বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪৭৭ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আনোয়ার হোসেন, বীর উত্তম বিপর্যয়েও অবিচল এক যোদ্ধা লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম থানার (বর্তমানে উপজেলা) অন্তর্গত বুড়িমারী। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে। বর্তমানে স্থলবন্দর।
বুড়িমারীর ওপর দিয়ে লালমনিরহাট থেকে সড়ক-রেলপথ ভারতের আসাম রাজ্যে প্রবেশ করেছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেশির ভাগ সময় বুড়িমারীসহ পাটগ্রাম মুক্ত এলাকা ছিল। বুড়িমারীতে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্রতিরক্ষা অবস্থান। এখানে ছিলেন আনোয়ার হোসেনসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা।
এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে বা আধিপত্য বিস্তারের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রায়ই সেখানে আক্রমণ করত। এরই ধারাবাহিকতায় ৫ জুলাই (মতান্তরে ১০ জুলাই) পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে আকস্মিক আক্রমণ করে। তখন সেখানে যুদ্ধ হয়।
সেদিন বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ যুদ্ধে অংশ নেয়। একপর্যায়ে তারা ব্যাপকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর চড়াও হয়। প্রচণ্ড আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তাঁদের দখলে থাকা বাংলাদেশ ভূমি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।
আনোয়ার হোসেন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা দলের এলএমজিম্যান। প্রচণ্ড রকমের সাহস ও অদম্য মনোবল ছিল তাঁর। ভয়কে পরোয়া করতেন না। বিপর্যয়কর ওই মুহূর্তে নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে এলএমজিসহ ক্রল করে তিনি একাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানের ভেতর ঢুকে পড়েন। তাঁর ব্রাশফায়ারে হতাহত হয় কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা।
এরপর আনোয়ার হোসেন আরও এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ঠিক তখনই একঝাঁক গুলি ছুটে আসে তাঁর দিকে। ঝাঁজরা হয়ে যায় তাঁর শরীর। শহীদ হন তিনি। এই যুদ্ধের বর্ণনা আছে মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান মণ্ডলের লেখায়। তিনি লিখেছেন:
‘...মুক্ত এলাকা পাটগ্রাম দখল করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী হাতীবান্ধা থেকে বুড়িমারী আমাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে। ইপিআর মোহন মিয়া ও অন্যান্য ইপিআর সদস্যসহ মুক্তিযোদ্ধারা সফলভাবে এই আক্রমণ প্রতিহত করেন।
‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণ তীব্রতর হলে আনোয়ার (হোসেন) এলএমজি নিয়ে ক্রলিং করে শত্রুর অবস্থানের প্রায় কাছে গিয়ে ব্রাশফায়ার করতে থাকলে ১৫-২০ জন শত্রুসেনা নিহত হয়। ঠিক এই অবস্থায় শত্রুবাহিনীর একঝাঁক গুলি বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ারের দেহ ঝাঁজরা করে দেয়। বাংলার আর একজন বীর সন্তানের দেহ মাতৃভূমি বাংলার মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
‘তবে অকুতোভয় অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার পাল্টা আক্রমণে শত্রুবাহিনী পিছু হটে হাতীবান্ধা চলে যায়। শহীদ আনোয়ার হোসেনকে পাটগ্রাম মুক্ত এলাকায় পূর্ণ মর্যাদায় সমাহিত করা হলো। এই দেশপ্রেমিক বীর সন্তানের কবর স্পর্শ করে মুক্তিযোদ্ধারা শপথ নেয়।’
শহীদ আনোয়ার হোসেনকে মুক্তিযোদ্ধারা সামরিক মর্যাদায় সমাহিত করেন পাটগ্রামের বাউরাবাজারসংলগ্ন জম গ্রামে মসজিদের পাশে। তাঁর সমাধি সংরক্ষিত।
আনোয়ার হোসেন ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন দিনাজপুর ইপিআর সেক্টরের অধীন রংপুর উইংয়ে (বর্তমানে ব্যাটালিয়ন)। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে পাটগ্রামে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে বুড়িমারী যুদ্ধে অসাধারণ সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য শহীদ আনোয়ার হোসেনকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৪৯।
শহীদ আনোয়ার হোসেনের পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার গোপিনাথপুর গ্রামে। বিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম আবদুল হামিদ ভূঁইয়া, মা কুলসুমের নেছা। স্ত্রী ছায়েদা বেগম। তাঁদের এক মেয়ে।
বিজিবি সদর দপ্তর শহীদ আনোয়ার হোসেনের পরিবারকে একটি পাকা ঘর তৈরি করে দিয়েছে। তাঁর একমাত্র মেয়ে তাহমিনা আক্তারের বিয়ে হয়ে গেছে। স্ত্রী ছায়েদা বেগম বর্তমানে মেয়ের সঙ্গে ঢাকার উত্তরখানে বসবাস করেন।
সূত্র: প্রথম আলোর আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি দুলাল ঘোষ, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৬ এবং ১৯৭১ উত্তর রণাঙ্গনে বিজয়, আখতারুজ্জামান মণ্ডল।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে বা আধিপত্য বিস্তারের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রায়ই সেখানে আক্রমণ করত। এরই ধারাবাহিকতায় ৫ জুলাই (মতান্তরে ১০ জুলাই) পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে আকস্মিক আক্রমণ করে। তখন সেখানে যুদ্ধ হয়।
সেদিন বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ যুদ্ধে অংশ নেয়। একপর্যায়ে তারা ব্যাপকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর চড়াও হয়। প্রচণ্ড আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তাঁদের দখলে থাকা বাংলাদেশ ভূমি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।
আনোয়ার হোসেন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা দলের এলএমজিম্যান। প্রচণ্ড রকমের সাহস ও অদম্য মনোবল ছিল তাঁর। ভয়কে পরোয়া করতেন না। বিপর্যয়কর ওই মুহূর্তে নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে এলএমজিসহ ক্রল করে তিনি একাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানের ভেতর ঢুকে পড়েন। তাঁর ব্রাশফায়ারে হতাহত হয় কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা।
এরপর আনোয়ার হোসেন আরও এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ঠিক তখনই একঝাঁক গুলি ছুটে আসে তাঁর দিকে। ঝাঁজরা হয়ে যায় তাঁর শরীর। শহীদ হন তিনি। এই যুদ্ধের বর্ণনা আছে মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান মণ্ডলের লেখায়। তিনি লিখেছেন:
‘...মুক্ত এলাকা পাটগ্রাম দখল করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী হাতীবান্ধা থেকে বুড়িমারী আমাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে। ইপিআর মোহন মিয়া ও অন্যান্য ইপিআর সদস্যসহ মুক্তিযোদ্ধারা সফলভাবে এই আক্রমণ প্রতিহত করেন।
‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণ তীব্রতর হলে আনোয়ার (হোসেন) এলএমজি নিয়ে ক্রলিং করে শত্রুর অবস্থানের প্রায় কাছে গিয়ে ব্রাশফায়ার করতে থাকলে ১৫-২০ জন শত্রুসেনা নিহত হয়। ঠিক এই অবস্থায় শত্রুবাহিনীর একঝাঁক গুলি বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ারের দেহ ঝাঁজরা করে দেয়। বাংলার আর একজন বীর সন্তানের দেহ মাতৃভূমি বাংলার মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
‘তবে অকুতোভয় অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার পাল্টা আক্রমণে শত্রুবাহিনী পিছু হটে হাতীবান্ধা চলে যায়। শহীদ আনোয়ার হোসেনকে পাটগ্রাম মুক্ত এলাকায় পূর্ণ মর্যাদায় সমাহিত করা হলো। এই দেশপ্রেমিক বীর সন্তানের কবর স্পর্শ করে মুক্তিযোদ্ধারা শপথ নেয়।’
শহীদ আনোয়ার হোসেনকে মুক্তিযোদ্ধারা সামরিক মর্যাদায় সমাহিত করেন পাটগ্রামের বাউরাবাজারসংলগ্ন জম গ্রামে মসজিদের পাশে। তাঁর সমাধি সংরক্ষিত।
আনোয়ার হোসেন ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন দিনাজপুর ইপিআর সেক্টরের অধীন রংপুর উইংয়ে (বর্তমানে ব্যাটালিয়ন)। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে পাটগ্রামে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে বুড়িমারী যুদ্ধে অসাধারণ সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য শহীদ আনোয়ার হোসেনকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৪৯।
শহীদ আনোয়ার হোসেনের পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার গোপিনাথপুর গ্রামে। বিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম আবদুল হামিদ ভূঁইয়া, মা কুলসুমের নেছা। স্ত্রী ছায়েদা বেগম। তাঁদের এক মেয়ে।
বিজিবি সদর দপ্তর শহীদ আনোয়ার হোসেনের পরিবারকে একটি পাকা ঘর তৈরি করে দিয়েছে। তাঁর একমাত্র মেয়ে তাহমিনা আক্তারের বিয়ে হয়ে গেছে। স্ত্রী ছায়েদা বেগম বর্তমানে মেয়ের সঙ্গে ঢাকার উত্তরখানে বসবাস করেন।
সূত্র: প্রথম আলোর আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি দুলাল ঘোষ, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৬ এবং ১৯৭১ উত্তর রণাঙ্গনে বিজয়, আখতারুজ্জামান মণ্ডল।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments