নদী বাঁচাতে পিলার পিলার বাঁচাবে কে? by তৌফিক মারুফ

পিলার আছে পিলারের জায়গায়। কোথাও সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে স্থাপনা চলে গেছে সীমানা পেরিয়ে নদীর ভেতরে। কোনোটা আবার চাপা পড়েছে নদী ভরাটের বালুর নিচে বা ঢাকা পড়েছে ইটখোলার চিমনির আড়ালে। অনেক পিলারের নিচের অংশ ঠিক থাকলেও ওপরের পাইপটি উধাও। বহু পিলার হেলে পড়ে আছে পানির ওপর।


আবার অনেক স্থানে বিভিন্ন স্থাপনা বাঁচিয়ে পিলার স্থাপনের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে আছে। নদীর সীমানা রক্ষার জন্য স্থাপন করা প্রায় ৩০ কোটি আট লাখ টাকার পিলার এভাবেই পানিতে ভেসে যেতে বসেছে। গতকাল শুক্রবার গাবতলী থেকে আশুলিয়া হয়ে টঙ্গী পর্যন্ত এলাকার তুরাগ নদের তীর ঘুরে দেখা যায় এমন চিত্র। তুরাগের এ অংশ বিস্তৃত ঢাকা ও গাজীপুরের অংশবিশেষজুড়ে।
নৌপরিবহনমন্ত্রী মো. শাজাহান খান এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, নদীতীরে সীমানা পিলার যথাযথ স্থানে স্থাপন ও গুণগতমান বজায় রেখে নির্মিত হলো কি না, তা মনিটর করার জন্য এরই মধ্যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ কমিটি পুরো পিলার স্থাপনকাজ পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন দেবে। এর ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পিলার দেওয়া সত্ত্বেও অনেক স্থানেই সীমানা অতিক্রম করে নদীর ভেতর পর্যন্ত বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি ও বালু বা মাটি দিয়ে ভরাট করা প্রসঙ্গে নৌমন্ত্রী বলেন, কারা এমন করেছে, তা চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গতকাল সকাল থেকে নদের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনকালে দেখা যায়, গাবতলীর কাছে বহুস্থানে সীমানা পিলার অতিক্রম করে নদীর দিকে প্রকাশ্যে ড্রেজার দিয়ে বালু ভরাট করা হচ্ছে। বহুসংখ্যক শ্রমিক এ কাজে নিয়োজিত থাকলেও কে তাদের নিয়োজিত করেছে, তা জানাতে রাজি হয়নি কেউ। সিন্নির টেক এলাকায় দেখা যায়, অনেক পিলারের বেশির ভাগ অংশ বালুতে চাপা পড়ে গেছে। পিলার ছাড়িয়ে নদীর ভেতরেও বালু ভরাট চলছে। সিন্নির টেকে বিআইডাব্লিউটিএর ল্যান্ডিং স্টেশনের আশপাশেও একই অবস্থা চলছে।
মিরপুর বেড়িবাঁধ সড়ক হয়ে আশুলিয়ার দিকে যেতে অনেক ইটখোলা দেখা যায় সীমানা পিলার ছাড়িয়ে নদীর দিকে এগিয়ে গেছে। কোনো কোনো ইটখোলায় আবার চিমনি বাঁচিয়ে পিলার স্থাপন করতে দেখা গেছে। এসব ইটখোলা বা বালু ভরাট করা স্থানটি কোন মালিক বা প্রতিষ্ঠানের, তা শনাক্ত করার মতো কোনো সাইনবোর্ড দেখা যায়নি।
স্থানীয় লোকজন জানায়, এসব জমির মালিকের বেশির ভাগই নদী ভরাটের সময় ঝামেলা এড়ানোর কৌশল হিসেবে নাম-ঠিকানা গোপন রাখার স্বার্থে কোনো সাইনবোর্ড ব্যবহার করে না। শ্রমিক বা স্থানীয় লোকজন তাদের নাম জানলেও ভয়ে তা জানানোর সাহস দেখায় না।
বিআইডাব্লিউটিএর উপপরিচালক ও ঢাকা নৌবন্দর কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, 'কিছু কিছু বিষয় আমাদের নজরে এসেছে। আমরা কোনো কোনো অবৈধ দখলকারীকে এরই মধ্যে নোটিশ দিয়েছি। কারো কারো বিরুদ্ধে মামলাও করেছি।' তিনি বলেন, 'বেশি নয়, অল্প কিছু পিলার হেলে পড়তে দেখা গেছে।'
আশুলিয়া মোড়ের কাছে বিআইডাব্লিউটিএর আশুলিয়া ল্যান্ডিং স্টেশন ভবনটিও পাশের সীমানা পিলার ছাড়িয়ে নদীর অনেকটা ভেতর পর্যন্ত চলে গেছে। ওই ভবনের ঠিক উল্টো দিকেই দেখা যায় পানির ভেতর হেলে পড়ে আছে সীমানা পিলার।
ঢাকা নৌবন্দর কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, জনস্বার্থেই ল্যান্ডিং স্টেশনের স্থাপনা সীমানা ছাড়িয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা অনুসরণ করা হয়েছে।
স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন হাত তুলে দূরে দেখিয়ে বলেন, 'তুরাগ বাঁচানোর লাইগ্যা এই পিলারগুলান দেওয়া অইছে, নাকি অবৈধ জমি দখল হালাল করতে এগুলান দেওয়া অইছে বুঝতাছি না। কেউ তো দেহি এই পিলার মানতাছে না।' এর পরই আলতাফ হোসেন যোগ করেন, 'দেহেন তো সীমানা ঠিক করণের নামে কেমনে পিলার দিয়া এত্ত বড় তুরাগডারে চিকনা খাল বানাইয়া ফালাইল! তুরাগ কি কুনোকালে এমুন চিকনা আছিল!'
আশুলিয়া মোড় থেকে আবদুল্লাহপুরের দিকে যাওয়ার পথেও বহু স্থানে একইভাবে সীমানা পিলার ছাড়িয়ে অবৈধ দখলের বিভিন্ন স্থাপনা দেখা যায়। আবার টঙ্গী এলাকায় দেখা যায় সীমানা পিলারের ভেতরে গড়ে উঠেছে বস্তি ও বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
পিলার স্থাপনের ক্ষেত্রে ঢাকা জেলার কাজের মনিটরিং কমিটির প্রধান ও ঢাকা জেলা প্রশাসক মো. মহিবুল হক বলেন, যদি কোনো পিলার হেলে বা উপড়ে পড়ে থাকে তা সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের মাধ্যমে পুনরায় স্থাপন করা হবে। কারণ, এসব পিলার দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার মতো উপযুক্ত মজবুতভাবে তৈরি ও স্থাপন করার কথা। এটা না হলে ঠিকাদাররা বিল পাবেন না।
পিলার না মানা প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক বলেন, 'মানুষ সহজে আইন মানতে চায় না। পিলার বসাতে গিয়ে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। অনেক স্থানে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবু আমরা চেষ্টা করেছি যতটা সঠিকভাবে কাজ করা যায় সেভাবে করতে। তার পরও অনেকে অমান্য করছে। স্থানীয় মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা প্রয়োজন। তা না হলে সরকারের একার পক্ষে এত কঠিন কাজ করা মুশকিল হয়ে পড়ে।'
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নদী রক্ষাসংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু এবং ধলেশ্বরী নদ-নদীর সীমানা পিলার স্থাপন কাজের জন্য গত বছর প্রথমে ২৫ কোটি ৮১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। পরে তা বাড়িয়ে ৩০ কোটি আট লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা জেলার ১১৬ কিলোমিটার, নারায়ণগঞ্জের ৬০ কিলোমিটার, গাজীপুরের ১৮.৫০ কিলোমিটার এবং মুন্সীগঞ্জের ২৫ কিলোমিটার এলাকায় নদ-নদীর সীমানা নির্ধারণী পিলার স্থাপন করার সিদ্ধান্ত হয়। এসব জেলার জেলা প্রশাসনকে স্থানীয় গণপূর্ত অধিদপ্তরের (পিডাব্লিউডি) মাধ্যমে পিলার নির্মাণকাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত বছর ১১ এপ্রিল নদী রক্ষাসংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সভাপতি ও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান টংগীর কামারপাড়া ব্রিজসংলগ্ন তুরাগ নদের তীরে সীমানা পিলার স্থাপনের কাজ উদ্বোধন করেন।
পরবর্তী এক বছরের কার্যক্রম সম্পর্কে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, গত ৮ মে পর্যন্ত ঢাকা জেলায় ছয় হাজার ৮৫৪টি সীমানা পিলারের মধ্যে দুই হাজার ৮০০, নারায়ণগঞ্জে পাঁচ হাজার ৪১টির মধ্যে চার হাজার ৪৯১টি, গাজীপুরে ৮০০টির মধ্যে ২৬৮টি এবং মুন্সীগঞ্জে ৬০৪টির মধ্যে ৫৬৩টি সীমানা পিলার স্থাপন করা হয়েছে। বাকি পিলার স্থাপনের কাজ চলছে। পিলার স্থাপন শেষ হলে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের আওতায় এসব নদীর তীরে বনায়ন কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। এসব পিলার স্থাপন তদারকির জন্য গত ৮ মে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত 'দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদীর নাব্যতা এবং নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে পরামর্শ প্রদান, সুপারিশ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য গঠিত টাস্কফোর্স'-এর ১৭তম সভায় একটি কমিটি গঠন করা হয়। স্থানীয় সংসদ সদস্যদের ওই কমিটিতে উপদেষ্টা হিসেবে রাখা হয়েছে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলার জেলা প্রশাসকদের নেতৃত্বে চারটি কমিটিকে বিষয়গুলো মনিটর করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কমিটিতে ভূমি জরিপ অধিদপ্তর, বিআইডাব্লিউটিএ, পরিবেশবিদ, গণপূর্ত অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট মেয়রের একজন করে প্রতিনিধি রয়েছেন। নদ-নদীর তীরে সীমানা পিলার যথাযথ স্থানে স্থাপন ও গুণমান বজায় রেখে পিলারগুলো নির্মিত হলো কি না তা পর্যবেক্ষণ করে আগামী ৩০ জুনের মধ্যে এসব কমিটি তাদের কাজ শেষ করবে এবং পরবর্তী টাস্কফোর্সের সভায় অগ্রগতির রিপোর্ট দেবে।

No comments

Powered by Blogger.