সহজ-সরল-আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় খুঁজছি! by কনকচাঁপা
এসেছে ফাল্গুন-ঋতুরাজ। এসেছে প্রাণের একুশ। একুশ মানে মায়ের ভাষায় কথা বলার, স্বাধীনতার উপাত্ত। এসেছে ভালোবাসার বইমেলা। সবই এসেছে মহাবিশ্বের ঘূর্ণায়মান আবর্তে। আমাদের বাঙালি জাতির গর্বের মৌসুম! কিন্তু এটা কি শুধু একটা উপলক্ষ হয়ে থাকছে? সত্যিকারের, একদম সত্যিকারের উপলক্ষ হয়ে উঠতে পারছে? অ আ ক খ, শহীদ
মিনার, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশ, সাদা-কালো শাড়ি-পাঞ্জাবি পরা, শিমুল তোড়ার পুষ্পাঞ্জলি- সবই কি এই একটি মাসের উপাচার হয়ে থাকছে? থাকার কথা নয়। কারণ এই ভাষা আমাদের, এই ঋতুরাজ আমাদের, এই দেশ আমাদের। আর এই আমাদেরই দুর্লভ-দুষ্প্রাপ্য সম্মানের খুব কম উপকরণের একটি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'। এ মাসের জন্য, এ ভাষার জন্য, ভাইয়ের-বোনের আত্মাহুতির জন্য আমরা তা পেয়েছি। এই পাওয়াটা আমরা কি বুঝতে পারছি ঠিকঠাক মতো? একুশ কোনো দিবস নয়, একুশ একটি সত্তা- এ কথা ভুলতেই যেন আমাদের ভালো লাগছে! বেনোজলের বেগে অন্য ভাষা আমাদের আক্রান্ত করছে অতিমাত্রায়। আজ প্রায় ১৫ বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে এই ধীরগতির বিষ নীলনকশার গুপ্ত খালের রাস্তা ধরে এগিয়ে এসে আমাদের অক্টোপাসের ভঙ্গিতে আষ্টেপৃষ্ঠে গিলে খাচ্ছে! আর আমরা একুশের জাতি সেই অপআগ্রাসনের হাতে হাত বাড়িয়ে ধরা দিচ্ছি, ধরা খাচ্ছি, ডুবে যাচ্ছি। হিন্দি সিরিয়ালগুলো বাড়ির বৌ, ঝি, কন্যা, কুমারী, মা, শাশুড়ি- সবাইকে নেশায় ডুবিয়ে ভাই-বেরাদরকেও হাত করেছে। অতি দুঃখের সঙ্গে প্রায় দেড় যুগ যাবৎ তা ধৈর্য ধরে দেখছি। আমার তো দেখা ছাড়া আর কিছুটি করার নেই। কিন্তু এখন? এখন আঁতকে উঠছি শিশুদেরও আক্রান্ত হতে দেখে। ভাইয়ের বাসায় গিয়ে দেখি, তার কন্যাশিশু হিন্দি ছাড়া প্রায় কথাই বলে না। বাংলা তার সহযোগী ভাষা! শীর্ষস্থানীয় মুরবি্ব একজন আমার বাসায় এলে তাঁর সঙ্গে গল্প করব কী, তাঁর সিরিয়াল দেখাই শেষ হয় না! বাসায় একজন মেহমান এলেন ছোট্ট চারজন শিশু অতিথি নিয়ে- তাদের দুজন হিন্দিতেই 'বাত' শুরু করল। আর দুঃখে ভেঙে পড়লাম প্রিয়তম বান্ধবীর কথা শুনে। তার ছেলে (ছয়-সাত বছরের) হিন্দি তো বলেই, এখন সে শব্দগুলো বাংলায় মিলিয়ে নিচ্ছে। সে তার হারিয়ে যাওয়া কিছু খুঁজতে বলছে, 'আম্মা, আমি এটা তুনতাছি-পাইতেছি না!' এর কারণ, তারা সকাল থেকে রাত অবধি একটা চ্যানেলে একটা হিন্দি কার্টুনের নেশায় পড়ে গেছে! এই চিত্র সারা বাংলাদেশের। সর্বাঙ্গে ঘা হলে ওষুধ দেব কোথা? কিন্তু ওষুধ তো দিতেই হবে! মহামারী হলে সেটা সেরকম শক্ত হাতে আটকাতে হবে না? এই মহামারী তো প্লেগ-বার্ডফ্লুর চেয়ে কম কিছু নয়! অথবা মাদকাসক্তির মতো ভয়ংকর কিছু নয় কি? অবশ্যই এর প্রতিকার করতে হবে। ইংরেজি সারা পৃথিবীস্বীকৃত আন্তর্জাতিক ভাষা। জীবনের প্রয়োজনে তা শিখতে হয়। কিন্তু হিন্দি-উর্দু? এই ভাষাভাষীরা কি বাংলা জানেন? না বাংলাদেশি কোনো চ্যানেল তাঁরা দেখেন! এর প্রবেশ, অনুপ্রবেশ, অতিপ্রবেশ ও উপনিবেশ কি কোনোভাবেই ঠেকানো সম্ভব নয়? আমরা বই পড়া- বই পড়া নিয়ে এত কথা বলি, কম্পিউটারের অতিব্যবহার, ই-বুকের আগ্রাসন নিয়ে কথা বলি, কিন্তু মাতৃভাষায় কথা না বলতে শিখলে শিশুরা মাতৃভাষায় বই পড়বে? ওরা যদি ইংরেজি বইয়ের পাশাপাশি হিন্দি পড়া শুরু করে? আমাদের বেশির ভাগ আপা-ভাবি-প্রতিবেশীরা শাড়ি-জামা কেনেন তাঁদের সিরিয়ালের নায়িকা-সাঁস-দাইদের ক্রমানুসার অনুযায়ী। দোকানিরাও সেই মতো কাপড়-জামা দিয়ে দোকান সাজান। গহনার দোকানগুলোও ধীরে ধীরে সুই হয়ে ঢুকে 'ফাল'-এর ভারে আসন গাড়ছে। তরুণদের কথা জানি না, তরুণীরা এর প্রধান ধারক। বাকি ছিল শিশু। তাদের দুধের বোতলের সঙ্গে 'ডরিমন' ধরিয়ে দিল কে? আমি যদি বলি, প্রথমে মা, তারপর সমাজ, তারপর সরকার, তাহলে কি আমায় কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে? এগারো মাস হিন্দি-উর্দুতে ঘুমিয়ে-জেগে, খেয়ে-পরে, বলে এক মাস বাংলা বোঝার কোনো প্রয়োজন নেই। এই এক মাসও না হয় বলি- 'হামারা সোনার বাংলা, ম্যায়নে তোমহারে তুনতাছি!' দুরারোগ্য ব্যাধি হলে অ্যান্টিবায়োটিকের দরজা পেরিয়ে কেমোথেরাপি-রেডিওথেরাপি দিয়েও কূল না পেলে আমরা তো সেই অঙ্গ ফেলে দিয়েও বেঁচে থাকতে চাই (যদিও সেই পর্যায়ে গেলে বাঁচার আশা খুব কমই থাকে)। আমরা কি সব হিন্দি চ্যানেল ত্যাগ করতে পারি না? আমাদের যদি 'বেঁচে থাকা' এত প্রিয় হয়, জাতিরও কিন্তু বেঁচে থাকা অতটাই জরুরি। জাতিসত্তা কিন্তু মানুষের প্রিয় ও জরুরি অনুভব। সেটা সমগ্র বাঙালি জাতি কী করে ভুলে যাচ্ছে, আমি তার কারণ খুঁজে পাচ্ছি না কিছুতেই!
লেখক : সংগীতশিল্পী
লেখক : সংগীতশিল্পী
No comments