কালান্তরের কড়চা-বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে একটি অভিনব ও অসম যুদ্ধ by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বাংলাদেশে একটি অভিনব যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যুদ্ধটি আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে বর্তমান সরকার ও এক ব্যক্তির মধ্যে। সরকারটি হচ্ছে আওয়ামী লীগের এবং ব্যক্তিটি হচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক এমডি ড. মুহম্মদ ইউনূস। এক ব্যক্তি একটি সরকারের বিরুদ্ধে একা যুদ্ধ চালাতে পারে- এ নজির আধুনিক বিশ্বে নেই। কিন্তু সেই নজির বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হলো।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ড. ইউনূস একালের একজন হারকিউলিস। একাই মহাবিক্রমে লড়ছেন। কিন্তু চোখ একটু খোলা রেখে তাকালেই দেখা যাবে, সামনে যুদ্ধরত সরকারটি হচ্ছে একটি গরিব দেশের দুর্বল গণতান্ত্রিক সরকার। আর ড. ইউনূস প্রকাশ্যে একা লড়লেও তাঁর পেছনে বিশ্বের একটি সুপার পাওয়ার, বিশ্বব্যাংক, একাধিক পশ্চিমা দাতা দেশ এবং দেশের ভেতরে আমেরিকা ও বিশ্বব্যাংকের অনুগ্রহভোগী নব্যধনী ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের মিলনে তৈরি এক বিরাট অ্যাক্সিস বা অক্ষশক্তির অস্তিত্ব ও তৎপরতা দৃশ্যমান।
এত দিন মনে হচ্ছিল, ড. ইউনূস সত্যই বুঝি গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে লড়াইয়ে একা। একা হয়ে একটি সরকারের বিরুদ্ধে আক্রোশ ও বৈরিতার বিরুদ্ধে লড়ছেন। তাঁকে নিয়ে তাই অনেকের মনে সহানুভূতিও জাগ্রত হয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, ড. ইউনূসের শক্তি ও প্রতাপের কাছে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার চুনোপটি মাত্র। ড. ইউনূসের সাহায্যকারী বিশাল অক্ষৌহনী বাহিনীর সামনের কাতারে আছে আমেরিকার গোটা এস্টাবলিশমেন্ট, বিশেষ করে বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। যাঁর আঙ্গুলি নির্দেশে বহু গরিব ও উন্নয়নশীল দেশকে মাথা নুইয়ে চলতে হয়।
তিনি ড. ইউনূসের পরম বান্ধব। সম্প্রতি ঢাকায় এসে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপারে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের রায়, দেশের সব নিয়মকানুন উপেক্ষা করে ড. ইউনূসকে যাতে খুশি করা হয় সে জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে গেছেন। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনা সাহেব তো ব্রিটিশ আমলের ভাইসরয়দের মতো সারা দেশ অবাধে চষে বেড়াচ্ছেন। নানা রকম সারমন দিচ্ছেন। ইউনূস সাহেবের হয়ে সাফাই গাইছেন। তাঁর আচরণ ও কথাবার্তা থেকে মনে হতে পারে, তিনি শুধু আমেরিকার রাষ্ট্রদূত নন, ইউনূস সাহেবেরও ব্যক্তিগত দূত।
ড. ইউনূস যে কত প্রতাপশালী, তা বাংলাদেশের জনরব থেকেও বোঝা যায়। এই জনরবটি কতটা সঠিক তা জানি না। কিন্তু দেশের এই বিরাট জনরবটি হচ্ছে, ইউনূস সাহেবের জন্যই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়নে অসম্মতি জানিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের কাছে গোটা বাংলাদেশের কোনো মূল্য নেই, কিন্তু একজন মাত্র ব্যক্তির আছে। তাহলেই আমার পাঠকরা বুঝুন, ড. ইউনূস সারা বিশ্বে কত বড় শক্তিমান মানুষ! আর এই শক্তিমান মানুষের সঙ্গে লড়তে নেমেছেন একটি গরিব দেশের দুর্বল গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ড. ইউনূসের নয়, বরং শেখ হাসিনার দুঃসাহসের তারিফ করতে হয়। কিন্তু এই লড়াইটাও শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত লড়াই নয়, নীতির লড়াই।
দেশের কজন বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট এই অসম লড়াইয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে আছেন? তাঁদের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। রোজ পত্রিকার পাতা খুললেই বিভিন্ন ছোট-বড় কলামিস্টের লেখায় ইউনূস-বন্দনার যে প্রতিযোগিতা দেখি, তাতে মাও জে দংয়ের সেই অমর উক্তিটি মনে পড়ে, 'অর্থের কাছে রূপসী নারীরা যেমন রূপ বিক্রি করে, তেমনি বুদ্ধিজীবীরা বিক্রি করে তাদের মেধা।' বাংলাদেশের এই অবস্থা আর কখনো দেখিনি। যখন সমাজের প্রতিটি স্তরের অসংখ্য মাথা অর্থ ও সুযোগ-সুবিধার কাছে বিক্রি হয়ে গেছে এবং আমাদের রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক পণ্ডিতকুলের একটা বড় অংশ তাঁদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে, সংবাদপত্রের কলামে, বেতার-টেলিভিশনের টক শোতে অনবরত কুযুক্তিকে যুক্তি হিসেবে প্রচার করে চলেছেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যানের ক্ষমতা বাড়িয়ে গ্রামীণ ব্যাংক (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০১২' নামে একটি খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অধ্যাদেশটি খারাপ কি ভালো, তা নিয়ে আলোচনা না হতেই সবার আগে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে এগিয়ে এসেছেন স্বয়ং ড. ইউনূস। তাঁর মতে, মন্ত্রিসভায় গৃহীত এই আইন কার্যকর হলে ব্যাংকটি ধ্বংস হযে যাবে।
ব্যাংকটির সর্বময় কর্র্তৃত্ব থেকে তাঁকে অপসারণের পর থেকেই তিনি বলে আসছেন, ব্যাংকটি তাঁকে ছাড়া ধ্বংস হয়ে যাবে। এখানে প্রশ্ন ওঠে, ড. ইউনূস কি অমর? তিনি না থাকলে যদি ব্যাংকটি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে তাঁর প্রয়াণের পর এই ব্যাংকের অবস্থা কী দাঁড়াবে? তবে কি এই বিশাল ব্যাংকের গোড়া শক্ত নয়? প্রতিষ্ঠাতার অনুপস্থিতিতে তা ধ্বংস হয়ে যাবে? একজন যোগ্য সহকর্মীও কি ড. ইউনূস ব্যাংকে তাঁর তিন দশকের বেশি সময়ের একাধিপত্যের সময় তৈরি করেননি? রবীন্দ্রনাথও নোবেল জয়ী এবং শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর ৭১ বছর পরও তো বিশ্বভারতী মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে!
ড. ইউনূস নোবেল জয়ী মনীষী হতে পারেন; কিন্তু মুনি-ঋষিদেরও মতিভ্রম হয় বলে কথা আছে। তাঁর বিরুদ্ধেও বাজারে অসংখ্য অভিযোগ ছড়িয়ে আছে। সবচেয়ে বড় অভিযোগ, তাঁর যে অভিজ্ঞ সহযোগীদের সহযোগিতায় গ্রামীণ ব্যাংক শক্ত ভিত্তির ওপর গড়ে উঠেছে, ২০ তলা ভবন বানিয়েছে, তাঁদের তিনি একে একে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে তাঁর হাতে গড়া পরিচালনা পর্ষদের সহায়তায় তাড়িয়েছেন। তাঁর এই তাড়ানো অভিজ্ঞ সহযোগীদেরই একজন বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত আছেন।
তিনি ব্যাংকটি খারাপ চালাচ্ছেন না। তাঁর পরিচালনায় ব্যাংকটি খারাপ চলছে, তার কোনা প্রমাণ নেই। বরং নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ব্যাংকটি আগের চেয়ে ভালো চলছে। আগের অনেক অনিয়ম দূর করা হয়েছে। সুদের হার নিয়মনীতির মধ্যে আনা হয়েছে। ঋণ আদায়ে কাবুলিওয়ালাদের নির্যাতনের নীতি পরিহার করা হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকটির ক্রমোন্নতি ছাড়া ধ্বংস হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।
কিন্তু ব্যাংকটির কর্তৃত্ব হারানোর পর থেকেই ড. ইউনূস ব্যাংকটি ধ্বংস হবে, হচ্ছে বলে চিৎকার জুড়েছেন। সেই সঙ্গে অভিযোগ তুলেছেন, এটা গরিবদের, বিশেষ করে গরিব নারীদের মালিকানা ও পরিচালনায় প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক। এই ব্যাংক পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করে সরকার গরিবদের ও নারীদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে। এই অভিযোগটি গরিব ও নারীদের অভিভাবক সেজে তিনি এমনভাবে তুলে ধরেন যে তাতে আমেরিকার সব নারী সিনেটর একজোট হয়ে শেখ হাসিনার কাছে গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে চিঠি পাঠিয়েছিলেন।
ড. ইউনূসের লাইফ স্টাইল, জেট-সেট জীবন, বিশ্বের তাবত রাজা-রানি, প্রেসিডেন্ট, ধনকুবেরদের সঙ্গে নিত্য ওঠা-বসা দেখে দেশের গরিব ও অধিকারবঞ্চিত নারীদের সঙ্গে তাঁর প্রকৃত সম্পর্ক কী, তা গবেষণা করে বের করতে হবে। কিন্তু এই গরিবদের ও নারীদের অধিকার থেকে শুরু করে এমন কোনো স্পর্শকাতর বিষয় নেই, যা তিনি গ্রামীণ ব্যাংকে তাঁর কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধারের জন্য শক্তিশালী ক্যাম্পেইনে ব্যবহার করছেন না। তথাকথিত সুশীল সমাজের একটা বড় অংশকেই তিনি এখন তাঁর এই ক্যাম্পেইনে ব্যবহার করছেন। তা ছাড়া বহুল প্রচারিত একটি ইংরেজি ও বাংলা দৈনিকও তাঁর ক্যাম্পেইনে 'হিজ মাস্টার্স ভয়েসের' ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
মজার ব্যাপার এই যে তিন দশকের বেশি সময় ধরে তিনি নিজের মনোনীত অথবা সংগৃহীত শিক্ষা-দীক্ষা ও ব্যাংক পরিচালনায় অভিজ্ঞতাহীন (বেশির ভাগ) একদল নারীকে ব্যাংকের মালিক দেখিয়ে একটি পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে ব্যাংকটিকে নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার করে আসছিলেন। সরকার সেই অনিয়ম ও অব্যবস্থা দূর করার লক্ষ্যে বর্তমান চেয়ারম্যানের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে (ব্যাংকের এমডি নিয়োগের ক্ষমতা) একটি অধ্যাদেশের খসড়া চূড়ান্ত করতেই ড. ইউনূস ও তাঁর ব্যান্ডবাদকরা জোর প্রতিবাদের আওয়াজ তুলেছেন যে সরকার ব্যাংকটি ধ্বংস করতে চলেছে। চেয়ারম্যানের হাতে ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া অগণতান্ত্রিক, পরিচালনা পর্ষদের ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে, এই অধ্যাদেশ নীতিগতভাবে অগ্রহণযোগ্য- ইত্যাদি, ইত্যাদি।
একটি সরকারি সিদ্ধান্ত ক্ষতিকর মনে করা হলে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ তার সমালোচনা অবশ্যই করতে পারেন। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে সরকারের নতুন অধ্যাদেশের খসড়া ঘোষিত হতেই একদল চেনা মুখের জোট বেঁধে সরকারের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই খসড়া অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে ড. ইউনূসের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে কড়া বিবৃতি দিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের শীর্ষে আছেন আবার সেই ড. কামাল হোসেন, যিনি এবং ড. ইউনূস রাজনৈতিক তপস্যায় অভিন্ন। অনেকে বলেন, তাঁদের রাজনৈতিক অভিভাবকও অভিন্ন।
ড. কামাল হোসেন যখন গণফোরাম নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেন, তখন ড. ইউনূস দৌড়ে গিয়ে সেই দলের উদ্বোধনী মঞ্চে দাঁড়িয়ে দেশবাসীকে রাজনীতির স্বপ্নের পোলাও খাইয়েছিলেন, আবার এক-এগারোর সময় যখন ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কার ও সেই পুরস্কারদাতাদের দ্বারা 'ইনস্পায়ার্ড' হয়ে এয়ারপোর্টকে রাজনৈতিক মঞ্চ বানিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন ড. কামাল হোসেন তাঁকে সমর্থন জানাতে দ্বিধা করেননি।
আর তিনজন বিবৃতিদাতা, যাঁরা সরকারের গ্রামীণ ব্যাংক সংক্রান্ত অধ্যাদেশের খসড়া নিয়ে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন, তাঁদের ক্রেডেনসিয়ালেও অতীতে গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক নিয়ম-কানুনের জন্য সামান্য কোনো ভূমিকা গ্রহণেরও প্রমাণ নেই। তাঁদের দুজনই ছিলেন সেনা তাঁবেদার এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। এই সরকারের আমলে দেশের সব রকমের নীতি-নিয়ম ভঙ্গ করা সত্ত্বেও তাঁরা মুখ খোলেননি। বরং তার সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন। এখন গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের অধ্যাদেশের খসড়ায় দেশের ও ব্যাংকিং সব নিয়মনীতি লংঘিত হলো বলে তাঁরা মাঠে নামার প্রয়োজনবোধ করলেন, তা এক রহস্যঘন ব্যাপার।
আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধির ধারণা, সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের বহু বছরের অনিয়ম, অব্যবস্থা দূর করার জন্য যে পদক্ষেপ নিয়েছে এবং সেই পদক্ষেপ ব্যর্থ করার জন্য ড. ইউনূসের নেতৃত্বে ব্যাংকটির ভেতরে ও বাইরে যে সংঘবদ্ধ চেষ্টা ও ক্যাম্পেইন চালানো হচ্ছে তাতে সরকারের পক্ষে এই অধ্যাদেশ জারির উদ্যোগ গ্রহণ করা ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। আর সরকারের এই অধ্যাদেশের খসড়ার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগবিরোধী সেই চেনা, পুরনো মুখগুলোই ও সঙ্গে দুটি ইংরেজি ও বাংলা মিডিয়া যে কোরাস গান শুরু করেছে, তা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতি দরদের জন্য নয়, এটা স্পষ্টতই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত একটি পলিটিক্যাল মুভ। এ সম্পর্কে একটু বিশদ আলোচনা প্রয়োজন।
(শেষাংশ আগামীকাল)
লন্ডন, ৬ আগস্ট, সোমবার ২০১২
এত দিন মনে হচ্ছিল, ড. ইউনূস সত্যই বুঝি গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে লড়াইয়ে একা। একা হয়ে একটি সরকারের বিরুদ্ধে আক্রোশ ও বৈরিতার বিরুদ্ধে লড়ছেন। তাঁকে নিয়ে তাই অনেকের মনে সহানুভূতিও জাগ্রত হয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, ড. ইউনূসের শক্তি ও প্রতাপের কাছে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার চুনোপটি মাত্র। ড. ইউনূসের সাহায্যকারী বিশাল অক্ষৌহনী বাহিনীর সামনের কাতারে আছে আমেরিকার গোটা এস্টাবলিশমেন্ট, বিশেষ করে বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। যাঁর আঙ্গুলি নির্দেশে বহু গরিব ও উন্নয়নশীল দেশকে মাথা নুইয়ে চলতে হয়।
তিনি ড. ইউনূসের পরম বান্ধব। সম্প্রতি ঢাকায় এসে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপারে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের রায়, দেশের সব নিয়মকানুন উপেক্ষা করে ড. ইউনূসকে যাতে খুশি করা হয় সে জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে গেছেন। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনা সাহেব তো ব্রিটিশ আমলের ভাইসরয়দের মতো সারা দেশ অবাধে চষে বেড়াচ্ছেন। নানা রকম সারমন দিচ্ছেন। ইউনূস সাহেবের হয়ে সাফাই গাইছেন। তাঁর আচরণ ও কথাবার্তা থেকে মনে হতে পারে, তিনি শুধু আমেরিকার রাষ্ট্রদূত নন, ইউনূস সাহেবেরও ব্যক্তিগত দূত।
ড. ইউনূস যে কত প্রতাপশালী, তা বাংলাদেশের জনরব থেকেও বোঝা যায়। এই জনরবটি কতটা সঠিক তা জানি না। কিন্তু দেশের এই বিরাট জনরবটি হচ্ছে, ইউনূস সাহেবের জন্যই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়নে অসম্মতি জানিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের কাছে গোটা বাংলাদেশের কোনো মূল্য নেই, কিন্তু একজন মাত্র ব্যক্তির আছে। তাহলেই আমার পাঠকরা বুঝুন, ড. ইউনূস সারা বিশ্বে কত বড় শক্তিমান মানুষ! আর এই শক্তিমান মানুষের সঙ্গে লড়তে নেমেছেন একটি গরিব দেশের দুর্বল গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ড. ইউনূসের নয়, বরং শেখ হাসিনার দুঃসাহসের তারিফ করতে হয়। কিন্তু এই লড়াইটাও শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত লড়াই নয়, নীতির লড়াই।
দেশের কজন বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট এই অসম লড়াইয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে আছেন? তাঁদের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। রোজ পত্রিকার পাতা খুললেই বিভিন্ন ছোট-বড় কলামিস্টের লেখায় ইউনূস-বন্দনার যে প্রতিযোগিতা দেখি, তাতে মাও জে দংয়ের সেই অমর উক্তিটি মনে পড়ে, 'অর্থের কাছে রূপসী নারীরা যেমন রূপ বিক্রি করে, তেমনি বুদ্ধিজীবীরা বিক্রি করে তাদের মেধা।' বাংলাদেশের এই অবস্থা আর কখনো দেখিনি। যখন সমাজের প্রতিটি স্তরের অসংখ্য মাথা অর্থ ও সুযোগ-সুবিধার কাছে বিক্রি হয়ে গেছে এবং আমাদের রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক পণ্ডিতকুলের একটা বড় অংশ তাঁদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে, সংবাদপত্রের কলামে, বেতার-টেলিভিশনের টক শোতে অনবরত কুযুক্তিকে যুক্তি হিসেবে প্রচার করে চলেছেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যানের ক্ষমতা বাড়িয়ে গ্রামীণ ব্যাংক (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০১২' নামে একটি খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অধ্যাদেশটি খারাপ কি ভালো, তা নিয়ে আলোচনা না হতেই সবার আগে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে এগিয়ে এসেছেন স্বয়ং ড. ইউনূস। তাঁর মতে, মন্ত্রিসভায় গৃহীত এই আইন কার্যকর হলে ব্যাংকটি ধ্বংস হযে যাবে।
ব্যাংকটির সর্বময় কর্র্তৃত্ব থেকে তাঁকে অপসারণের পর থেকেই তিনি বলে আসছেন, ব্যাংকটি তাঁকে ছাড়া ধ্বংস হয়ে যাবে। এখানে প্রশ্ন ওঠে, ড. ইউনূস কি অমর? তিনি না থাকলে যদি ব্যাংকটি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে তাঁর প্রয়াণের পর এই ব্যাংকের অবস্থা কী দাঁড়াবে? তবে কি এই বিশাল ব্যাংকের গোড়া শক্ত নয়? প্রতিষ্ঠাতার অনুপস্থিতিতে তা ধ্বংস হয়ে যাবে? একজন যোগ্য সহকর্মীও কি ড. ইউনূস ব্যাংকে তাঁর তিন দশকের বেশি সময়ের একাধিপত্যের সময় তৈরি করেননি? রবীন্দ্রনাথও নোবেল জয়ী এবং শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর ৭১ বছর পরও তো বিশ্বভারতী মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে!
ড. ইউনূস নোবেল জয়ী মনীষী হতে পারেন; কিন্তু মুনি-ঋষিদেরও মতিভ্রম হয় বলে কথা আছে। তাঁর বিরুদ্ধেও বাজারে অসংখ্য অভিযোগ ছড়িয়ে আছে। সবচেয়ে বড় অভিযোগ, তাঁর যে অভিজ্ঞ সহযোগীদের সহযোগিতায় গ্রামীণ ব্যাংক শক্ত ভিত্তির ওপর গড়ে উঠেছে, ২০ তলা ভবন বানিয়েছে, তাঁদের তিনি একে একে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে তাঁর হাতে গড়া পরিচালনা পর্ষদের সহায়তায় তাড়িয়েছেন। তাঁর এই তাড়ানো অভিজ্ঞ সহযোগীদেরই একজন বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত আছেন।
তিনি ব্যাংকটি খারাপ চালাচ্ছেন না। তাঁর পরিচালনায় ব্যাংকটি খারাপ চলছে, তার কোনা প্রমাণ নেই। বরং নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ব্যাংকটি আগের চেয়ে ভালো চলছে। আগের অনেক অনিয়ম দূর করা হয়েছে। সুদের হার নিয়মনীতির মধ্যে আনা হয়েছে। ঋণ আদায়ে কাবুলিওয়ালাদের নির্যাতনের নীতি পরিহার করা হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকটির ক্রমোন্নতি ছাড়া ধ্বংস হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।
কিন্তু ব্যাংকটির কর্তৃত্ব হারানোর পর থেকেই ড. ইউনূস ব্যাংকটি ধ্বংস হবে, হচ্ছে বলে চিৎকার জুড়েছেন। সেই সঙ্গে অভিযোগ তুলেছেন, এটা গরিবদের, বিশেষ করে গরিব নারীদের মালিকানা ও পরিচালনায় প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক। এই ব্যাংক পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করে সরকার গরিবদের ও নারীদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে। এই অভিযোগটি গরিব ও নারীদের অভিভাবক সেজে তিনি এমনভাবে তুলে ধরেন যে তাতে আমেরিকার সব নারী সিনেটর একজোট হয়ে শেখ হাসিনার কাছে গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে চিঠি পাঠিয়েছিলেন।
ড. ইউনূসের লাইফ স্টাইল, জেট-সেট জীবন, বিশ্বের তাবত রাজা-রানি, প্রেসিডেন্ট, ধনকুবেরদের সঙ্গে নিত্য ওঠা-বসা দেখে দেশের গরিব ও অধিকারবঞ্চিত নারীদের সঙ্গে তাঁর প্রকৃত সম্পর্ক কী, তা গবেষণা করে বের করতে হবে। কিন্তু এই গরিবদের ও নারীদের অধিকার থেকে শুরু করে এমন কোনো স্পর্শকাতর বিষয় নেই, যা তিনি গ্রামীণ ব্যাংকে তাঁর কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধারের জন্য শক্তিশালী ক্যাম্পেইনে ব্যবহার করছেন না। তথাকথিত সুশীল সমাজের একটা বড় অংশকেই তিনি এখন তাঁর এই ক্যাম্পেইনে ব্যবহার করছেন। তা ছাড়া বহুল প্রচারিত একটি ইংরেজি ও বাংলা দৈনিকও তাঁর ক্যাম্পেইনে 'হিজ মাস্টার্স ভয়েসের' ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
মজার ব্যাপার এই যে তিন দশকের বেশি সময় ধরে তিনি নিজের মনোনীত অথবা সংগৃহীত শিক্ষা-দীক্ষা ও ব্যাংক পরিচালনায় অভিজ্ঞতাহীন (বেশির ভাগ) একদল নারীকে ব্যাংকের মালিক দেখিয়ে একটি পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে ব্যাংকটিকে নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার করে আসছিলেন। সরকার সেই অনিয়ম ও অব্যবস্থা দূর করার লক্ষ্যে বর্তমান চেয়ারম্যানের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে (ব্যাংকের এমডি নিয়োগের ক্ষমতা) একটি অধ্যাদেশের খসড়া চূড়ান্ত করতেই ড. ইউনূস ও তাঁর ব্যান্ডবাদকরা জোর প্রতিবাদের আওয়াজ তুলেছেন যে সরকার ব্যাংকটি ধ্বংস করতে চলেছে। চেয়ারম্যানের হাতে ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া অগণতান্ত্রিক, পরিচালনা পর্ষদের ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে, এই অধ্যাদেশ নীতিগতভাবে অগ্রহণযোগ্য- ইত্যাদি, ইত্যাদি।
একটি সরকারি সিদ্ধান্ত ক্ষতিকর মনে করা হলে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ তার সমালোচনা অবশ্যই করতে পারেন। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে সরকারের নতুন অধ্যাদেশের খসড়া ঘোষিত হতেই একদল চেনা মুখের জোট বেঁধে সরকারের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই খসড়া অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে ড. ইউনূসের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে কড়া বিবৃতি দিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের শীর্ষে আছেন আবার সেই ড. কামাল হোসেন, যিনি এবং ড. ইউনূস রাজনৈতিক তপস্যায় অভিন্ন। অনেকে বলেন, তাঁদের রাজনৈতিক অভিভাবকও অভিন্ন।
ড. কামাল হোসেন যখন গণফোরাম নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেন, তখন ড. ইউনূস দৌড়ে গিয়ে সেই দলের উদ্বোধনী মঞ্চে দাঁড়িয়ে দেশবাসীকে রাজনীতির স্বপ্নের পোলাও খাইয়েছিলেন, আবার এক-এগারোর সময় যখন ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কার ও সেই পুরস্কারদাতাদের দ্বারা 'ইনস্পায়ার্ড' হয়ে এয়ারপোর্টকে রাজনৈতিক মঞ্চ বানিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন ড. কামাল হোসেন তাঁকে সমর্থন জানাতে দ্বিধা করেননি।
আর তিনজন বিবৃতিদাতা, যাঁরা সরকারের গ্রামীণ ব্যাংক সংক্রান্ত অধ্যাদেশের খসড়া নিয়ে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন, তাঁদের ক্রেডেনসিয়ালেও অতীতে গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক নিয়ম-কানুনের জন্য সামান্য কোনো ভূমিকা গ্রহণেরও প্রমাণ নেই। তাঁদের দুজনই ছিলেন সেনা তাঁবেদার এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। এই সরকারের আমলে দেশের সব রকমের নীতি-নিয়ম ভঙ্গ করা সত্ত্বেও তাঁরা মুখ খোলেননি। বরং তার সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন। এখন গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের অধ্যাদেশের খসড়ায় দেশের ও ব্যাংকিং সব নিয়মনীতি লংঘিত হলো বলে তাঁরা মাঠে নামার প্রয়োজনবোধ করলেন, তা এক রহস্যঘন ব্যাপার।
আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধির ধারণা, সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের বহু বছরের অনিয়ম, অব্যবস্থা দূর করার জন্য যে পদক্ষেপ নিয়েছে এবং সেই পদক্ষেপ ব্যর্থ করার জন্য ড. ইউনূসের নেতৃত্বে ব্যাংকটির ভেতরে ও বাইরে যে সংঘবদ্ধ চেষ্টা ও ক্যাম্পেইন চালানো হচ্ছে তাতে সরকারের পক্ষে এই অধ্যাদেশ জারির উদ্যোগ গ্রহণ করা ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। আর সরকারের এই অধ্যাদেশের খসড়ার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগবিরোধী সেই চেনা, পুরনো মুখগুলোই ও সঙ্গে দুটি ইংরেজি ও বাংলা মিডিয়া যে কোরাস গান শুরু করেছে, তা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতি দরদের জন্য নয়, এটা স্পষ্টতই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত একটি পলিটিক্যাল মুভ। এ সম্পর্কে একটু বিশদ আলোচনা প্রয়োজন।
(শেষাংশ আগামীকাল)
লন্ডন, ৬ আগস্ট, সোমবার ২০১২
No comments