স্মরণ-মায়ের কথা বলি by নাসরীন সুলতানা

মা, কাল ছিল তোমার মৃত্যুদিন। কালের স্রোতে একটি, দুটি করে আজ এসে দাঁড়াল দশটি বছরে! কত দিন দেখি না তোমায় মা! অধ্যাপক পিতার ছয় সন্তানের মধ্যে তুমি ছিলে চতুর্থ। প্রথম সন্তানের কাঙ্ক্ষিত স্থানটিতেও নয় অথবা ছোট্ট সন্তানটির আব্দারের জায়গাতেও নয়।


মাঝামাঝি অবস্থানে থেকেও মা-বাবার কাছে ছোটবেলা থেকেই একটি বিশেষ স্থান করে নিয়েছিলে তুমি তোমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আর প্রতিভার গুণে। একবার তোমার গায়ে এলার্জি হওয়ায় তোমার মা রাতে ঘুমাতে পারছিলেন না, আর তাই তোমাকে বিছানা ছাড়তে হয়েছিল। তখন তোমার বাবা তোমাকে কোলে তুলে সারা পিঠে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এভাবেই শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা রাখলে। তোমার পড়াশোনার প্রতি আগ্রহে তোমার মা আরও বেশি সতর্ক হয়েছিলেন। বছর শেষে যখন শ্রেণীতে প্রথম হয়ে রিপোর্ট কার্ড নিয়ে আসতে, তখন তোমার মা আদর করে লোহার কড়াইয়ে জ্বাল দেওয়া নিজের গোয়ালের গরুর দুধের সর দিয়ে ভাত খেতে দিয়ে তোমাকে করতেন পুরস্কৃত।
১৯৪৯ সালে ঢাকা বোর্ড থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় যখন প্রথম বিভাগে মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সবার মধ্যে ১৬তম স্থান অধিকার করলে, তখন সবার খুশির সীমা ছিল না। তুমি বিজ্ঞান পড়বে, কিন্তু পড়বে কোথায়? তোমার মা তোমার বাবাকে বললেন, ‘আমার মেয়ে ঢাকার বাইরে যাবে না। তুমি কেমন প্রিন্সিপাল হয়েছ? ঢাকায় বিজ্ঞান পড়ার ব্যবস্থা নেই, বললেই হলো?’
অতএব ঢাকা কলেজে মেয়েদের বিজ্ঞান শাখায় পড়ার ব্যবস্থা চালু হলো। ১৯৫১ সালে ইন্টারমিডিয়েটে তুমি মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয় এবং সবার মধ্যে ২২তম স্থান অধিকার করলে। তোমার মায়ের আদেশ হলো, তোমাকে ডাক্তারি পড়তে হবে। ১৯৫২ সালে গুটিকয়েক মেয়ের সঙ্গে শুরু হলো তোমার পথচলা ঢাকা মেডিকেল কলেজে। সেখানেও মেধাবী ছাত্রী হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে দেরি হয়নি তোমার। ডিসেক্শনের (মরদেহ ব্যবচ্ছেদ) ক্লাস যখন শুরু হলো, অনেক দিন হাতে ভাত খেতে পারনি। তোমার মা আর তোমার বড় আপার বিশেষ সহযোগিতা আর অনুপ্রেরণাতেই তুমি এগিয়ে চললে সামনের দিকে। তোমার স্মার্টনেস, তোমার ব্যক্তিত্ব, তোমার চারিত্রিক দৃঢ়তায় আকৃষ্ট হলেন মেডিকেল কলেজের আরেক ভবিষ্যৎ দিকপাল অধ্যাপক শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি। তোমার এবং তোমার মা-বাবার মন জয় করে জীবনসঙ্গিনী করতে পেরেছিলেন তিনি তোমায়। এ যেন ছিল এক অপূর্ব যুগল, যার স্মৃতি শাহজাহান-মমতাজের মতো আজও করে ঝলমল। তোমার মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল তুমিও আব্বার সঙ্গে লন্ডনে যাবে উচ্চশিক্ষার জন্য। কিন্তু আব্বার উত্তর ছিল, দুজনেই পেশায় বেশি জড়িয়ে পড়লে ছেলেমেয়ে, সংসার অবহেলিত হবে। তোমাকে তাই দেখেছি আব্বার অনুপস্থিতিতে কীভাবে তুমি আমাদের দুই ভাইবোনকে (তখন) নিয়ে নানির যৌথ পরিবারে নানা অসুবিধা, সমস্যার মাঝেও কোনো কষ্ট, অভাব বুঝতে দাওনি আমাদের; জানতে দাওনি প্রবাসী আব্বাকেও। এমনকি তোমার শ্বশুরালয়েও বিভিন্নভাবে সাহায্য করে গেছ আব্বার অগোচরে, আর আব্বার প্রতীক্ষায় দিন গুনেছ। বছর না ঘুরতেই আব্বা ফিরে এল, জয়েন করল ঢাকা মেডিকেল কলেজেই। তারপর শুরু হলো আলাদা সংসার।
অতি সযতনে সাজালে তোমার ছোট্ট নীড়টি। আব্বার সুনাম অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে লাগল দেশে-বিদেশে। একটুও বিচলিত হওনি তুমি। সমানতালে আব্বার চেম্বার, পেশাগত দায়িত্ব পালন, সামাজিকতা, বাড়িতে অনুকূল পরিবেশ রক্ষাসহ আব্বার রাজনৈতিক প্রগতিশীল চিন্তাধারায়ও সমানভাবে অংশ নিয়েছ। আর সব রকম চিন্তা, সমস্যা থেকে আড়াল করে রাখতে আমাদের তিন ভাইবোনকে। তোমাদের অত্যন্ত সুখী দাম্পত্য জীবন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যে মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আসছিল, তা কে জানত? আব্বার চেম্বারে নানা ধরনের রাজনৈতিক দলের লোকের আসা-যাওয়া ছিল। আব্বা সবাইকেই আর্থিক সাহায্য চাইলে দিত। তোমার এক প্রশ্নের উত্তরে আব্বা বলেছিল, ওরা সবাই তো দেশের জন্য কাজ করছে।
এল মুক্তিযুদ্ধ। আব্বার পাশাপাশি অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে সেবা দিয়েছ গভীর রাতেও, যা আমরা টের পেতাম না। তুমি লিখে গেছ, সিজদায় গিয়ে আল্লাহর কাছে বলতে, ‘আগে বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাও, তারপর আমার ছেলে, যেখানেই থাকুক তাকে বাঁচাও।’ কারণ আমার ভাই তখন মুক্তিযুদ্ধে চলে গিয়েছিল। যখন খবর পেয়েছ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে খুন করা হয়েছে, তখনো তোমার চোখের পানি বাঁধ মানেনি। স্বাধীনতার প্রাক্কালে হারাতে হলো তোমার প্রাণপ্রিয় স্বামীকে। তবু ভেঙে পড়নি তুমি। অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝার সম্মুখীন হতে হয়েছে তোমাকে পারিবারিক ও পেশাগত দিক থেকে। সরকারি বাড়ি দান, দূতাবাসের চাকরিসহ অনেক লোভও দেখানো হয়েছে। কিন্তু তুমি তোমার স্বামীর মরদেহ ও স্মৃতি এখানে ফেলে পারনি সুখের জন্য বিদেশ যেতে, পারনি সরকার থেকে কিছু সুবিধা গ্রহণ করে আব্বার আত্মত্যাগকে ছোট করতে। টানা ঊনত্রিশটি বছর তুমি আব্বার স্মৃতি বুকে ধারণ করেছ। এর মাঝে কত চড়াই-উতরাই-ই না পার হতে হয়েছে তোমায়। তোমাকেও সেই কালরাতে নিতে এসেছিল ওই রাজাকারেরা। কিন্তু ভাগ্যচক্রে কী ভেবে চেঁচামেচি করে তারপর চলে গিয়েছিল। দেখে যেতে পারনি তোমার স্বামীর হত্যাকারীদের বিচার, যে পাষণ্ডরা তোমার বুকে বন্দুকের নল চেপে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তোমার স্বামীকে। তুমি সরকারি চাকরি করতে বলে অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। যোগ্যতার চরম শিখরে থাকা সত্ত্বেও তোমার চাকরিজীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছেও পক্ষপাতিত্বের কারণে পাওনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাঙ্ক্ষিত ‘মহাপরিচালক’-এর পদটি। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে বিধবা হয়ে অনেক যাতনা, মনোকষ্ট ও নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর ঊনত্রিশটি বছর আমরণ টেনে গেছ। অতীতের বিভীষিকাময় দিনগুলোতে তোমার পাশে, আমাদের পাশে যাঁরা এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি।
তুমি একজন সাধারণ নারী নও। আর তাই তুমি তোমার ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিদের চলার পথে, বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা ও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে একজন আদর্শ কন্যা, জায়া ও জননী হিসেবে।

No comments

Powered by Blogger.