লাল গ্রহে নামল কিউরিসিটি by চৌধুরী আফতাবুল ইসলাম

নানুর বাড়িতে বিশাল ছাদটা আমার ভীষণ পছন্দের। বড় একতলা দালান। চুন-সুরকির ঢালাই। রাত নামলে ছাদটাই প্রিয় আশ্রয়স্থল। চারদিকের গাছপালা থেকে যেন থোকা থোকা অন্ধকার ছুটে এসে আরো আঁধার করে দেয় ছাদটা। পাটি পেড়ে গরমের রাতে শুয়ে আকাশ দেখার শুরু সেই ছোট্টবেলাতেই।


আকাশে যে এত তারা থাকে নানুর বাড়িতেই তার প্রথম পাঠ। আমার বিশ্বাস জন্মাল, ওই ছাদটার ওপরেই সবচেয়ে বেশি তারার বাস। যেন ঠোকাঠুকি করছে ওরা। উত্তর-দক্ষিণ আলোর ফিতাটাও সেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। পরে জেনেছি, ওটা মিল্কিওয়ে- আমাদের গ্যালাক্সি। সব তারাই নীলচে-সাদা। একটিই ব্যতিক্রম- লালচে মতো। মামার কাছে জেনেছি, ওটি তারা নয়, গ্রহ। মঙ্গল গ্রহ। সেই থেকে আমার কাছে ওটা লাল গ্রহ। রহস্যময় একটা জিনিস। শুধু আমি কেন, তাবৎ পৃথিবীবাসীও দারুণ কৌতূহলী ওই গ্রহটা নিয়ে। সে কারণেই মার্স বা মঙ্গল নিয়ে আজ পর্যন্ত যত বই, সায়েন্স ফিকশন বেরিয়েছে আর কোনো মহাজাগতিক বস্তু নিয়ে তেমনটি ঘটেনি। রে ব্র্যাডবারি, কিম স্ট্যানলি রবিনসন, এইচ জি ওয়েলস, এডগার রাইস বারোজ, রবার্ট এ হেইনলিন, আইজাক অসিমভের বইগুলোও তাই বেস্ট সেলার এ কৌতূহলের কারণেই। মানুষ শিহরিত হয়েছে মঙ্গলবাসীর বুদ্ধিমত্তার কথা জেনে। গ্রহটির বুকে সাগর, গাছপালা, ঝড়ের বর্ণনা শুনে। এই কৌতূহলের বশেই হয়তো মঙ্গল নিয়ে মানুষ যত অভিযান চালিয়েছে, সৌরবিশ্বে আর কোনো গ্রহের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেনি। ফলাফল, আশাহত মানুষ। মঙ্গল যে প্রাণহীন মৃত গ্রহ। সর্বশেষ যে রোভারটি গতকাল সোমবার লাল গ্রহের বুকে নামল তার নামও কিউরিসিটি- বাংলায় কৌতূহল।

কিউরিসিটি
পৃথিবী থেকে মঙ্গলের গড় দূরত্ব ২২ কোটি ৫০ লাখ কিলোমিটার। আমাদের প্রতিবেশী গ্রহ। আকারেও প্রায় পৃথিবীর কাছাকাছি। সে জন্য সেখানেও একই রকম পরিবেশ ও আবহাওয়া থাকার সম্ভাবনা। সেই সঙ্গে প্রাণও। শুরু হয়ে যায় হৈচৈ। শুরু হয় মিশন। পাঠানো হয় অনেক অর্বিটার, যারা আকাশে থেকে মঙ্গল পর্যবেক্ষণ করেছে। পাঠানো হয় বেশ কিছু রোভার, যেগুলো মঙ্গলের বুকে নেমে চালিয়েছে পর্যবেক্ষণ। যেমন ভাইকিং-১, ভাইকিং-২, ফিনিঙ্, অপরচুনিটি, স্পিরিট, মার্স পাথ ফাইন্ডার। এর আগে সর্বশেষ ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা বিগল-২ নামের একটি রোভার পাঠায়, যেটি লাল গ্রহের বুকে নামতে গিয়ে দুর্ঘটনায় নিখোঁজ হয়। ফলে এবার ভীষণ উৎকণ্ঠায় ছিলেন নাসার বিজ্ঞানীরা। কেননা কিউরিসিটি এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় রোভার। এটি আয়তনে ছোটখাটো একটি গাড়ির মতো। কিউরিসিটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ ফুট। ওজন ৯০০ কেজি। প্রস্থে ৯ ফুট। উচ্চতা ২ দশমিক ১ মিটার। ছয় চাকার রোভারটির গতি হবে সেকেন্ডে ৪ সেন্টিমিটার। এতে রয়েছে মাটি ও পাথর খোদাইয়ের ড্রিলার, দুটি হাইটেক অ্যানালিসিস ল্যাব, মাইক্রোস্কোপ, বিভিন্ন মাপের ১৭টি ক্যামেরা, পৃথিবীতে সংকেত পাঠানোর অ্যান্টেনা। কিউরিসিটি তৈরিতে খরচ হয়েছে মোট ২৬০ কোটি আমেরিকান ডলার।
২০১১ সালের ২৬ নভেম্বর এই রোভারটি পৃথিবী থেকে মঙ্গল অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। এরপর গত ২৫৪ দিনে এটি মহাকাশে পাড়ি দিয়েছে ৫৬ কোটি ৭০ লাখ কিলোমিটার পথ। অবশেষে গতকাল ৬ আগস্ট বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ১০টায় রোভারটি গেল ক্রেটার নামের একটি খাদে নিরাপদে গিয়ে নামে। যতটা সহজভাবে বলা হলো অত সরল ছিল না এর মঙ্গলে অবতরণ পর্বটি। কিউরিসিটি মিশনটি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসাডোনার নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরি থেকে। বিজ্ঞানীরা ছিলেন ভীষণ উৎকণ্ঠায়। মঙ্গলের আবহাওয়া প্রচণ্ড খামখেয়ালিপূর্ণ। যখন তখন সেখানে ঝড় ওঠে- ধূলিঝড়। কিউরিসিটি নামার সময় সেখানকার আবহাওয়া কেমন থাকবে সেটা আগাম আঁচ করে রকেটের গতি ও অন্যান্য বিষয় নিয়ন্ত্রণের বিষয়টা ছিল প্রচণ্ড কঠিন কাজ। একে তো মঙ্গলের আবহাওয়ামণ্ডলে ঢোকার সময় রকেটের গতি ছিল প্রচণ্ড, একই সঙ্গে আগেরগুলোর তুলনায় এ রোভারটির ওজন অনেক বেশি। প্রথমত, গতি সামলানো, বাতাসের সঙ্গে সংঘর্ষে তৈরি হওয়া তাপ থেকে রোভারটিকে বাঁচানোও ছিল খুব ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। ফলে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে ঢোকার পর প্রকাণ্ড মহাজাগতিক ক্রেনে করে কিউরিসিটিকে গ্রহটির মাটিতে নামানো পর্যন্ত এই সাত মিনিট ছিল আতঙ্ক জাগানো সময়। বিজ্ঞানীদের ভাষায়, 'সেভেন মিনিটস অব টেরর'। সব আশঙ্কা দূরে ঠেলে অবশেষে স্বস্তির সংবাদ। ঢাকার সকাল সাড়ে ১০টায় সুপ্রাচীন গেল ক্রেটারের মধ্যে নিরাপদে নামে কিউরিসিটি। সঙ্গে সঙ্গে জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরিতে উচ্ছ্বাস আর হাততালি। এর ঠিক দুই ঘণ্টা বাদে রোভারটি মঙ্গলের আকাশে প্রদক্ষিণরত অর্বিটার ওডেসির সাহায্যে প্রথম ছবিটি পাঠায় পৃথিবীতে। মঙ্গলপৃষ্ঠের প্রথম সাদাকালো একটি ছবি। ১০ বছর ধরে যে বিজ্ঞানীরা কিউরিসিটি মিশন নিয়ে দিন-রাত পরিশ্রম করেছেন তাঁরা আনন্দে কেঁদে ফেলেন এ সময়। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরেন। নাসার প্রশাসক চার্লস বলডেন এ সময় ঘোষণা করেন- 'আমরা আবার মঙ্গলে, এ এক অসম্ভব আনন্দের সময়। এর চেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারে না।' কিউরিসিটি আগামী সপ্তাহ থেকেই হাই রেজ্যুলেশনের রঙিন ছবি পাঠাতে শুরু করবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এ সাফল্যে প্রেসিডেন্ট ওবামা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে দেওয়া বিবৃতিতে বলেন, প্রযুক্তির যে অভূতপূর্ব গৌরবময় অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র পা রাখল ভবিষ্যতে তা জাতিকে আরো বড় সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে যাবে।
মিশনের উদ্দেশ্য
কিউরিসিটি আগামী দুই বছর মঙ্গলে প্রাণের সন্ধান চালাবে। সেখানকার আবহাওয়ার খোঁজখবর নেবে। মাটির উপাদান নিয়ে গবেষণা চলবে। একসময় মানুষের ধারণা ছিল, পৃথিবীর মতোই এক পরিবেশ আছে মঙ্গলে। প্রাণের অস্তিত্বও আছে সেখানে। তবে নানা মিশনের পর বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন, লাল গ্রহটি বর্তমানে ভীষণ শীতল, রুক্ষ, ঊষর, প্রাণহীন এক জগৎ। তবে একসময় ওই গ্রহটির বুকে প্রচুর পানি ছিল। উষ্ণ পরিবেশ ছিল। এখনো গ্রহটির দুই মেরুতে প্রচুর পানি জমে আছে বরফ আকারে। গ্রহটির মাটির নিচেও প্রচুর পানি আছে বলে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন। কিউরিসিটি যে গর্তটিতে নেমেছে, সেটি পানিপ্রবাহের কারণেই সৃষ্টি হয়েছিল বলে ধারণা। কেন যেন এক অজ্ঞাত কারণে মঙ্গলের আবহাওয়া বদলে যায়, পানি উধাও হয়। হয়তো একসময় গ্রহটিতে প্রাণ ছিল। কিউরিসিটির কাজ এসব বিষয়ে খোঁজখবর করা। আপাতত দুই বছর রোভারটি ঘুরে ঘুরে মঙ্গলের আবহাওয়া, পরিবেশ ও প্রাণের অস্তিত্বের খোঁজখবর করবে। তারপর কী হবে তার? বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, দুই বছর পরও যদি সেটা সক্রিয় থাকে তাহলে তার সাহায্যে গবেষণাকাজ অব্যাহত রাখা হবে।
একনজরে মঙ্গল
মঙ্গলের ব্যাস ৪,২০০ মাইল। প্রাচীন রোমান যুদ্ধের দেবতার নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে মার্স। মঙ্গলের মাটি ও বাতাসে প্রচুর আয়রন থাকায় এর বর্ণ লালচে। সৌরজগতের সবচেয়ে উঁচু আগ্নেয়গিরির (বর্তমানে মৃত) অবস্থান লাল গ্রহে। এর নাম অলিম্পাস, উচ্চতা ১৫ মাইল। মঙ্গলে এক বছর ৬৮৭ দিনে। আবহাওয়ামণ্ডলের মূল উপাদান কার্বন ডাইঅক্সাইড। শীতকালে গ্রহটির তাপমাত্রা রাতের বেলা মাইনাস ১৯১ ডিগ্রি ফারেনহাইটে নেমে যায়। পৃথিবীতে ১০০ পাউন্ড ওজনের একজন মঙ্গলে গেলে তার ওজন হবে ৩৮ পাউন্ড। মঙ্গলের চাঁদসংখ্যা দুটি- ফোবোস ও দিমোস।
একনজরে কিউরিসিটি

No comments

Powered by Blogger.