গার্মেন্ট খাতে বিশৃঙ্খলা by সৈয়দ আরিফ নিয়াজি

বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পকে সাফল্য অর্জনে সব সময় নানামুখী প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগোতে হয়েছে। সেসব কাটিয়ে উঠে নতুন করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে। শুধু রাষ্ট্রবিরোধী, বিরোধীদলীয় কর্মী, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, গার্মেন্ট শ্রমিক অথবা তাঁদের নেতাদের এবং অধিকার সংরক্ষণ কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেই সমস্যার সমাধান হবে না।


এখন দমন কৌশল অবলম্বন করলেও কাজ হবে না। সমস্যাগুলোকে জিইয়ে রাখা হয়েছে এবং তা এখন স্থায়ী সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এই সবচেয়ে বড় উৎসকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
বাংলাদেশ সফরকালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের অপহরণ ও নৃশংস হত্যার ঘটনায় একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন দাবি করেছেন। কিন্তু স্বাধীন বলা যায় এমন একটি তদন্ত কমিটি করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে সম্প্রতি শুনানি হয়। গার্মেন্ট মালিকদের দুটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান বিজেএমইএ এবং বিকেএমইএ এই রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড স্বাধীন ও স্বচ্ছভাবে উদ্ঘাটনে সরকারকে চাপ দেওয়া থেকে বিরত থাকে। কিছু পশ্চিমা কূটনীতিকের মতে, বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএর এ নিয়ে বিবৃতি দেওয়া এবং স্বাধীন তদন্তের মাধ্যমে হত্যাকারীদের বিচারের দাবি জানানো উচিত ছিল। কিন্তু তারা এমন কিছু করবে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের নেতা আমিনুল ইসলামকে গত ৪ এপ্রিল ঢাকার পার্শ্ববর্তী আশুলিয়া থেকে অপহরণ করা হয় বলে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। পরদিন তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয় ঢাকা থেকে ৬০ কিলোমিটার উত্তরে, ঘাটাইলের একটি ডোবা থেকে। শ্রমিক নেতা আমিনুলের গায়ে ছিল নির্যাতনের চিহ্ন। একজন যুগ্ম সচিব, টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের একজন পরিচালক সমন্বয়ে গঠিত সরকারের নিয়োজিত অনুসন্ধান কমিটি বলেছে, এ 'রহস্যজনক' হত্যাকাণ্ডের কারণ কী এবং কারা এর পেছনে রয়েছে তা জানা যায়নি। বাংলাদেশের গার্মেন্টসের একজন নেতৃস্থানীয় ক্রেতা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এ কমিটির 'রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড' উল্লেখ করার বিষয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সটাইল আমদানিকারক অ্যাসোসিয়েশনসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এ হত্যাকাণ্ডের স্বাধীন তদন্ত কমিটি দাবি করেছে। তারা যৌথভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে গত ১৮ এপ্রিল একটি চিঠি দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
সরকার এবং গার্মেন্টস মালিক অ্যাসোসিয়েশন বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শুধু যে আমিনুলের হত্যার একটি স্বাধীন অনুসন্ধান চাচ্ছে তা-ই নয়, একই সঙ্গে তারা সরকার ও গার্মেন্টস মালিক অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক গার্মেন্ট খাতে একটি সমঝোতাপূর্ণ, ন্যায়সংগত পরিবেশ সৃষ্টির আশা করে। শ্রমিকদের প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশের লাঠিপেটা করা, টিয়াগ্যাস নিক্ষেপ, নির্দয়ভাবে রাবার বুলেট ছোড়া দুঃখজনক। কারখানা শিল্প এলাকা অথবা দেশব্যাপী কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি কোনো সমাধান নয়। শ্রমিকদের সমস্যাবলি সমাধান না করে এ ধরনের হুমকি প্রদান অপরিণত এবং অ-ব্যবসায়ীসুলভ বলে মনে করেন একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কূটনীতিক।
বিদেশি কূটনীতিকরা, বিশেষ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গার্মেন্ট খাতে সমস্যাবলি নিয়ে বহুবার সতর্ক করেছেন। যথাযথভাবে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, এ পরিস্থিতির কারণে কিভাবে 'মেড ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ড' ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাঁর মতে, ক্রেতারা নিয়মিত তাঁদের তাগিদ দিচ্ছেন। সরকার এবং গার্মেন্ট মালিকদের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। কিন্তু বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ- এই দুটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান সে উদ্বেগের কথা বুঝতে পারছে না। তারা সরকারকে দিয়ে নিয়মিত চাপ দিয়ে শ্রমিকদের দমন করছে এ কথা বলে যে এ আন্দোলন রাষ্ট্রবিরোধী এবং ষড়যন্ত্রমূলক।
সরকার, মালিক এবং সব বিনিয়োগকারীকে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে : বিশ্বের দেশগুলো এখন একে অন্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। যেকোনো কিছু মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের এ গার্মেন্ট শিল্পে অসন্তোষের কথা সারা বিশ্বে প্রচার হয়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে, যারা বাংলাদেশের গার্মেন্ট রপ্তানির ৮৫ শতাংশ ক্রেতা। এরপর যেকোনো ধরনের সংঘাতপূর্ণ পরিবেশ আরো খারাপ করে তুলবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে বদনাম কুড়াতে হবে। বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে গার্মেন্ট শ্রমিকদের তেমন বড় কোনো নেতা না থাকলেও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো, রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এবং পরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বড় বড় ক্রেতা শ্রমিকদের স্বার্থের ব্যাপারে মনোযোগী হয়েছে এবং তাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সোচ্চার হতে দেখা যাচ্ছে। দাবি উঠেছে ন্যায্য, মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সংগতি রেখে বাজারভিত্তিক বেতন-কাঠামো তৈরি এবং তাদের কাজ ও জীবনযাত্রার পরিবেশ সৃষ্টির।
গত ২৫ জুলাই আন্তর্জাতিক ক্রেতারা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে একটি বৈঠক করে গার্মেন্টকর্মীদের আন্দোলন এবং বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যা মোটেই শুভ লক্ষণ নয়। একটি বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানা গেছে, কম্পানি প্রতিনিধিরা শ্রমিকদের অধিকার বিষয়ে অভিযোগ করেছেন এবং মন্ত্রীর ওপর চাপ দিয়েছেন অতি জরুরিভাবে একেটি স্বচ্ছ ও বিশ্বস্ত বেতন-কাঠামো তৈরিতে রিভিউ-প্রক্রিয়া চালাতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মন্ত্রী তা গায়ে মাখেননি। তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, 'উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই, দেশের পরিস্থিতি এমন স্তরে পৌঁছায়নি যে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা অর্ডার বাতিল করবে এবং অন্যত্র চলে যাবে।'
ক্রেতাদের আগস্টের মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। এবং তারা পর্যায়ক্রমে কয়েকটি মন্ত্রণালয়, বিজেএমইএ, বিকেএমইএ এবং অন্য বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে তাদের উদ্বেগের জায়গাগুলো জানানোর জন্য।
স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্যসম্মত জীবনধারণ, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ও কাজের পরিবেশ সবচেয়ে প্রয়োজনীয়, যা উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে এবং গুণগত মান বৃদ্ধিতে সহায়ক। মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে বাংলাদেশকে এসব ইস্যুতে এমন কিছু করতে হবে যা চোখে পড়ে। অন্যথায় প্রস্তুত থাকতে হবে শাস্তি পাওয়ার জন্য।
বাংলাদেশের গার্মেন্ট এবং টেক্সটাইল মালিকরা সফলভাবে এ খাতে অনেক সমস্যা মোকাবিলা করেছে। এর মধ্যে রয়েছে শিশুশ্রমের বিষয়টিও। কিন্তু এখন যে গড়িমসি ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে যা তাদের স্বার্থের জন্য দীর্ঘমেয়াদের ক্ষতিই বয়ে আনবে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বেশ কিছু ক্ষেত্রে নতুন অপ্রয়োজনীয় বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। এখন বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা সেতু বিতর্ক মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট নিয়ে আরেকটি বিতর্ক শুরু হতে পারে। শ্রমমন্ত্রীকে শ্রম নিয়ে মোহাবিষ্ট সমাধানে নিয়োজিত করা উচিত হবে না, বরং খোদ প্রধানমন্ত্রীকে বিলম্ব না করে এ দায়িত্ব নিতে হবে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার কথার আলোকে। কারণ তা না হলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের এ উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছতে হবে। তাতে জনপ্রিয়তা হারানোর এ সময়ে কিছুটা কৃতিত্ব অর্জন সম্ভব হতে পারে। আর ব্যর্থ হলে যে ক্ষতি হবে তা কল্পনাতীত।

লেখক : সাম্প্রতিক বিষয়ে ভাষ্যকার। লেখাটি ইংরেজি থেকে ইষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তরিত।

No comments

Powered by Blogger.