বিশেষ সাক্ষাৎকার : এম কে আনোয়ার-প্রধানমন্ত্রী কখন কী বলেন তা বোঝা মুশকিল
সমকালীন রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কালের কণ্ঠের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার এমপি। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন মোস্তফা হোসেইন
কালের কণ্ঠ : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকালে দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারব্যবস্থার প্রস্তাব করেছেন
কালের কণ্ঠ : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকালে দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারব্যবস্থার প্রস্তাব করেছেন
প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু আপনারা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাহলে এ সমস্যার সমাধান কিভাবে হতে পারে?
এম কে আনোয়ার : প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা অত্যন্ত অস্পষ্ট। শুধু তা-ই নয়, তাঁর বক্তব্য বিভ্রান্তিমূলকও বটে। আমরা দাবি করে আসছি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। এই সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল আওয়ামী লীগের দাবির মুখে। সমাধান হচ্ছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করা। তার জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ব্যবস্থা গ্রহণ।
কালের কণ্ঠ : তিনি তো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন। এই সূত্রেও তো এগিয়ে যাওয়া যায়?
এম কে আনোয়ার : প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সম্মান রেখেই বলতে চাই, তিনি কখন কী বলেন তা বোঝা মুশকিল। এখন যা বলেন, পরে তার বিপরীতও বলতে পারেন। কথার ধারাবাহিকতা থাকে না, আবার সামঞ্জস্যও থাকে না। হয়তো বলেন একটা, করেন আরেকটা। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কথাই যদি বলি, তাহলে সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যায়। সেই সংসদীয় কমিটি হয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সংসদ সদস্যদের নিয়ে। তিনি সেখানে স্পষ্ট বলেছিলেন, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হলো। সংবিধান সংশোধনীতে এমন কিছু বিষয় আনা হয়েছে, যা পৃথিবীর কোথাও আছে কি না সন্দেহ। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে থাকতে পারবে। কিন্তু তিনি বলেননি এই সরকার নির্দলীয় কিংবা দলনিরপেক্ষ হবে কি না। তাঁকেই প্রধানমন্ত্রী রেখে একটি সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছে। আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য, কোনো দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না।
কালের কণ্ঠ : আপনারা বলছেন দেশবাসী এই প্রস্তাব মেনে নেবে না, কিন্তু কেন?
এম কে আনোয়ার : ১৯৯৫ সালে ফিরে যেতে পারি। কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ানের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। তিনি সেদিন প্রস্তাব দিয়েছিলেন ১১ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিপরিষদ গঠনের জন্য। সেই মন্ত্রিপরিষদে প্রধানমন্ত্রীসহ বিএনপি থেকে পাঁচজন, বিরোধী দল থেকে পাঁচজন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছিল। তার বাইরে একজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, যিনি হবেন দলীয় রাজনীতির বাইরের কেউ। আবার তাঁর হাতে স্বরাষ্ট্র ও সংস্থাপনের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ন্যস্ত থাকবে। আজকে প্রধানমন্ত্রী যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তার চেয়ে বহুগুণ ভালো ছিল সেদিনের সেই প্রস্তাবটি। কিন্তু তাঁরা সেই প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আজকে প্রধানমন্ত্রী কিভাবে আশা করছেন দেশবাসী তাঁর এই প্রস্তাব মেনে নেবে?
কালের কণ্ঠ : বর্তমান সরকারের সাড়ে তিন বছর চলছে। সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার মূল্যায়ন করবেন কিভাবে?
এম কে আনোয়ার : মূল্যায়নের জন্য তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের দিকে তাকাতে হবে। তাদের পাঁচটি ওয়াদার মধ্যে অন্যতম ছিল, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও জনগণের সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা। এই ব্যর্থতা প্রমাণের জন্য তথ্য-প্রমাণ দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। ২০০৬ সালে বিএনপি দ্রব্যমূল্য যে স্তরে রেখে এসেছিল, তা আজকে দ্বিগুণ কিংবা তিন গুণ পর্যন্ত হয়েছে। চালের দাম ছিল ১৭ টাকা। সেই চাল এখন ৩৫ টাকা। সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৪৫ টাকা। সেই তেল এখন ১১০ টাকায় কিনতে হয় সাধারণ মানুষকে। কয়টা দ্রব্যের দামের কথা আমি উল্লেখ করব? নিত্যপ্রয়োজনীয় এমন কোনো দ্রব্য নেই, যার দাম আকাশছোঁয়া হয়নি।
কালের কণ্ঠ : দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনেও তাদের প্রতিশ্রুতি ছিল। সে ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
এম কে আনোয়ার : নির্বাচনী ইশতেহারে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিল দেশকে তারা দুর্নীতিমুক্ত করবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স হবে। আজকে দুর্নীতিতে সয়লাব হয়ে গেছে দেশ। সরকার ধারাবাহিকভাবে দুর্নীতিবাজদের পক্ষ অবলম্বন করে চলেছে। দ্রব্যমূল্য বিষয়ে যেমন উদাহরণ দেওয়া ছাড়াই মানুষ বুঝতে পারে, তেমনি দুর্নীতির ক্ষেত্রটিও অধিকতর বিস্তৃত।
কালের কণ্ঠ : দুর্নীতি দমন কমিশন সম্পর্কিত গৃহীত পদক্ষেপ কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
এম কে আনোয়ার : দুর্নীতি দমন ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে দুদককে শক্তিশালী করতে হবে। অথচ এই প্রতিষ্ঠানটিকে নিষ্ক্রিয় ও আজ্ঞাবহ করে তোলা হয়েছে। দুদকের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য একটি আইনের খসড়া ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত মূল্যমানের পণ্য ক্রয়ের জন্য কোনো দরপত্র প্রয়োজন হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই টাকা পর্যন্ত কাজ পেতে হলে দরপত্রদাতার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতার প্রয়োজনীয়তাকেও বাদ দেওয়া হয়েছে। আসলে সরকারি সমর্থনপুষ্ট ক্যাডারদের অবৈধ সহযোগিতা করার জন্যই এই বিধান করা হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : বিদ্যুৎ খাত সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
এম কে আনোয়ার : গোটা জাতিকে একটি অশুভ সিদ্ধান্তের ফল ভোগ করতে হবে দীর্ঘদিন। আর সেই সিদ্ধান্তটি বিদ্যুৎসংক্রান্ত। দরপত্র ছাড়া অযাচিত প্রস্তাবের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার কাজ দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। সেই টাকা বিদ্যুৎ তৈরির নামে ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ কি উৎপাদন হয়েছে? সবচেয়ে বড় কথা, দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করার জন্য সরকার দায়মুক্তি আইনের ব্যবস্থা করেছে। এভাবে আইন করে কোথাও দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করা হয় এটা ভাবাও যায় না।
কালের কণ্ঠ : আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
এম কে আনোয়ার : চরম অবনতি হয়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। প্রতিদিন সংবাদপত্রই তার বড় প্রমাণ। এ পরিস্থিতির জন্য কোন কোন কারণ দায়ী বলে যদি জিজ্ঞেস করেন তাহলে বলব, আইন নিজের পথে চলার সুযোগ পায় না বলেই এমনটা হচ্ছে। দেখুন, সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের ক্ষেত্রে আইনের কোনো বিধান মানার প্রয়োজন হয় না। তাদের জন্য আইন অচল। সে যত অপরাধই করুক না কেন। সাড়ে সাত হাজার মামলা তুলে নেওয়া হলো সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের নামের। এই মামলাগুলোর মধ্যে অভিযুক্ত ছিল অন্তত লক্ষাধিক মানুষ। তাদের মুক্তির পর নিজেরা আইনের উর্ধ্বে বলে মনে করবে, এটাই স্বাভাবিক। অসংখ্য মানুষ খুন হয়েছে গত সাড়ে তিন বছরে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই সময় সাংবাদিকই খুন হয়েছেন ১৮ জন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সরকার দোষীদের আইনের আওতায় আনতে পারেনি। সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের প্রধান কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে, সরকারের দুর্নীতির খবর প্রকাশের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে। দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন, কারো শোয়ার ঘরের নিরাপত্তা দিতে পারবেন না। শোয়ার ঘরে মানুষ খুন হয়, রাস্তায় খুন হয়, মানুষ তাহলে যাবে কোথায়? বিখ্যাত সাংবাদিকের সেই উক্তিকেই মনে করতে চাই, আমরা স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই।
সাড়ে তিন বছরে গ্যাস-বিদ্যুৎ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বিদ্যুতের লোডশেডিং আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই সারা দিন চার-পাঁচ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ থাকে না।
বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা দেশকে আজ বন্ধুহীন করে রেখেছে। একদেশমুখী বৈদেশিক নীতির ফলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দরকষাকষির যে শক্তি ছিল, তা হ্রাস পেয়েছে। করিডর, ট্রানজিট, ভারতের চাহিদামতো বন্দর সুবিধা- সবই তো দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে তিস্তার পানি চুক্তি সম্পন্ন হয়নি এমন অনেক সমস্যারই সমাধান করা সম্ভব হয়নি সরকারের পক্ষে।
কালের কণ্ঠ : আপনাদের শাসনামলে প্রশাসনে দলীয়করণের অভিযোগ আনা হয়েছিল তৎকালীন বিরোধী দলের পক্ষ থেকে। এখন অভিযোগ করছেন আপনারা। স্পষ্টত প্রশাসন আজকে দ্বিধাবিভক্ত। এ পরিস্থিতির অবসান হবে কিভাবে?
এম কে আনোয়ার : প্রশাসনের প্রধান শক্তি হচ্ছে তার নির্দলীয় ভাবমূর্তি। আজ সেগুলো শেষ করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের হস্তক্ষেপ থেকে বিচার বিভাগও রেহাই পায়নি। দলীয়করণ শুরু হয় ১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চের মাধ্যমে। সেই ধারাবাহিকতা আরো বিস্তৃত হয়েছে। আজকে নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতির ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। সরকারের অনুগত না হলে যোগ্যদেরও চরম দুরবস্থায় পড়তে হয়। দলীয়করণের মাধ্যমে প্রশাসনের কর্মীদের যেভাবে নৈতিক বল ক্ষুণ্ন করা হয়েছে, তার প্রভাব থাকবে অনেক দিন।
একটি ব্যক্তিগত বিষয় বলতে চাই। প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সামনে গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে আমাদের ৪৬ জন নেতার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তার মধ্যে আমিও একজন। গত ৩১ জুলাই মামলার শুনানিকালে মামলা থেকে আমাদের অব্যাহতি দেওয়ার জন্য আবেদন করা হয়। কোনো শুনানি না করেই আদালত এই আবেদন বাতিল করে দেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়ার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করা হয়। সেটিও বাতিল হয়ে যায়। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী আসামিদের প্রত্যেককে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ পড়ে শোনাতে হয়। সে দোষী কি না জিজ্ঞেস করা হয়। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আছে, তা পড়ে শোনানো হয়নি। এ ব্যাপারে আদালত প্রভাবমুক্তভাবে কাজ করতে পেরেছে বলে আমার কাছে মনে হয়নি।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি কতটুকু দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পেরেছে বলে আপনি মনে করেন?
এম কে আনোয়ার : বিরোধী দলের দায়িত্ব হচ্ছে সরকারের ভুলত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেওয়া। আমার মনে হয়, সে ক্ষেত্রে আমরা শতভাগ দায়িত্ব পালন করেছি। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, সরকার আমাদের কোনো প্রস্তাবই গ্রহণ করে না। উল্টো অশ্লীল কথাবার্তাও শুনতে হচ্ছে। যেমন- এসব চোর-ডাকাতের সঙ্গে কি আলোচনায় বসব! যখনই কোনো বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে তখনই আমরা সরকারকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে গেছি। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সময় আমাদের নেত্রী প্রথমই বলেছিলেন যে আমরা সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই। সহযোগিতা গ্রহণ না করে উল্টো বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধেই মামলা ঠুকে দেওয়া হলো। আমরা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পর্কে সরকারকে সাবধান করে দিয়েছিলাম। আজকে এই প্রকল্প আমাদের অর্থনীতিকে দীর্ঘমেয়াদি সংকটে ফেলবে। শত শত কোটি টাকা বিদেশে চলে গেছে এই কুইক রেন্টালের নামে। শেয়ারবাজার সম্পর্কে সরকারকে বলেছিলাম দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে; কিন্তু নেওয়া হয়নি। বরং দোষীদের পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হলো। একজন মন্ত্রীর ভাষায়ই বলতে হয়, শুঁটকির বাজারে বিড়াল পাহারাদার নিয়োগের মতো মনে হবে। সরকারের সব ব্যর্থতার কথা জনগণকে জানানোর চেষ্টা করেছি আমরা। যে কারণে সরকারের ব্যর্থতা সম্পর্কে ব্যাপক জনমত তৈরি হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। এই বিচারকে আপনারা কিভাবে দেখছেন?
এম কে আনোয়ার : আমরাও বিচার চাই। এ সম্পর্কে দ্বিতীয় কথা বলার সুযোগ নেই। কিন্তু আমরা বিচারের নামে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ হোক, এটা চাই না। একে সমর্থনও করি না। বিচারের মান হতে হবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। ১৯৫ জন প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীকে কেন ক্ষমা করে দেওয়া হলো সেটি বের করতে হবে। মূল আসামির বিচার না করে সহযোগীদের বিচার কেন হবে- এ প্রশ্ন আছে। আমরা দাবি করি, পাকিস্তানি দোষী সৈনিকদের বিচার হোক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সংবিধান সংশোধন করা হলো। এক লাখ লোককে গ্রেপ্তার করা হলো। ৪০ হাজারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলো। আট হাজারের মতো বিচার হলো। ৭০০ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দেওয়া হলো। আওয়ামী লীগ সরকার তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করল।
কালের কণ্ঠ : কিন্তু সাধারণ ক্ষমায় সবাই অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অনেকেই শাস্তি ভোগ করতে শুরু করেছিল। অনেকেই ছিল বিচারাধীন।
এম কে আনোয়ার : সরকার কেন বলছে না, যারা এখন আদালতের কাঠগড়ায় আছে, তাদের মধ্যে কারা সাধারণ ক্ষমার আওতার বাইরে আছে। বলা হয়, সরকারি দলের মধ্যেও যুদ্ধাপরাধী রয়েছে।
কালের কণ্ঠ : বিএনপি-আওয়ামী লীগের এই বিবাদের সুযোগে তৃতীয় শক্তির উত্থান ঘটতে পারে?
এম কে আনোয়ার : তৃতীয় শক্তি সম্পর্কে আপনারা যা বলছেন সে সম্পর্কে আমি পরিষ্কার নই। তৃতীয় শক্তি বলতে যদি সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বাইরে কারো কথা বলেন, তাহলে আমি বলব, এটা ঠিক না। কারণ মানুষ এটা চায় না।
কালের কণ্ঠ : বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে মতানৈক্য হয়েছে পদ্মা সেতুতে কথিত দুর্নীতি নিয়ে। একজন মন্ত্রী পদত্যাগও করেছেন। বিশ্বব্যাংক, সরকার ও পদ্মা সেতু সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
এম কে আনোয়ার : এ নিয়ে এত বেশি বলা হয়েছে আর কী বলব? আমাদের দেশ গরিব। আমাদের ইতিবাচক বেশ কিছু অর্জন আছে। আমরা খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে পেরেছি, দারিদ্র্যমুক্তির পথে অনেকটা এগিয়েছি, তিন-চারটা নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে। আমাদের উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক। সেই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন লেজেগোবরে করে ফেলেছে সরকার। আমাদের আঞ্চলিক একটি শব্দ আছে 'ব্যাটাগিরি'। সরকার ব্যাটাগিরি দেখাতে গিয়ে এই দুরবস্থার সৃষ্টি করেছে। বিশ্বব্যাংক চুক্তি বাতিল করেছে। তার পরও দেখুন, অর্থমন্ত্রী দায়িত্বহীন কথা বলছেন। সরকার বিশ্বব্যাংকের চিঠিগুলো প্রকাশ করছে না কেন? যেহেতু অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, তাই মনে করা যায়, শীর্ষস্থানীয় কেউ জড়িত থাকতে পারেন। আমরা বলেছি দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা করতে।
কালের কণ্ঠ : বিকল্প অর্থায়নের কথা বলা হচ্ছে। এটা কি সম্ভব?
এম কে আনোয়ার : কল্পনাপ্রসূত। ৫৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ আছে উন্নয়ন খাতে। সেখান থেকে ২৪ হাজার কোটি টাকা নেওয়া হবে। এটা কি যেমন-তেমন ব্যাপার নাকি? এতে করে শিক্ষা-স্বাস্থ্য ইত্যাদি অতিজরুরি খাতগুলো ভেঙে পড়বে। দ্বিতীয় সূত্র থেকে অর্থায়ন হলে দায়ভার অনেক বেড়ে যাবে। আবেগ নয়, সরকার বাস্তবতা মেনে নিলেই ভালো করবে।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
এম কে আনোয়ার : আপনাকেও ধন্যবাদ।
এম কে আনোয়ার : প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা অত্যন্ত অস্পষ্ট। শুধু তা-ই নয়, তাঁর বক্তব্য বিভ্রান্তিমূলকও বটে। আমরা দাবি করে আসছি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। এই সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল আওয়ামী লীগের দাবির মুখে। সমাধান হচ্ছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করা। তার জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ব্যবস্থা গ্রহণ।
কালের কণ্ঠ : তিনি তো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন। এই সূত্রেও তো এগিয়ে যাওয়া যায়?
এম কে আনোয়ার : প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সম্মান রেখেই বলতে চাই, তিনি কখন কী বলেন তা বোঝা মুশকিল। এখন যা বলেন, পরে তার বিপরীতও বলতে পারেন। কথার ধারাবাহিকতা থাকে না, আবার সামঞ্জস্যও থাকে না। হয়তো বলেন একটা, করেন আরেকটা। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কথাই যদি বলি, তাহলে সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যায়। সেই সংসদীয় কমিটি হয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সংসদ সদস্যদের নিয়ে। তিনি সেখানে স্পষ্ট বলেছিলেন, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হলো। সংবিধান সংশোধনীতে এমন কিছু বিষয় আনা হয়েছে, যা পৃথিবীর কোথাও আছে কি না সন্দেহ। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে থাকতে পারবে। কিন্তু তিনি বলেননি এই সরকার নির্দলীয় কিংবা দলনিরপেক্ষ হবে কি না। তাঁকেই প্রধানমন্ত্রী রেখে একটি সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছে। আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য, কোনো দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না।
কালের কণ্ঠ : আপনারা বলছেন দেশবাসী এই প্রস্তাব মেনে নেবে না, কিন্তু কেন?
এম কে আনোয়ার : ১৯৯৫ সালে ফিরে যেতে পারি। কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ানের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। তিনি সেদিন প্রস্তাব দিয়েছিলেন ১১ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিপরিষদ গঠনের জন্য। সেই মন্ত্রিপরিষদে প্রধানমন্ত্রীসহ বিএনপি থেকে পাঁচজন, বিরোধী দল থেকে পাঁচজন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছিল। তার বাইরে একজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, যিনি হবেন দলীয় রাজনীতির বাইরের কেউ। আবার তাঁর হাতে স্বরাষ্ট্র ও সংস্থাপনের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ন্যস্ত থাকবে। আজকে প্রধানমন্ত্রী যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তার চেয়ে বহুগুণ ভালো ছিল সেদিনের সেই প্রস্তাবটি। কিন্তু তাঁরা সেই প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আজকে প্রধানমন্ত্রী কিভাবে আশা করছেন দেশবাসী তাঁর এই প্রস্তাব মেনে নেবে?
কালের কণ্ঠ : বর্তমান সরকারের সাড়ে তিন বছর চলছে। সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার মূল্যায়ন করবেন কিভাবে?
এম কে আনোয়ার : মূল্যায়নের জন্য তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের দিকে তাকাতে হবে। তাদের পাঁচটি ওয়াদার মধ্যে অন্যতম ছিল, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও জনগণের সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা। এই ব্যর্থতা প্রমাণের জন্য তথ্য-প্রমাণ দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। ২০০৬ সালে বিএনপি দ্রব্যমূল্য যে স্তরে রেখে এসেছিল, তা আজকে দ্বিগুণ কিংবা তিন গুণ পর্যন্ত হয়েছে। চালের দাম ছিল ১৭ টাকা। সেই চাল এখন ৩৫ টাকা। সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৪৫ টাকা। সেই তেল এখন ১১০ টাকায় কিনতে হয় সাধারণ মানুষকে। কয়টা দ্রব্যের দামের কথা আমি উল্লেখ করব? নিত্যপ্রয়োজনীয় এমন কোনো দ্রব্য নেই, যার দাম আকাশছোঁয়া হয়নি।
কালের কণ্ঠ : দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনেও তাদের প্রতিশ্রুতি ছিল। সে ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
এম কে আনোয়ার : নির্বাচনী ইশতেহারে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিল দেশকে তারা দুর্নীতিমুক্ত করবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স হবে। আজকে দুর্নীতিতে সয়লাব হয়ে গেছে দেশ। সরকার ধারাবাহিকভাবে দুর্নীতিবাজদের পক্ষ অবলম্বন করে চলেছে। দ্রব্যমূল্য বিষয়ে যেমন উদাহরণ দেওয়া ছাড়াই মানুষ বুঝতে পারে, তেমনি দুর্নীতির ক্ষেত্রটিও অধিকতর বিস্তৃত।
কালের কণ্ঠ : দুর্নীতি দমন কমিশন সম্পর্কিত গৃহীত পদক্ষেপ কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
এম কে আনোয়ার : দুর্নীতি দমন ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে দুদককে শক্তিশালী করতে হবে। অথচ এই প্রতিষ্ঠানটিকে নিষ্ক্রিয় ও আজ্ঞাবহ করে তোলা হয়েছে। দুদকের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য একটি আইনের খসড়া ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত মূল্যমানের পণ্য ক্রয়ের জন্য কোনো দরপত্র প্রয়োজন হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই টাকা পর্যন্ত কাজ পেতে হলে দরপত্রদাতার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতার প্রয়োজনীয়তাকেও বাদ দেওয়া হয়েছে। আসলে সরকারি সমর্থনপুষ্ট ক্যাডারদের অবৈধ সহযোগিতা করার জন্যই এই বিধান করা হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : বিদ্যুৎ খাত সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
এম কে আনোয়ার : গোটা জাতিকে একটি অশুভ সিদ্ধান্তের ফল ভোগ করতে হবে দীর্ঘদিন। আর সেই সিদ্ধান্তটি বিদ্যুৎসংক্রান্ত। দরপত্র ছাড়া অযাচিত প্রস্তাবের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার কাজ দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। সেই টাকা বিদ্যুৎ তৈরির নামে ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ কি উৎপাদন হয়েছে? সবচেয়ে বড় কথা, দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করার জন্য সরকার দায়মুক্তি আইনের ব্যবস্থা করেছে। এভাবে আইন করে কোথাও দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করা হয় এটা ভাবাও যায় না।
কালের কণ্ঠ : আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
এম কে আনোয়ার : চরম অবনতি হয়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। প্রতিদিন সংবাদপত্রই তার বড় প্রমাণ। এ পরিস্থিতির জন্য কোন কোন কারণ দায়ী বলে যদি জিজ্ঞেস করেন তাহলে বলব, আইন নিজের পথে চলার সুযোগ পায় না বলেই এমনটা হচ্ছে। দেখুন, সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের ক্ষেত্রে আইনের কোনো বিধান মানার প্রয়োজন হয় না। তাদের জন্য আইন অচল। সে যত অপরাধই করুক না কেন। সাড়ে সাত হাজার মামলা তুলে নেওয়া হলো সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের নামের। এই মামলাগুলোর মধ্যে অভিযুক্ত ছিল অন্তত লক্ষাধিক মানুষ। তাদের মুক্তির পর নিজেরা আইনের উর্ধ্বে বলে মনে করবে, এটাই স্বাভাবিক। অসংখ্য মানুষ খুন হয়েছে গত সাড়ে তিন বছরে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই সময় সাংবাদিকই খুন হয়েছেন ১৮ জন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সরকার দোষীদের আইনের আওতায় আনতে পারেনি। সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের প্রধান কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে, সরকারের দুর্নীতির খবর প্রকাশের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে। দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন, কারো শোয়ার ঘরের নিরাপত্তা দিতে পারবেন না। শোয়ার ঘরে মানুষ খুন হয়, রাস্তায় খুন হয়, মানুষ তাহলে যাবে কোথায়? বিখ্যাত সাংবাদিকের সেই উক্তিকেই মনে করতে চাই, আমরা স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই।
সাড়ে তিন বছরে গ্যাস-বিদ্যুৎ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বিদ্যুতের লোডশেডিং আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই সারা দিন চার-পাঁচ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ থাকে না।
বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা দেশকে আজ বন্ধুহীন করে রেখেছে। একদেশমুখী বৈদেশিক নীতির ফলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দরকষাকষির যে শক্তি ছিল, তা হ্রাস পেয়েছে। করিডর, ট্রানজিট, ভারতের চাহিদামতো বন্দর সুবিধা- সবই তো দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে তিস্তার পানি চুক্তি সম্পন্ন হয়নি এমন অনেক সমস্যারই সমাধান করা সম্ভব হয়নি সরকারের পক্ষে।
কালের কণ্ঠ : আপনাদের শাসনামলে প্রশাসনে দলীয়করণের অভিযোগ আনা হয়েছিল তৎকালীন বিরোধী দলের পক্ষ থেকে। এখন অভিযোগ করছেন আপনারা। স্পষ্টত প্রশাসন আজকে দ্বিধাবিভক্ত। এ পরিস্থিতির অবসান হবে কিভাবে?
এম কে আনোয়ার : প্রশাসনের প্রধান শক্তি হচ্ছে তার নির্দলীয় ভাবমূর্তি। আজ সেগুলো শেষ করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের হস্তক্ষেপ থেকে বিচার বিভাগও রেহাই পায়নি। দলীয়করণ শুরু হয় ১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চের মাধ্যমে। সেই ধারাবাহিকতা আরো বিস্তৃত হয়েছে। আজকে নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতির ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। সরকারের অনুগত না হলে যোগ্যদেরও চরম দুরবস্থায় পড়তে হয়। দলীয়করণের মাধ্যমে প্রশাসনের কর্মীদের যেভাবে নৈতিক বল ক্ষুণ্ন করা হয়েছে, তার প্রভাব থাকবে অনেক দিন।
একটি ব্যক্তিগত বিষয় বলতে চাই। প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সামনে গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে আমাদের ৪৬ জন নেতার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তার মধ্যে আমিও একজন। গত ৩১ জুলাই মামলার শুনানিকালে মামলা থেকে আমাদের অব্যাহতি দেওয়ার জন্য আবেদন করা হয়। কোনো শুনানি না করেই আদালত এই আবেদন বাতিল করে দেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়ার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করা হয়। সেটিও বাতিল হয়ে যায়। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী আসামিদের প্রত্যেককে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ পড়ে শোনাতে হয়। সে দোষী কি না জিজ্ঞেস করা হয়। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আছে, তা পড়ে শোনানো হয়নি। এ ব্যাপারে আদালত প্রভাবমুক্তভাবে কাজ করতে পেরেছে বলে আমার কাছে মনে হয়নি।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি কতটুকু দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পেরেছে বলে আপনি মনে করেন?
এম কে আনোয়ার : বিরোধী দলের দায়িত্ব হচ্ছে সরকারের ভুলত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেওয়া। আমার মনে হয়, সে ক্ষেত্রে আমরা শতভাগ দায়িত্ব পালন করেছি। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, সরকার আমাদের কোনো প্রস্তাবই গ্রহণ করে না। উল্টো অশ্লীল কথাবার্তাও শুনতে হচ্ছে। যেমন- এসব চোর-ডাকাতের সঙ্গে কি আলোচনায় বসব! যখনই কোনো বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে তখনই আমরা সরকারকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে গেছি। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সময় আমাদের নেত্রী প্রথমই বলেছিলেন যে আমরা সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই। সহযোগিতা গ্রহণ না করে উল্টো বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধেই মামলা ঠুকে দেওয়া হলো। আমরা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পর্কে সরকারকে সাবধান করে দিয়েছিলাম। আজকে এই প্রকল্প আমাদের অর্থনীতিকে দীর্ঘমেয়াদি সংকটে ফেলবে। শত শত কোটি টাকা বিদেশে চলে গেছে এই কুইক রেন্টালের নামে। শেয়ারবাজার সম্পর্কে সরকারকে বলেছিলাম দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে; কিন্তু নেওয়া হয়নি। বরং দোষীদের পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হলো। একজন মন্ত্রীর ভাষায়ই বলতে হয়, শুঁটকির বাজারে বিড়াল পাহারাদার নিয়োগের মতো মনে হবে। সরকারের সব ব্যর্থতার কথা জনগণকে জানানোর চেষ্টা করেছি আমরা। যে কারণে সরকারের ব্যর্থতা সম্পর্কে ব্যাপক জনমত তৈরি হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। এই বিচারকে আপনারা কিভাবে দেখছেন?
এম কে আনোয়ার : আমরাও বিচার চাই। এ সম্পর্কে দ্বিতীয় কথা বলার সুযোগ নেই। কিন্তু আমরা বিচারের নামে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ হোক, এটা চাই না। একে সমর্থনও করি না। বিচারের মান হতে হবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। ১৯৫ জন প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীকে কেন ক্ষমা করে দেওয়া হলো সেটি বের করতে হবে। মূল আসামির বিচার না করে সহযোগীদের বিচার কেন হবে- এ প্রশ্ন আছে। আমরা দাবি করি, পাকিস্তানি দোষী সৈনিকদের বিচার হোক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সংবিধান সংশোধন করা হলো। এক লাখ লোককে গ্রেপ্তার করা হলো। ৪০ হাজারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলো। আট হাজারের মতো বিচার হলো। ৭০০ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দেওয়া হলো। আওয়ামী লীগ সরকার তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করল।
কালের কণ্ঠ : কিন্তু সাধারণ ক্ষমায় সবাই অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অনেকেই শাস্তি ভোগ করতে শুরু করেছিল। অনেকেই ছিল বিচারাধীন।
এম কে আনোয়ার : সরকার কেন বলছে না, যারা এখন আদালতের কাঠগড়ায় আছে, তাদের মধ্যে কারা সাধারণ ক্ষমার আওতার বাইরে আছে। বলা হয়, সরকারি দলের মধ্যেও যুদ্ধাপরাধী রয়েছে।
কালের কণ্ঠ : বিএনপি-আওয়ামী লীগের এই বিবাদের সুযোগে তৃতীয় শক্তির উত্থান ঘটতে পারে?
এম কে আনোয়ার : তৃতীয় শক্তি সম্পর্কে আপনারা যা বলছেন সে সম্পর্কে আমি পরিষ্কার নই। তৃতীয় শক্তি বলতে যদি সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বাইরে কারো কথা বলেন, তাহলে আমি বলব, এটা ঠিক না। কারণ মানুষ এটা চায় না।
কালের কণ্ঠ : বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে মতানৈক্য হয়েছে পদ্মা সেতুতে কথিত দুর্নীতি নিয়ে। একজন মন্ত্রী পদত্যাগও করেছেন। বিশ্বব্যাংক, সরকার ও পদ্মা সেতু সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
এম কে আনোয়ার : এ নিয়ে এত বেশি বলা হয়েছে আর কী বলব? আমাদের দেশ গরিব। আমাদের ইতিবাচক বেশ কিছু অর্জন আছে। আমরা খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে পেরেছি, দারিদ্র্যমুক্তির পথে অনেকটা এগিয়েছি, তিন-চারটা নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে। আমাদের উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক। সেই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন লেজেগোবরে করে ফেলেছে সরকার। আমাদের আঞ্চলিক একটি শব্দ আছে 'ব্যাটাগিরি'। সরকার ব্যাটাগিরি দেখাতে গিয়ে এই দুরবস্থার সৃষ্টি করেছে। বিশ্বব্যাংক চুক্তি বাতিল করেছে। তার পরও দেখুন, অর্থমন্ত্রী দায়িত্বহীন কথা বলছেন। সরকার বিশ্বব্যাংকের চিঠিগুলো প্রকাশ করছে না কেন? যেহেতু অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, তাই মনে করা যায়, শীর্ষস্থানীয় কেউ জড়িত থাকতে পারেন। আমরা বলেছি দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা করতে।
কালের কণ্ঠ : বিকল্প অর্থায়নের কথা বলা হচ্ছে। এটা কি সম্ভব?
এম কে আনোয়ার : কল্পনাপ্রসূত। ৫৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ আছে উন্নয়ন খাতে। সেখান থেকে ২৪ হাজার কোটি টাকা নেওয়া হবে। এটা কি যেমন-তেমন ব্যাপার নাকি? এতে করে শিক্ষা-স্বাস্থ্য ইত্যাদি অতিজরুরি খাতগুলো ভেঙে পড়বে। দ্বিতীয় সূত্র থেকে অর্থায়ন হলে দায়ভার অনেক বেড়ে যাবে। আবেগ নয়, সরকার বাস্তবতা মেনে নিলেই ভালো করবে।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
এম কে আনোয়ার : আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments