
১৯৯৪ সাল থেকে প্ল্যান বাংলাদেশে কাজ শুরু করে। কিন্তু পুষ্টির কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৩-০৪ সাল থেকে। বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে পুষ্টি বিষয়ে কাজ করে এ পর্যন্ত মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট, ইনটিগ্রেটেড নিউট্রিশন প্রজেক্ট, ইনটিগ্রেটেড ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন সিকিউরিটি প্রজেক্ট নামে তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। তা ছাড়া প্ল্যান বাংলাদেশ ‘প্রমোশন অব এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং’ নামে একটি প্রকল্প ২০১২ সালের মার্চ মাসে শেষ করেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ২৯ হাজার গর্ভবতী মা এবং ৪৬ হাজার প্রসূতি মা উপকৃত হয়েছেন। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৯৩ শতাংশ মা তাঁদের শিশুদের শালদুধ এবং ৬৫ শতাংশ মা তাঁদের সন্তানদের শুধুমাত্র বুকের দুধ পান করিয়েছেন। ৬২ শতাংশ পুরুষকেও আমরা এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছি। এখন আমরা ‘উইনি’ নামে আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি, যেখানে নারীর পুষ্টিসহ অন্যান্য বিষয় থাকবে। গাজীপুর, দিনাজপুর ও নীলফামারীর ২৫টি ইউনিয়নে এই প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়িত হচ্ছে। এখান থেকে গর্ভবতী মাসহ দুই বছরের নিচের দুই লাখেরও অধিক জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে বলে আশা করছি। এই প্রকল্পের মাধ্যমে মায়েরা বাড়িতে বাগান ও মুরগির খামারের ওপর প্রশিক্ষণ পাবেন।
প্রকল্প থেকে মায়েরা যেমন পুষ্টি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করছেন, তেমন কিশোরীরা স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জেন্ডার বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পারবে। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, পুষ্টি বিষয়ে শুধু নারীদের সচেতন করলে বেশি ফল পওয়া যায় না। এর জন্য আমরা পুরুষদেরও সম্পৃক্ত করেছি।
মো. এখলাসুর রহমান
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সুস্থ মায়ের জন্য অত্যন্ত বাস্তবভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের ৩০ শতাংশ মা অপুষ্টিতে ভুগছেন। ৪৬ শতাংশ গর্ভবতী মা অ্যানিমিয়ায় ভুগছেন। এ ছাড়া, বিভিন্ন রোগে মায়েরা আক্রান্ত হচ্ছেন। সরকারি কার্যক্রমের একটা প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে মায়েদের অপুষ্টি থেকে রক্ষা করা। আমরা দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সামনে এনেছি। এক. পুষ্টিকে মূল স্রোতধারায় আনার উদ্যোগ নিয়েছি। ইতিপূর্বে ভিটামিন ‘এ’ কভারেজ কার্যক্রমসহ বিভিন্ন কার্যক্রম মূল স্রোতধারায় এনে সফলতা অর্জন করেছি। সে কারণে নারীর পুষ্টিকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছি এবং মূল স্রোতধারায় আনার ব্যবস্থা করছি। দুই. পুষ্টি কার্যক্রমকে সমন্বিত করে পরিচালনা করার পরিকল্পনা করেছি। দেশে আরও ১৩টি মন্ত্রণালয় পুষ্টি কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এদের একত্র করে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটি ব্যাপকভিত্তিক পুষ্টি কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এই কাজগুলো ঠিকমতো পরিচালিত হওয়ার জন্য কমিটি আছে। জাতীয় পুষ্টিসেবার আওতায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে আচরণের পরিবর্তন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সাপ্লিমেন্টেশনসহ ২০টি কার্যক্রম রয়েছে। এই ২০টি কার্যক্রমের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি হলো সমগ্র বাংলাদেশে ও হাসপাতালগুলোতে পুষ্টি কার্যক্রম পরিচালিত করা। দেশের ৮০টি উপজেলায় কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে যাঁরা স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। গ্রামাঞ্চলের মা ও শুিশুদের অপুষ্টি বের করার পদ্ধতি শিখিয়েছি। অপুষ্টি নির্ণয়ের পদ্ধতির মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশের মা ও শিশুদের অপুষ্টি নির্ণয় করে তাদের পুষ্টির আওতায় আনার ব্যবস্থা করা যাবে।
এস কে রায়
মায়ের পুষ্টি এতটা গুরুত্বপূর্ণ যে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০১১ সালের জরিপে দেখা যায়, নারীর গড় উচ্চতা ১৫০ সেন্টিমিটার। ১৪০ থেকে ১৫০ সেন্টিমিটার উচ্চতায় গর্ভধারণ করলে তাঁরা ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। সে হিসাবে দেশের অর্ধেক নারী গর্ভঝুঁকিতে রয়েছেন, যা মা ও সন্তান উভয়ের জন্য বিপদ হতে পারে। দেশের মায়েদের গড় ওজন ৫০ কেজি। এর অর্থ হচ্ছে, ৫০ শতাংশ নারীর ওজন ৫০ কেজির নিচে। উচ্চতা ও ওজনের অনুপাত হিসাব করে যে বিএমআই (বডি মাস ইনডেক্স) করা হয়, তা ১৮ দশমিক ৫-এর নিচে হলে ক্রনিক এনার্জি ডেফিসিয়েন্সি বলে ধরা হয়। এখন গড়ে দেশের ৩০ শতাংশ নারী ক্রনিক এনার্জি ডেফিসিয়েন্সির নিচে। আবার শহরে ২৫ শতাংশ ও গ্রামে ৮ শতাংশ নারীর বিএমআই ২৫-এর ওপরে। তাঁরা হূদরোগের ঝুঁকিতে আছেন। দেশে ৩৬ শতাংশ শিশুর জন্ম কম ওজনে, অর্থাৎ আড়াই কেজির নিচে। এই শিশুদের একটা অংশ নারী, যাদের ১৮ বছরের নিচে বিয়ে হয়। পারিবারিক চাপের কারণে বিয়ের এক বছরের মধ্যে সন্তান ধারণ করতে হয়। এঁরা আবার কম ওজনের সন্তান জন্ম দেয়। এভাবে দুর্বল মা ও দুর্বল সন্তানের একটি চক্র গড়ে উঠছে। জন্ম থেকে প্রতিটি পর্যায়ে এই নারীরা ঝুঁকি বহন করছে। অন্যদিকে খাদ্যনিরাপত্তা জরিপ থেকে দেখা যায়, ৪০ শতাংশ মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নেই। অর্থাৎ, এত বড় একটা জনগোষ্ঠী খুব প্রান্তিক জীবন যাপন করে। দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ প্রোটিন, খনিজ লবণ ইত্যাদি উপাদান থেকে বঞ্চিত।
পুষ্টির ঘাটতিজনিত কারণে একটা বড় জনগোষ্ঠী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে বিশাল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে। এই অর্থ দিয়ে যদি তাদের পুষ্টির ব্যবস্থা করা যেত, তাহলে এত হাসপাতাল ও চিকিৎসকের প্রয়োজন হতো না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করব, এই খাতে বিনিয়োগ করা হোক। অবশ্যই এই বিনিয়োগ ফেরত পাওয়া যাবে। আজকে চীনারা রোগ প্রতিরোধের ওপর জোর দিয়ে হাসপাতালের খরচ অনেক কমিয়ে ফেলেছে এবং সুস্থ জীবন যাপন করছে। শেষ কথা হলো, অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, যদি গঠনমূলক পরিকল্পনা ও সত্যিকার অর্থে এ ক্ষেত্রে কাজ করার ইচ্ছ থাকে, তাহলে দেশীয় ব্যবস্থাপনায় অনেক কিছু করা যায়।
আব্দুল কাইয়ুম
আলোচনা থেকে দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে, পুষ্টি বাড়ালে কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে আর্থিক সমৃদ্ধি আসে এবং অসুস্থতা কমে গিয়ে চিকিৎসক ও হাসপাতালের খরচ কমে যায়। এবার শুনব জেবা মাহমুদের কাছ থেকে।
জেবা মাহমুদ
আজ থেকে স্লোগান হওয়া উচিত ‘নারীর প্রতি আর কোনো বৈষম্য, অবহেলা নয়’। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। তাদের পিছিয়ে রেখে সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়। পুষ্টির অভাবে কর্মদক্ষতা কমে যায়। অধিকাংশ নারীকেই ঘর-সংসারের কাজ করতে হয়। ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে হয়। পুষ্টির ঘাটতির জন্য নারীরা এই কাজগুলো সঠিকভাবে করতে ব্যর্থ হন। ফলে ছেলেমেয়েদের পরিমিত পরিচর্যা হয় না। সংসারজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মায়ের অপুষ্টি শুধু মাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, তাঁর গর্ভজাত সন্তানকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
গর্ভধারণ থেকে শিশুর বয়স দুই বছর পর্যন্ত, অর্থাৎ এক হাজার দিন মায়ের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় মায়ের অপুষ্টি থাকলে কম ওজনের অপুষ্ট সন্তান হবে। এক হিসাবমতে, দেশের প্রায় আড়াই কোটি নারী আয়রন, আয়োডিনসহ বিভিন্ন খাদ্য উপাদানের ঘাটতিতে ভুগছেন। এঁরা যদি একটি করে শিশু জন্ম দেন, তাহলেও আড়াই কোটি শিশু জন্ম নেবে অল্প আয়রন, আয়োডিনসহ অন্যান্য উপাদানের অভাব নিয়ে। এই শিশুরা রক্তশূন্যতায় ভুগবে। আয়োডিনের অভাবে মেধ বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। আরও নানাবিধ সমস্যায় ভুগতে থাকবে।
নারীর পুষ্টির বিষয়টিকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে মূলধারায় নিয়ে আসতে হবে। এবং সরকারের নেতৃত্বে, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সবাই একসঙ্গে এগিয়ে এলে এই সমস্যা থেকে নারীরা মুক্তি পাবেন। তাহলে আমরা পাব সমৃদ্ধ মা, বলিষ্ঠ শিশু ও আলোকিত ভবিষ্যৎ।
খুরশীদ তালুকদার
নারীর পুষ্টির ক্ষেত্রে আমাদের জ্ঞানের অভাব রয়েছে। গতানুগতিক কিছু বিষয়কে পুষ্টির মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করছি। পুষ্টির মাপকাঠি হিসেবে ১৮ দশমিক ৫ বিএমআইকে ধরা হচ্ছে। অথচ বিগত ১৪ বছরের হিসাব অনুযায়ী, পুষ্টিবঞ্চিত মানুষের হার ৫৩ শতাংশ থেকে ২৬ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ, অপুষ্টি অর্ধেকে নেমে গেছে। এক গবেষণায় বলা হচ্ছে, বিএমআই ২৩ শতাংশের ওপরে গেলেই ডায়াবেটিস, হূদরোগ, ক্যানসার, স্ট্রোকসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। দেশে এখন এত অধিকসংখ্যক নারী-পুরুষের বিএমআই ২৩ শতাংশের ওপরে, যা জাতীয় সমস্যা তৈরি করছে। ২০০৬ সালে ছয়টি বিভাগীয় শহরের বস্তি এলাকার জরিপে দেখা যায়, সেখানকার নারীদের মধ্যে ২৫ শতাংশ এবং পুরুষের মধ্যে ১৭ শতাংশ হাইপারটেনশনে ভুগছেন। ডায়াবেটিস নারীর মধ্যে ৯ এবং পুরুষের মধ্যে ১৩ শতাংশ। যারা বস্তি এলাকার বাইরে, তাদের অবস্থা বুঝতে কষ্ট হয় না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে এসব রোগের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে।
পুষ্টি কার্যক্রমের মধ্যে অতিপুষ্টি, ডায়াবেটিস, হাইপার টেনশনসহ অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। একজন কম ওজন ও অন্যজন বেশি ওজন—উভয় নারীকেই স্বাস্থ্যসেবার কার্যক্রমের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।
২০০৮ সালের ল্যানসেট নিউট্রিশন সিরিজে প্রতিটি দেশের মায়েদের জন্য পুষ্টি কার্যক্রমের মধ্যে ছিল আয়রন ট্যাবলেট সরবরাহ—সেটা আমরা করছি। মাল্টিনিউট্রিয়েন্ট পাউডারের ব্যাপারে কাজ হচ্ছে। আয়োডিনযুক্ত লবণ সর্বত্র পাওয়া যাচ্ছে। মায়েদের যদি ক্যালসিয়াম ঠিকমতো না থাকে, তাহলে সন্তান প্রসবের সময় তাঁদের রক্তচাপ ও খিঁচুনি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই পুষ্টির সঙ্গে ক্যালসিয়ামকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
ফেরদৌসী বেগম
খাবারের পর্যাপ্ততা, প্রাপ্যতা ও সঠিক ব্যবহারের ওপর পুষ্টি নির্ভর করে। আজকের আলোচনা থেকে আরেকটি বিষয় ধারণা হলো যে এটি একক কোনো মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো আয়োজন করলে অন্যান্য মন্ত্রণালয়কে আমন্ত্রণ জানাতে হবে। একজন মায়ের পুষ্টির নিশ্চয়তার জন্য পরিবারের সবাইকে লক্ষ রাখতে হবে। পারিবারিক সহযোগিতা পুষ্টির একটি বড় দিক। পুষ্টির জন্য দেশব্যাপী প্রচার করতে হবে। জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যতালিকায় নির্দিষ্টভাবে পুষ্টি কর্মসূচি রেখে কার্য পরিচালনা করলে মায়েরা বেশি উপকৃত হবে।
অপুষ্টি ও অতিপুষ্টি—এ দুটো বিষয়ও মানুষকে জানাতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। শেষে বলতে চাই, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রধান ব্যক্তি ও এনজিওগুলোকে নিয়ে একসঙ্গে বসে একটি বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে পুষ্টি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময় পর পর কার্য মূল্যায়নের ব্যবস্থা করতে হবে।
শুভ্রা চাকমা
অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। দেশে খাদ্যের সমস্যা রয়েছে। পুষ্টির জন্য প্রথমে দরকার খাদ্যের নিরাপত্তা। শুধু খাদ্যের নিরাপত্তা হলেও হবে না, দরকার সুষম খাদ্য। বর্তমানে ইপিএ কর্মসূচির মাধ্যমে শিশুদের আটটি রোগের প্রতিষেধক দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে মেয়েদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হয়। মেয়েরা ১৫ বছর অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে ধনুষ্টংকারের প্রতিষেধক টিকা দিয়ে মা ও নবজাতককে ধনুষ্টংকারের হাত থেকে রক্ষা করি। ইপিআই কর্মসূচির মাধ্যমে মেয়েদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। পাশাপাশি বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে ৫৩টি উপজেলায় গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের বিশেষ সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। খুব প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে নারী, কিশোরী ও শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছি।
মো. ইফতেখার হাসান খান
নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে বলতে চাই। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা পরিমিত থাকলে কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়ে। আয়রনের ঘাটতি দেখা দিলে দক্ষতা কমে যায়। মা ও শিশুর মধ্যে আয়োডিনের ঘাটতি থাকলে উপস্থিত বুদ্ধি কমে যায়। আয়োডিনের অভাব থাকলে মায়েরা ভালো অভিভাবকত্ব করতে পারেন না। দই খেলে চিন্তা করার ক্ষমতা বাড়ে।
এই কাজের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করতে হবে। আয়োডিন, আয়রন ইত্যাদি উপাদানের অভাবে কী কী ক্ষতি হয়, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে। যদি বলি অ্যানিমিয়া হয়, তাহলে তারা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেবে না। যদি বলা হয় যে নানাবিধ অসুখ-বিসুখে পড়বে, পড়ালেখার দক্ষতা কমে যাবে, পরীক্ষার ফল ভালো হবে না, নিজেদের আয় ও উৎপাদনক্ষমতা কমে যাবে, দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে পড়ে জীবনে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না; তাহলে শিক্ষার্থীরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে।
শহরাঞ্চলে মায়েরা শিশুদের শাক-সবজির পরিবর্তে আমিষ ও চর্বিজাতীয় খাবার বেশি খাওয়ান। শাক-সবজি খাওয়ান না। তাই শিশুরা স্থূলকায় হয়। যেটা শিশুদের জন্য ক্ষতিকর। শহরের মায়েদের এ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
এস এম মোস্তাফিজুর রহমান
আয়রন, আয়োডিনের অভাবে আমাদের অনেক সমস্যা হয়। এশিয়া মহাদেশে কেউ অলিম্পিকে প্রথম হতে পারেনি। কারণ, আয়রনের অভাবে অক্সিজেনের স্বল্পতা। তৃপ্তির মানদণ্ডে খাবার রান্না করা হয়, পুষ্টির মানদণ্ডে নয়। বাজার থেকে খাবার কেনার পর টেবিলে আসা পর্যন্ত ৩৫ শতাংশ পুষ্টি নষ্ট হয়ে যায়। খাদ্যে যেটুকু নিরাপত্তা আছে, তাকে কাজে লাগাতে পারছি না। দেশে প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন গর্ভবতী, যার বয়স ১৮ বছরের নিচে। প্রতি তিনজন শিশুর মধ্যে একজন শিশু জন্ম নিচ্ছে, যার ওজন আড়াই কেজির নিচে।
মানুষের জন্মের পর আর কোনো মাথার কোষ তৈরি হয় না। জন্মের দুই বছর পর্যন্ত কোষগুলো একে অন্যের সঙ্গে জোড়া লাগে। এই কাজের জন্য পুষ্টির প্রয়োজন হয়। খাওয়ার আগে সবাইকে হাত ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। পুষ্টি কার্যক্রম শুধু হাসপাতালে সীমাবদ্ধ না রেখে স্কুল-কলেজ, দুর্গম এলাকা—সব জায়গায় পৌঁছে দিতে হবে। বিশেষ করে স্কুল-কলেজগুলোতে পুষ্টি ক্লাব তৈরি করতে হবে, যাতে নিজের জীবনে পুষ্টিজ্ঞান কাজে লাগাতে পারে। দেশের সব সেবাকেন্দ্রে সন্তান জন্মের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যেন ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। শেষ কথা হলো, পুষ্টির ক্ষেত্রে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হলে সবার মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন।
আব্দুল কাইয়ুম
আমরা যদি পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত নিই, মায়ের শরীর ভালো রাখতে হবে, প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান দিতে হবে এবং দুটির বেশি সন্তান হবে না; তাহলে মায়ের সুস্বাস্থ্য ও কর্মদক্ষতা নিশ্চিত হতে পারে। এখন বলবেন মোহাম্মদ শরীফ।
মোহাম্মদ শরীফ
একটি অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করি। দেশের মায়েদের এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগতে পারে। একসময় চিটাগংয়ের বাকুলিয়ায় কাজ করি। একজন গর্ভবতী রোগী ছিলেন, তিনি চিটাগং কলেজের প্রভাষক। আমি তাঁকে নিয়মিত খওয়াদাওয়ার কথা বলতাম। আয়রন, আয়োডিনসহ বিভিন্ন ভিটামিনের কথা বলতাম। একপর্যায়ে তিনি খুবই দুর্বল এবং কম ওজনের একটি সন্তান জন্ম দিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তিনি শরীর ঠিক রাখার জন্য ভিটামিনসহ কোনো খাবারই ঠিকমতো খাননি এবং শিশুর জন্মের পর বুকের দুধ পান করাননি। পরে সেই শিশুটি এতটাই অসুস্থ হলো যে তাকে বাঁচানোই কষ্টকর হয়ে গেল। এখনো সে দুর্বল হয়েই বেঁচে আছে। তার পক্ষে ভালো কিছু করা সম্ভব হয়নি। পরে সেই মা অনেক কেঁদেছেন। কিন্তু তখন সময় অনেক চলে গেছে। তাই মায়েদের বলব, সন্তানের জীবন ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবেন না।
পরিবার পরিকল্পনায় এখন অনেক নারীকর্মী আছেন। তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে শুধু পরিবার পরিকল্পনার কথা বলবেন কেন। আমরা উদ্যোগ নিয়েছি, সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে পুষ্টিসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁরা কথা বলবেন। আমার বিশ্বাস, এটি করলে পুষ্টির ক্ষেত্রে আরও একধাপ এগিয়ে যাব। কমিউনিটি ক্লিনিক ও পুষ্টির ক্ষেত্রে যত ধরনের সহযোগিতা আমাদের করার সুযোগ আছে, সবটাই করব।
সেলিনা আমিন
দেশব্যাপী সচেতনতা বাড়ানোর কার্যক্রম গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। নারীশক্তির উন্নয়ন হচ্ছে একটি দেশের উন্নয়নের সূচক। আমরা টিকার কথা বলছি, কিন্তু একবারও গর্ভাশয় ক্যানসার রোধে টিকার কথা বলছি না। আমরা সাধারণত মায়ের স্বাস্থ্যের কথা বলে থাকি, কিন্তু নারীর স্বাস্থ্য ও পুষ্টির কথা বলছি না। শুধু মাকে নিয়ে ভাবলে মায়ের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির উন্নয়ন হবে না। যদি বড় পরিসরে নারীসমাজ নিয়ে ভাবি, কেবল তখনই মায়ের উন্নয়ন হওয়া সম্ভব। এখনো নারীর জন্য সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত বাধা রয়েছে। প্ল্যান এ বিষয়ে কাজ করছে।
মাঠে কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পেরেছি, নারীর পুষ্টি খুবই জরুরি একটি বিষয়। এ ক্ষেত্রে পুরুষের ভূমিকা রয়েছে। তাই এ কাজের জন্য কিছু পুরুষকে নিয়োগ দিয়েছি। প্ল্যানের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নারী ও শিশুর উন্নয়ন করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। যখন কমিউনিটিতে কাজ করি, তখন সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করি। কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, উপজেলা পর্যায়ে সমস্যা কম। সবাই মিলেমিশে কাজ করতে পারছি। কিন্তু অন্যান্য পর্যায়ে সমস্যা বেশি। সেখানে সমন্বয়ের অভাব, সিদ্ধান্ত গ্রহণে জটিলতাসহ নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। যেকোনো কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য সিদ্ধান্ত ও সমন্বয় জরুরি।
ইকবাল কবীর
আজকের আলোচনার শিরোনাম অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী, তাদের পেছনে রেখে সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। নারী উন্নয়নের জন্য খাদ্য-পুষ্টি সবই অপরিহার্য উপাদান। ১৯৯৮ সালে পুষ্টি বিষয়ে কিছু কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। তখন অপুষ্টি ও অতিপুষ্টি—দুটোই লক্ষ করেছি। আমাদের দুটোই মোকাবিলা করতে হবে। মায়েদের পুষ্টির সঙ্গে সঙ্গে কিশোরী মা ও কিশোরীদের পুষ্টির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। শেষে দুটো জায়গা বলতে চাই—এক. নবদম্পতিদের পরামর্শদানের ব্যবস্থা করা। সারা জীবন তাঁরা একসঙ্গে অতিবাহিত করবেন। জীবনের শুরুতে একটি রুটিন তৈরি করে দিতে পারলে জীবন অনেক পরিচ্ছন্ন হবে। দুই. আগামী ১০ বছর পর দেশে বয়স্ক লোকের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। অপুষ্টিসহ তাঁরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবেন। সেই অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
খন্দকার মো. সিফায়েত উল্লাহ
জাতীয় পুষ্টি পরিষদ প্রায় অকার্যকর বিষয়ে যে সংবাদ আজকে প্রথম আলোয় এসেছে, তার সঙ্গে একমত হতে পারছি না। জাতীয় পুষ্টি পরিষদ নামেমাত্র প্রতিষ্ঠান আমরা দেখতে চাই না। একে মূল স্রোতে আনার জন্য কাজ চলছে। আমরা বুঝতে পারছি, পুষ্টিকে মূলধারায় না আনতে পারলে এ ক্ষেত্রে সার্বিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। কোন খাবারে কোন ভিটামিন আছে, কী খাওয়া এবং কী না খাওয়া দরকার, এখন মানুষ তা জানে। সকালবেলা রুটি ও মিষ্টি, বাজারে গিয়ে চা-পাউরুটি খাচ্ছে। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আরও প্রচার দরকার। পাঠ্যপুস্তকে পুষ্টি বিষয়ে যেভাবে আছে, সেটা যথেষ্ট না। শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে আরও বিস্তারিতভাবে লিখতে হবে। যাতে পরে তারা এটিকে প্রয়োগ করতে পারে। কাজটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
আলোচনায় রান্না-প্রক্রিয়ার বিষয় এসেছে। এটা সত্যি কথা, দেশে খাদ্য রান্নার প্রক্রিয়া পরিবর্তন করতে হবে। রান্নার সময় দেশের অধিকাংশ পরিবার পুষ্টির বড় অংশ নষ্ট করে ফেলে। এই দিকটি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, এটা শুধু চালের হিসাবে। খাদ্যের অন্য বিষয়গুলো বিবেচনায় আসছে না।
এ কে এম আমির হোসেন
পরিবারে ও সমাজে মায়ের ভূমিকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। সব কালে, সব সমাজে, সব সময় মায়েরা ছিলেন অনন্য, এখনো আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন। দেশে বেশির ভাগ মা গৃহবধূ। সন্তান মানুষ করাসহ ঘর-সংসারের প্রায় সব কাজ তাঁরা করেন। এই মায়েদের যদি ভালো পুষ্টিজ্ঞান থাকে, তাহলে তা নিজেরসহ সন্তান ও পরিবারের অন্য সবার ক্ষেত্রে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারেন। এ জন্য মায়েদের পুষ্টিজ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই। চীনাদের উচ্চতা একসময় কম ছিল। এখন তারা অস্ট্রেলীয়দের ছুঁই ছুঁই করছে। চিনের নগ্নপদ চিকিৎসকের কথা জানি, যাঁরা পায়ে হেঁটে বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্য বিষয়ে জ্ঞান দিতেন। তারা আজকে যে লম্বা হচ্ছে, মনে হয় এর পেছনে এই নগ্নপদ চিকিৎসকের একটা বড় ভূমিকা আছে। আমাদের এ রকম কোনো ভূমিকা নিতে হবে। এক অনুষ্ঠানে গিয়ে জানতে পারলাম, একজন স্বাস্থ্যকর্মী একটি স্কুলে স্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করেন। দেখা গেল, সেই স্কুলের শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য তুলনামূলক অন্য স্কুলের শিক্ষার্থীদের চেয়ে ভালো। ভালো হওয়ার কারণ হিসেবে জানা গেল, তারা খাওয়ার আগে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিত। স্বাস্থ্যকর্মী সে ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন। শুধু হাত ধোয়ার জন্য যদি এই পরিবর্তন আসে, তাহলে এটা গবেষণার বিষয় হতে পারে।
মেয়েশিশুদের জীবনের শুরু থেকে পুষ্টির মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠতে হবে। কারণ, ভবিষ্যতে এরাই মা হবে। শিশু বয়সে অপুষ্টি থাকলে পূর্ণ বয়সে সেটা কতটুকু পূরণ করা সম্ভব, সেটা হয়তো আরেকটি জরুরি প্রশ্ন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পুষ্টি বিষয়ে একটি অধ্যায় থাকার ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিতে পারে।
মাখদুমা নার্গিস
যখন নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, তখন এই আন্দোলনকে মূলধারার সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েই আন্দোলন করেছিলাম। আজকে পুষ্টির ক্ষেত্রে যদি সফলতা অর্জন করতে চাই, তাহলে অবশ্যই একে মূলধারায় আনতে হবে। বর্তমান সরকার ও প্রধানমন্ত্রী নিজে বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সময় বুঝেছি, তিনি কাজটিকে অনেক গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন। তিনি চান কাজটি সফলভাবে পরিচালিত হোক। আমরা কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে পুষ্টির ধারণা দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছি। প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকের সঙ্গে কমিউনিটি গ্রুপ এবং সাপোর্ট গ্রুপ আছে, যারা গ্রামের মানুষের মধ্যে পুষ্টিসহ স্বাস্থ্যের নানা দিক নিয়ে পরামর্শ দেয়। তারা যাতে কাজটি সফলভাবে করতে পারে, তার জন্য তাদের উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এখন সরকারি-বেসরকারি যাঁরাই আপনারা কমিউনিটি ক্লিনিকে যান, তাঁরা খোঁজখবর নেবেন যে কাজটি ঠিকভাবে হচ্ছে কি না। আলোচনায় বারবার এসেছে যে এটি একার কারও কাজ নয়, সবার কাজ। এদের স্বাস্থ্য বিষয়ে যে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, তা যদি ঠিকমতো প্রয়োগ করতে পারে, তাহলে চীনের সেই নগ্নপদ চিকিৎসক থেকে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আমাদের দেশেও বড় কোনো বিপ্লব ঘটতে পারে।
মুহম্মদ হুমায়ুন কবির
বাংলাদেশকে সাবসাহারান আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। এটা কিছুটা দুর্ভাগ্যজনক। কারণ, আমাদের অবস্থা এত খারাপ না। এখানে মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে, শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। আমার যেটা মনে হয়, পুষ্টির পূর্বশর্ত হচ্ছে দারিদ্র্য দূরীকরণ। দারিদ্র্য ও পুষ্টিকে একই সঙ্গে মোকাবিলা করতে না পারলে পুষ্টির ক্ষেত্রে অগ্রগতি হবে না। মাকে প্রথমে খাবার খেতে হবে, সেই খাবার থেকেই বুকের দুধ তৈরি হবে। খাবারের সংকট থাকলে বুকের দুধ তৈরি হবে না। পুষ্টিতে সফলতা আনতে হলে অবশ্যই দারিদ্র্যকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। পুষ্টির জন্য আয়োডিন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আয়োডিন কীভাবে ব্যবহার করেতে হবে, সেটা অনেকেই জানে না। লবণে আয়োডিনের মাত্রা কমপক্ষে ১৫ পিপিএম থাকতে হবে। কিন্তু ব্যবহারবিধি না জানার কারণে অনেক ক্ষেত্রে এই মাত্রা থাকে না।
আবার চিকিৎসকেরা এখন শিশুদের ফল খাওয়াতে নিষেধ করছেন ফরমালিনের ভয়ে। তাহলে শিশুদের পুষ্টি আসবে কোথা থেকে? পুষ্টির জন্য জরুরি হচ্ছে পুষ্টিকর খাদ্যের নিরাপত্তা বিধান করা। সেটি কতটুকু করতে পেরেছি, সে বিষয়ে প্রশ্ন আছে। কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যন্ত পুষ্টিকে নিয়ে যেতে পেরেছি। পুষ্টির বিষয়টি পারিপার্শ্বিক কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। যেমন—যদি খাদ্যনিরাপত্তা থাকে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা থাকে, অন্যান্য মন্ত্রণালয় তাদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করে, গণমাধ্যম পুষ্টির বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রচার করে, পাঠ্যপুস্তকে বিস্তারিতভাবে অন্তর্ভুক্ত করা য়ায়, তাহলে এ ক্ষেত্রে আমরা দ্রুত সফলতা অর্জন করব।
আব্দুল কাইয়ুম
নারীর পুষ্টি নিশ্চিত হলে সমগ্র জাতি উপকৃত হয়। আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
যাঁরা অংশ নিলেন
মুহম্মদ হুমায়ুন কবির
সিনিয়র সচিব, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়
মাখদুমা নার্গিস
অতিরিক্ত সচিব ও প্রকল্প পরিচালক, আরসিএইচসিআইভি (কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প)
খন্দকার মো. সিফায়েত উল্লাহ
মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়
এ কে এম আমির হোসেন
মহাপরিচালক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
মোহাম্মদ শরীফ
পরিচালক, এমসিএইচ সার্ভিসেস ও লাইন ডিরেক্টর এমসিআরএইচ, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
মো. এখলাসুর রহমান
পরিচালক, জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি প্রতিষ্ঠান এবং লাইন ডিরেক্টর, ন্যাশনাল নিউট্রিশন সার্ভিসেস
এস এম মুস্তাফিজুর রহমান
প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ন্যাশনাল নিউট্রিশন সার্ভিসেস, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়
আনোয়ার হোসেন শিকদার
ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর, প্ল্যান বাংলাদেশ
সেলিনা আমিন
কান্ট্রি প্রজেক্টস ম্যানেজার, প্ল্যান বাংলাদেশ
তাসকীন চৌধুরী
প্রজেক্ট ম্যানেজার নিউট্রিশন, প্ল্যান বাংলাদেশ
এস কে রায়
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশন
মো. ইফতেখার হাসান খান
হেলথ অ্যাডভাইজার, প্ল্যান বাংলাদেশ
জেবা মাহমুদ
প্রধান, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ইনিশিয়েটিভ
ফেরদৌসী বেগম
কান্ট্রি ম্যানেজার, দ্য ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন টেকনিক্যাল অ্যাসিসট্যান্স III প্রজেক্ট
খুরশীদ তালুকদার
কনসালট্যান্ট পেডিয়েট্রিশিয়ান ও রিসার্চ কো-অর্ডিনেটর সেন্টার ফর উইম্যান অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ
শুভ্রা চাকমা
ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ট্রাইবাল হেলথ, ইএসডি, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা
ইকবাল কবীর
সহকারী অধ্যাপক, রোগতত্ত্ব বিভাগ, নিপসম
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো
মুহম্মদ হুমায়ুন কবির
আজকের আলোচ্য বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টির ওপর আগেই অনেক বেশি জোর দেওয়া উচিত ছিল। মানুষ এখন পুষ্টির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পুষ্টির বিষয়টিতে বিতর্ক রয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে কথা বলতে হয়েছে। পুষ্টির ক্ষেত্রে আমরা কোন ধারায় যাচ্ছি, এ নিয়ে একধরনের পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একসময় বিআইএনপি ও এনএনপি (বাংলাদেশ ইনটিগ্রেটেড নিউট্রিশন প্রোগ্রাম ও ন্যাশনাল নিউট্রিশন প্রজেক্ট) কর্মসূচি করেছে। ভার্টিকাল কর্মসূচি: প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব করা হয়েছে। ৪৮৩টি উপজেলার মধ্যে প্রায় ১৬৭টিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পুষ্টি কার্যক্রম চলছে।
শহরাঞ্চলে পুষ্টির কোনো কার্যক্রম নেই। কাজেই দেশের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে পুষ্টির ক্ষেত্রে যে অর্জন, সেটা খুবই সামান্য। এর কোনো প্রভাব লক্ষ করা যায় না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পুষ্টিকে পৃথক কার্যক্রম হিসেবে পরিচালনা করেছে। পুষ্টির বিষয়টি মূলধারায় ছিল না। আমরা এটিকে মূল স্রোতে নিয়ে আসার কথা বলেছি। পুষ্টি কোনো একক মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। এর সঙ্গে কয়েকটি মন্ত্রণালয় জড়িত। বিশেষ করে খাদ্য, কৃষি ও মৎস্য মন্ত্রণালয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কাজটি করে, তখন অনেকের ধারণা হয় যে কাজটি শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। এখন সবার দায়িত্ব ঠিক করে নিতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যদি নেতৃত্বে থাকে, তাহলে তার দায়িত্ব কতটুকু, অন্যদের কতটুকু। আমাদের অতীত কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা কী, এসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। পুষ্টির ক্ষেত্রে পাঁচ বছর মেয়াদি হেল্থ পপুলেশন অ্যান্ড নিউট্রিশন সেক্টর ডেভেলপমেন্ট কর্মসূচির আওতায় নারী-শিশু সবার পুষ্টির বিষয় বিবেচনা করা হয়েছে।
আব্দুল কাইয়ুম
আমাদের আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হলো নারীর পুষ্টির দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ দিকগুলো যেন সামনে আসে এবং সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এবার বলবেন তাসকীন চৌধুরী।
তাসকীন চৌধুরী
স্বাস্থ্য ও পুষ্টি একে অন্যের সঙ্গে জড়িত। স্বাস্থ্যে ছাড়াও অপুষ্টির প্রভাব পড়ে অর্থনীতি, শিক্ষা ও বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রে। গত চার দশকে বাংলাদেশে, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যার কিছু সূচকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। তথাপি অপুষ্টি বাংলাদেশের জন্য এখনো একটি বড় সমস্যা, আর এর প্রধান শিকার আমাদের নারী ও শিশুরা। এক হিসাবমতে, দেশের ৩০ শতাংশ নারী মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছেন, ১৫ শতাংশ খর্বকায়ত্বের শিকার। প্রতি ১০ জন নারীর চারজনই রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন। ৩৯ শতাংশ নারীর মধ্যে আয়োডিনের ঘাটতি রয়েছে। আবার অন্যদিকে অতিপুষ্টি আমাদের দেশে ধীরে ধীরে বাড়ছে। এক তথ্য থেকে জানা যায়, এশিয়ান কাটঅফ ব্যবহার করে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ নারীর বিএমআই ২৩-এর ওপরে। অপুষ্টির এই চিত্র সত্যি ভয়াবহ। বাংলাদেশের মতো ‘স্বল্প আয়ের’ দেশকে এর জন্য মূল্য দিতে হয় প্রতিবছর প্রায় ৭০০ কোটি টাকা।
একজন অপুষ্টিতে আক্রান্ত নারী কেবল নিজেই ভুক্তভোগী হন না; তিনি জন্ম দেন কম ওজনের শিশুর, যাদের সঠিক শারীরিক বৃদ্ধি হয় না, ঘন ঘন রোগাক্রান্ত হয় আর সারা জীবন রোগ বা মৃত্যুঝুঁকির সঙ্গে বসবাস করে। এভাবেই অপুষ্টির দুষ্টচক্র এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে যায় আর চাপ সৃষ্টি করে দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবার ওপর।
গত দুই দশকে পোশাকশিল্প আর ক্ষুদ্র ঋণ প্রণীত ব্যবসায় বাংলাদেশের নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। এই বিশাল জনসম্পদ যদি অপুষ্টির শিকার হয়, তাহলে আর্থিক অসচ্ছলতায় পড়েন তিনি নিজে, তাঁর পরিবার এবং সর্বোপরি জাতি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, অপুষ্টির কারণে কর্মক্ষমতা ১০-১৫ শতাংশ আর জাতীয় উৎপাদন ৫-১০ শতাংশ কমে যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, খর্বকায় শিশুরা দেরিতে স্কুলে যায়, নিয়মিত স্কুলে যেতে পারে না আর একই ক্লাসে বারবার অধ্যয়ন করে। ভিটামিন এ-র অভাবে শিশু ঘন ঘন অসুখে ভোগে আর তাই ঘন ঘন স্কুল কামাই করে।
বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই বরাদ্দ খুবই কম। তবে পুষ্টির মতো বা নারী পুষ্টির মতো জরুরি বিষয়টি শুধু স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত নয়। নারীরা যেহেতু জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখতে পারেন, তাই পুষ্টিকে অন্যান্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরেরও বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া উচিত। এর জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় সাধন।
আনোয়ার হোসেন শিকদার
১৯৯৪ সাল থেকে প্ল্যান বাংলাদেশে কাজ শুরু করে। কিন্তু পুষ্টির কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৩-০৪ সাল থেকে। বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে পুষ্টি বিষয়ে কাজ করে এ পর্যন্ত মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট, ইনটিগ্রেটেড নিউট্রিশন প্রজেক্ট, ইনটিগ্রেটেড ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন সিকিউরিটি প্রজেক্ট নামে তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। তা ছাড়া প্ল্যান বাংলাদেশ ‘প্রমোশন অব এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং’ নামে একটি প্রকল্প ২০১২ সালের মার্চ মাসে শেষ করেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ২৯ হাজার গর্ভবতী মা এবং ৪৬ হাজার প্রসূতি মা উপকৃত হয়েছেন। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৯৩ শতাংশ মা তাঁদের শিশুদের শালদুধ এবং ৬৫ শতাংশ মা তাঁদের সন্তানদের শুধুমাত্র বুকের দুধ পান করিয়েছেন। ৬২ শতাংশ পুরুষকেও আমরা এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছি। এখন আমরা ‘উইনি’ নামে আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি, যেখানে নারীর পুষ্টিসহ অন্যান্য বিষয় থাকবে। গাজীপুর, দিনাজপুর ও নীলফামারীর ২৫টি ইউনিয়নে এই প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়িত হচ্ছে। এখান থেকে গর্ভবতী মাসহ দুই বছরের নিচের দুই লাখেরও অধিক জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে বলে আশা করছি। এই প্রকল্পের মাধ্যমে মায়েরা বাড়িতে বাগান ও মুরগির খামারের ওপর প্রশিক্ষণ পাবেন।
প্রকল্প থেকে মায়েরা যেমন পুষ্টি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করছেন, তেমন কিশোরীরা স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জেন্ডার বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পারবে। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, পুষ্টি বিষয়ে শুধু নারীদের সচেতন করলে বেশি ফল পওয়া যায় না। এর জন্য আমরা পুরুষদেরও সম্পৃক্ত করেছি।
মো. এখলাসুর রহমান
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সুস্থ মায়ের জন্য অত্যন্ত বাস্তবভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের ৩০ শতাংশ মা অপুষ্টিতে ভুগছেন। ৪৬ শতাংশ গর্ভবতী মা অ্যানিমিয়ায় ভুগছেন। এ ছাড়া, বিভিন্ন রোগে মায়েরা আক্রান্ত হচ্ছেন। সরকারি কার্যক্রমের একটা প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে মায়েদের অপুষ্টি থেকে রক্ষা করা। আমরা দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সামনে এনেছি। এক. পুষ্টিকে মূল স্রোতধারায় আনার উদ্যোগ নিয়েছি। ইতিপূর্বে ভিটামিন ‘এ’ কভারেজ কার্যক্রমসহ বিভিন্ন কার্যক্রম মূল স্রোতধারায় এনে সফলতা অর্জন করেছি। সে কারণে নারীর পুষ্টিকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছি এবং মূল স্রোতধারায় আনার ব্যবস্থা করছি। দুই. পুষ্টি কার্যক্রমকে সমন্বিত করে পরিচালনা করার পরিকল্পনা করেছি। দেশে আরও ১৩টি মন্ত্রণালয় পুষ্টি কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এদের একত্র করে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটি ব্যাপকভিত্তিক পুষ্টি কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এই কাজগুলো ঠিকমতো পরিচালিত হওয়ার জন্য কমিটি আছে। জাতীয় পুষ্টিসেবার আওতায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে আচরণের পরিবর্তন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সাপ্লিমেন্টেশনসহ ২০টি কার্যক্রম রয়েছে। এই ২০টি কার্যক্রমের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি হলো সমগ্র বাংলাদেশে ও হাসপাতালগুলোতে পুষ্টি কার্যক্রম পরিচালিত করা। দেশের ৮০টি উপজেলায় কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে যাঁরা স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। গ্রামাঞ্চলের মা ও শুিশুদের অপুষ্টি বের করার পদ্ধতি শিখিয়েছি। অপুষ্টি নির্ণয়ের পদ্ধতির মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশের মা ও শিশুদের অপুষ্টি নির্ণয় করে তাদের পুষ্টির আওতায় আনার ব্যবস্থা করা যাবে।
এস কে রায়
মায়ের পুষ্টি এতটা গুরুত্বপূর্ণ যে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০১১ সালের জরিপে দেখা যায়, নারীর গড় উচ্চতা ১৫০ সেন্টিমিটার। ১৪০ থেকে ১৫০ সেন্টিমিটার উচ্চতায় গর্ভধারণ করলে তাঁরা ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। সে হিসাবে দেশের অর্ধেক নারী গর্ভঝুঁকিতে রয়েছেন, যা মা ও সন্তান উভয়ের জন্য বিপদ হতে পারে। দেশের মায়েদের গড় ওজন ৫০ কেজি। এর অর্থ হচ্ছে, ৫০ শতাংশ নারীর ওজন ৫০ কেজির নিচে। উচ্চতা ও ওজনের অনুপাত হিসাব করে যে বিএমআই (বডি মাস ইনডেক্স) করা হয়, তা ১৮ দশমিক ৫-এর নিচে হলে ক্রনিক এনার্জি ডেফিসিয়েন্সি বলে ধরা হয়। এখন গড়ে দেশের ৩০ শতাংশ নারী ক্রনিক এনার্জি ডেফিসিয়েন্সির নিচে। আবার শহরে ২৫ শতাংশ ও গ্রামে ৮ শতাংশ নারীর বিএমআই ২৫-এর ওপরে। তাঁরা হূদরোগের ঝুঁকিতে আছেন। দেশে ৩৬ শতাংশ শিশুর জন্ম কম ওজনে, অর্থাৎ আড়াই কেজির নিচে। এই শিশুদের একটা অংশ নারী, যাদের ১৮ বছরের নিচে বিয়ে হয়। পারিবারিক চাপের কারণে বিয়ের এক বছরের মধ্যে সন্তান ধারণ করতে হয়। এঁরা আবার কম ওজনের সন্তান জন্ম দেয়। এভাবে দুর্বল মা ও দুর্বল সন্তানের একটি চক্র গড়ে উঠছে। জন্ম থেকে প্রতিটি পর্যায়ে এই নারীরা ঝুঁকি বহন করছে। অন্যদিকে খাদ্যনিরাপত্তা জরিপ থেকে দেখা যায়, ৪০ শতাংশ মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নেই। অর্থাৎ, এত বড় একটা জনগোষ্ঠী খুব প্রান্তিক জীবন যাপন করে। দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ প্রোটিন, খনিজ লবণ ইত্যাদি উপাদান থেকে বঞ্চিত।
পুষ্টির ঘাটতিজনিত কারণে একটা বড় জনগোষ্ঠী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে বিশাল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে। এই অর্থ দিয়ে যদি তাদের পুষ্টির ব্যবস্থা করা যেত, তাহলে এত হাসপাতাল ও চিকিৎসকের প্রয়োজন হতো না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করব, এই খাতে বিনিয়োগ করা হোক। অবশ্যই এই বিনিয়োগ ফেরত পাওয়া যাবে। আজকে চীনারা রোগ প্রতিরোধের ওপর জোর দিয়ে হাসপাতালের খরচ অনেক কমিয়ে ফেলেছে এবং সুস্থ জীবন যাপন করছে। শেষ কথা হলো, অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, যদি গঠনমূলক পরিকল্পনা ও সত্যিকার অর্থে এ ক্ষেত্রে কাজ করার ইচ্ছ থাকে, তাহলে দেশীয় ব্যবস্থাপনায় অনেক কিছু করা যায়।
আব্দুল কাইয়ুম
আলোচনা থেকে দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে, পুষ্টি বাড়ালে কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে আর্থিক সমৃদ্ধি আসে এবং অসুস্থতা কমে গিয়ে চিকিৎসক ও হাসপাতালের খরচ কমে যায়। এবার শুনব জেবা মাহমুদের কাছ থেকে।
জেবা মাহমুদ
আজ থেকে স্লোগান হওয়া উচিত ‘নারীর প্রতি আর কোনো বৈষম্য, অবহেলা নয়’। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। তাদের পিছিয়ে রেখে সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়। পুষ্টির অভাবে কর্মদক্ষতা কমে যায়। অধিকাংশ নারীকেই ঘর-সংসারের কাজ করতে হয়। ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে হয়। পুষ্টির ঘাটতির জন্য নারীরা এই কাজগুলো সঠিকভাবে করতে ব্যর্থ হন। ফলে ছেলেমেয়েদের পরিমিত পরিচর্যা হয় না। সংসারজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মায়ের অপুষ্টি শুধু মাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, তাঁর গর্ভজাত সন্তানকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
গর্ভধারণ থেকে শিশুর বয়স দুই বছর পর্যন্ত, অর্থাৎ এক হাজার দিন মায়ের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় মায়ের অপুষ্টি থাকলে কম ওজনের অপুষ্ট সন্তান হবে। এক হিসাবমতে, দেশের প্রায় আড়াই কোটি নারী আয়রন, আয়োডিনসহ বিভিন্ন খাদ্য উপাদানের ঘাটতিতে ভুগছেন। এঁরা যদি একটি করে শিশু জন্ম দেন, তাহলেও আড়াই কোটি শিশু জন্ম নেবে অল্প আয়রন, আয়োডিনসহ অন্যান্য উপাদানের অভাব নিয়ে। এই শিশুরা রক্তশূন্যতায় ভুগবে। আয়োডিনের অভাবে মেধ বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। আরও নানাবিধ সমস্যায় ভুগতে থাকবে।
নারীর পুষ্টির বিষয়টিকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে মূলধারায় নিয়ে আসতে হবে। এবং সরকারের নেতৃত্বে, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সবাই একসঙ্গে এগিয়ে এলে এই সমস্যা থেকে নারীরা মুক্তি পাবেন। তাহলে আমরা পাব সমৃদ্ধ মা, বলিষ্ঠ শিশু ও আলোকিত ভবিষ্যৎ।
খুরশীদ তালুকদার
নারীর পুষ্টির ক্ষেত্রে আমাদের জ্ঞানের অভাব রয়েছে। গতানুগতিক কিছু বিষয়কে পুষ্টির মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করছি। পুষ্টির মাপকাঠি হিসেবে ১৮ দশমিক ৫ বিএমআইকে ধরা হচ্ছে। অথচ বিগত ১৪ বছরের হিসাব অনুযায়ী, পুষ্টিবঞ্চিত মানুষের হার ৫৩ শতাংশ থেকে ২৬ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ, অপুষ্টি অর্ধেকে নেমে গেছে। এক গবেষণায় বলা হচ্ছে, বিএমআই ২৩ শতাংশের ওপরে গেলেই ডায়াবেটিস, হূদরোগ, ক্যানসার, স্ট্রোকসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। দেশে এখন এত অধিকসংখ্যক নারী-পুরুষের বিএমআই ২৩ শতাংশের ওপরে, যা জাতীয় সমস্যা তৈরি করছে। ২০০৬ সালে ছয়টি বিভাগীয় শহরের বস্তি এলাকার জরিপে দেখা যায়, সেখানকার নারীদের মধ্যে ২৫ শতাংশ এবং পুরুষের মধ্যে ১৭ শতাংশ হাইপারটেনশনে ভুগছেন। ডায়াবেটিস নারীর মধ্যে ৯ এবং পুরুষের মধ্যে ১৩ শতাংশ। যারা বস্তি এলাকার বাইরে, তাদের অবস্থা বুঝতে কষ্ট হয় না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে এসব রোগের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে।
পুষ্টি কার্যক্রমের মধ্যে অতিপুষ্টি, ডায়াবেটিস, হাইপার টেনশনসহ অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। একজন কম ওজন ও অন্যজন বেশি ওজন—উভয় নারীকেই স্বাস্থ্যসেবার কার্যক্রমের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।
২০০৮ সালের ল্যানসেট নিউট্রিশন সিরিজে প্রতিটি দেশের মায়েদের জন্য পুষ্টি কার্যক্রমের মধ্যে ছিল আয়রন ট্যাবলেট সরবরাহ—সেটা আমরা করছি। মাল্টিনিউট্রিয়েন্ট পাউডারের ব্যাপারে কাজ হচ্ছে। আয়োডিনযুক্ত লবণ সর্বত্র পাওয়া যাচ্ছে। মায়েদের যদি ক্যালসিয়াম ঠিকমতো না থাকে, তাহলে সন্তান প্রসবের সময় তাঁদের রক্তচাপ ও খিঁচুনি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই পুষ্টির সঙ্গে ক্যালসিয়ামকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
ফেরদৌসী বেগম
খাবারের পর্যাপ্ততা, প্রাপ্যতা ও সঠিক ব্যবহারের ওপর পুষ্টি নির্ভর করে। আজকের আলোচনা থেকে আরেকটি বিষয় ধারণা হলো যে এটি একক কোনো মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো আয়োজন করলে অন্যান্য মন্ত্রণালয়কে আমন্ত্রণ জানাতে হবে। একজন মায়ের পুষ্টির নিশ্চয়তার জন্য পরিবারের সবাইকে লক্ষ রাখতে হবে। পারিবারিক সহযোগিতা পুষ্টির একটি বড় দিক। পুষ্টির জন্য দেশব্যাপী প্রচার করতে হবে। জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যতালিকায় নির্দিষ্টভাবে পুষ্টি কর্মসূচি রেখে কার্য পরিচালনা করলে মায়েরা বেশি উপকৃত হবে।
অপুষ্টি ও অতিপুষ্টি—এ দুটো বিষয়ও মানুষকে জানাতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। শেষে বলতে চাই, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রধান ব্যক্তি ও এনজিওগুলোকে নিয়ে একসঙ্গে বসে একটি বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে পুষ্টি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময় পর পর কার্য মূল্যায়নের ব্যবস্থা করতে হবে।
শুভ্রা চাকমা
অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। দেশে খাদ্যের সমস্যা রয়েছে। পুষ্টির জন্য প্রথমে দরকার খাদ্যের নিরাপত্তা। শুধু খাদ্যের নিরাপত্তা হলেও হবে না, দরকার সুষম খাদ্য। বর্তমানে ইপিএ কর্মসূচির মাধ্যমে শিশুদের আটটি রোগের প্রতিষেধক দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে মেয়েদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হয়। মেয়েরা ১৫ বছর অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে ধনুষ্টংকারের প্রতিষেধক টিকা দিয়ে মা ও নবজাতককে ধনুষ্টংকারের হাত থেকে রক্ষা করি। ইপিআই কর্মসূচির মাধ্যমে মেয়েদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। পাশাপাশি বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে ৫৩টি উপজেলায় গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের বিশেষ সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। খুব প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে নারী, কিশোরী ও শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছি।
মো. ইফতেখার হাসান খান
নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে বলতে চাই। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা পরিমিত থাকলে কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়ে। আয়রনের ঘাটতি দেখা দিলে দক্ষতা কমে যায়। মা ও শিশুর মধ্যে আয়োডিনের ঘাটতি থাকলে উপস্থিত বুদ্ধি কমে যায়। আয়োডিনের অভাব থাকলে মায়েরা ভালো অভিভাবকত্ব করতে পারেন না। দই খেলে চিন্তা করার ক্ষমতা বাড়ে।
এই কাজের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করতে হবে। আয়োডিন, আয়রন ইত্যাদি উপাদানের অভাবে কী কী ক্ষতি হয়, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে। যদি বলি অ্যানিমিয়া হয়, তাহলে তারা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেবে না। যদি বলা হয় যে নানাবিধ অসুখ-বিসুখে পড়বে, পড়ালেখার দক্ষতা কমে যাবে, পরীক্ষার ফল ভালো হবে না, নিজেদের আয় ও উৎপাদনক্ষমতা কমে যাবে, দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে পড়ে জীবনে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না; তাহলে শিক্ষার্থীরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে।
শহরাঞ্চলে মায়েরা শিশুদের শাক-সবজির পরিবর্তে আমিষ ও চর্বিজাতীয় খাবার বেশি খাওয়ান। শাক-সবজি খাওয়ান না। তাই শিশুরা স্থূলকায় হয়। যেটা শিশুদের জন্য ক্ষতিকর। শহরের মায়েদের এ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
এস এম মোস্তাফিজুর রহমান
আয়রন, আয়োডিনের অভাবে আমাদের অনেক সমস্যা হয়। এশিয়া মহাদেশে কেউ অলিম্পিকে প্রথম হতে পারেনি। কারণ, আয়রনের অভাবে অক্সিজেনের স্বল্পতা। তৃপ্তির মানদণ্ডে খাবার রান্না করা হয়, পুষ্টির মানদণ্ডে নয়। বাজার থেকে খাবার কেনার পর টেবিলে আসা পর্যন্ত ৩৫ শতাংশ পুষ্টি নষ্ট হয়ে যায়। খাদ্যে যেটুকু নিরাপত্তা আছে, তাকে কাজে লাগাতে পারছি না। দেশে প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন গর্ভবতী, যার বয়স ১৮ বছরের নিচে। প্রতি তিনজন শিশুর মধ্যে একজন শিশু জন্ম নিচ্ছে, যার ওজন আড়াই কেজির নিচে।
মানুষের জন্মের পর আর কোনো মাথার কোষ তৈরি হয় না। জন্মের দুই বছর পর্যন্ত কোষগুলো একে অন্যের সঙ্গে জোড়া লাগে। এই কাজের জন্য পুষ্টির প্রয়োজন হয়। খাওয়ার আগে সবাইকে হাত ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। পুষ্টি কার্যক্রম শুধু হাসপাতালে সীমাবদ্ধ না রেখে স্কুল-কলেজ, দুর্গম এলাকা—সব জায়গায় পৌঁছে দিতে হবে। বিশেষ করে স্কুল-কলেজগুলোতে পুষ্টি ক্লাব তৈরি করতে হবে, যাতে নিজের জীবনে পুষ্টিজ্ঞান কাজে লাগাতে পারে। দেশের সব সেবাকেন্দ্রে সন্তান জন্মের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যেন ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। শেষ কথা হলো, পুষ্টির ক্ষেত্রে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হলে সবার মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন।
আব্দুল কাইয়ুম
আমরা যদি পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত নিই, মায়ের শরীর ভালো রাখতে হবে, প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান দিতে হবে এবং দুটির বেশি সন্তান হবে না; তাহলে মায়ের সুস্বাস্থ্য ও কর্মদক্ষতা নিশ্চিত হতে পারে। এখন বলবেন মোহাম্মদ শরীফ।
মোহাম্মদ শরীফ
একটি অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করি। দেশের মায়েদের এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগতে পারে। একসময় চিটাগংয়ের বাকুলিয়ায় কাজ করি। একজন গর্ভবতী রোগী ছিলেন, তিনি চিটাগং কলেজের প্রভাষক। আমি তাঁকে নিয়মিত খওয়াদাওয়ার কথা বলতাম। আয়রন, আয়োডিনসহ বিভিন্ন ভিটামিনের কথা বলতাম। একপর্যায়ে তিনি খুবই দুর্বল এবং কম ওজনের একটি সন্তান জন্ম দিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তিনি শরীর ঠিক রাখার জন্য ভিটামিনসহ কোনো খাবারই ঠিকমতো খাননি এবং শিশুর জন্মের পর বুকের দুধ পান করাননি। পরে সেই শিশুটি এতটাই অসুস্থ হলো যে তাকে বাঁচানোই কষ্টকর হয়ে গেল। এখনো সে দুর্বল হয়েই বেঁচে আছে। তার পক্ষে ভালো কিছু করা সম্ভব হয়নি। পরে সেই মা অনেক কেঁদেছেন। কিন্তু তখন সময় অনেক চলে গেছে। তাই মায়েদের বলব, সন্তানের জীবন ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবেন না।
পরিবার পরিকল্পনায় এখন অনেক নারীকর্মী আছেন। তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে শুধু পরিবার পরিকল্পনার কথা বলবেন কেন। আমরা উদ্যোগ নিয়েছি, সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে পুষ্টিসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁরা কথা বলবেন। আমার বিশ্বাস, এটি করলে পুষ্টির ক্ষেত্রে আরও একধাপ এগিয়ে যাব। কমিউনিটি ক্লিনিক ও পুষ্টির ক্ষেত্রে যত ধরনের সহযোগিতা আমাদের করার সুযোগ আছে, সবটাই করব।
সেলিনা আমিন
দেশব্যাপী সচেতনতা বাড়ানোর কার্যক্রম গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। নারীশক্তির উন্নয়ন হচ্ছে একটি দেশের উন্নয়নের সূচক। আমরা টিকার কথা বলছি, কিন্তু একবারও গর্ভাশয় ক্যানসার রোধে টিকার কথা বলছি না। আমরা সাধারণত মায়ের স্বাস্থ্যের কথা বলে থাকি, কিন্তু নারীর স্বাস্থ্য ও পুষ্টির কথা বলছি না। শুধু মাকে নিয়ে ভাবলে মায়ের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির উন্নয়ন হবে না। যদি বড় পরিসরে নারীসমাজ নিয়ে ভাবি, কেবল তখনই মায়ের উন্নয়ন হওয়া সম্ভব। এখনো নারীর জন্য সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত বাধা রয়েছে। প্ল্যান এ বিষয়ে কাজ করছে।
মাঠে কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পেরেছি, নারীর পুষ্টি খুবই জরুরি একটি বিষয়। এ ক্ষেত্রে পুরুষের ভূমিকা রয়েছে। তাই এ কাজের জন্য কিছু পুরুষকে নিয়োগ দিয়েছি। প্ল্যানের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নারী ও শিশুর উন্নয়ন করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। যখন কমিউনিটিতে কাজ করি, তখন সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করি। কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, উপজেলা পর্যায়ে সমস্যা কম। সবাই মিলেমিশে কাজ করতে পারছি। কিন্তু অন্যান্য পর্যায়ে সমস্যা বেশি। সেখানে সমন্বয়ের অভাব, সিদ্ধান্ত গ্রহণে জটিলতাসহ নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। যেকোনো কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য সিদ্ধান্ত ও সমন্বয় জরুরি।
ইকবাল কবীর
আজকের আলোচনার শিরোনাম অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী, তাদের পেছনে রেখে সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। নারী উন্নয়নের জন্য খাদ্য-পুষ্টি সবই অপরিহার্য উপাদান। ১৯৯৮ সালে পুষ্টি বিষয়ে কিছু কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। তখন অপুষ্টি ও অতিপুষ্টি—দুটোই লক্ষ করেছি। আমাদের দুটোই মোকাবিলা করতে হবে। মায়েদের পুষ্টির সঙ্গে সঙ্গে কিশোরী মা ও কিশোরীদের পুষ্টির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। শেষে দুটো জায়গা বলতে চাই—এক. নবদম্পতিদের পরামর্শদানের ব্যবস্থা করা। সারা জীবন তাঁরা একসঙ্গে অতিবাহিত করবেন। জীবনের শুরুতে একটি রুটিন তৈরি করে দিতে পারলে জীবন অনেক পরিচ্ছন্ন হবে। দুই. আগামী ১০ বছর পর দেশে বয়স্ক লোকের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। অপুষ্টিসহ তাঁরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবেন। সেই অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
খন্দকার মো. সিফায়েত উল্লাহ
জাতীয় পুষ্টি পরিষদ প্রায় অকার্যকর বিষয়ে যে সংবাদ আজকে প্রথম আলোয় এসেছে, তার সঙ্গে একমত হতে পারছি না। জাতীয় পুষ্টি পরিষদ নামেমাত্র প্রতিষ্ঠান আমরা দেখতে চাই না। একে মূল স্রোতে আনার জন্য কাজ চলছে। আমরা বুঝতে পারছি, পুষ্টিকে মূলধারায় না আনতে পারলে এ ক্ষেত্রে সার্বিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। কোন খাবারে কোন ভিটামিন আছে, কী খাওয়া এবং কী না খাওয়া দরকার, এখন মানুষ তা জানে। সকালবেলা রুটি ও মিষ্টি, বাজারে গিয়ে চা-পাউরুটি খাচ্ছে। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আরও প্রচার দরকার। পাঠ্যপুস্তকে পুষ্টি বিষয়ে যেভাবে আছে, সেটা যথেষ্ট না। শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে আরও বিস্তারিতভাবে লিখতে হবে। যাতে পরে তারা এটিকে প্রয়োগ করতে পারে। কাজটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
আলোচনায় রান্না-প্রক্রিয়ার বিষয় এসেছে। এটা সত্যি কথা, দেশে খাদ্য রান্নার প্রক্রিয়া পরিবর্তন করতে হবে। রান্নার সময় দেশের অধিকাংশ পরিবার পুষ্টির বড় অংশ নষ্ট করে ফেলে। এই দিকটি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, এটা শুধু চালের হিসাবে। খাদ্যের অন্য বিষয়গুলো বিবেচনায় আসছে না।
এ কে এম আমির হোসেন
পরিবারে ও সমাজে মায়ের ভূমিকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। সব কালে, সব সমাজে, সব সময় মায়েরা ছিলেন অনন্য, এখনো আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন। দেশে বেশির ভাগ মা গৃহবধূ। সন্তান মানুষ করাসহ ঘর-সংসারের প্রায় সব কাজ তাঁরা করেন। এই মায়েদের যদি ভালো পুষ্টিজ্ঞান থাকে, তাহলে তা নিজেরসহ সন্তান ও পরিবারের অন্য সবার ক্ষেত্রে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারেন। এ জন্য মায়েদের পুষ্টিজ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই। চীনাদের উচ্চতা একসময় কম ছিল। এখন তারা অস্ট্রেলীয়দের ছুঁই ছুঁই করছে। চিনের নগ্নপদ চিকিৎসকের কথা জানি, যাঁরা পায়ে হেঁটে বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্য বিষয়ে জ্ঞান দিতেন। তারা আজকে যে লম্বা হচ্ছে, মনে হয় এর পেছনে এই নগ্নপদ চিকিৎসকের একটা বড় ভূমিকা আছে। আমাদের এ রকম কোনো ভূমিকা নিতে হবে। এক অনুষ্ঠানে গিয়ে জানতে পারলাম, একজন স্বাস্থ্যকর্মী একটি স্কুলে স্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করেন। দেখা গেল, সেই স্কুলের শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য তুলনামূলক অন্য স্কুলের শিক্ষার্থীদের চেয়ে ভালো। ভালো হওয়ার কারণ হিসেবে জানা গেল, তারা খাওয়ার আগে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিত। স্বাস্থ্যকর্মী সে ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন। শুধু হাত ধোয়ার জন্য যদি এই পরিবর্তন আসে, তাহলে এটা গবেষণার বিষয় হতে পারে।
মেয়েশিশুদের জীবনের শুরু থেকে পুষ্টির মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠতে হবে। কারণ, ভবিষ্যতে এরাই মা হবে। শিশু বয়সে অপুষ্টি থাকলে পূর্ণ বয়সে সেটা কতটুকু পূরণ করা সম্ভব, সেটা হয়তো আরেকটি জরুরি প্রশ্ন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পুষ্টি বিষয়ে একটি অধ্যায় থাকার ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিতে পারে।
মাখদুমা নার্গিস
যখন নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, তখন এই আন্দোলনকে মূলধারার সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েই আন্দোলন করেছিলাম। আজকে পুষ্টির ক্ষেত্রে যদি সফলতা অর্জন করতে চাই, তাহলে অবশ্যই একে মূলধারায় আনতে হবে। বর্তমান সরকার ও প্রধানমন্ত্রী নিজে বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সময় বুঝেছি, তিনি কাজটিকে অনেক গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন। তিনি চান কাজটি সফলভাবে পরিচালিত হোক। আমরা কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে পুষ্টির ধারণা দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছি। প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকের সঙ্গে কমিউনিটি গ্রুপ এবং সাপোর্ট গ্রুপ আছে, যারা গ্রামের মানুষের মধ্যে পুষ্টিসহ স্বাস্থ্যের নানা দিক নিয়ে পরামর্শ দেয়। তারা যাতে কাজটি সফলভাবে করতে পারে, তার জন্য তাদের উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এখন সরকারি-বেসরকারি যাঁরাই আপনারা কমিউনিটি ক্লিনিকে যান, তাঁরা খোঁজখবর নেবেন যে কাজটি ঠিকভাবে হচ্ছে কি না। আলোচনায় বারবার এসেছে যে এটি একার কারও কাজ নয়, সবার কাজ। এদের স্বাস্থ্য বিষয়ে যে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, তা যদি ঠিকমতো প্রয়োগ করতে পারে, তাহলে চীনের সেই নগ্নপদ চিকিৎসক থেকে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আমাদের দেশেও বড় কোনো বিপ্লব ঘটতে পারে।
মুহম্মদ হুমায়ুন কবির
বাংলাদেশকে সাবসাহারান আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। এটা কিছুটা দুর্ভাগ্যজনক। কারণ, আমাদের অবস্থা এত খারাপ না। এখানে মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে, শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। আমার যেটা মনে হয়, পুষ্টির পূর্বশর্ত হচ্ছে দারিদ্র্য দূরীকরণ। দারিদ্র্য ও পুষ্টিকে একই সঙ্গে মোকাবিলা করতে না পারলে পুষ্টির ক্ষেত্রে অগ্রগতি হবে না। মাকে প্রথমে খাবার খেতে হবে, সেই খাবার থেকেই বুকের দুধ তৈরি হবে। খাবারের সংকট থাকলে বুকের দুধ তৈরি হবে না। পুষ্টিতে সফলতা আনতে হলে অবশ্যই দারিদ্র্যকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। পুষ্টির জন্য আয়োডিন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আয়োডিন কীভাবে ব্যবহার করেতে হবে, সেটা অনেকেই জানে না। লবণে আয়োডিনের মাত্রা কমপক্ষে ১৫ পিপিএম থাকতে হবে। কিন্তু ব্যবহারবিধি না জানার কারণে অনেক ক্ষেত্রে এই মাত্রা থাকে না।
আবার চিকিৎসকেরা এখন শিশুদের ফল খাওয়াতে নিষেধ করছেন ফরমালিনের ভয়ে। তাহলে শিশুদের পুষ্টি আসবে কোথা থেকে? পুষ্টির জন্য জরুরি হচ্ছে পুষ্টিকর খাদ্যের নিরাপত্তা বিধান করা। সেটি কতটুকু করতে পেরেছি, সে বিষয়ে প্রশ্ন আছে। কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যন্ত পুষ্টিকে নিয়ে যেতে পেরেছি। পুষ্টির বিষয়টি পারিপার্শ্বিক কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। যেমন—যদি খাদ্যনিরাপত্তা থাকে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা থাকে, অন্যান্য মন্ত্রণালয় তাদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করে, গণমাধ্যম পুষ্টির বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রচার করে, পাঠ্যপুস্তকে বিস্তারিতভাবে অন্তর্ভুক্ত করা য়ায়, তাহলে এ ক্ষেত্রে আমরা দ্রুত সফলতা অর্জন করব।
আব্দুল কাইয়ুম
নারীর পুষ্টি নিশ্চিত হলে সমগ্র জাতি উপকৃত হয়। আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
যাঁরা অংশ নিলেন
মুহম্মদ হুমায়ুন কবির
সিনিয়র সচিব, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়
মাখদুমা নার্গিস
অতিরিক্ত সচিব ও প্রকল্প পরিচালক, আরসিএইচসিআইভি (কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প)
খন্দকার মো. সিফায়েত উল্লাহ
মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়
এ কে এম আমির হোসেন
মহাপরিচালক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
মোহাম্মদ শরীফ
পরিচালক, এমসিএইচ সার্ভিসেস ও লাইন ডিরেক্টর এমসিআরএইচ, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
মো. এখলাসুর রহমান
পরিচালক, জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি প্রতিষ্ঠান এবং লাইন ডিরেক্টর, ন্যাশনাল নিউট্রিশন সার্ভিসেস
এস এম মুস্তাফিজুর রহমান
প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ন্যাশনাল নিউট্রিশন সার্ভিসেস, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়
আনোয়ার হোসেন শিকদার
ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর, প্ল্যান বাংলাদেশ
সেলিনা আমিন
কান্ট্রি প্রজেক্টস ম্যানেজার, প্ল্যান বাংলাদেশ
তাসকীন চৌধুরী
প্রজেক্ট ম্যানেজার নিউট্রিশন, প্ল্যান বাংলাদেশ
এস কে রায়
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশন
মো. ইফতেখার হাসান খান
হেলথ অ্যাডভাইজার, প্ল্যান বাংলাদেশ
জেবা মাহমুদ
প্রধান, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ইনিশিয়েটিভ
ফেরদৌসী বেগম
কান্ট্রি ম্যানেজার, দ্য ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন টেকনিক্যাল অ্যাসিসট্যান্স III প্রজেক্ট
খুরশীদ তালুকদার
কনসালট্যান্ট পেডিয়েট্রিশিয়ান ও রিসার্চ কো-অর্ডিনেটর সেন্টার ফর উইম্যান অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ
শুভ্রা চাকমা
ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ট্রাইবাল হেলথ, ইএসডি, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা
ইকবাল কবীর
সহকারী অধ্যাপক, রোগতত্ত্ব বিভাগ, নিপসম
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো
No comments