কল্পকথার গল্প-যে যা বলুক ভাই, আমাদের আরেকটা পল চাই by আলী হাবিব

মার্চের ১১। দিন একটা গেল বটে। না, শুধু তো দিন নয়। দিনে শুরু, রাতে শেষ। আগের দিন তো দিনেরবেলায়ই ফুরিয়ে গিয়েছিল খেলা। কিন্তু চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে তেমনটি ঘটেনি। বিলেতি বাবুদের কাবু করে দিল দেশের দামাল ছেলেরা।


সে একটা সময় গেল বটে! শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অন্য রকম একটা অবস্থার ভেতর দিয়ে পার করতে হলো। কেমন সেই অবস্থা? কী বললে অবস্থার বর্ণনা সঠিক হবে? বাংলায় কিছু শব্দ আছে। সেসব শব্দ দিয়ে কি বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ম্যাচের পুরো বর্ণনা দেওয়া সম্ভব? এমন কঠিন অবস্থায় বোধ হয় অনেকদিন পড়তে হয়নি বাংলাদেশের দর্শকদের। খেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একঠায় বসে থাকা। না, বসে থাকাটা সবার ধৈর্যে কুলায়নি। অনেকে তো শেষ দিকে মাঠ ছাড়তে শুরু করেছিলেন। যাঁরা মাঠ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তাঁরা সেদিনকার ইতিহাসের সাক্ষী হতে পারেননি। মাঠ ছেড়ে গিয়ে অনেকেই হয়তো টেলিভিশনের সামনে বসেছিলেন। কিন্তু কে জানত, অদৃশ্যে এমনটাই লেখা ছিল! কেউ কি ঘুণাক্ষরেও জানতে পেরেছিলেন, সবার অলক্ষ্যে লেখা হয়ে যাচ্ছে এক বিলেতবধ কাব্য_শফিউল ও রিয়াদের হাত দিয়ে। আগে থেকে জানা থাকলে বেশ একটা সুবিধা পাওয়া যেত। কিন্তু এবার তো পল নেই। পল নেই, তাই আগাম ফলও নেই। কিন্তু বল আছে। আগের বার ছিল ফুটবল, এবার আছে ক্রিকেট-বল। আকারে ছোট, কিন্তু সেই বলেও বল প্রয়োগ করতে হয়। বল প্রয়োগ ছাড়া বলের ওপর খবরদারি করা যায় না। অবশ্য বল না থাকলে বল প্রয়োগ করাও যায় না। তাই দুর্বলরা বল প্রয়োগ করতে পারে না। বল না থাকলে দুর্বল হতে হয়। বল থাকলে সবল। বলের ওপর বল প্রয়োগ করতে না পারলে খেলায় জয় পাওয়া যায় না। ফুটবল কিংবা ক্রিকেট_সবখানেই বলের ওপর বল প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু তার পরও একটা পল চাই। ফল আগে থেকেই জেনে নিতে পল চাই।
পল একজন ছিল। মহাজ্যোতিষী পল। খেলার আগে ফল বলে দিত। যা বলত, তা-ই ফলে যেত। গত বিশ্বকাপ ফুটবল আসরের সময় সবাইকে ছাড়িয়ে হিরো হয়ে গিয়েছিল পল। মাঠে ছুটত বল। ওদিকে জার্মানিতে ছিল পল। ইংল্যান্ডের পল জায়গা পেয়েছিল জার্মানিতে। হয়ে উঠেছিল খেলার গুরু। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে দলের পক্ষ নিয়েছিল পল, সেই দলের শিকে ছিঁড়ত মাঠে। শুধু কি বিশ্বকাপ ফুটবল? তার আগে ইউরোপিয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলায়ও পল বলে দিয়েছিল, ফল কী হবে। তখন থেকেই সে খেলার গুরু। খেলার ফল আগাম বলে দেওয়া ভবিষ্যৎদ্রষ্টা সেই পল এখন নেই। পল নেই তো আগাম ফল বলারও কেউ নেই। কিন্তু এভাবে তো আর চলছে না। আমাদের পল চাই। মাঠে যাওয়ার আগে আমরা পলের কাছে যাব। পল আমাদের বলে দেবে, ফল কী হবে। আমরা প্রস্তুতি নিয়ে যাব। পল যদি বলে জিতবে, এবার জিতবে বাংলাদেশ, আমরা বেশ তৈরি হয়ে যাব। যদি বলে, আজ হবে না, ধেড়াবে, তাহলে আমরা সেরকম প্রস্তুতি নিয়ে যাব।
যেমন ধরা যাক, গত শুক্রবারের কথা। অমন ক্রিকেট মহাকাব্য লেখা হবে, সেটা কে জানত! পল থাকলে হয়তো আগে থেকেই জানা যেত। পল থাকলে জানা যেত আগের শুক্রবারও, যেদিন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ। অনেক আশা নিয়ে মিরপুরের শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে হাজির হয়েছিলেন দর্শকরা। মনে ছিল আশা_খাসা একটা খেলা হবে, হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। যথাসাধ্য প্রস্তুত হয়েই গিয়েছিলেন সবাই। খেলা দেখতে হবে। কিন্তু অনেকে স্টেডিয়ামে পেঁৗছার আগেই খেলা শেষ হয়ে গেল। দর্শকরা ঢোল-বাঁশি নিয়ে গিয়েছিলেন। আজকাল ভুভুজেলাও এসেছে এখানে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অনেকেই প্রস্তুত ছিলেন আনন্দ মিছিল বের করার জন্য। কিন্তু হলো না। তাঁরা আনন্দ করতে পারলেন না। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি বাংলাদেশ। মাত্র ৫৮তেই ফুরিয়ে গেল বাংলাদেশ ইনিংসের আয়ু। হতাশ হয়ে ফিরতে হলো সবাইকে। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেনি ইংল্যান্ডের সঙ্গে খেলার দিন। সেই দিনটি বাংলাদেশের ক্রিকেট-ইতিহাসের এক উজ্জ্বল দিন। খেলার শুরুতে তো মনে হয়েছিল, এ আর এমন কী দূরত্ব। ঝট করেই পেরিয়ে যাওয়া যাবে। এক লাফে টার্গেট ছুঁয়ে ফেলা যাবে। শুরুতে তামিম ও ইমরুল সেই ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর? তারপর যা হলো, তাকে কী বলা যাবে? শুধু আসা-যাওয়ার ভেতর দিয়ে হঠাৎই আবার দাঁড়িয়ে গেল বাংলাদেশ। শংকর-এহসান-লয় বিশ্বকাপ ক্রিকেটকে নিয়ে একটা বেশ জমাট গান বেঁধেছেন_'মার ঘুমাকে'। বাংলা করলে নাকি দাঁড়ায় এ রকম_'মার ঘুরিয়ে'। না, ঘুরিয়ে মারতে হয়নি। স্ট্রেইট ব্যাটে সেদিন রিয়াদ-শফিউল যা করলেন, তা অনেকদিন মনে থাকবে বাংলাদেশের দর্শকদের। মনে থাকবে ইংল্যান্ডেরও। এমন একটা ইতিহাস রচিত হতে পারে, সেটা কার ভাবনায় এসেছিল কবে! একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে গেল সেদিন। কিন্তু সেই ঘটনার সাক্ষী যাঁরা হয়েছেন, তাঁরা জানেন, কেমন উত্তেজনায় কেটেছে পুরো খেলা। আশার পারদ একটু একটু করে উঠেছে, আবার নেমেছে। নেমেছে, আবার উঠেছে। তামিম-জুনায়েদ-মুশফিকদের আউট হয়ে যাওয়ার পর নাটকীয়তা শুরু। সেই নাটকের ক্লাইমেঙ্ কাকে বলে, তা দেখিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। কেমন করে এর বর্ণনা দেওয়া যায়? টেনশন? পুরোটা ম্যাচজুড়ে টেনশনে থাকতে হয়েছে দর্শকদের? হয়তো। এ জন্যই একজন পল চাই। পল যদি ফল বলে দেয়, তাহলে আর কোনো টেনশনই থাকে না_আগে থেকেই জানা হয়ে যেত, ওভারের চতুর্থ বলে বোল্ড হয়ে যাবেন তামিম। সেক্ষেত্রে নির্ভার হয়ে খেলা দেখা যায়। এই যে উত্থান-পতন, এই যে টেনশন, এ থেকে মনে হয়, এই খেলা দেখা সবার জন্য নয়। বিশেষ করে যাঁদের হৃৎপিণ্ড এই চাপ নিতে পারবে না, তাঁদের জন্য তো অবশ্যই সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ_তাঁরা দয়া করে এই খেলা দেখবেন না। না, ফুরিয়ে যায়নি বাংলাদেশ। ৫৮-র খাদ থেকে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। দেখিয়ে দিয়েছে, ইয়েস, উই ক্যান। খেলার শেষ বলটি যখন মাঠের বাইরে যাচ্ছে, তখন টেলিভিশনের ধারাভাষ্যকারদের একজন বলে উঠলেন, 'হোয়াট এ কামব্যাক'। এই কামব্যাক আবার ব্যাকফুটে চলে যাবে না তো? এটা নিশ্চিত করার জন্য একজন পল চাই, যে পল বলে দেবে_'জিতবে এবার, জিতবে ক্রিকেট'। তবে সেই ক্রিকেট বাংলাদেশের ক্রিকেট। সামনে আরো দুটি খেলা। সেই খেলার ফল আগে জানতে একটা পল খুঁজে বের করতে হবে। যে যা বলুক ভাই, আমাদের আরেকটা পল চাই। মহাজ্যোতিষী পল। পল যা বলবে পল, তা-ই ফলবে ফল।

লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.