বাজেট-বিনিয়োগবান্ধব বাজেটের প্রত্যাশা by মনজুর হোসেন
বাজেট হচ্ছে সাধারণভাবে সরকারের এক বছরের আয় ও ব্যয়ের হিসাব। তবে, অর্থনীতিতে এর একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, কারণ বাজেটে সরকারের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রাগুলোর প্রতিফলন ঘটে থাকে। ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেট সরকারের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় প্রথম বাজেট বিধায় এতে পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রাগুলোর প্রতিফলন হওয়া বাঞ্ছনীয়।
সরকার ২০১১ সালের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৬.৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে পুরো দশকজুড়ে সাত শতাংশ বা তার ওপরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। এটি একটি কঠিন লক্ষ্য, কিন্তু অসম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন তাৎপর্যপূর্ণভাবে বিনিয়োগ (দেশীয় ও বিদেশি) বাড়ানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং সঙ্গে সঙ্গে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। এ বিষয়গুলোর প্রতি নজর রেখে ভবিষ্যৎ বাজেট প্রণয়ন করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের সরকারি বিনিয়োগ হার জিডিপির প্রায় ১৫ শতাংশ, যা আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও কম। অন্যদিকে, উন্নয়ন কর্মসূচিতে বিনিয়োগের হার জিডিপির মাত্র ৪ শতাংশ, উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে আগামী বাজেটে এ হার পাঁচ শতাংশের ওপর হওয়া নিতান্তই প্রয়োজন। সরকারি বিনিয়োগ না বাড়াতে পারলে বেসরকারি বিনিয়োগও বাড়বে না এবং বিনিয়োগের পরিবেশও উন্নত হবে না।
বর্তমান অর্থবছরে আমদানি ও রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হলেও আগামী বছর রপ্তানি ও আমদানি বাড়বে বলে আশা করা যায়। এ ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনামূলক পদক্ষেপগুলো কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আগামী বছরের বাজেটে প্রণোদনা প্যাকেজকে আরও সুবিন্যস্ত ও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
বাজেট দৃশ্যকল্প: সরকার ২০১০-১১ সালের জন্য একটি বড় বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে, যার আকার ১,৩২,০০০ কোটি টাকার মতো হবে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৬ শতাংশ বেশি। এডিপির আকার ৩৮ হাজার কোটি টাকার মতো হবে, যা গত বছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। অতীতের রেকর্ড থেকে দেখা যায় যে মূল এডিপির প্রায় ৮৫ শতাংশ বছর শেষে বাস্তবায়ন হয়। সেদিক থেকে এডিপির আকার যত বড় হবে তত ভালো। যদিও বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য এডিপির আকার বাড়ানো প্রয়োজন, কিন্তু তা বাস্তবায়নযোগ্য ও বাস্তবসম্মত হওয়া প্রয়োজন। অন্যদিকে রাজস্ব আয় বাড়ানো সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে কর ও জিডিপির অনুপাত ১০ শতাংশের মতো, যা প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও কম। উচ্চ প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য এ হার ১৪ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন।
এডিপি বাস্তবায়নে করণীয়: ১. এমটিবিএফের আওতায় প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন সংস্থা বা মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে জবাবদিহির ব্যবস্থার প্রবর্তন; ২. আইএমইডিকে আরও শক্তিশালী করা এবং মন্ত্রণালয়গুলোর পরিকল্পনা কোষগুলোকে কার্যকর করা ৩. যেসব প্রকল্পের জন্য সম্পদের সরবরাহ নিশ্চিত রয়েছে এবং যেসব প্রকল্প চালু রয়েছে এবং অগ্রগতি ভালো, সেগুলোকেই প্রাধান্য দেওয়া; ৪. এডিপি বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটিগুলো (যেমন—অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটি, পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি, এস্টিমেটস কমিটি) জোরালো ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। নিয়মিতভাবে কমিটিগুলো এডিপি বাস্তবায়ন মনিটর করে ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করতে পারে।
সরকার ২০১০ সালের বাজেটে পিপিপির জন্য ২৫০০ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখলেও যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে বাস্তবায়নে অসুবিধার কারণে এ বাজেট ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। বর্তমান বাজেটে পিপিপি বাস্তবায়নে একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ থাকা এবং যথাযথ আইনগত কাঠামো প্রণয়ন প্রয়োজন।
২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটে নিম্নোক্ত খাতগুলোকে বিনিয়োগের জন্য প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত: সরকার ২০২১ সালের মধ্যে সবার জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপও নিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিদ্যুৎ খাতে এডিপি বরাদ্দ বিগত কয়েক বছরে কমেছে। যদিও বর্তমান সরকার ২০১০ অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে আগের বছরের তুলনায় ৩২ শতাংশ বেশি বরাদ্দ রেখেছিল। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে এ বরাদ্দের পরিমাণ গত বছরের বাজেটের তুলনায় কম রাখা হয়েছে। আগামী বাজেটে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে এ অর্থের সঠিক ও সময়মতো ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যুৎ-ব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে দেশের সঠিক উন্নয়ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এ খাতের উন্নয়নে সরকারি বিনিয়োগকে প্রাধান্য দিতে হবে। বিদ্যুৎ খাতের মাস্টারপ্ল্যান ২০০৫ অনুযায়ী, আগামী বছর (২০১১-১২) দেশে বিদ্যুতের চাহিদা হবে সাত হাজার মেগাওয়াট। ফলে দুই হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ-ঘাটতি মেটাতে হবে আগামী বছর। এ লক্ষ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে স্বল্প মেয়াদে ডিজেলচালিত ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন, মধ্য মেয়াদে কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন এবং দীর্ঘ মেয়াদে পারমাণবিক পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। জ্বালানি-নিরাপত্তার অংশ হিসেবে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে গ্যাস, বিদ্যুৎ, কয়লা ইত্যাদি আমদানির দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা প্রয়োজন।
খাদ্যনিরাপত্তা: খাদ্যের পর্যাপ্ততা, জনগণের ক্রয়ক্ষমতার উন্নয়ন এবং খাদ্যের সুষম ব্যবহার—এই তিনটি বিষয়ের সমন্বয়ই হচ্ছে খাদ্যনিরাপত্তা। বিগত তিন দশকে দেশে খাদ্য উৎপাদন তিন গুণ বেড়েছে। ২০১২ সাল নাগাদ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে বাজেটে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন—সেচ এলাকার সম্প্রসারণ, কৃষি ভর্তুকি বৃদ্ধিকরণ, উচ্চফলনশীল বীজের উৎপাদন ও বিতরণ বৃদ্ধিকরণ, কৃষিঋণের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিতকরণ এবং আবাদি জমি যাতে হ্রাস না পায় সে বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ, জনগণের খাদ্য ক্রয়ক্ষমতা উন্নয়নের লক্ষ্যে আয়বর্ধক কর্মসূচি গ্রহণ, সামাজিক বেষ্টনীর সম্প্রসারণ এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। সুষম খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পশুসম্পদ, মৎস্য, শাক-সবজি, ফলমুল অধিকতর হারে উৎপাদনের জন্য বাজেটে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন: কৃষিপণ্যের বা খাদ্যশস্যের উৎপাদন গত তিন দশকে তিন গুণ বৃদ্ধি পেলেও কৃষি খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়নি। অন্যদিকে শিল্প খাতের অবদান জিডিপিতে বৃদ্ধি পেলেও সে হারে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়নি। এ জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন অত্যন্ত প্রয়োজন। বর্তমানে জিডিপিতে এ খাতের অবদান হচ্ছে মাত্র তিন শতাংশ। এ খাতের উন্নয়নে নিম্নের পদক্ষেপগুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে: ১. অল্প সুদে জামানতবিহীন ঋণের সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, ২. বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃ অর্থায়ন স্কিমের সম্প্রসারণ, ৩. মহিলা উদ্যোক্তাদের আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া, ৪. এসএমই ফাউন্ডেশনকে শক্তিশালী করা, ৫. ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মধ্যে আইসিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। এ খাতের উন্নয়নে আইটি পার্ক স্থাপনের সমস্যাগুলো দূরীভূত করার পদক্ষেপ এখনই নেওয়া প্রয়োজন।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা: পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীর নাব্যতা হ্রাস, নদীভাঙন, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি আগামী বছরগুলোতে অনেক বেশি হারে বৃদ্ধি পাবে। এসব দুর্যোগের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে কৃষি খাতের। সরকার ইতিমধ্যে ৭০০ কোটি টাকার ক্লাইমেট ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে। বিদেশি সাহায্যও এ ক্ষেত্রে পাওয়া যাবে। তবে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে সঠিক পরিকল্পনা (স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি) গ্রহণের মাধ্যমে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা, যাতে করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির মাত্রা সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় এ মুহূর্তে করণীয় কী? বিশেষজ্ঞদের মতে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় হচ্ছে: এক. দীর্ঘমেয়াদি আবহাওয়ার পূর্বাভাস পদ্ধতি প্রবর্তন অর্থাৎ কৃষকেরা যাতে এক মৌসুম আগেই আবহাওয়ার খবর জানতে পারে এবং সে অনুযায়ী ফসল উৎপাদনে পূর্বপ্রস্তুতি নিতে পারে। এ খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন, যাতে কারিগরি যন্ত্রপাতি এবং দক্ষতা অর্জন এখনই সম্ভব। বাংলাদেশের আবহাওয়ার পূর্বাভাস অত্যন্ত উপেক্ষিত একটি বিষয়, যার প্রতি এখনই নজর দেওয়ার সময় এসেছে। দুই. দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের বাঁধ নির্মাণ—এ দুটি বিষয়ের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন।
মনজুর হোসেন: রিসার্চ ফেলো, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)।
monzur@bids.org.bd
বর্তমান অর্থবছরে আমদানি ও রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হলেও আগামী বছর রপ্তানি ও আমদানি বাড়বে বলে আশা করা যায়। এ ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনামূলক পদক্ষেপগুলো কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আগামী বছরের বাজেটে প্রণোদনা প্যাকেজকে আরও সুবিন্যস্ত ও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
বাজেট দৃশ্যকল্প: সরকার ২০১০-১১ সালের জন্য একটি বড় বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে, যার আকার ১,৩২,০০০ কোটি টাকার মতো হবে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৬ শতাংশ বেশি। এডিপির আকার ৩৮ হাজার কোটি টাকার মতো হবে, যা গত বছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। অতীতের রেকর্ড থেকে দেখা যায় যে মূল এডিপির প্রায় ৮৫ শতাংশ বছর শেষে বাস্তবায়ন হয়। সেদিক থেকে এডিপির আকার যত বড় হবে তত ভালো। যদিও বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য এডিপির আকার বাড়ানো প্রয়োজন, কিন্তু তা বাস্তবায়নযোগ্য ও বাস্তবসম্মত হওয়া প্রয়োজন। অন্যদিকে রাজস্ব আয় বাড়ানো সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে কর ও জিডিপির অনুপাত ১০ শতাংশের মতো, যা প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও কম। উচ্চ প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য এ হার ১৪ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন।
এডিপি বাস্তবায়নে করণীয়: ১. এমটিবিএফের আওতায় প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন সংস্থা বা মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে জবাবদিহির ব্যবস্থার প্রবর্তন; ২. আইএমইডিকে আরও শক্তিশালী করা এবং মন্ত্রণালয়গুলোর পরিকল্পনা কোষগুলোকে কার্যকর করা ৩. যেসব প্রকল্পের জন্য সম্পদের সরবরাহ নিশ্চিত রয়েছে এবং যেসব প্রকল্প চালু রয়েছে এবং অগ্রগতি ভালো, সেগুলোকেই প্রাধান্য দেওয়া; ৪. এডিপি বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটিগুলো (যেমন—অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটি, পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি, এস্টিমেটস কমিটি) জোরালো ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। নিয়মিতভাবে কমিটিগুলো এডিপি বাস্তবায়ন মনিটর করে ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করতে পারে।
সরকার ২০১০ সালের বাজেটে পিপিপির জন্য ২৫০০ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখলেও যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে বাস্তবায়নে অসুবিধার কারণে এ বাজেট ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। বর্তমান বাজেটে পিপিপি বাস্তবায়নে একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ থাকা এবং যথাযথ আইনগত কাঠামো প্রণয়ন প্রয়োজন।
২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটে নিম্নোক্ত খাতগুলোকে বিনিয়োগের জন্য প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত: সরকার ২০২১ সালের মধ্যে সবার জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপও নিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিদ্যুৎ খাতে এডিপি বরাদ্দ বিগত কয়েক বছরে কমেছে। যদিও বর্তমান সরকার ২০১০ অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে আগের বছরের তুলনায় ৩২ শতাংশ বেশি বরাদ্দ রেখেছিল। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে এ বরাদ্দের পরিমাণ গত বছরের বাজেটের তুলনায় কম রাখা হয়েছে। আগামী বাজেটে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে এ অর্থের সঠিক ও সময়মতো ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যুৎ-ব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে দেশের সঠিক উন্নয়ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এ খাতের উন্নয়নে সরকারি বিনিয়োগকে প্রাধান্য দিতে হবে। বিদ্যুৎ খাতের মাস্টারপ্ল্যান ২০০৫ অনুযায়ী, আগামী বছর (২০১১-১২) দেশে বিদ্যুতের চাহিদা হবে সাত হাজার মেগাওয়াট। ফলে দুই হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ-ঘাটতি মেটাতে হবে আগামী বছর। এ লক্ষ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে স্বল্প মেয়াদে ডিজেলচালিত ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন, মধ্য মেয়াদে কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন এবং দীর্ঘ মেয়াদে পারমাণবিক পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। জ্বালানি-নিরাপত্তার অংশ হিসেবে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে গ্যাস, বিদ্যুৎ, কয়লা ইত্যাদি আমদানির দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা প্রয়োজন।
খাদ্যনিরাপত্তা: খাদ্যের পর্যাপ্ততা, জনগণের ক্রয়ক্ষমতার উন্নয়ন এবং খাদ্যের সুষম ব্যবহার—এই তিনটি বিষয়ের সমন্বয়ই হচ্ছে খাদ্যনিরাপত্তা। বিগত তিন দশকে দেশে খাদ্য উৎপাদন তিন গুণ বেড়েছে। ২০১২ সাল নাগাদ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে বাজেটে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন—সেচ এলাকার সম্প্রসারণ, কৃষি ভর্তুকি বৃদ্ধিকরণ, উচ্চফলনশীল বীজের উৎপাদন ও বিতরণ বৃদ্ধিকরণ, কৃষিঋণের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিতকরণ এবং আবাদি জমি যাতে হ্রাস না পায় সে বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ, জনগণের খাদ্য ক্রয়ক্ষমতা উন্নয়নের লক্ষ্যে আয়বর্ধক কর্মসূচি গ্রহণ, সামাজিক বেষ্টনীর সম্প্রসারণ এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। সুষম খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পশুসম্পদ, মৎস্য, শাক-সবজি, ফলমুল অধিকতর হারে উৎপাদনের জন্য বাজেটে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন: কৃষিপণ্যের বা খাদ্যশস্যের উৎপাদন গত তিন দশকে তিন গুণ বৃদ্ধি পেলেও কৃষি খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়নি। অন্যদিকে শিল্প খাতের অবদান জিডিপিতে বৃদ্ধি পেলেও সে হারে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়নি। এ জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন অত্যন্ত প্রয়োজন। বর্তমানে জিডিপিতে এ খাতের অবদান হচ্ছে মাত্র তিন শতাংশ। এ খাতের উন্নয়নে নিম্নের পদক্ষেপগুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে: ১. অল্প সুদে জামানতবিহীন ঋণের সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, ২. বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃ অর্থায়ন স্কিমের সম্প্রসারণ, ৩. মহিলা উদ্যোক্তাদের আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া, ৪. এসএমই ফাউন্ডেশনকে শক্তিশালী করা, ৫. ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মধ্যে আইসিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। এ খাতের উন্নয়নে আইটি পার্ক স্থাপনের সমস্যাগুলো দূরীভূত করার পদক্ষেপ এখনই নেওয়া প্রয়োজন।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা: পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীর নাব্যতা হ্রাস, নদীভাঙন, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি আগামী বছরগুলোতে অনেক বেশি হারে বৃদ্ধি পাবে। এসব দুর্যোগের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে কৃষি খাতের। সরকার ইতিমধ্যে ৭০০ কোটি টাকার ক্লাইমেট ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে। বিদেশি সাহায্যও এ ক্ষেত্রে পাওয়া যাবে। তবে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে সঠিক পরিকল্পনা (স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি) গ্রহণের মাধ্যমে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা, যাতে করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির মাত্রা সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় এ মুহূর্তে করণীয় কী? বিশেষজ্ঞদের মতে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় হচ্ছে: এক. দীর্ঘমেয়াদি আবহাওয়ার পূর্বাভাস পদ্ধতি প্রবর্তন অর্থাৎ কৃষকেরা যাতে এক মৌসুম আগেই আবহাওয়ার খবর জানতে পারে এবং সে অনুযায়ী ফসল উৎপাদনে পূর্বপ্রস্তুতি নিতে পারে। এ খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন, যাতে কারিগরি যন্ত্রপাতি এবং দক্ষতা অর্জন এখনই সম্ভব। বাংলাদেশের আবহাওয়ার পূর্বাভাস অত্যন্ত উপেক্ষিত একটি বিষয়, যার প্রতি এখনই নজর দেওয়ার সময় এসেছে। দুই. দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের বাঁধ নির্মাণ—এ দুটি বিষয়ের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন।
মনজুর হোসেন: রিসার্চ ফেলো, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)।
monzur@bids.org.bd
No comments