চারদিক- বর্ষামঙ্গল, বরিষ ধরা-মাঝে... by মাহবুব আলম
এ বছর আষাঢ়ের প্রথম দিনটিতে সজল মেঘে সাজেনি রাজধানীর আকাশ। বাদল মেঘে মাদলও বাজেনি সেদিন। তাই বলে বর্ষণ-প্রতীক্ষাতুর ঢাকার নাগরিকদের বর্ষা-বন্দনায় ছিল না সামান্যতম ঘাটতি।তাদের বর্ষণ প্রতীক্ষার শেষ হতেও খুব বেশি সময় লাগেনি; নীল আকাশ ঘন মেঘে ঢেকে গিয়ে তরুণ হলো অঝোর বর্ষা। বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি...।
আগে বর্ষার বৃষ্টি নামত টানা কয়েক দিন ধরে। তবে থেমে থেমে একটু একটু করে। মাটির সেই পানি শুষে নিতে তৃষ্ণার্ত মাটির বেগ পেতে হতো না। এখন বৃষ্টি পড়ে প্রবল দ্রুত, বড় বড় ফোঁটায় অঝোরে এবং সামান্য ব্যবধানে। অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর বর্ষণের কারণে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। দেশের এক প্রান্তে যখন অতিবর্ষণে জনজীবন বিপর্যস্ত, তখন অন্য প্রান্তে বৃষ্টির দেখা নেই, গরমে মানুষ অস্থির সেখানে। আর এসবই ঘটে চলেছে বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। যার জন্য বাংলাদেশ কোনোভাবেই দায়ী নয়। ধনী এবং উন্নত দেশের ভোগবিলাস আর অপরিণামদর্শিতার দায় মেটাতে হচ্ছে বাংলাদেশসহ অন্য দেশগুলোর।
সেই কালিদাসের কাল থেকে ঋতুরাজের পদটি বসন্তের জন্য বাঁধা। তবে আমাদের দেশে এই রাজার রাজ্যপাট তো মাত্র কদিনের জন্য! সিংহাসনে বসতে না বসতেই ঋতুরাজ বসন্তকে গ্রীষ্মের চোখ রাঙানিতে দেশান্তরি হতে হয় প্রতিবছরই। রাজার মুকুট যদি কোনো ঋতুর প্রাপ্য, তবে তা অবশ্যই বর্ষার। ঋতুদের মধ্যে একমাত্র বর্ষাই হাজির হয় রাজকীয় প্রতাপে। সব ভাসিয়ে সব ছাপিয়ে সব একাকার করে সে তার আনুগত্য আদায় করে নেয় অতিসহজেই। তাই বহুশত বছর আগে কবি কালিদাস ‘ঋতু সংহারে’ বর্ষার অভিষেক বর্ণনা করেছিলেন এমনই রাজকীয় ভাষায় ‘বর্ষা এলো রাজার মতো। জলকণায় পরিপূর্ণ মেঘ তারা মত্ত হাতি, বিদ্যুৎ তার পতাকা, বজ্রধ্বনি তার মাদল, তার বেশ উজ্জ্বল। প্রার্থিজনের প্রিয় বাজার মতো কামি জনের প্রিয় বর্ষাকাল...’। এই ঋতুতেই বিরহীর হূদয়সংগীত বর্ষার মেঘের বাহনে প্রিয়ার লক্ষ্যে উড়ে যায়। বৈষ্ণব কবিতায়ও অনবরত শুনি বর্ষা-মঙ্গল। এমনকি বাংলার লোককাব্যেও রয়েছে অজস্র মনোরম বর্ষা-বন্দনা।
‘তোমার গর্জনে ভূমিভেদ করে ভূকন্দলী ফুল বের হয়ে ঘোষণা করে আবার পৃথিবী অবন্ধ্যা হবে’ আরও লিখেছেন ‘কৃষি ফল তো তোমারই অধীন—তাই জনপদবধূরা তোমার দিকে প্রীতি স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে।’। বর্ষা তাই শুধু বিরহের সংগীত নয়, এর বর্ষণে আবহমানকাল ধরে রচিত হয়ে চলেছে নবজীবনের গানও।
২.
ষাটের দশকে ঢাকার বর্ষা ছিল সাদা-কালো বাংলা ছায়াছবির মতো আন্তরিক আর সারল্যে ভরানো, সঙ্গে মধ্যবিত্ত রোমান্টিকতার আমেজ। তখন বৃষ্টি ছিল প্রচুর, নামত একটানা তবে টিপটিপ করে। আনুষঙ্গিক যন্ত্রণা ছিল কম। রেসকোর্সের বিশাল মাঠের ওপর সেদিন আকাশ ছিল আকাশে ভরা। সেই আকাশ থেকে জনবিরল রেসকোর্সে বৃষ্টি নামত দলবেঁধে, হাত ধরাধরি করে। ডাবের পানির মতো ফ্যাকাশে রঙের সেই আহ্লাদী বৃষ্টির ঝাঁক বাতাসের গায়ে ঢলে ঢলে এদিক-ওদিক ভেসে বেড়ায়। মাঠের একেবারে শেষ প্রান্তের রাস্তা দিয়ে অফিস-ফেরতা যানবাহনের ঝাপসা চেহারা বৃষ্টিতে আরও ঝাপসা হয়ে ওঠে। শেষ বিকেলের আলো না ফুরানো পর্যন্ত সেই বাউকুণ্ঠা বৃষ্টি যন আর শেষ হয় না।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। তখন সোনারগাঁও হোটেলের পেছনের হাটখাল বেয়ে বেয়ে আসা বর্ষার নতুন পানিতে হাতিরঝিল টইটম্বুর। প্রতি বর্ষায় সেই পানি এসে দাঁড়ায় একেবারে ময়মনসিংহ রোডের গা ঘেঁষে নিচু জমিতে। সেখানে নোঙর বাঁধত ছোট-বড় মহাজনি নৌকা। কোনো নৌকা কাঁঠাল বোঝাই, কোনোটায় বালু, ইট, মাটির হাঁড়িকুঁড়ি। আরও কত কী! বর্ষার শেষে পানি নেমে গেলে এসব নৌকার আর দেখা মিলত না। পুরো হাতিরঝিল তখন সবুজে ভরা।
শহরে জন্ম নেওয়া, শহরে বেড়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ, শাহজাদপুর আর শান্তিনিকেতনে বর্ষার আদিগন্ত মেঘ দেখে আল্পুত হতেন। আমাদের সবার কপালে এই আদিগন্ত মেঘদর্শন হয়তো ঘটে না। বহুতলের দাপটে রাজধানীর আকাশই দেখা কষ্টসাধ্য, আকাশজোড়া মেঘের শোভা তো পরের কথা। তা ছাড়া আমাদের এই একফালি নাগরিক আকাশটির বহুদিন হলো কাঠা-বিঘার মাপে বিলিবন্দোবস্ত হয়ে গেছে।
এমনি নাই নাই চিন্তায় ডুবে একদিন ফার্মগেট দিয়ে তেজগাঁও পুরোনো বিমানবন্দরের সীমানায় পৌঁছে হঠাৎ বহুদিনের লালিত ভুলটি ভেঙে গেল। চোখে পড়ল ধু ধু বিশাল এক আকাশ, ধূসর মেঘে ছাওয়া শক্ত এক আকাশ। দৈত্যাকৃতি আকাশঢাকা সারি সারি বিলবোর্ডগুলো সরিয়ে ফেলায় এই নয়নসুখ আকাশটি এখন আবার ভেসে উঠেছে। বিমানবন্দরের নিচু পাঁচিলের ওপর দিয়ে, গাছের মাথা পেরিয়ে যত দূর দৃষ্টি যায়, চোখে পড়ে শুধু আকাশ আর আকাশ, বিঘের পর বিঘে, একরের পর একর নিষ্কণ্টক আকাশ, মেঘের ফসল ফলিয়ে আত্মহারা যেন।
আদিগন্ত মেঘের শোভা তো হাতের কাছেই ছিল, এত দিন কেন খুঁজে দেখা হয়নি? বৃষ্টিভেজা স্নিগ্ধ বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে বড় ভালো লাগল সেদিন। এখনো বেশ কয়েকটি বিরাটাকার বিলবোর্ড রয়ে গেছে তেজগাঁও বিমানবন্দরের শেষ সীমার সবচেয়ে সুন্দর সাজানো বাগানের মাথার ওপরে। এগুলো সরিয়ে দিলে নগরবাসী দৃষ্টি দূষণের হাত থেকে রেহাই পাবেন। ঝড়ের রাতে বিলবোর্ড ভেঙে পড়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও কমে যাবে। বলাবাহুল্য কর্তৃপক্ষকে নগরবাসীও জানাবেন অকুণ্ঠ সাধুবাদ।
মাহবুব আলম
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও লেখক।
সেই কালিদাসের কাল থেকে ঋতুরাজের পদটি বসন্তের জন্য বাঁধা। তবে আমাদের দেশে এই রাজার রাজ্যপাট তো মাত্র কদিনের জন্য! সিংহাসনে বসতে না বসতেই ঋতুরাজ বসন্তকে গ্রীষ্মের চোখ রাঙানিতে দেশান্তরি হতে হয় প্রতিবছরই। রাজার মুকুট যদি কোনো ঋতুর প্রাপ্য, তবে তা অবশ্যই বর্ষার। ঋতুদের মধ্যে একমাত্র বর্ষাই হাজির হয় রাজকীয় প্রতাপে। সব ভাসিয়ে সব ছাপিয়ে সব একাকার করে সে তার আনুগত্য আদায় করে নেয় অতিসহজেই। তাই বহুশত বছর আগে কবি কালিদাস ‘ঋতু সংহারে’ বর্ষার অভিষেক বর্ণনা করেছিলেন এমনই রাজকীয় ভাষায় ‘বর্ষা এলো রাজার মতো। জলকণায় পরিপূর্ণ মেঘ তারা মত্ত হাতি, বিদ্যুৎ তার পতাকা, বজ্রধ্বনি তার মাদল, তার বেশ উজ্জ্বল। প্রার্থিজনের প্রিয় বাজার মতো কামি জনের প্রিয় বর্ষাকাল...’। এই ঋতুতেই বিরহীর হূদয়সংগীত বর্ষার মেঘের বাহনে প্রিয়ার লক্ষ্যে উড়ে যায়। বৈষ্ণব কবিতায়ও অনবরত শুনি বর্ষা-মঙ্গল। এমনকি বাংলার লোককাব্যেও রয়েছে অজস্র মনোরম বর্ষা-বন্দনা।
‘তোমার গর্জনে ভূমিভেদ করে ভূকন্দলী ফুল বের হয়ে ঘোষণা করে আবার পৃথিবী অবন্ধ্যা হবে’ আরও লিখেছেন ‘কৃষি ফল তো তোমারই অধীন—তাই জনপদবধূরা তোমার দিকে প্রীতি স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে।’। বর্ষা তাই শুধু বিরহের সংগীত নয়, এর বর্ষণে আবহমানকাল ধরে রচিত হয়ে চলেছে নবজীবনের গানও।
২.
ষাটের দশকে ঢাকার বর্ষা ছিল সাদা-কালো বাংলা ছায়াছবির মতো আন্তরিক আর সারল্যে ভরানো, সঙ্গে মধ্যবিত্ত রোমান্টিকতার আমেজ। তখন বৃষ্টি ছিল প্রচুর, নামত একটানা তবে টিপটিপ করে। আনুষঙ্গিক যন্ত্রণা ছিল কম। রেসকোর্সের বিশাল মাঠের ওপর সেদিন আকাশ ছিল আকাশে ভরা। সেই আকাশ থেকে জনবিরল রেসকোর্সে বৃষ্টি নামত দলবেঁধে, হাত ধরাধরি করে। ডাবের পানির মতো ফ্যাকাশে রঙের সেই আহ্লাদী বৃষ্টির ঝাঁক বাতাসের গায়ে ঢলে ঢলে এদিক-ওদিক ভেসে বেড়ায়। মাঠের একেবারে শেষ প্রান্তের রাস্তা দিয়ে অফিস-ফেরতা যানবাহনের ঝাপসা চেহারা বৃষ্টিতে আরও ঝাপসা হয়ে ওঠে। শেষ বিকেলের আলো না ফুরানো পর্যন্ত সেই বাউকুণ্ঠা বৃষ্টি যন আর শেষ হয় না।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। তখন সোনারগাঁও হোটেলের পেছনের হাটখাল বেয়ে বেয়ে আসা বর্ষার নতুন পানিতে হাতিরঝিল টইটম্বুর। প্রতি বর্ষায় সেই পানি এসে দাঁড়ায় একেবারে ময়মনসিংহ রোডের গা ঘেঁষে নিচু জমিতে। সেখানে নোঙর বাঁধত ছোট-বড় মহাজনি নৌকা। কোনো নৌকা কাঁঠাল বোঝাই, কোনোটায় বালু, ইট, মাটির হাঁড়িকুঁড়ি। আরও কত কী! বর্ষার শেষে পানি নেমে গেলে এসব নৌকার আর দেখা মিলত না। পুরো হাতিরঝিল তখন সবুজে ভরা।
শহরে জন্ম নেওয়া, শহরে বেড়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ, শাহজাদপুর আর শান্তিনিকেতনে বর্ষার আদিগন্ত মেঘ দেখে আল্পুত হতেন। আমাদের সবার কপালে এই আদিগন্ত মেঘদর্শন হয়তো ঘটে না। বহুতলের দাপটে রাজধানীর আকাশই দেখা কষ্টসাধ্য, আকাশজোড়া মেঘের শোভা তো পরের কথা। তা ছাড়া আমাদের এই একফালি নাগরিক আকাশটির বহুদিন হলো কাঠা-বিঘার মাপে বিলিবন্দোবস্ত হয়ে গেছে।
এমনি নাই নাই চিন্তায় ডুবে একদিন ফার্মগেট দিয়ে তেজগাঁও পুরোনো বিমানবন্দরের সীমানায় পৌঁছে হঠাৎ বহুদিনের লালিত ভুলটি ভেঙে গেল। চোখে পড়ল ধু ধু বিশাল এক আকাশ, ধূসর মেঘে ছাওয়া শক্ত এক আকাশ। দৈত্যাকৃতি আকাশঢাকা সারি সারি বিলবোর্ডগুলো সরিয়ে ফেলায় এই নয়নসুখ আকাশটি এখন আবার ভেসে উঠেছে। বিমানবন্দরের নিচু পাঁচিলের ওপর দিয়ে, গাছের মাথা পেরিয়ে যত দূর দৃষ্টি যায়, চোখে পড়ে শুধু আকাশ আর আকাশ, বিঘের পর বিঘে, একরের পর একর নিষ্কণ্টক আকাশ, মেঘের ফসল ফলিয়ে আত্মহারা যেন।
আদিগন্ত মেঘের শোভা তো হাতের কাছেই ছিল, এত দিন কেন খুঁজে দেখা হয়নি? বৃষ্টিভেজা স্নিগ্ধ বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে বড় ভালো লাগল সেদিন। এখনো বেশ কয়েকটি বিরাটাকার বিলবোর্ড রয়ে গেছে তেজগাঁও বিমানবন্দরের শেষ সীমার সবচেয়ে সুন্দর সাজানো বাগানের মাথার ওপরে। এগুলো সরিয়ে দিলে নগরবাসী দৃষ্টি দূষণের হাত থেকে রেহাই পাবেন। ঝড়ের রাতে বিলবোর্ড ভেঙে পড়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও কমে যাবে। বলাবাহুল্য কর্তৃপক্ষকে নগরবাসীও জানাবেন অকুণ্ঠ সাধুবাদ।
মাহবুব আলম
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও লেখক।
No comments