রোহিঙ্গা- পূর্ব সীমান্তে এখনো দুঃসংবাদ by ফারুক ওয়াসিফ

মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের দাবি শুনে আমাদের পুরান ঢাকার ঘোড়াগুলো পর্যন্ত হেসে উঠতে পারত। কিন্তু সামরিক বাহিনী-সমর্থিত সরকারের প্রেসিডেন্ট বলে কথা, হাসা বারণ। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক তদারক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রধানের কাছে তিনি বলেছেন, ‘রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের জনগণ নয়, বিতাড়নই এ সমস্যার


একমাত্র সমাধান।’ ১৫ জুলাই তাঁর বাংলাদেশ সফরের কথা ছিল। কিন্তু তিনি কথা রাখতে পারেননি, প্রচ্ছন্ন হুমকি রাখতে পেরেছেন। রোহিঙ্গা বিতাড়নের লক্ষ্য যে বাংলাদেশ, মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট একভাবে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘তৃতীয় কোনো দেশ চাইলে সেখানেও তাদের পাঠানো হবে।’ অর্থাৎ, দ্বিতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশে বিতাড়ন তো চলছেই, তৃতীয় দেশেও সেটা চলতে পারে। এমন চিন্তা মগের মুল্লুকে বসে করা সম্ভব, বাংলাদেশের দুশ্চিন্তাটা সেখানেই।
রোহিঙ্গা অধ্যুষিত আরাকানের সঙ্গে বাংলাদেশের আছে ২৬৭ কিলোমিটারের সীমান্ত। এই সীমান্তজুড়ে আরেকটি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল মোকাবিলা করা বাংলাদেশের জন্য খুব মুশকিলের ব্যাপার। তার পরও সত্তরের দশক থেকে এ রকম বিতাড়ন অভিযানের ধাক্কা বাংলাদেশকে পোহাতে হচ্ছে। প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীতে ভারাক্রান্ত বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও শান্তিও হুমকির মুখে। অথচ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেইন সেইনের হঠকারি বক্তব্য হজম করেছে; কোনো প্রতিবাদ করেনি। বাংলাদেশের রোহিঙ্গাবিষয়ক নীতি কি মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা নির্ধারিত? মিয়ানমারের বাংলাদেশ-দর্শনই কি আমাদের আত্মদর্শন?
রোহিঙ্গা সমস্যাকে শুধু মিয়ানমারের ঘরের সমস্যা বলা যাচ্ছে না। তিন লাখ ভাগ্যতাড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এখন বাংলাদেশেরও সমস্যা। সুতরাং, আরাকানকে রোহিঙ্গামুক্ত করার কর্মসূচি সরাসরি মিয়ানমারের সমস্যা বাংলাদেশে চালান করার কর্মসূচি। মনে রাখতে হবে, একদা বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত পার্বত্য জনগোষ্ঠী ভারতে আশ্রয় নিয়ে অধিকার আদায়ের যুদ্ধ শুরু করেছিল। বাংলাদেশে নির্বাসিত রোহিঙ্গারা কখনো সে রকম পথে গেলে, তা আমরা কীভাবে সামলাব? রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিলে বা বিদেশি কোনো শক্তি তাদের সেই পথে চালিত করলে কী করবে বাংলাদেশ? আমরা যেন ভুলে না যাই, খনিজসমৃদ্ধ আরাকান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং বঙ্গোপসাগর এলাকার ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের প্রতি শনির চোখ পড়েছে। সমস্যা পাকতে দেওয়া তাই বাংলাদেশের জন্য আখেরে আত্মঘাতী বলেই বিবেচিত হবে। অন্যদিকে সমুদ্রসীমা নিয়ে ইটলসের রায়ের সঙ্গে বাংলাদেশকে বিপর্যস্ত করার রোহিঙ্গা সমস্যার কোনো সম্পর্ক রয়েছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার।
আরাকানকে বর্মিকরণ অর্থাৎ সিনো-তিব্বতি চেহারার বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী দিয়ে ভরিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ প্রথম দেখা যায় মধ্যযুগে। বর্মি অধ্যুষিত মিয়ানমার আর আরাকানের মধ্যে বিরাট এক পাহাড়। মধ্যযুগে সেই পাহাড় ডিঙিয়ে বর্মি রাজারা আরাকান দখল করে সেখানকার স্থানীয় শাসক ও প্রজাদের উচ্ছেদ করা শুরু করলে তারা বঙ্গে আশ্রয় নেয়। তখন থেকেই আরাকানের বর্মিকরণ শুরু হয়। ষাটের দশকে সামরিক শাসনকবলিত মিয়ানমারে আবার সেই বর্মিকরণ শুরু হয়। ইসরায়েলের বর্ণবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে মিয়ানমারের বর্মি জাতীয়তাবাদীদের মিলটা চোখে পড়ার মতো। ৬৫ বছর ধরে উড়ে এসে জুড়ে বসা ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের আপন ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনিরা সেখানকার আদি জনগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও ইসরায়েলের দাবি, ফিলিস্তিনিরা নাকি বহিরাগত। আরাকান রাজ্যটিতে গত এক হাজার বছর ধরে কালো-বাদামি চামড়ার রোহিঙ্গাদের বসবাসের ইতিহাস রয়েছে। অন্যদিকে সিনো-তিব্বতি মঙ্গোলীয় চেহারার বর্মিদের আগমন মাত্র কয়েক শ বছর আগে। তা সত্ত্বেও ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।’
প্রথমত, বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণকে জানতে ও মানতে হবে যে রোহিঙ্গারা সহস্র বছর ধরে আরাকানেরই অধিবাসী। গত ১৬ জুন ‘দরিয়া কিনারে আজ দুঃখ অথৈ’ শিরোনামে এই লেখকের নিবন্ধটিতে আরাকানের ভূমিপুত্র হিসেবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দাবির ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণ দেওয়া হয়েছিল। http://www.prothom-alo.com/detail/news/266044 শত শত বছরজুড়ে আরাকান ও চট্টগ্রাম যেমন এক রাজ্য ছিল, তেমনি বিপদে-আপদে নাফ নদীর এপার-ওপারের মানুষের চলাচলও জারি ছিল। এর অর্থ এই নয় যে তারা বাংলাদেশি। রোহিঙ্গারা যদি আরাকানি তথা মিয়ানমারি না হবে, তাহলে ১৯৪৭ সালে বার্মার প্রথম সংবিধান সভার নির্বাচনে কীভাবে তারা ভোট দিয়েছিল? ১৯৫১ সালে তাদের আরাকানের অধিবাসী হিসেবে পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। বার্মার প্রথম প্রেসিডেন্ট উ নু রোহিঙ্গাদের আরাকানের অধিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ১৯৫৯ সালে প্রধানমন্ত্রী উ বা রোহিঙ্গাদের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতোই একটি জাতিগোষ্ঠী বলে অভিহিত করেন। ১৯৪৭ সালে অং সান সু চির বাবা জেনারেল অং সানের উদ্যোগে জাতিগত সমঝোতার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত পাংলং সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা স্বাধীন মিয়ানমারের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম শাও সোয়ে থাইক বলেছিলেন, ‘রোহিঙ্গারা যদি স্থানীয় আদিবাসী না হয়, তাহলে আমিও তা নই।’ ১৯৬২ সালে সামরিক শাসন জারির আগে পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে অবাঞ্ছিত বলার বাস্তবতা ছিল না। কিন্তু জেনারেল নে উইনের সামরিক সরকারের প্রতিষ্ঠার দিন থেকেই শুরু হয় রোহিঙ্গাদের দুর্ভাগ্যের করুণ মহাকাব্য। তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়, বন্ধ হয়ে যায় রোহিঙ্গা ভাষায় রেডিও অনুষ্ঠান প্রচার। শুরু হয় অপারেশন ড্রাগন কিং নামে রোহিঙ্গা বিতাড়ন কর্মসূচি। বর্তমান প্রেসিডেন্ট সম্ভবত সেই জাতিগত শুদ্ধি অভিযানই আবার শুরু করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু এটা হবে সরাসরি আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ এবং বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিভঙ্গ।
১৯৭৯ সালে বার্মা ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী ‘অপারেশন গোল্ডেন ঈগল’ নামের এক কর্মসূচিতে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া আড়াই লাখ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়া শুরু করে বার্মা। আন্তর্জাতিক চাপ মিয়ানমারকে তখন পিছু হটতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু আবার ১৯৯১-৯২ সালে গণতন্ত্রীপন্থী বিক্ষোভ দমনের তালে তালে রোহিঙ্গা বিতাড়নও শুরু হয়। নতুন করে আবার আড়াই লাখ রোহিঙ্গা গণহত্যা এড়াতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সেবারও বাংলাদেশ-বার্মা চুক্তি করে এবং ১৯৯৪ নাগাদ দুই লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার গ্রহণ করে। এদের অনেককেই তখন অস্থায়ী নাগরিকত্ব কার্ডও দেওয়া হয়। মিয়ানমারের বেশ কটি নির্বাচনের ভোটার তালিকা প্রমাণ এবং বাংলাদেশের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোও প্রমাণ যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারেরই নাগরিক। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিয়ানমার সফরের সময় সে দেশের সরকার ২৫ হাজার শরণার্থীকে ফেরত নিতে রাজি হয়। প্রথমত, মাত্র ২৫ হাজারের বিষয়ে রাজি হওয়াই সমীচীন হয়নি; দ্বিতীয়ত, এই চুক্তিও মিয়ানমার অদ্যাবধি বাস্তবায়ন করেনি। থেইন সেইন হয়তো অচিরেই বাংলাদেশে আসবেন। তিনি শান্তি না অশান্তির বার্তা নিয়ে আসবেন, তা বাংলাদেশের জোরালো অবস্থান এবং কৌশলী পররাষ্ট্রনীতির ওপর নির্ভর করবে। গণহত্যা, বসতি ধ্বংস ও ধর্ষণ থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রতি আমাদের সদয় হতেই হবে। এটাও একাত্তরের একটি চেতনা। দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তন এবং আরও নানা কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোয় আশ্রয় নেওয়াকে অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করায় বাংলাদেশকেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। তৃতীয়ত, ঐতিহাসিকভাবে যে আরাকান রাজ্য বাংলাদেশের অংশ ছিল, তার বিপদে আমরা উদাসীন থাকতে পারি না।
সর্বশেষ, মিয়ানমারের বিরোধীদলীয় নেত্রী অং সান সু চি সে দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় আইন সংশোধনের কথা বলেছেন। সংখ্যালঘু বলতে তিনি শান, কাচিন, কারেন প্রভৃতি বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কথা বলেছেন, জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত রোহিঙ্গাদের চিন্তা তাঁর মনে ছিল না। পশ্চিমারা মিয়ানমারে গণতন্ত্র আসছে বলে জয়ধ্বনি দিচ্ছে। এ কেমন গণতন্ত্র, যেখানে মানবাধিকার নেই? সেই গণতন্ত্রের এ কেমন মানসকন্যা, যিনি নোবেল বিজয়ের গর্বে গর্বিত, অথচ জাতিগত নিপীড়ন নিয়ে নির্বিকার? মিয়ানমারের সামরিক সাঁড়াশি আলগা হওয়া শুরু করেছে। এমন সময় সু চি বিপ্লবী অবস্থান নিয়ে সাঁড়াশিটাকে আবার চেপে বসার সুযোগ দেবেন না। কিন্তু বাংলাদেশকে তো বসে থাকলে চলবে না। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাকে সামনে নিয়ে আসতে হবে, যাতে করে মিয়ানমার আরেকটি বিতাড়ন অভিযান শুরু করতে না পারে। দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত থেকে আর দুঃসংবাদ আমরা নিতে পারব না।
 ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.