সবচেয়ে ভালোবাসো মাতৃভাষাকে by আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) ইংরেজি তোমাদের প্রথম ভাষা। এটা হওয়া উচিত ছিল না। কোনো উন্নত দেশে এটা নেই। আমরা অনুন্নত বলেই তা হয়েছে। তাতেও অসুবিধা নেই। কিন্তু মূল অসুবিধা হলো, তোমাদের ইংরেজি শেখার ওপর এতই বেশি জোর দেওয়া হয় যে তার পাশে বাংলা প্রায় শেখানোই হয় না।
এর ফলে তোমরা যেমন বাংলা ভাষাটা শেখ না, তেমনি বাঙালি হয়েও ওঠো না। এর ফলে ব্রিটিশ আমলের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মতো এ কোটি কোটি বাঙালির দেশে তোমাদের একটা আধখাচড়া শ্রেণী হয়ে পড়ে থাকতে হবে। আমি বুঝি, তোমাদের একটা অসুবিধা আছে। তোমাদের স্কুল ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল। এ দেশে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল করাকে অনুমোদন দেওয়া হয়। তোমাদের পরীক্ষায় ১২০০ বা ১০০০ নম্বরের মাত্র ১০০ নম্বর থাকে মাতৃভাষার জন্য। আর সব পড়াশোনা, কথাবার্তা, সাংস্কৃতিক ব্যাপার-স্যাপার সবই ইংরেজিতে। পুরো পরিবেশটাই ইংরেজি। এর মধ্যে এতটুকু পড়ে বাংলা তোমরা শিখবে কী করে? এ তো হয়ে গেল সেই এক পায়ের নাচ। আছাড় খেয়ে পড়লে তোমাদের ওঠাবে কে? আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখন আমাদের উর্দু বা আরবির ছিল এই অবস্থা। মাত্র ১০০ নম্বর। আমরা তাতে কোনোমতে পাস মার্ক পেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম। এ কোনো তৃতীয় ভাষা নিয়ে করা যেতে পারে। কিন্তু যে ভাষা আমাদের মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষা, যে ভাষার জন্যে এ দেশের মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, যার ফলশ্রুতিতে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, যার সম্মানে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করা হয়েছে, সে ভাষাকে নিয়ে কি এমন তাচ্ছিল্য করা চলে? আমি মনে করি, তোমাদের আরো অনেক বেশি বাংলা পড়া উচিত। তাহলে বাংলার দুর্বলতা তোমাদের কেটে যাবে। কী করে এ সম্ভব, এবার তাই বলছি।
শিশু বয়সে মানুষ যে ভাষা বেশি পড়ে, তার মস্তিষ্কের গড়নটা সে ভাষার মতো হয়ে যায়। তোমরা শিশু বয়স থেকে শুধু ইংরেজি পড় বলে তোমাদের মস্তিষ্কের বোঝাপড়া হয় শুধু ইংরেজির সঙ্গে। তোমাদের মস্তিষ্ক ওই ভাষাকেই শুধু চেনে, ওতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কাজেই যখন তোমরা ক্লাস ফাইভ বা সিক্সে ওঠো, তখন কোনো বাংলা বই পড়তে দিলে তোমরা ভয় পাও। কেননা তত দিনে এ ভাষা তোমাদের কাছে হয়ে পড়েছে বিদেশি ভাষা। মাতৃভাষার সঙ্গে এই দূরত্ব ঘটে যাওয়া কি ভালো, না কাম্য?
এই অসুবিধা দূর করার একটা উপায় আছে। যখন তোমরা ক্লাস টুতে উঠবে তখন থেকেই তোমাদের স্কুল থেকে যদি প্রতি সপ্তাহে তোমাদের একটা করে বাংলা গল্পের বই পড়তে দেয়- নানা রকমের হাসির বই, মজার বই, গল্পের বই- তবে সেসব পড়তে পড়তে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতিও তোমাদের কাছে সহজ-স্বচ্ছন্দ আর আনন্দময় হয়ে উঠবে। এর ফলে তোমরা একই সঙ্গে দুটো ভাষা আর দুটো সংস্কৃতির মধ্যে বড় হবে, বাংলা পড়ে তোমরা যেমন বাঙালি হবে, তেমনি আবার ইংরেজি পড়ে পাশ্চাত্য সভ্যতাকে চেতনায় ধারণ করবে। তোমাদের পা হবে দুটো, চমৎকার নাচ পরিবেশন করতে পারবে তোমরা। পুরো স্কুলজীবনটাতে তোমরা যদি এই সুযোগ পাও, তবে সত্যি তোমাদের খুবই উপকার হবে। ব্যাপারটা নিয়ে তোমাদের স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমি আলাপও করেছি। তোমরা হয়তো ভাবছ, এত এত গল্পের বই, মজার বই, হাসির বই পাওয়া যাবে কোথায়। বাংলা ভাষায় শিশুদের জন্য কি এত মজার বই আছে? স্কুলের কর্তৃপক্ষের কাছে আমি বলেছি, এ ধরনের অনেক সুন্দর সুন্দর গল্পের বই এখন বাজারে বেরিয়েছে। তাঁরা চাইলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পক্ষ থেকে আমরা সেগুলো তাঁদের জোগাড় করে দিতে পারি।
৭
তোমরা কি মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাম জানো? তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন খুবই অসাধারণ কবি। তিনি এত ভালো ইংরেজি জানতেন যে তাঁর মতো ভালো ইংরেজি বাঙালিদের মধ্যে আর কেউ কখনো লিখেছেন কি না সন্দেহ। কিন্তু এত অসাধারণ ইংরেজি জানার পরও তিনি লিখেছেন বাংলা ভাষায়। কারণ তিনি জানতেন, যদি সত্যিকারভাবে তাঁকে কেউ বোঝে বা মনে রাখে, এ দেশের মানুষই তা করবে। প্রথমে কিন্তু তিনি এ কথা বোঝেননি। প্রথমে তিনি ইংরেজিতে লেখা শুরু করেছিলেন, লিখেছিলেনও খুবই ভালো। কিন্তু কলকাতায় একজন নামকরা ইংরেজ তাঁকে বলেছিলেন, দেখো তুমি খুবই শক্তিমান কবি (সে সময় ইংল্যান্ডের সবচেয়ে নামজাদা কবি ছিলেন বায়রন। সবাই মনে করত- বায়রন সে সময়কার ইংরেজি ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি তো বটেই, ইউরোপেরও শ্রেষ্ঠ কবি)। সেই সাহেব তাঁকে বললেন, তোমার কবিতা অসাধারণ, তোমার প্রতিভা সত্যি সত্যি বায়রনের সমান। কিন্তু ইংরেজি ভাষায় তো একজন বায়রন আছেন, আরেকজন বায়রন দিয়ে ওই সাহিত্য কী করবে? তুমি বরং বাংলাতে লেখো, তুমি বাংলার বায়রন হও। সত্যি সত্যি তিনি তাই হয়েছিলেন। তাঁর কবরের গায়ে একটি ছোট্ট কবিতা লেখা আছে, মৃত্যুর আগে সেটা তিনি তাঁর কবরের জন্য লিখে গিয়েছিলেন। এর প্রথম দুটো লাইন এমন : 'দাঁড়াও, পথিক-বর, 'জন্ম যদি তব বঙ্গে,/তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে।' হে পথিক দাঁড়াও। তুমি যদি বাঙালি হও। তোমার জন্ম যদি বঙ্গদেশে হয়ে থাকে, তাহলেই আমার কবরের পাশে শুধু দাঁড়াও। কেন লিখেছিলেন তিনি কথাগুলো? তিনি কেবল ভালো ইংরেজি জানতেন না, জানতেন ফ্রেঞ্চ, জানতেন ল্যাটিন, জানতেন গ্রিক, জানতেন হিব্রু এমনি অনেক ভাষা। কিন্তু লিখেছেন বাংলায়। তিনি বুঝেছিলেন, তাঁর প্রতিভাকে যদি কেউ বোঝে, কেউ যদি সম্মান দেয়, মনে রাখে, কেউ যদি মাথায় করে রাখে তবে বাঙালিরাই রাখবে। দেখো, এ জন্য আজ পর্যন্ত বাঙালিরা তাঁকে ভোলেনি। ইংরেজিতে লিখলে হয়তো তাঁকে ভুলে যেত। ইংল্যান্ডে বহু বড় কবি আছেন, এর ওপর আরেকজন বিদেশি কবিকে কে মনে রাখবে, বল? আর বাঙালিরাই-বা কেন একজন ইংরেজি ভাষায় লেখা বাঙালিকে মনে রাখতে যাবে। তাই দেশকে ভালোবাসো, দেশের গাছপালা, নীল আকাশ আর জোছনা রাতগুলোকে ভালোবাসো, বিশাল বিশাল নদী আছে বাংলাদেশে, সেগুলোকে ভালোবাসো, সবুজ গ্রাম আছে, অরণ্য আছে, পাহাড় আছে, সেগুলোকে ভালোবাসো, তবে সবচেয়ে বেশি কাকে ভালোবাসবে? নিজের মুখের ভাষাটাকে- তোমাদের মাতৃভাষাটাকে- যে ভাষার মধ্যে রয়েছে তোমার আত্মার প্রতিধ্বনি, কেমন? ধন্যবাদ।
(চলবে)
শিশু বয়সে মানুষ যে ভাষা বেশি পড়ে, তার মস্তিষ্কের গড়নটা সে ভাষার মতো হয়ে যায়। তোমরা শিশু বয়স থেকে শুধু ইংরেজি পড় বলে তোমাদের মস্তিষ্কের বোঝাপড়া হয় শুধু ইংরেজির সঙ্গে। তোমাদের মস্তিষ্ক ওই ভাষাকেই শুধু চেনে, ওতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কাজেই যখন তোমরা ক্লাস ফাইভ বা সিক্সে ওঠো, তখন কোনো বাংলা বই পড়তে দিলে তোমরা ভয় পাও। কেননা তত দিনে এ ভাষা তোমাদের কাছে হয়ে পড়েছে বিদেশি ভাষা। মাতৃভাষার সঙ্গে এই দূরত্ব ঘটে যাওয়া কি ভালো, না কাম্য?
এই অসুবিধা দূর করার একটা উপায় আছে। যখন তোমরা ক্লাস টুতে উঠবে তখন থেকেই তোমাদের স্কুল থেকে যদি প্রতি সপ্তাহে তোমাদের একটা করে বাংলা গল্পের বই পড়তে দেয়- নানা রকমের হাসির বই, মজার বই, গল্পের বই- তবে সেসব পড়তে পড়তে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতিও তোমাদের কাছে সহজ-স্বচ্ছন্দ আর আনন্দময় হয়ে উঠবে। এর ফলে তোমরা একই সঙ্গে দুটো ভাষা আর দুটো সংস্কৃতির মধ্যে বড় হবে, বাংলা পড়ে তোমরা যেমন বাঙালি হবে, তেমনি আবার ইংরেজি পড়ে পাশ্চাত্য সভ্যতাকে চেতনায় ধারণ করবে। তোমাদের পা হবে দুটো, চমৎকার নাচ পরিবেশন করতে পারবে তোমরা। পুরো স্কুলজীবনটাতে তোমরা যদি এই সুযোগ পাও, তবে সত্যি তোমাদের খুবই উপকার হবে। ব্যাপারটা নিয়ে তোমাদের স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমি আলাপও করেছি। তোমরা হয়তো ভাবছ, এত এত গল্পের বই, মজার বই, হাসির বই পাওয়া যাবে কোথায়। বাংলা ভাষায় শিশুদের জন্য কি এত মজার বই আছে? স্কুলের কর্তৃপক্ষের কাছে আমি বলেছি, এ ধরনের অনেক সুন্দর সুন্দর গল্পের বই এখন বাজারে বেরিয়েছে। তাঁরা চাইলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পক্ষ থেকে আমরা সেগুলো তাঁদের জোগাড় করে দিতে পারি।
৭
তোমরা কি মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাম জানো? তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন খুবই অসাধারণ কবি। তিনি এত ভালো ইংরেজি জানতেন যে তাঁর মতো ভালো ইংরেজি বাঙালিদের মধ্যে আর কেউ কখনো লিখেছেন কি না সন্দেহ। কিন্তু এত অসাধারণ ইংরেজি জানার পরও তিনি লিখেছেন বাংলা ভাষায়। কারণ তিনি জানতেন, যদি সত্যিকারভাবে তাঁকে কেউ বোঝে বা মনে রাখে, এ দেশের মানুষই তা করবে। প্রথমে কিন্তু তিনি এ কথা বোঝেননি। প্রথমে তিনি ইংরেজিতে লেখা শুরু করেছিলেন, লিখেছিলেনও খুবই ভালো। কিন্তু কলকাতায় একজন নামকরা ইংরেজ তাঁকে বলেছিলেন, দেখো তুমি খুবই শক্তিমান কবি (সে সময় ইংল্যান্ডের সবচেয়ে নামজাদা কবি ছিলেন বায়রন। সবাই মনে করত- বায়রন সে সময়কার ইংরেজি ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি তো বটেই, ইউরোপেরও শ্রেষ্ঠ কবি)। সেই সাহেব তাঁকে বললেন, তোমার কবিতা অসাধারণ, তোমার প্রতিভা সত্যি সত্যি বায়রনের সমান। কিন্তু ইংরেজি ভাষায় তো একজন বায়রন আছেন, আরেকজন বায়রন দিয়ে ওই সাহিত্য কী করবে? তুমি বরং বাংলাতে লেখো, তুমি বাংলার বায়রন হও। সত্যি সত্যি তিনি তাই হয়েছিলেন। তাঁর কবরের গায়ে একটি ছোট্ট কবিতা লেখা আছে, মৃত্যুর আগে সেটা তিনি তাঁর কবরের জন্য লিখে গিয়েছিলেন। এর প্রথম দুটো লাইন এমন : 'দাঁড়াও, পথিক-বর, 'জন্ম যদি তব বঙ্গে,/তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে।' হে পথিক দাঁড়াও। তুমি যদি বাঙালি হও। তোমার জন্ম যদি বঙ্গদেশে হয়ে থাকে, তাহলেই আমার কবরের পাশে শুধু দাঁড়াও। কেন লিখেছিলেন তিনি কথাগুলো? তিনি কেবল ভালো ইংরেজি জানতেন না, জানতেন ফ্রেঞ্চ, জানতেন ল্যাটিন, জানতেন গ্রিক, জানতেন হিব্রু এমনি অনেক ভাষা। কিন্তু লিখেছেন বাংলায়। তিনি বুঝেছিলেন, তাঁর প্রতিভাকে যদি কেউ বোঝে, কেউ যদি সম্মান দেয়, মনে রাখে, কেউ যদি মাথায় করে রাখে তবে বাঙালিরাই রাখবে। দেখো, এ জন্য আজ পর্যন্ত বাঙালিরা তাঁকে ভোলেনি। ইংরেজিতে লিখলে হয়তো তাঁকে ভুলে যেত। ইংল্যান্ডে বহু বড় কবি আছেন, এর ওপর আরেকজন বিদেশি কবিকে কে মনে রাখবে, বল? আর বাঙালিরাই-বা কেন একজন ইংরেজি ভাষায় লেখা বাঙালিকে মনে রাখতে যাবে। তাই দেশকে ভালোবাসো, দেশের গাছপালা, নীল আকাশ আর জোছনা রাতগুলোকে ভালোবাসো, বিশাল বিশাল নদী আছে বাংলাদেশে, সেগুলোকে ভালোবাসো, সবুজ গ্রাম আছে, অরণ্য আছে, পাহাড় আছে, সেগুলোকে ভালোবাসো, তবে সবচেয়ে বেশি কাকে ভালোবাসবে? নিজের মুখের ভাষাটাকে- তোমাদের মাতৃভাষাটাকে- যে ভাষার মধ্যে রয়েছে তোমার আত্মার প্রতিধ্বনি, কেমন? ধন্যবাদ।
(চলবে)
No comments