দ্ধাপরাধের বিচার ॥ সরকারের শৈথিল্য না নীতি? by মুনতাসীর মামুন
মুক্তিযোদ্ধা ও প্রাক্তন সচিব জনাব মহিউদ্দিন আহমদ আমাকে বিষণ্ণ কণ্ঠে জানালেন, ‘মনটা ভাই খুবই খারাপ হয়ে গেল।’ আমি কারণ জানতে চাইলাম। পটভূমিটা হলো, তিনি প্রধানমন্ত্রীর ইফতার নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেন।‘বঙ্গবন্ধু কন্যার ইফতার নিমন্ত্রণ, সানন্দে গেছি, তাছাড়া অনেক দূরে থাকি,’ জানালেন তিনি।
‘এইসব অনুষ্ঠানে গেলে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। এটা বাড়তি পাওনা।’ তারপর প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে দেখেন বসে আছেন, ডা. নুরুল ইসলাম। ডাকসাইটে ডাক্তার। প্রাক্তন জাতীয় অধ্যাপক। কিন্তু অনেকে জানেন তাঁকে বঙ্গবন্ধুর চিকিৎসক হিসেবেই। তিনিও সে পরিচয় দেন প্রয়োজনে। আমি বললাম, ‘তাতে আপনার সমস্যা কি? যারা বিখ্যাত ও ক্ষমতাবান তাদের সম্মান করে বসতে দেয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে, সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে এটি তো আপনিও জানেন।’
‘ব্যাপারটা তা নয়,’ ধৈর্য্যসহকারে আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন জনাব মহিউদ্দিন, ডা. নুরুল ইসলাম মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতকারী বলেছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা, মুক্তিযুদ্ধের সরকারের প্রধানের সঙ্গে এরকম লোক কিভাবে বসতে পারে। বুঝছেন, মনটা খুব খারাপ।
আমি এতে অবাক হইনি, বিচলিতও নয়। ডা. নুরুল ইসলামকে আমরা হাড়ে হাড়ে চিনি। শেখ হাসিনার প্রথম আমলে ঘটা করে তিনি তাঁর লেখা বই তাঁকে উপহার দিতে গেলেন। সেটা খবরও হলো। জাতীয় অধ্যাপক হলেন। তার একটি ব্যক্তিগত বিশ্ববিদ্যালয় আছে। সেখানে একটি হল করে নাম দিলেন বঙ্গবন্ধুর নামে। এরপর এলেন খালেদা জিয়া। তখন এই লোক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি চট্টগ্রামের পাহাড়তলি বধ্যভূমির একাংশ কিনে সেখানে একটি বিজনেস ইনস্টিটিউট স্থাপন করলেন, নাম দিলেন জিয়াউর রহমানের নামে। একদিক দিয়ে অবশ্য এর প্রতীকী অর্থ আছে। শহীদদের অবমাননা করেছিলেন জিয়াউর রহমান। সুতরাং বধ্যভূমিতেই তো তার নামে প্রতিষ্ঠান হবে। শহীদদের অবমাননা করে এই কাজটি তাঁকে না করার জন্য অনেক অনুরোধ করা হয়েছে, কর্ণপাত করেননি। কারণ, তৎকালীন মেয়র মহিউদ্দিন তাঁকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন আঞ্চলিকতার কারণে। আমি, গাজী সালাউদ্দিন, প্রজন্ম ’৭১ ও আরও অনেকে চট্টগ্রামে নানা প্রতিবাদ কর্মসূচী করেছি। পরে মামলা করেছি। প্রায় এক দশক হতে চলল সেই মামলা চলছে। এখন তা আপীল বিভাগে। সুতরাং, এরা কি জিনিস আমরা জানি।
মহিউদ্দিন ভাই যেটা জানালেন তাহলো আলবদর প্রতিষ্ঠিত চরম প্রতিক্রিয়াশীল পত্রিকা দৈনিক ইনকিলাব নিয়মিত কুখ্যাত মোনায়েম খানের নামে একটি ক্রোড়পত্র বের করত। পত্রিকাটির রাজাকারী চরিত্রের প্রমাণস্বরূপ এটিই যথেষ্ট। ২০০৬ সালের ১৪ অক্টোবর এই পত্রিকাটি ‘মোনায়েম খান-এর ৩৪তম শাহাদাতবার্ষিকী’ উপলক্ষে একটি ক্রোড়পত্র বের করে। ডা. ইসলাম ‘গবর্নর মোনায়েম খান এবং আমাদের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসা শিক্ষা’ নামে ইনকিলাবে একটি নিবন্ধ লেখেন। সেখানে প্রাক্তন গবর্নরের নানারকম স্তুতি করে আফসোস করে লেখেন, ১৪ অক্টোবর ১৯৭১ সালে ‘কয়েকজন দুস্কৃতকারী বাইরে থেকে গুলি করে মোনায়েম খানকে হত্যার চেষ্টা চালায়।’ পাকি, জামায়াতীরা ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতকারী বলত। রাজাকারী দিল হলেই মুক্তিযুদ্ধের ৩৫ বছর পর একটি লোক বলতে পারে মুক্তিযোদ্ধারা ছিল দুষ্কৃতকারী এবং রাজাকারী স্পিরিট বর্তমান থাকলেই বধ্যভূমিতে জিয়াউর রহমানের নামে ইনস্টিটিউট বানান সম্ভব। এই সব লোককে সম্মান জানানো মানে নিজেকে এবং মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করা।
মহিউদ্দিন ভাই এ প্রসঙ্গে জানালেন, লন্ডনে বসে যখন শুনলাম দুই কিশোর এ কাজটি করেছে তখন আমরা উদ্বেলিত হয়ে বলেছিলাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর কেউ ঠেকাতে পারবে না। সেই কিশোর মোজাম্মেলকে বঙ্গবন্ধু সরকার দিয়েছিল বীর প্রতীক উপাধি। আর ত্ার ডাক্তার বলেন, সেই কিশোরকে দুষ্কৃতকারী।
মহিউদ্দিন ভাইকে আমি বলি, ছদ্মবেশে সুযোগ সন্ধানীরা এসব করবেই। বিএনপি যেমন সমন্বয়ের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে তখন ক্ষমতাবানদের অনেকেও একই রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। তবে, নুরুল ইসলামের খুঁটিনাটি প্রধানমন্ত্রীর জানার কথা নয়। তাছাড়া বয়োজ্যেষ্ঠদের তিনি সম্মান করেন। কিন্তু তাঁর আশপাশের লোকজনদের বিষয়গুলো জানা দরকার। সুযোগ সন্ধানীরা সম্মানিত হলে, সুবিধা পেলে সমাজে এই বার্তা দেয়া হয় যে, সততা কোন বিষয় নয়, ইনটেগ্রেটি কোন সম্পদ নয়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে রাজাকারদের বিচারের প্রসঙ্গটি আনতে চাই। যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে আমার মনে হলো, এই বিচার পরিচালনায় সরকার যথেষ্ট শৈথিল্য দেখাচ্ছে। এর কারণ কি বোধগম্য হলো না। এর একটি কারণ কি এই যে ডা. নুরুল ইসলামের মতো অনেকে এখন প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে আছেন বা নীতি নির্ধারণে? গোলাম আযমের নাগরিকত্ব চেয়েছেন এবং মোশতাকের সমর্থক এরকম অনেকে এখন ঘোর আওয়ামী লীগার। পদেও আছেন। যাক এগুলো শোনা কথা বলে উড়িয়ে দিতে পারেন।
ইতিহাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃতিত্ব বলে একটি বিষয়ই বারবার উল্লেখিত হবে তাহলো, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, পদ্মা সেতু নয়, জিডিপি বৃদ্ধিও নয়। এই নিয়ে তাঁর আন্তরিকতার কোন ঘাটতি আছে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহ তাঁকে প্রয়োজনীয় তথ্য দিচ্ছে না ইচ্ছে করে। কারণ, যুদ্ধাপরাধের বিচার সুষ্ঠুভাবে না হলে বা অভিযুক্তরা ছাড়া পেলে এর মাসুল দেবেন প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নয়। দায়-দায়িত্বও বর্তাবে তাঁর ওপর। অন্যরা ডা. নুরুল ইসলাম হয়ে যাবে।
এবার আমার সাক্ষ্যের কথা বলি। সাক্ষ্য দিতে গিয়ে দেখি একজন মহিলা কম্পিউটার অপারেটরকে বগুড়ার কোন এক সরকারী বিভাগ থেকে বদলি করা হয়েছে প্রথম ট্রাইব্যুনালে। এই মহিলা ১০টা থেকে ৪/৫টা পর্যন্ত একটানা বসে আদালতের কার্যবিবরণী টাইপ করেন। তাঁর কোন অবকাশ নেই। তাঁকে বেতন আনতে যেতে হয় বগুড়া। থাকার জায়গা নেই। অসুস্থ হওয়ার অধিকার নেই। আইটির একজন আছেন তিনি দু’টি ট্রাইব্যুনালে দৌড়াদৌড়ি করেন। এদের বিশেষ কোন ভাতা নেই। দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে যথাযথ জায়গাও নেই। নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে আমরা অনেক আবেদন নিবেদন করেছিলাম অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়ে। একমাত্র অর্থমন্ত্রী তাতে সাড়া দিয়েছিলেন। টাকা বরাদ্দ দিয়েছিলেন। কোন কাজ হয়নি। এই জনকণ্ঠে শাহরিয়ার কবির লিখেছিলেন, ‘ট্রাইব্যুনাল গঠনের এক বছর আগেই আমরা সরকারের নীতি নির্ধারকদের জানিয়েছিলাম, ৮/১০ জন শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীর বিচার এক বছরের ভেতর শেষ করা যাবে যদি পর্যাপ্ত লোকবল ও রসদ সরবরাহ করা হয়। প্রথম দফায় আমরা অন্ততপক্ষে ২৫ জন দক্ষ, সৎ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি দায়বদ্ধ সর্বক্ষণিক আইনজীবী নিয়োগের কথা বলেছিলাম। এ পর্যন্ত ১৫ জন আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হলেও এদের অধিকাংশ এই মামলার বাইরে অন্য আদালতে অন্য মামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ট্রাইব্যুনালের প্রশাসনিক বিভাগে জনবল প্রয়োজন অন্ততপক্ষে ১৫০ জন, বর্তমানে রয়েছে মাত্র ১৩ জন। ভাবতে পারেন? বিচারকদের দাফতরিক কোন সুযোগ সুবিধাও নেই।
প্রসিকিউশনে দায়বদ্ধ এবং বিষয়টি বোঝেন এমন আইনজীবী খুব বেশি নেই। এতে আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা চটতে পারেন কিন্তু বিষয়টি সত্য। কোন কোন ক্ষেত্রে দক্ষতাকে গুরুত্ব দিতে হয় দলীয় আনুগত্য নয়। আপনারা কি বিশ্বাস করবেন যে, ট্রাইব্যুনালের কোন রেফারেন্স লাইব্রেরি নেই, গবেষক নেই, কিচ্ছু নেই। ট্রাইব্যুনালের কারণে সেখানে প্রচুর লোকের জমায়েত হয়। একটি ক্যান্টিন নেই। প্রসিকিউশনের চা খাওয়ার পেয়ালা আছে কিনা তাও সন্দেহ। এই দিয়ে একটা বিচার কাজ চলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? তখন কি ধারণা হতে পারে না যে, ‘লোক দেখানো একটি বিচার কাজ চলছে।’
বিদেশে এত অপপ্রচার চলছে শেখ হাসিনা ও যুদ্ধাপরাধ নিয়ে বলার নয়। এর জবাব দেয়ার জন্য একটি কাঠামো বা সেল নির্মাণের জন্য আইনমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সবার কাছে অনুরোধ করা হয়েছে, কিচ্ছু হয়নি। নিজেদের খরচে বা কোথাও থেকে অর্থ সংগ্রহ করে আমরা বিদেশের বিভিন্ন স্থানে/ সম্মেলনে যোগ দিয়ে অপ্রচারের জবাব দিয়েছি যদিও সেটি আমাদের কাজ নয়। শাহরিয়ার লিখেছেনÑ
“গত দু’বছরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে জামায়াত এক ডজনেরও বেশি বই প্রকাশ করেছে ইংরেজীতে, লাখ লাখ কপি ছেপে সর্বত্র বিনামূল্যে সরবরাহ করছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের শুনানিতে যাওয়ার সময় আমরা ‘৭১-এর গণহত্যা ও আইন সম্পর্কে এবং জামায়াতের বিভিন্ন অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আমাদের বক্তব্য ছবিসহ একটি পুস্তিকা ইংরেজীতে প্রকাশ করেছিলাম। সঙ্গে ছিল মানবাধিকার কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত আরও সীমিত কলেবরের একটি পুস্তিকার কিছু কপি। বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলোয় জামায়াতের অপপ্রচারের জবাব দেয়ার মতো কোন তথ্যসমৃদ্ধ প্রকাশনা আমরা দেখিনি। সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিলাম যেহেতু তারা ছাপাতে পারছেন না, ইচ্ছে করলে আমাদের প্রকাশনা তারা বিভিন্ন দূতাবাসে পাঠাতে পারেন। ছয় মাস হতে চলেছে এ বিষয়ে কোন অগ্রগতি হয়নি।
পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে ইউরোপের বহু মানবাধিকার সংগঠন, আইনপ্রণেতা ও সাংবাদিকরা জামায়াতী তৎপরতায় বিভ্রান্ত হচ্ছেন। যার ফলে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ক্ষুণœ হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে সরকারের কোন ভূমিকা দৃশ্যমান নয়। কেন নয় তার জবাব সরকারের নীতিনির্ধারকরাই দিতে পারবেন। অনেক সময় তাঁরা বলেন, বিদেশীদের সব প্রশ্নের জবাব দিতে আমরা কূটনৈতিকভাবে বাধ্য নই। কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতার বাইরেও বাংলাদেশের মর্যাদার বিষয়টি আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর মহাজোট সরকার যখন ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে তখন আন্তর্জাতিক মহলে যথেষ্ট আগ্রহ ছিলÑ একটি উন্নয়নশীল দেশ কিভাবে নিজেদের আইন, মেধা ও সম্পদের দ্বারা এসব আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার করে তা পর্যবেক্ষণের জন্য। জামায়াতের ধারাবাহিক অপপ্রচারে সে আগ্রহে অনেক ভাটা পড়েছে, কোথাও প্রশ্ন উঠেছে সরকারের যোগ্যতা ও সদিচ্ছা সম্পর্কে।”
এ মানসিকতা হবে বেগম জিয়া বা তার সরকারের। শেখ হাসিনা বা তার সরকারের এ ধরনের মানসিকতা কাম্য নয়।
আমরা সবসময় বলেছি, এখনও বলি, জামায়াতকে বঙ্গবন্ধু নিষিদ্ধ করে ঠিক কাজটি করেছিলেন। যে কারণে তিনি একজন স্টেটসম্যান। এখনও যুদ্ধাপরাধের কারণে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা উচিত। নূরেমবার্গে কিন্তু অপরাধী সংগঠন হিসেবে নাৎসী দলকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল যে কারণে সেখানে আর কখনও জঙ্গীবাদ বিকশিত হতে পারেনি। জামায়াতের সদস্যরাই রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটি গড়েছিল। একদিকে যেমন তারা সহযোগী শক্তি পাকিদের তেমনি ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশনেও। এবং সে কারণে তাদের দলীয় নেতৃত্বের ওপর কমান্ড রেসপনসিবিলিটির দায় বর্তায়। প্রসিকিউশন কেন এতে গুরুত্ব দেয় না তা বোধগম্য নয়।
জামায়াতী আইনজীবীরা কৌশল হিসেবে চাইবে এই ট্রাইব্যুনাল অনন্তকাল চলুক। কিন্তু, বিচারকরা তা চলতে দিতে পারেন না। সমাজ রাষ্ট্রে তাদেরও একটা দায় আছে। বিচারপতি নিজামুল হক সময় বেঁধে দেয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটি সময়োপযোগী, যা আগেই দেয়া উচিত ছিল। তার এই সিদ্ধান্ত প্রশংসিত হয়েছে। ১৫০০ সাক্ষীর নাম জমা দেয়া মানে ট্রাইব্যুনালকে ঠাট্টা করা। এসব ঠাট্টাও প্রতিহত করা বাঞ্ছনীয়।
এত সমালোচনার পরও আমরা বলতে চাই, যা আমাদের পক্ষে বলেছেন শাহরিয়ার যে, “এতসব সীমাবদ্ধতার পরও ট্রাইব্যুনালের কয়েকজন আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তা সাধ্যাতীত পরিশ্রম করছেন। তারপরও এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, সব সাধ্যেরই সীমা থাকে। আমরা এখনও মনে করি, প্রয়োজনীয় লোকবল, রসদ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে ২০১৩ সালের ভেতর ১০ জন শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন করা সম্ভব।”
এ প্রসঙ্গে সাক্ষীদের নিরাপত্তার কথাটি একটু বলি। উইটনেস প্রটেকশন আইন আমাদের অনেক দিনের দাবি। শুনেছি, কেবিনেটে এ প্রসঙ্গ উঠেছিল ও কিন্তু তা স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে। এ তথ্য ভুল হলে ক্ষমাপ্রার্থী। সত্য হলে বলব, এ সিদ্ধান্ত ভুল। কারণ কেবিনেটে যাঁরা আছেন তাদের অনেকের থেকে নিরাপত্তা বেশি দরকার যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছেন তাদের। কারণ, তাদের অর্থ, পেশী কোন শক্তিই নেই। লক্ষণীয়, ট্রাইব্যুনালে কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে সাক্ষী দিতে আনা যায়নি। আমাদের যত ছাপোষারাই সেখানে গেছেন।
সরকারের এই শৈথিল্যের কারণেই আমরা বলি বিচারটা না প্রহসনের হয়ে দাঁড়ায়। তখন সরকারী নেতারা তারস্বরে কথা বলা শুরু করেন এবং হাস্যাস্পদ হন। কারণ যা বলা হচ্ছে তা তারা করেছেন কিনা সে ব্যাপারে তারা কিছু বলতে পারেন না। যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় পেলে ও কার্যকর হলে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে শেখ হাসিনা উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বে পরিণত হবেন। তাঁর নামে যেসব সম্মেলন করা হয় বা প্রচার হয় তাতে কোন ফল আসবে না। প্রধানমন্ত্রী চাচ্ছেন কিন্তু হচ্ছে না, তা’হলে বলা যাবে শৈথিল্য করছে মন্ত্রীরাই। তাঁরাই দায়ী। আর যদি সম্মিলিত নীতি হয় শৈথিল্য প্রদর্শন করা, তা’হলে আমাদের এসব বক্তব্য অরণ্যে রোদন মাত্র। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ ডা. নুরুল ইসলামের মতো কারা আপনার টেবিল চেয়ারের পাশে বা বারান্দায় আছে তাঁদের চিহ্নিত করুন। তা’হলে এ ক্ষেত্রে হয়ত শৈথিল্য প্রদর্শন হ্রাস পাবে। নাকি প্রধানমন্ত্রীই চান এরকম শৈথিল্য থাকুক?
‘ব্যাপারটা তা নয়,’ ধৈর্য্যসহকারে আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন জনাব মহিউদ্দিন, ডা. নুরুল ইসলাম মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতকারী বলেছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা, মুক্তিযুদ্ধের সরকারের প্রধানের সঙ্গে এরকম লোক কিভাবে বসতে পারে। বুঝছেন, মনটা খুব খারাপ।
আমি এতে অবাক হইনি, বিচলিতও নয়। ডা. নুরুল ইসলামকে আমরা হাড়ে হাড়ে চিনি। শেখ হাসিনার প্রথম আমলে ঘটা করে তিনি তাঁর লেখা বই তাঁকে উপহার দিতে গেলেন। সেটা খবরও হলো। জাতীয় অধ্যাপক হলেন। তার একটি ব্যক্তিগত বিশ্ববিদ্যালয় আছে। সেখানে একটি হল করে নাম দিলেন বঙ্গবন্ধুর নামে। এরপর এলেন খালেদা জিয়া। তখন এই লোক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি চট্টগ্রামের পাহাড়তলি বধ্যভূমির একাংশ কিনে সেখানে একটি বিজনেস ইনস্টিটিউট স্থাপন করলেন, নাম দিলেন জিয়াউর রহমানের নামে। একদিক দিয়ে অবশ্য এর প্রতীকী অর্থ আছে। শহীদদের অবমাননা করেছিলেন জিয়াউর রহমান। সুতরাং বধ্যভূমিতেই তো তার নামে প্রতিষ্ঠান হবে। শহীদদের অবমাননা করে এই কাজটি তাঁকে না করার জন্য অনেক অনুরোধ করা হয়েছে, কর্ণপাত করেননি। কারণ, তৎকালীন মেয়র মহিউদ্দিন তাঁকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন আঞ্চলিকতার কারণে। আমি, গাজী সালাউদ্দিন, প্রজন্ম ’৭১ ও আরও অনেকে চট্টগ্রামে নানা প্রতিবাদ কর্মসূচী করেছি। পরে মামলা করেছি। প্রায় এক দশক হতে চলল সেই মামলা চলছে। এখন তা আপীল বিভাগে। সুতরাং, এরা কি জিনিস আমরা জানি।
মহিউদ্দিন ভাই যেটা জানালেন তাহলো আলবদর প্রতিষ্ঠিত চরম প্রতিক্রিয়াশীল পত্রিকা দৈনিক ইনকিলাব নিয়মিত কুখ্যাত মোনায়েম খানের নামে একটি ক্রোড়পত্র বের করত। পত্রিকাটির রাজাকারী চরিত্রের প্রমাণস্বরূপ এটিই যথেষ্ট। ২০০৬ সালের ১৪ অক্টোবর এই পত্রিকাটি ‘মোনায়েম খান-এর ৩৪তম শাহাদাতবার্ষিকী’ উপলক্ষে একটি ক্রোড়পত্র বের করে। ডা. ইসলাম ‘গবর্নর মোনায়েম খান এবং আমাদের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসা শিক্ষা’ নামে ইনকিলাবে একটি নিবন্ধ লেখেন। সেখানে প্রাক্তন গবর্নরের নানারকম স্তুতি করে আফসোস করে লেখেন, ১৪ অক্টোবর ১৯৭১ সালে ‘কয়েকজন দুস্কৃতকারী বাইরে থেকে গুলি করে মোনায়েম খানকে হত্যার চেষ্টা চালায়।’ পাকি, জামায়াতীরা ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতকারী বলত। রাজাকারী দিল হলেই মুক্তিযুদ্ধের ৩৫ বছর পর একটি লোক বলতে পারে মুক্তিযোদ্ধারা ছিল দুষ্কৃতকারী এবং রাজাকারী স্পিরিট বর্তমান থাকলেই বধ্যভূমিতে জিয়াউর রহমানের নামে ইনস্টিটিউট বানান সম্ভব। এই সব লোককে সম্মান জানানো মানে নিজেকে এবং মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করা।
মহিউদ্দিন ভাই এ প্রসঙ্গে জানালেন, লন্ডনে বসে যখন শুনলাম দুই কিশোর এ কাজটি করেছে তখন আমরা উদ্বেলিত হয়ে বলেছিলাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর কেউ ঠেকাতে পারবে না। সেই কিশোর মোজাম্মেলকে বঙ্গবন্ধু সরকার দিয়েছিল বীর প্রতীক উপাধি। আর ত্ার ডাক্তার বলেন, সেই কিশোরকে দুষ্কৃতকারী।
মহিউদ্দিন ভাইকে আমি বলি, ছদ্মবেশে সুযোগ সন্ধানীরা এসব করবেই। বিএনপি যেমন সমন্বয়ের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে তখন ক্ষমতাবানদের অনেকেও একই রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। তবে, নুরুল ইসলামের খুঁটিনাটি প্রধানমন্ত্রীর জানার কথা নয়। তাছাড়া বয়োজ্যেষ্ঠদের তিনি সম্মান করেন। কিন্তু তাঁর আশপাশের লোকজনদের বিষয়গুলো জানা দরকার। সুযোগ সন্ধানীরা সম্মানিত হলে, সুবিধা পেলে সমাজে এই বার্তা দেয়া হয় যে, সততা কোন বিষয় নয়, ইনটেগ্রেটি কোন সম্পদ নয়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে রাজাকারদের বিচারের প্রসঙ্গটি আনতে চাই। যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে আমার মনে হলো, এই বিচার পরিচালনায় সরকার যথেষ্ট শৈথিল্য দেখাচ্ছে। এর কারণ কি বোধগম্য হলো না। এর একটি কারণ কি এই যে ডা. নুরুল ইসলামের মতো অনেকে এখন প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে আছেন বা নীতি নির্ধারণে? গোলাম আযমের নাগরিকত্ব চেয়েছেন এবং মোশতাকের সমর্থক এরকম অনেকে এখন ঘোর আওয়ামী লীগার। পদেও আছেন। যাক এগুলো শোনা কথা বলে উড়িয়ে দিতে পারেন।
ইতিহাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃতিত্ব বলে একটি বিষয়ই বারবার উল্লেখিত হবে তাহলো, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, পদ্মা সেতু নয়, জিডিপি বৃদ্ধিও নয়। এই নিয়ে তাঁর আন্তরিকতার কোন ঘাটতি আছে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহ তাঁকে প্রয়োজনীয় তথ্য দিচ্ছে না ইচ্ছে করে। কারণ, যুদ্ধাপরাধের বিচার সুষ্ঠুভাবে না হলে বা অভিযুক্তরা ছাড়া পেলে এর মাসুল দেবেন প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নয়। দায়-দায়িত্বও বর্তাবে তাঁর ওপর। অন্যরা ডা. নুরুল ইসলাম হয়ে যাবে।
এবার আমার সাক্ষ্যের কথা বলি। সাক্ষ্য দিতে গিয়ে দেখি একজন মহিলা কম্পিউটার অপারেটরকে বগুড়ার কোন এক সরকারী বিভাগ থেকে বদলি করা হয়েছে প্রথম ট্রাইব্যুনালে। এই মহিলা ১০টা থেকে ৪/৫টা পর্যন্ত একটানা বসে আদালতের কার্যবিবরণী টাইপ করেন। তাঁর কোন অবকাশ নেই। তাঁকে বেতন আনতে যেতে হয় বগুড়া। থাকার জায়গা নেই। অসুস্থ হওয়ার অধিকার নেই। আইটির একজন আছেন তিনি দু’টি ট্রাইব্যুনালে দৌড়াদৌড়ি করেন। এদের বিশেষ কোন ভাতা নেই। দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে যথাযথ জায়গাও নেই। নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে আমরা অনেক আবেদন নিবেদন করেছিলাম অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়ে। একমাত্র অর্থমন্ত্রী তাতে সাড়া দিয়েছিলেন। টাকা বরাদ্দ দিয়েছিলেন। কোন কাজ হয়নি। এই জনকণ্ঠে শাহরিয়ার কবির লিখেছিলেন, ‘ট্রাইব্যুনাল গঠনের এক বছর আগেই আমরা সরকারের নীতি নির্ধারকদের জানিয়েছিলাম, ৮/১০ জন শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীর বিচার এক বছরের ভেতর শেষ করা যাবে যদি পর্যাপ্ত লোকবল ও রসদ সরবরাহ করা হয়। প্রথম দফায় আমরা অন্ততপক্ষে ২৫ জন দক্ষ, সৎ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি দায়বদ্ধ সর্বক্ষণিক আইনজীবী নিয়োগের কথা বলেছিলাম। এ পর্যন্ত ১৫ জন আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হলেও এদের অধিকাংশ এই মামলার বাইরে অন্য আদালতে অন্য মামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ট্রাইব্যুনালের প্রশাসনিক বিভাগে জনবল প্রয়োজন অন্ততপক্ষে ১৫০ জন, বর্তমানে রয়েছে মাত্র ১৩ জন। ভাবতে পারেন? বিচারকদের দাফতরিক কোন সুযোগ সুবিধাও নেই।
প্রসিকিউশনে দায়বদ্ধ এবং বিষয়টি বোঝেন এমন আইনজীবী খুব বেশি নেই। এতে আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা চটতে পারেন কিন্তু বিষয়টি সত্য। কোন কোন ক্ষেত্রে দক্ষতাকে গুরুত্ব দিতে হয় দলীয় আনুগত্য নয়। আপনারা কি বিশ্বাস করবেন যে, ট্রাইব্যুনালের কোন রেফারেন্স লাইব্রেরি নেই, গবেষক নেই, কিচ্ছু নেই। ট্রাইব্যুনালের কারণে সেখানে প্রচুর লোকের জমায়েত হয়। একটি ক্যান্টিন নেই। প্রসিকিউশনের চা খাওয়ার পেয়ালা আছে কিনা তাও সন্দেহ। এই দিয়ে একটা বিচার কাজ চলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? তখন কি ধারণা হতে পারে না যে, ‘লোক দেখানো একটি বিচার কাজ চলছে।’
বিদেশে এত অপপ্রচার চলছে শেখ হাসিনা ও যুদ্ধাপরাধ নিয়ে বলার নয়। এর জবাব দেয়ার জন্য একটি কাঠামো বা সেল নির্মাণের জন্য আইনমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সবার কাছে অনুরোধ করা হয়েছে, কিচ্ছু হয়নি। নিজেদের খরচে বা কোথাও থেকে অর্থ সংগ্রহ করে আমরা বিদেশের বিভিন্ন স্থানে/ সম্মেলনে যোগ দিয়ে অপ্রচারের জবাব দিয়েছি যদিও সেটি আমাদের কাজ নয়। শাহরিয়ার লিখেছেনÑ
“গত দু’বছরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে জামায়াত এক ডজনেরও বেশি বই প্রকাশ করেছে ইংরেজীতে, লাখ লাখ কপি ছেপে সর্বত্র বিনামূল্যে সরবরাহ করছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের শুনানিতে যাওয়ার সময় আমরা ‘৭১-এর গণহত্যা ও আইন সম্পর্কে এবং জামায়াতের বিভিন্ন অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আমাদের বক্তব্য ছবিসহ একটি পুস্তিকা ইংরেজীতে প্রকাশ করেছিলাম। সঙ্গে ছিল মানবাধিকার কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত আরও সীমিত কলেবরের একটি পুস্তিকার কিছু কপি। বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলোয় জামায়াতের অপপ্রচারের জবাব দেয়ার মতো কোন তথ্যসমৃদ্ধ প্রকাশনা আমরা দেখিনি। সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিলাম যেহেতু তারা ছাপাতে পারছেন না, ইচ্ছে করলে আমাদের প্রকাশনা তারা বিভিন্ন দূতাবাসে পাঠাতে পারেন। ছয় মাস হতে চলেছে এ বিষয়ে কোন অগ্রগতি হয়নি।
পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে ইউরোপের বহু মানবাধিকার সংগঠন, আইনপ্রণেতা ও সাংবাদিকরা জামায়াতী তৎপরতায় বিভ্রান্ত হচ্ছেন। যার ফলে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ক্ষুণœ হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে সরকারের কোন ভূমিকা দৃশ্যমান নয়। কেন নয় তার জবাব সরকারের নীতিনির্ধারকরাই দিতে পারবেন। অনেক সময় তাঁরা বলেন, বিদেশীদের সব প্রশ্নের জবাব দিতে আমরা কূটনৈতিকভাবে বাধ্য নই। কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতার বাইরেও বাংলাদেশের মর্যাদার বিষয়টি আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর মহাজোট সরকার যখন ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে তখন আন্তর্জাতিক মহলে যথেষ্ট আগ্রহ ছিলÑ একটি উন্নয়নশীল দেশ কিভাবে নিজেদের আইন, মেধা ও সম্পদের দ্বারা এসব আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার করে তা পর্যবেক্ষণের জন্য। জামায়াতের ধারাবাহিক অপপ্রচারে সে আগ্রহে অনেক ভাটা পড়েছে, কোথাও প্রশ্ন উঠেছে সরকারের যোগ্যতা ও সদিচ্ছা সম্পর্কে।”
এ মানসিকতা হবে বেগম জিয়া বা তার সরকারের। শেখ হাসিনা বা তার সরকারের এ ধরনের মানসিকতা কাম্য নয়।
আমরা সবসময় বলেছি, এখনও বলি, জামায়াতকে বঙ্গবন্ধু নিষিদ্ধ করে ঠিক কাজটি করেছিলেন। যে কারণে তিনি একজন স্টেটসম্যান। এখনও যুদ্ধাপরাধের কারণে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা উচিত। নূরেমবার্গে কিন্তু অপরাধী সংগঠন হিসেবে নাৎসী দলকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল যে কারণে সেখানে আর কখনও জঙ্গীবাদ বিকশিত হতে পারেনি। জামায়াতের সদস্যরাই রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটি গড়েছিল। একদিকে যেমন তারা সহযোগী শক্তি পাকিদের তেমনি ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশনেও। এবং সে কারণে তাদের দলীয় নেতৃত্বের ওপর কমান্ড রেসপনসিবিলিটির দায় বর্তায়। প্রসিকিউশন কেন এতে গুরুত্ব দেয় না তা বোধগম্য নয়।
জামায়াতী আইনজীবীরা কৌশল হিসেবে চাইবে এই ট্রাইব্যুনাল অনন্তকাল চলুক। কিন্তু, বিচারকরা তা চলতে দিতে পারেন না। সমাজ রাষ্ট্রে তাদেরও একটা দায় আছে। বিচারপতি নিজামুল হক সময় বেঁধে দেয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটি সময়োপযোগী, যা আগেই দেয়া উচিত ছিল। তার এই সিদ্ধান্ত প্রশংসিত হয়েছে। ১৫০০ সাক্ষীর নাম জমা দেয়া মানে ট্রাইব্যুনালকে ঠাট্টা করা। এসব ঠাট্টাও প্রতিহত করা বাঞ্ছনীয়।
এত সমালোচনার পরও আমরা বলতে চাই, যা আমাদের পক্ষে বলেছেন শাহরিয়ার যে, “এতসব সীমাবদ্ধতার পরও ট্রাইব্যুনালের কয়েকজন আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তা সাধ্যাতীত পরিশ্রম করছেন। তারপরও এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, সব সাধ্যেরই সীমা থাকে। আমরা এখনও মনে করি, প্রয়োজনীয় লোকবল, রসদ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে ২০১৩ সালের ভেতর ১০ জন শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন করা সম্ভব।”
এ প্রসঙ্গে সাক্ষীদের নিরাপত্তার কথাটি একটু বলি। উইটনেস প্রটেকশন আইন আমাদের অনেক দিনের দাবি। শুনেছি, কেবিনেটে এ প্রসঙ্গ উঠেছিল ও কিন্তু তা স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে। এ তথ্য ভুল হলে ক্ষমাপ্রার্থী। সত্য হলে বলব, এ সিদ্ধান্ত ভুল। কারণ কেবিনেটে যাঁরা আছেন তাদের অনেকের থেকে নিরাপত্তা বেশি দরকার যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছেন তাদের। কারণ, তাদের অর্থ, পেশী কোন শক্তিই নেই। লক্ষণীয়, ট্রাইব্যুনালে কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে সাক্ষী দিতে আনা যায়নি। আমাদের যত ছাপোষারাই সেখানে গেছেন।
সরকারের এই শৈথিল্যের কারণেই আমরা বলি বিচারটা না প্রহসনের হয়ে দাঁড়ায়। তখন সরকারী নেতারা তারস্বরে কথা বলা শুরু করেন এবং হাস্যাস্পদ হন। কারণ যা বলা হচ্ছে তা তারা করেছেন কিনা সে ব্যাপারে তারা কিছু বলতে পারেন না। যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় পেলে ও কার্যকর হলে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে শেখ হাসিনা উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বে পরিণত হবেন। তাঁর নামে যেসব সম্মেলন করা হয় বা প্রচার হয় তাতে কোন ফল আসবে না। প্রধানমন্ত্রী চাচ্ছেন কিন্তু হচ্ছে না, তা’হলে বলা যাবে শৈথিল্য করছে মন্ত্রীরাই। তাঁরাই দায়ী। আর যদি সম্মিলিত নীতি হয় শৈথিল্য প্রদর্শন করা, তা’হলে আমাদের এসব বক্তব্য অরণ্যে রোদন মাত্র। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ ডা. নুরুল ইসলামের মতো কারা আপনার টেবিল চেয়ারের পাশে বা বারান্দায় আছে তাঁদের চিহ্নিত করুন। তা’হলে এ ক্ষেত্রে হয়ত শৈথিল্য প্রদর্শন হ্রাস পাবে। নাকি প্রধানমন্ত্রীই চান এরকম শৈথিল্য থাকুক?
No comments