দ্বীপের জীবন-সোনাদিয়ার দুঃখগাথা by মোকারম হোসেন

কক্সবাজার থেকে মহেশখালী দ্বীপ পর্যন্ত যাতায়াতব্যবস্থা মোটামুটি ভালোই। যদিও জলপথ, তবু স্পিডবোট আর ট্রলার সহজলভ্য। তবে রাতে আর এসব চলে না। কিন্তু কেউ যদি মহেশখালী থেকে সোনাদিয়া দ্বীপে যেতে চান, তাহলে কীভাবে যাবেন! গোরকঘাটা থেকে ঘটিভাঙা পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার পথ বেবিট্যাক্সিতে, তারপর নৌকায় সোনাদিয়া চ্যানেল পার হয়ে বাকিটা হাঁটাপথ।


প্রতিদিন জোয়ারের সময় পশ্চিম সোনাদিয়া থেকে ঘটিভাঙা পর্যন্ত মাত্র একবার একটি ট্রলার ছেড়ে আসে। এই ট্রলারটিই কিছুক্ষণের মধ্যে যাত্রীদের তুলে নিয়ে আবার ফিরতি যাত্রা করে। এটাই একমাত্র ভরসা, তাও আবার জোয়ারের ওপর নির্ভরশীল। এমন কষ্টকর যাতায়াতব্যবস্থা একজন পর্যটকের কাছে মাত্র একবার আনন্দদায়ক হতে পারে। কিন্তু পশ্চিম সোনাদিয়ার মানুষ হররোজ এভাবেই যায় মহেশখালী কিংবা কক্সবাজার। স্থানীয় পরিবেশকর্মী গিয়াস উদ্দিন যেতে যেতে শোনান তাঁর বোনের প্রসূতিকালীন করুণ মৃত্যুর কাহিনি। এভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু সেখানকার নৈমিত্তিক ঘটনা।
কক্সবাজার জেলার একটি প্রত্যন্ত দ্বীপ সোনাদিয়া। দ্বীপের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে ১৫০ ও ১৩০ পরিবারের বসবাস। মাঝখানের বিশাল জায়গা লবণ তৈরির খামার। তবে এই দুই পাড়ার সঙ্গেও নির্দিষ্ট কোনো সংযোগ সড়ক নেই। এমন বিচ্ছিন্ন জনপদটি একক কোনো ইউনিয়ন নয়, মহেশখালীর ৮ নম্বর কুতুবজুম ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড মাত্র। জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ জেলে। বাকিরা লবণ চাষ, কৃষি ও অন্যান্য পেশার সঙ্গে জড়িত। তাদের জীবন নোনা দরিয়ার সঙ্গে বাঁধা। জোয়ার-ভাটা, নৌকা, জাল, দাঁড়, মাছ, জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য। জীবিকার জন্য জীবনটা হাতের মুঠোয় রেখে নৌকা ভাসাতে হয় সাগরে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হরহামেশা লেগেই থাকে। পশ্চিমপাড়ার মানুষগুলোর ভয়টা তখনই। সেখানে নেই কোনো সাইক্লোন আশ্রয়কেন্দ্র। এ কারণে গোটা বসতিটিই অরক্ষিত। বর্ষায় কখনো কখনো জোয়ারের পানি চলে আসে একেবারে বসতভিটায়। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ।
এখানে কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও নেই। পশ্চিমপাড়ার কয়েক শ শিশুর জন্য বাংলাদেশ সেন্টার ফর ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট পরিচালিত একটি ছোট্ট স্কুল আছে। অতি ক্ষুদ্র আয়তনের এই ঘরে মাত্র তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। একই ঘরে আবার বেসরকারি সংস্থা ‘ইপসা’র মাধ্যমে বয়স্কদেরও পড়ানো হয়। এমন অপ্রতুল শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুরা শিক্ষায় প্রাথমিক ধারণা পাওয়ার আগেই তাদের শিক্ষাজীবনের পাঠ চুকিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়। তারপর তাদের জীবনের সেই অনিবার্য পরিণতি। জলজীবনের সঙ্গে সখ্য। এভাবে বংশপরম্পরায় তাদের পুরোনো পেশাতেই থাকতে হচ্ছে। আপাতত এর কোনো বিকল্প তাদের জানা নেই।
মানুষের তিনটি প্রধান মৌলিক চাহিদার মধ্যে বাসস্থান অন্যতম। কিন্তু তাদের বাসস্থান কেমন হতে পারে, তা বর্ণনা না করলেও পাঠকমাত্রই অনুমান করতে পারেন। যখন বড় ধরনের কোনো ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হয়, তখন সমুদ্র থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে থাকা এই মানুষগুলো জীবনটা হাতে নিয়ে অসহায়ের মতো বসে থাকে। সৃষ্টিকর্তা যদি তাদের রক্ষা করেন, তাহলেই আবার নতুন করে শুরু হয় বেঁচে থাকার লড়াই। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা নয়। যে দেশের কোটি কোটি ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়ে যায় বিদেশে, যে দেশে এত বড় বড় এনজিও মানুষের কল্যাণে কাজ করে, তারা কি কেউ এই ছোট্ট কাজটুকু করতে পারে না? একটি সাইক্লোন আশ্রয়কেন্দ্র বানাতে পারে না এই অসহায় মানুষগুলোর জন্য! কাজটি কি খুব বেশি ব্যয়বহুল?
এখানে এতগুলো মানুষের জন্য একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র তো দূরের কথা, একটি ডাক্তারখানাও নেই। অসুস্থ হলে তারা কার কাছে যাবে? কে দেবে তাদের ব্যবস্থাপত্র? কোথায় পাবে ওষুধপথ্য? প্রতিদিন না হোক, সপ্তাহে অন্তত এক দিনও কি একজন চিকিৎসক তারা পেতে পারে না? তাদের চারপাশে শুধু নেই আর নেই। এত নেই-এর পর আরও একটি নেই আছে, তা হচ্ছে হাটবাজার। হাজারখানেক মানুষের সওদাপাতি করার কোনো ব্যবস্থা এখানে নেই। অনেকেই মহেশখালী থেকে বাজার নিয়ে আসে। স্থানীয়ভাবে যেটুকু পাওয়া যায় তাও বেশ চড়া মূল্যে। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে একটু ভালোমন্দ বাজার করে খাওয়াটাও তাদের ভাগ্যে নেই।
স্থানীয় লোকজন আরও দুটি সমস্যার কথা তুলে ধরল। ২০০০ সাল থেকে চিংড়িঘের করার জন্য এখানে নির্বিচারে প্যারাবন ধ্বংস শুরু হয়। হেঁটে আসতে আসতে সেই ক্ষতচিহ্ন চোখে পড়ে। সম্প্রতি আরেকটি সমস্যা শুরু হয়েছে। বন বিভাগের যোগসাজশে কতিপয় অবিবেচক মানুষ প্যারাবনে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ শুরু করেছে। এতে বনের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে যেমন বিঘ্ন ঘটতে পারে, তেমনি একসময় বনটি বিলুপ্তও হতে পারে। তারা যদি জানত, এই বন শুধু উপকূলবাসীর নয়, পুরো দেশবাসীর সবুজ ছাতাস্বরূপ; যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বুক পেতে দিয়ে আমাদের রক্ষা করে, তাহলে নিশ্চয় এমন গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকত। অসচেতনতা থেকেই তারা এমন বিধ্বংসী কাজে লিপ্ত হয়েছে। এ ধরনের কাজ থেকে তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে।
এ মুহূর্তে যে কাজটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, সোনাদিয়ায় নতুন কোনো বসতি সম্পর্কে নিরুৎসাহিত করা। দ্বীপটিকে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবেই রেখে দেওয়া উচিত। কারণ দ্বীপটি অতিরিক্ত মানুষের জন্য বসবাসের উপযোগী নয়, তা ছাড়া অতিরিক্ত জনসংখ্যা দুর্ভোগের পাশাপাশি পরিবেশগত বিপর্যয়ও ডেকে আনবে। প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দর এ ক্ষেত্রে একটি বিরাট হুমকি। পশ্চিম সোনাদিয়া থেকে গভীর সমুদ্রবন্দরের দূরত্ব খুব বেশি নয়। যদি বন্দরটি স্থাপিত হয়, তাহলে সর্বপ্রথম সোনাদিয়াই আক্রান্ত হবে। কারণ প্রথমেই উন্নত করা হবে যাতায়াতব্যবস্থা। তাতে স্রোতের মতো মানুষ আসতে থাকবে। এসব অসচেতন মানুষ (পর্যটকেরা) কী কী ক্ষতি করতে পারে, তার তরতাজা দৃষ্টান্ত সেন্ট মার্টিন ও ছেঁড়াদ্বীপ। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে দালানকোঠা, দালাল-ফড়িয়া, মহাজন, ধান্ধাবাজ ও কুচক্রী মানুষের আনাগোনা। বড় ব্যবসায়ীরা পানির দরে জায়গা কিনবেন। সেখানে বানাবেন সুরম্য অট্টালিকা। কেউ কেউ আবার ভাড়া দিয়ে দুই পয়সা বাড়তি ইনকামেরও ব্যবস্থা করবেন। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটবে কি না, আমার জানা নেই। একেবারেই সহজ সমীকরণ। যতদূর জেনেছি, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কর্তৃক নিয়োগকৃত বিদেশি জরিপকারী দল ইতিমধ্যেই তাদের জরিপের ফলাফল জমা দিয়েছে। এর একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলে পরিবেশ অধিদপ্তর প্রতিবাদ জানিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দিয়েছে। কিন্তু এখনো এর কোনো জবাব মেলেনি। আমরা আশা করব, সরকার বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখবে।
মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক
tarupallab@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.