অন্তর্বর্তী না নির্দলীয়- ঈদের পরে জমবে রাজনীতি
জাতীয় নির্বাচনের এখনও ১৪ মাস বাকি। কিন্তু এখনই ‘অন্তর্বর্তী’ নাকি ‘নির্দলীয়’ কোন পদ্ধতির সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে আগামী নির্বাচনÑ এ ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দল মুখোমুখি অবস্থানে। জাতীয় নির্বাচনের সময় অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভায় বিরোধী দলকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব, আর বিরোধী দলের নাকচÑ রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এ নিয়ে চলছে দু’পক্ষের পাল্টাপাল্টি বাহাস, দোষারোপের রাজনীতি।
বিরোধী দল বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না, করতেও দেবে না। সরকারী পক্ষ বলছে, সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার কোন সুযোগ নেই। তাই তত্ত্বাবধায়ক নয়, আলোচনা হতে পারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরোধী দলকে নিয়েই ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ গঠনের ইতিবাচক প্রস্তাব দিয়ে রাজনৈতিক বল ঠেলে দিয়েছেন বিরোধী দলের কোর্টে। প্রশ্ন উঠেছেÑ প্রধানমন্ত্রীর এই ইতিবাচক প্রস্তাব আমলে নিয়ে বিরোধী দল সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসবে, নাকি বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতেই ঈদের পর রাজপথ উত্তপ্ত করতে চাইবেÑ সেদিকেই তাকিয়ে এখন দেশের মানুষ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজপথে নয়, সমাধান খুঁজতে হবে সংসদেই। আর সংলাপই একমাত্র সমাধানের পথ। আর এ ক্ষেত্রে বড় দল দুটিকেই কিছুটা ছাড় দিয়ে এক বা একাধিক ফর্মুলা নিয়ে সংলাপে বসতে হবে। তবে কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসে প্রধানমন্ত্রীর নতুন প্রস্তাবকে তাঁরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। তাঁরা মনে করেন, সংলাপের বন্ধ জানালা ঈষৎ খুলেছে। এখন দরজাও খুলতে হবে। দেশ, গণতন্ত্র ও জনগণের কল্যাণে সরকার ও বিরোধী দল উভয়কে আরও ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় আবারও ওয়ান-ইলেভেনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এর পরিণাম কারোর জন্যই শুভ হবে না। প্রধানমন্ত্রীর নতুন প্রস্তাবকে ঘিরে এক ধরনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলেই মনে করছেন তাঁরা।
এ প্রসঙ্গে দেশের প্রবীণতম আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিক-উল-হকও মনে করেন, নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আহ্বান জানিয়েছেন তাতে বিএনপির ইতিবাচক সাড়া দেয়া উচিত। এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ, নানা আশঙ্কা রয়েছে। নির্বাচন যথাসময়ে হবে কিনা তা নিয়ে অনেকেই কথা বলছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের যে প্রস্তাব দিয়েছেন তাতে সঙ্কট উত্তরণের একটি উপায় বের হলো। এর মাধ্যমে অন্তত সমঝোতার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর এখন আমার মনে হচ্ছে, নির্বাচন প্রশ্নে সমঝোতা হবেই। এতদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে যে কোন মূল্যে নির্বাচন করতে মরিয়া ছিল শাসক দল আওয়ামী লীগ। এ লক্ষ্যে বিরোধী দলকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে মোকাবেলা করে আসছে তারা। অন্যদিকে যে কোন নামেই নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে অনড় ছিল বিএনপি। দাবি আদায়ে ঈদের পর কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়েও রেখেছে তারা।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ওই পদ্ধতিতে ফিরে যেতে রাজি নয়। তারা নির্বাচনকালে একটি ছোট আকারের অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে রাজি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডনে বিবিসির সঙ্গে দেয়া সাক্ষাতে নিজেই হার্ডলাইন থেকে সরে এসে নতুন প্রস্তাব রেখে বলেছেন, ইচ্ছা করলে বিরোধী দল বিএনপিও নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দিতে পারে। একইসঙ্গে সেই অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা কী হবে, সে ব্যাপারে বিএনপির কাছ থেকে প্রস্তাবও চেয়েছেন তিনি।
তবে প্রধানমন্ত্রীর এই প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। তাঁর অবস্থানে অনড় থেকে বলেন, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। বিএনপি কোন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না। তিনি এও হুমকি দেন, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার গঠনের ব্যাপারে সরকার পদক্ষেপ না নিলে ঈদের পর আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে তা মানতে বাধ্য করা হবে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এ প্রস্তাবের ব্যাপারে বিএনপির কোন চিন্তাভাবনা নেই। দলের একটিই সিদ্ধান্ত, তা হলো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি কোন নির্বাচনে যাবে না। সরকার যেভাবে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছে, একইভাবে সরকারকে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করতে হবে। অন্যথায় সরকার বা কোন দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না।
বিরোধীদলীয় নেত্রী নাকচ করলেও প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বানে কিছুটা আশাবাদী হয়ে উঠছেন রাজনৈতিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। নির্বাচনের সময় সরকার পদ্ধতি নিয়ে আগেভাগেই প্রস্তাব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী সুবিবেচনার পরিচয় দিয়েছেন বলে মনে করেন তাঁরা। তবে তাঁরা এও বলছেন, নির্বাচনটা কীভাবে হলো সেটি বড় কথা নয়। সব রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেই নির্বাচন সফল হবে। জনগণও সেটি মেনে নেবে। সেক্ষেত্রে কীভাবে নির্বাচন হবে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে অন্তত সংলাপের প্রস্তাবটা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় মন্ত্রিসভার প্রস্তাবকে একটি মাইলফলক রাজনৈতিক অগ্রগতি হিসেবেও গণ্য করছেন তাঁরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব বিরোধী দল নাকচ করলেও সমঝোতার সব পথ বন্ধ হয়ে যায়নি। দেশী-বিদেশী অব্যাহত চাপের মুখে কোন পদ্ধতির সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন হবে তা নিয়ে ঈদের পর বহুল আলোচিত সংলাপ অনুষ্ঠিত হতে পারে। নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোন পদ্ধতিতে হবেÑ এই একমাত্র এজেন্ডা নিয়েই সংলাপ হতে পারে সংসদ বা বাইরে যে কোন স্থানেই। এ ক্ষেত্রে উদ্যোগ সরকার তরফেই নেয়া হতে পারে। বিরোধী দল ইতিবাচক সাড়া দিলে ঈদের পরই বিএনপিসহ বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দেয়া হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর নতুন প্রস্তাবের পর নড়েচড়ে বসেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব নাকচ করলেও ভেতরে ভেতরে বিএনপিও তৈরি করছে নতুন একটি বিকল্প প্রস্তাব। ঈদের পর তারা এ বিকল্প প্রস্তাব হাজির করতে পারে সরকারের সামনে। দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতে, বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাতকার কোন দেশের জাতীয় সঙ্কট নিরসনের ভিত্তি হতে পারে না। তাই আওয়ামী লীগের উচিত হবে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা সংসদে কিংবা দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশ করা। সরকারী দলের কাছ থেকে কোন আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পেলে বিএনপিও বিকল্প প্রস্তাব দেবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের এমন বক্তব্যের ইতিবাচক জবাব দিয়েছেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা ঠিক করতে বিএনপি আলোচনার ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে এলে আওয়ামী লীগ অবশ্যই আলোচনার উদ্যোগ নেবে। আওয়ামী লীগ সংলাপে বসতে প্রস্তুত। এ বিষয়ে তারা (বিএনপি) সংসদে যৌক্তিক দাবি নিয়ে এলে দেশ ও জনগণের কল্যাণে তা মেনে নেয়া হবে।
বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে সাড়া দেবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি এও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাব না এমন সিদ্ধান্তে যদি বিএনপি অটল থাকে তাহলে আলোচনার ব্যাপারে আমাদের দিক থেকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয়ার সুযোগ কম থাকে। অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে বিএনপি কোন ইতিবাচক কথা বললে আওয়ামী লীগ আলোচনায় বসার আহ্বান জানাতে পারে। আমরা চাই তারা সংসদে এসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা কি হবে তা নিয়ে প্রস্তাব দিক। তারপর দু’দল আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধানের পথ বের হয়ে আসবে। বিএনপি আগে প্রস্তাব দিলে আমরা দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য যে কোন যৌক্তিক প্রস্তাব মেনে নিতে পারি। আগামী নির্বাচন সংবিধান অনুসারেই হবে। যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে তাদের তত্ত্বাবধায়ক দাবি থেকে সরে আসা উচিত।
প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের এমন বৈপরীত্য অবস্থান প্রসঙ্গে দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। আলোচনার বিকল্প হলো সংঘাত, যা দেশ ও জনগণÑ কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। আমাদের বিশ্বাস, সরকারী দল যদি সত্যি সত্যি নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনায় আগ্রহী হয়, বিরোধী দল তাতে ইতিবাচক সাড়া দেবে। সেই সরকারের ধরন কী হবে, সরকারে কারা থাকবেন, নির্বাচন কমিশনকে কীভাবে শক্তিশালী করা যাবে, কীভাবে দলীয় হস্তক্ষেপ বন্ধ করা যাবে- সেসব বিষয়ে দু’পক্ষই সংসদে আলোচনার মাধ্যমে স্পষ্ট করতে হবে। কারণ রাজনৈতিক সংঘাত বাড়ালেই ক্ষতি হবে দেশের, ক্ষতিগ্রস্ত হবে কষ্টার্জিত গণতন্ত্র।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজপথে নয়, সমাধান খুঁজতে হবে সংসদেই। আর সংলাপই একমাত্র সমাধানের পথ। আর এ ক্ষেত্রে বড় দল দুটিকেই কিছুটা ছাড় দিয়ে এক বা একাধিক ফর্মুলা নিয়ে সংলাপে বসতে হবে। তবে কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসে প্রধানমন্ত্রীর নতুন প্রস্তাবকে তাঁরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। তাঁরা মনে করেন, সংলাপের বন্ধ জানালা ঈষৎ খুলেছে। এখন দরজাও খুলতে হবে। দেশ, গণতন্ত্র ও জনগণের কল্যাণে সরকার ও বিরোধী দল উভয়কে আরও ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় আবারও ওয়ান-ইলেভেনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এর পরিণাম কারোর জন্যই শুভ হবে না। প্রধানমন্ত্রীর নতুন প্রস্তাবকে ঘিরে এক ধরনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলেই মনে করছেন তাঁরা।
এ প্রসঙ্গে দেশের প্রবীণতম আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিক-উল-হকও মনে করেন, নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আহ্বান জানিয়েছেন তাতে বিএনপির ইতিবাচক সাড়া দেয়া উচিত। এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ, নানা আশঙ্কা রয়েছে। নির্বাচন যথাসময়ে হবে কিনা তা নিয়ে অনেকেই কথা বলছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের যে প্রস্তাব দিয়েছেন তাতে সঙ্কট উত্তরণের একটি উপায় বের হলো। এর মাধ্যমে অন্তত সমঝোতার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর এখন আমার মনে হচ্ছে, নির্বাচন প্রশ্নে সমঝোতা হবেই। এতদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে যে কোন মূল্যে নির্বাচন করতে মরিয়া ছিল শাসক দল আওয়ামী লীগ। এ লক্ষ্যে বিরোধী দলকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে মোকাবেলা করে আসছে তারা। অন্যদিকে যে কোন নামেই নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে অনড় ছিল বিএনপি। দাবি আদায়ে ঈদের পর কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়েও রেখেছে তারা।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ওই পদ্ধতিতে ফিরে যেতে রাজি নয়। তারা নির্বাচনকালে একটি ছোট আকারের অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে রাজি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডনে বিবিসির সঙ্গে দেয়া সাক্ষাতে নিজেই হার্ডলাইন থেকে সরে এসে নতুন প্রস্তাব রেখে বলেছেন, ইচ্ছা করলে বিরোধী দল বিএনপিও নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দিতে পারে। একইসঙ্গে সেই অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা কী হবে, সে ব্যাপারে বিএনপির কাছ থেকে প্রস্তাবও চেয়েছেন তিনি।
তবে প্রধানমন্ত্রীর এই প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। তাঁর অবস্থানে অনড় থেকে বলেন, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। বিএনপি কোন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না। তিনি এও হুমকি দেন, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার গঠনের ব্যাপারে সরকার পদক্ষেপ না নিলে ঈদের পর আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে তা মানতে বাধ্য করা হবে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এ প্রস্তাবের ব্যাপারে বিএনপির কোন চিন্তাভাবনা নেই। দলের একটিই সিদ্ধান্ত, তা হলো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি কোন নির্বাচনে যাবে না। সরকার যেভাবে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছে, একইভাবে সরকারকে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করতে হবে। অন্যথায় সরকার বা কোন দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না।
বিরোধীদলীয় নেত্রী নাকচ করলেও প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বানে কিছুটা আশাবাদী হয়ে উঠছেন রাজনৈতিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। নির্বাচনের সময় সরকার পদ্ধতি নিয়ে আগেভাগেই প্রস্তাব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী সুবিবেচনার পরিচয় দিয়েছেন বলে মনে করেন তাঁরা। তবে তাঁরা এও বলছেন, নির্বাচনটা কীভাবে হলো সেটি বড় কথা নয়। সব রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেই নির্বাচন সফল হবে। জনগণও সেটি মেনে নেবে। সেক্ষেত্রে কীভাবে নির্বাচন হবে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে অন্তত সংলাপের প্রস্তাবটা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় মন্ত্রিসভার প্রস্তাবকে একটি মাইলফলক রাজনৈতিক অগ্রগতি হিসেবেও গণ্য করছেন তাঁরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব বিরোধী দল নাকচ করলেও সমঝোতার সব পথ বন্ধ হয়ে যায়নি। দেশী-বিদেশী অব্যাহত চাপের মুখে কোন পদ্ধতির সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন হবে তা নিয়ে ঈদের পর বহুল আলোচিত সংলাপ অনুষ্ঠিত হতে পারে। নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোন পদ্ধতিতে হবেÑ এই একমাত্র এজেন্ডা নিয়েই সংলাপ হতে পারে সংসদ বা বাইরে যে কোন স্থানেই। এ ক্ষেত্রে উদ্যোগ সরকার তরফেই নেয়া হতে পারে। বিরোধী দল ইতিবাচক সাড়া দিলে ঈদের পরই বিএনপিসহ বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দেয়া হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর নতুন প্রস্তাবের পর নড়েচড়ে বসেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব নাকচ করলেও ভেতরে ভেতরে বিএনপিও তৈরি করছে নতুন একটি বিকল্প প্রস্তাব। ঈদের পর তারা এ বিকল্প প্রস্তাব হাজির করতে পারে সরকারের সামনে। দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতে, বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাতকার কোন দেশের জাতীয় সঙ্কট নিরসনের ভিত্তি হতে পারে না। তাই আওয়ামী লীগের উচিত হবে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা সংসদে কিংবা দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশ করা। সরকারী দলের কাছ থেকে কোন আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পেলে বিএনপিও বিকল্প প্রস্তাব দেবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের এমন বক্তব্যের ইতিবাচক জবাব দিয়েছেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা ঠিক করতে বিএনপি আলোচনার ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে এলে আওয়ামী লীগ অবশ্যই আলোচনার উদ্যোগ নেবে। আওয়ামী লীগ সংলাপে বসতে প্রস্তুত। এ বিষয়ে তারা (বিএনপি) সংসদে যৌক্তিক দাবি নিয়ে এলে দেশ ও জনগণের কল্যাণে তা মেনে নেয়া হবে।
বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে সাড়া দেবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি এও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাব না এমন সিদ্ধান্তে যদি বিএনপি অটল থাকে তাহলে আলোচনার ব্যাপারে আমাদের দিক থেকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয়ার সুযোগ কম থাকে। অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে বিএনপি কোন ইতিবাচক কথা বললে আওয়ামী লীগ আলোচনায় বসার আহ্বান জানাতে পারে। আমরা চাই তারা সংসদে এসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা কি হবে তা নিয়ে প্রস্তাব দিক। তারপর দু’দল আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধানের পথ বের হয়ে আসবে। বিএনপি আগে প্রস্তাব দিলে আমরা দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য যে কোন যৌক্তিক প্রস্তাব মেনে নিতে পারি। আগামী নির্বাচন সংবিধান অনুসারেই হবে। যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে তাদের তত্ত্বাবধায়ক দাবি থেকে সরে আসা উচিত।
প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের এমন বৈপরীত্য অবস্থান প্রসঙ্গে দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। আলোচনার বিকল্প হলো সংঘাত, যা দেশ ও জনগণÑ কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। আমাদের বিশ্বাস, সরকারী দল যদি সত্যি সত্যি নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনায় আগ্রহী হয়, বিরোধী দল তাতে ইতিবাচক সাড়া দেবে। সেই সরকারের ধরন কী হবে, সরকারে কারা থাকবেন, নির্বাচন কমিশনকে কীভাবে শক্তিশালী করা যাবে, কীভাবে দলীয় হস্তক্ষেপ বন্ধ করা যাবে- সেসব বিষয়ে দু’পক্ষই সংসদে আলোচনার মাধ্যমে স্পষ্ট করতে হবে। কারণ রাজনৈতিক সংঘাত বাড়ালেই ক্ষতি হবে দেশের, ক্ষতিগ্রস্ত হবে কষ্টার্জিত গণতন্ত্র।
No comments