অস্বীকার নয়, উন্নয়নে পদক্ষেপ প্রয়োজন-মানবাধিকার পরিস্থিতি

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ২০১১ সালের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির যে বর্ণনা ফুটে উঠেছে, তা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির জন্য এককথায় হতাশাব্যঞ্জক। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদ্য প্রকাশিত মানবাধিকারবিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির চিত্র একই রকম হতাশা সৃষ্টি করে।


মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকারের ক্ষেত্রে চিহ্নিত প্রধান সমস্যাগুলোর এক নম্বরে আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যদের দ্বারা হত্যা ও নির্যাতন। সরকারি বাহিনীগুলোর সদস্যদের হাতে সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে যত সমালোচনার শিকার হতে হয়, ততটা আর কিছুতেই নয়। কিন্তু এসব বন্ধ করতে সরকারের উদ্যোগ লক্ষ করা যায় না। অথচ বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার ছিল, তারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করবে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সরকারের এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের বিষয়টি লক্ষ করেছে এবং তাদের প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করে লিখেছে, বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার পক্ষে সরকারের অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও এসব হত্যাকাণ্ড অব্যাহতভাবে চলছে। গত এক বছরে র‌্যাবের সদস্যদের হাতে ৫৪টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে উল্লেখ করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল লিখেছে, এসব হত্যাকাণ্ড র‌্যাবের সদস্যরা ঘটিয়েছেন—এমন অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও হত্যাকাণ্ডগুলোর স্বাধীন তদন্ত বা বিচারের কোনো ব্যবস্থাই সরকার করেনি।
শুধু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডই নয়, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতির সূচক হিসেবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে আরও কিছু গুরুতর প্রবণতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্য হিসেবে আইনানুগ পন্থার বাইরে সাধারণ নাগরিকদের ধরে নিয়ে যাওয়া, তারপর তাদের ‘গুম’ করে দেওয়া। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের হেফাজতে থাকা অবস্থায় আটক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনা পুরোনো; কিন্তু তাঁদের হাতে ‘গুম’-এর অভিযোগ নতুন এবং এটা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি মূল্যায়নে নিশ্চিতভাবেই গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তা ছাড়া মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, র‌্যাবের বিরুদ্ধে অযৌক্তিকভাবে গ্রেপ্তার করার অভিযোগ অসংখ্য। পুলিশ, র‌্যাব ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির সদস্যরা অযৌক্তিকভাবে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে মানুষের মৃত্যুর কারণ ঘটান—এই তথ্যও গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একটি পর্যবেক্ষণ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো, বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে উঠলেও সরকার তা তদন্তের ব্যবস্থা করে না, বরং যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তাদের অব্যাহতি দেয়। এমন অব্যাহতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছেন র‌্যাবের সদস্যরা। এটি কেবল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য নয়, যেকোনো সমাজের জন্য গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনকে ‘ঢালাওভাবে দেওয়া প্রতিবেদন’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এ প্রতিবেদন সত্য নয়। তাঁর এই মন্তব্য দুর্ভাগ্যজনক, কেননা এতে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্রকে অস্বীকার করা হয়। আসলে প্রয়োজন অস্বীকার না করে বাস্তবতা স্বীকার করা এবং পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া।

No comments

Powered by Blogger.