চারদিক-রহমত সরদারের স্বপ্ন by সিদরাতুল সিনড্রেলা

দিনে এক হাজার টাকার চালান আনলে ৫০০ টাকা লাভ থাকে। তা দিয়ে দুজনের সংসার খুব ভালোভাবে চলে। কিন্তু সংসার যদি হয় ছয়জনের? আর সবাই যদি নিশ্চিন্তে নির্ভর করে একজনেরই ওপর? তাহলে একমাত্র কর্তাব্যক্তির পক্ষে পরিবার চালনা কতটুকু কষ্টকর হয়ে ওঠে তা ভাবতে পারেন কি?


উপরন্তু অভাবের সংসারে রোজ কি আর এক হাজার টাকার চালান আনা সম্ভব হয়? যদি কোনো দিন বেশি টাকার চালান আনা হয়, তবে পরের দিন আর আনা সম্ভব হয় না। ফলে গড়পরতা হিসাবে যা দাঁড়ায় তাতে কষ্টের প্রহর আর শেষ হয় না রহমত সরদারের মতো ফলবিক্রেতাদের।
এই প্রচণ্ড গরমে একটু শীতল হাওয়ার আশায় যদি বিকেলে চলে যান ধানমন্ডি ৩২ নম্বর লেকের ধারে তবে দেখা মিলবে রহমত সরদারের। তাঁর কাছ থেকে খেতেও পারেন আম ভর্তা বা শসা। আবার সকালে গেলে দেখবেন তিনি নেই, কারণ তখন তিনি শুক্রাবাদ নিউ মডেল স্কুল গেটে শিক্ষার্থীদের মন মাতাতে ব্যস্ত। এভাবেই সবার সেবার তাগিদে সকাল নয়টায় দিন শুরু হয় রহমত সরদারের। শেষ হয় আবার সেই রাত ১০টায়। কিন্তু অন্যকে তৃপ্ত করার কাজ করে কখনোই নিজে তৃপ্ত হতে পারেননি এই সাদাসিধে মানুষটি।
মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী থানার ছোট তেওয়ার গ্রামে তাঁর বাপ-দাদার বাড়ি। পঁচিশ বছর আগে যখন রহমত সরদারের বয়স ছিল নয়-দশ বছর, তখন ছোট ছোট দুটো হাত দিয়ে বাবা-মাকে ধরে এসেছিলেন ঢাকায়। পরে বাবা-মা একসময় আবার চলে গেছেন গ্রামে। কিন্তু তাঁর আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। বাবা ঢাকায় ফলের ব্যবসা করতেন। রহমত সরদার শুরু করলেন পিঠার ব্যবসা। ১৫-১৬ বছর পিঠা বিক্রির পরে আবার ফিরেছেন সেই ফলের ব্যবসাতেই। বেশি লাভের ব্যবসা না হলেও এটাই তাঁর ভালো লাগার ব্যবসা। বিকেলে যখন অনেক লোক লেকের ধারে ঘুরতে আসে, তখন তিনি খুব খুশি হয়ে ওঠেন। আবার সকালে স্কুলের ছেলেমেয়েদের তৃপ্ত করেও তাঁর শান্তি।
তিন বোন, দুই ভাই রহমত সরদাররা। তিনিই সবার বড়। মা-বাবা তো গ্রামেই থাকেন। ছোট ভাইটিও তাঁদের সঙ্গেই থাকে। গ্রামে একটা চায়ের দোকান দেখাশোনা করেন মা-বাবা। ‘ছোট ভাইটা গ্রামে গ্রিলমিস্ত্রির কাজ করে। আর মা বাবাকে দেখাশোনা করে। ভাই-বোনের মধ্যে আমিই সবার বড়। তাই দায়িত্ব একটু বেশি। কিন্তু সবকিছু করতে পারি কই?’ আক্ষেপ ঝরছিল রহমত সরদারের মুখ দিয়ে।
বিয়ে করেছেন একই গ্রাম ছোট তেওয়ারের তারাবানুকে। তাঁদের সংসারে চার ছেলে। রাসেল, আলাউদ্দিন, রনি আর রাতুল। গ্রামে যাওয়া হয় বড়জোর দুই মাসে একবার। ‘কষ্ট আবার হয় না? মায়ের জন্য বেশি কষ্ট হয়। কিন্তু কী আর করব? আমরা তো দিন আনি দিন খাই। একদিন ঢাকায় না থাকা মানে সেদিনের আয় বন্ধ। আবার গ্রামে গিয়েই বা কী করব?’ রহমত সরদারের এই প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর করতে পারলাম না। ‘জমি-জায়গা যা ছিল তা ভাগ হতে হতে প্রায় শেষ। ওরাও তো কষ্ট করেই খায়।’
‘অভাবের সংসারে খরচের তো আর মাফ নেই। থাকার জায়গা থেকে শুরু করে খাবার পানি পর্যন্ত সবটাতেই লাগে টাকা। তবুও একটু বেঁচেছি এই জন্য যে বাসা ভাড়াটা লাগে না। বোন বিলকিস আর তাঁর স্বামী কাইয়ুমের সঙ্গে থাকি। কাইয়ুম কাপড়ের ব্যবসা করেন। বাসা ভাড়াটা তাঁরাই দেন।’ রহমত সরদারের দুই বোন থাকেন ঢাকায় আর একজন থাকেন মানিকগঞ্জে। যে বোন মানিকগঞ্জে থাকেন তাঁর বর রিকশার ব্যবসা করেন।
মেজ দুই ছেলে পড়াশোনা করে। ‘আমি নিজে পড়াশোনা করিনি। তখন নিজের ইচ্ছেও ছিল না, আবার কেউ জোর করেও বলেনি পড়ার কথা। তাই চাইছিলাম ছেলেরা পড়াশোনা করবে। তা আর হলো কই?’ রহমত সরদারের দীর্ঘশ্বাসের ঘন বাতাসটা আমার চোখের সামনে যেন দেখতে পেলাম। ‘দ্বিতীয় ছেলে আলাউদ্দিন পড়ে পঞ্চম শ্রেণীতে। তৃতীয় ছেলে রনি পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে। ছোট ছেলে রাতুলের বয়স তো সবে চার। বড় ছেলেটাকে তো আর পড়াতে পারলাম না। সে কেবল “বাপের হোটেলে” খায় আর ঘোরে। ভাবছি এবার তাকে একটা কাজে লাগিয়ে দেব। গ্রিলের কাজ শিখিয়ে দেব।’ ছেলেদের ভবিষ্যতের চিন্তায় উদ্বিগ্ন রহমত সরদার। তাঁর সাধ পূরণ হবে তো? ‘ছেলেরা পড়ালেখা করলে হয়তো এক নিশ্চিন্ত সুখের জীবন যাপন করবে তারা’—সরদারের এই স্বপ্নটা সত্যি হবে কি না কে জানে?
গ্রামের পুকুরে সাঁতার কাটা কিংবা মাছ ধরা রহমত সরদারকে টানে খুব। গ্রামে মায়ের নীড় বা বন্ধুদের সাহচর্য ঢাকায় মেলে না। ‘গ্রামে তো আনন্দও কম হয় না কিন্তু কাজ ছেড়ে আর যাওয়া হয় কই?’ এই ব্যবসাটাই করতে চান তিনি। ‘তবে যদি আর একটু বেশি টাকা খাটাতে পারতাম তবে হয়তো আর একটু ভালো থাকা যেত। চার ছেলে আর স্ত্রী নিয়ে হয়তো স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করতে পারতাম।’ সেই দিনের স্বপ্ন দেখেন সরদার যখন তাঁর ‘ছেলেরা পড়াশোনা করে অনেক ভালো চাকরি করবে’।

No comments

Powered by Blogger.