বহেকাল নিরবধি-এখন কে আমেরিকার 'মোস্ট ওয়ান্টেড ম্যান'? by এম আবদুল হাফিজ

গত বছরের এ মাসেরই ২ তারিখে আমেরিকার ত্রাস বিন লাদেনকে প্রেসিডেন্ট ওবামার সরাসরি নির্দেশে নেভিসিলসের কমান্ডোরা তাঁর অ্যাবোটাবাদের গুপ্ত নিবাসে অতর্কিত হামলায় ভোররাতে হত্যা করেছিল। সে সময় মার্কিন পরাশক্তির এই শত্রু শুধু স্বজন পরিবেষ্টিতই ছিলেন না, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছিল তিনি যেন তাঁর এই মৃত্যুরই অপেক্ষায় ছিলেন।


সাতপাঁচ বিবেচনা করে মার্কিনিরা তাঁকে নিশ্চিহ্ন করার মানসে তাঁর মৃতদেহকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করেছিল বলে অসমর্থিত খবরে প্রকাশ পেয়েছিল। তবে এত আপাত দুঃসাহসিক অপারেশনে নয়, এগারোর নেপথ্য নায়ককে হত্যার পরও মানসিক বৈকল্যের শিকার মার্কিনিরা এখনো আশ্বস্ত নয়। তারা এখন নিশ্চিত হতে পারছে না যে এরপর আল-কায়েদার শিকড় সম্পূর্ণভাবে উৎপাটিত হয়েছে। পৃথিবীজুড়ে অনেক অন্যায়ের হোতা ও প্রশ্রয়দাতা এই পরাশক্তি এখনো অহরহ নিরাপত্তাহীনতার বিকারে ভোগে। লাদেনকে হত্যার পর এখন তাই অস্ত্রের নল তাদের এ মুহূর্তের এক নম্বর শত্রুর দিকেই তাক করা হচ্ছে।
কে আজকের এই এক নম্বর শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের- এ নিয়ে মতভেদ বা বিতর্ক থাকলেও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস যে বিলুপ্ত হয়নি, তা নিয়ে গোটা পাশ্চাত্যজগতে কোনো দ্বিমত নেই। জানা মতে, লাদেনের জীবদ্দশায়ই তাঁর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মিসরের সাবেক সামরিক শল্যচিকিৎসক আল-জাওয়াহিরি, যিনি আল-কায়েদার প্রভাবশালী নেতা ছাড়াও আমেরিকাসহ অন্যান্য টার্গেটে হামলার মূল পরিকল্পক ছিলেন। তাঁর অনুগত ভক্ত-সমর্থকদের কাছে তিনি 'চশমা', তাঁর ট্রেডমার্ক তাঁর পরিহিত বড় আকারের চশমার জন্য। এই আল-কায়েদা নেতা 'চশমা'কে সুরক্ষা দিতে তাঁর ভক্তরা নিবেদিতপ্রাণ।
ছয় মাস আগে (লাদেনের মৃত্যুর পর) উত্তর ওয়াজিরিস্তানে এক নৈশভোজ-পরবর্তী আলোচনা সভায় লাদেনের হত্যার নিরিখে জাওয়াহিরির নিরাপত্তাব্যবস্থাই ছিল আলোচনার বিষয়বস্তু। অতিথিসেবক এক বিখ্যাত তালেবান পরিবার প্রদত্ত এই নৈশভোজে লাদেনের মৃত্যু-পরবর্তী পারিপশ্বর্িকতায় উপস্থিত সবাই জাওয়াহিরির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। জাওয়াহিরির গাইড এবং উপজাতীয় শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁকে একটি নতুন কোনো স্থানে আশ্রয় নিতে জোর পরামর্শ দেন। আরো পরামর্শ দেওয়া হয়, তিনি (জাওয়াহিরি) যেন কোনো ইলেকট্রনিক যন্ত্র ব্যবহার না করেন, অডিও এবং ভিডিও সংকেত ও বার্তা প্রেরণ সম্পর্কে সতর্ক থাকেন। তাঁকে 'কুরিয়ার' বাছাই করা সম্পর্কেও সাবধান করা হয়।
মিরনশাহ শহরে অনুষ্ঠিত ওই নৈশভোজে উপস্থিত তালেবান ও আল-কায়েদা যোদ্ধাদের আলোচনায় জাওয়াহিরির আরো ১০ বছর মার্কিনিদের হাতে ধরা না পড়ার আশাবাদ ব্যক্ত হয়। কিন্তু জাওয়াহিরির কোনো আফগান গুপ্ত আশ্রয়ে থাকার প্রশ্নে তালেবানরা তা নিশ্চিত করা থেকে বিরত থাকে। অথচ তালেবান ও আল-কায়েদা যোদ্ধার মধ্যে যেই তাঁর সংস্পর্শে এসেছে, তাঁর কাছে জাওয়াহিরি অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় না হয়ে পারেননি। তিনি লাদেনের মতো ঠিক অতটা বিভাময় (ক্যারিশম্যাটিক) না হয়েও জঙ্গি মহলে একজন চিন্তাবিদ এবং সঙ্গে সঙ্গে একজন কর্মসম্পাদক হিসেবে পরিচিত। লাদেন যদি সন্ত্রাসের মুখাবয়ব, জাওয়াহিরি তাঁর মনন। তিনি তাত্তি্বক এবং সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্রাসের অঙ্গনে সৈন্যধ্যক্ষও বটে।
নয়-এগারোর মতো জল-স্থল ও অন্তরীক্ষ কাঁপানো সন্ত্রাসের শিরোনাম হওয়ার মতো এক অপারেশনের জন্য জাওয়াহিরির ওপর এখন প্রচণ্ড চাপ। লাদেনের দীর্ঘমেয়াদি উত্তরাধিকারের জন্য এমন সন্ত্রাস সৃষ্টির যোগ্যতা তাঁকে প্রদর্শন করতেই হবে। এমন অভিমত প্রকাশ করেছেন একজন সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা ব্রস রিডেল। তবু এই আল-কায়েদা প্রধানের সংকট যে যতই তিনি প্রচার ও পরিকল্পনায় জড়িয়ে পড়েন, তিনি সর্বসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়েন। ফলে যদি তিনি নিহত হন, তিনি সেই কাঙ্ক্ষিত সন্ত্রাসটি ঘটাতে পারবেন না বা আল-কায়েদার অন্তর্নিহিত স্থিতিস্থাপকতাও প্রমাণ করতে সক্ষম হবেন না।
জাওয়াহিরিকে নিয়ে মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যও অসম্পূর্ণ। সর্বশেষ কোনো অর্থবহ তথ্য বা জাওয়াহিরিকে ঘিরে গৃহীত হয়েছিল, তা ছিল ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে তাঁর অবস্থান সম্পর্কিত। তখন জানাজানি হয়েছিল যে তিনি পাকিস্তান-আফগানিস্তানের সীমান্তে এক মাটির গৃহে (mudhouse) এক ইসলামী প্রীতিভোজে নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেই প্রীতিভোজে আগত তিনিসহ অন্যান্য বেশ কিছু আগন্তুককে লক্ষ্য করে মার্কিনিরা একটি ড্রোন হামলাও করেছিল। এতে কিছু আল-কায়েদাসহ প্রায় ১৮ জন নিহত হলেও তার মধ্যে জাওয়াহিরি ছিলেন না।
তবে এমন তথ্য রয়েছে যে জাওয়াহিরি জীবিত এবং পাকিস্তান সরকারেরই একটি অংশ হয়তোবা জাওয়াহিরিকে আশ্রয় দিয়েছে। নাম জানাতে অনিচ্ছুক একজন মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, আমরা এটুকু জানি যে শেখ এখন করাচিতে অল্প দিনের জন্য অবস্থান করছেন এবং সেটা একাধিক পক্ষের অবগতি সাপেক্ষেই সম্ভব। এ মুহূর্তে মার্কিন বিশেষ বাহিনী বা সিআইএর জন্য কোনো আক্রমণ আসন্ন বিপদের রাজনৈতিক সংকেতে পরিপূর্ণ হবে। যদিওবা তা এই উপজাতীয় কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলেও হয়। জনবহুল নগরীতে তো এর প্রশ্নই ওঠে না। সবেমাত্র লাদেনের হত্যাকে ঘিরে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। পাকিস্তানিরা মনে করে যে দেশের অভ্যন্তরে মার্কিনিদের একটি চোরা অভিযান পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ন করেছে। আবার মার্কিনিদের কাছেও লাদেনের এমন সুরক্ষিত অবস্থান, তাও তো মৈত্রীর সম্পর্কে বিশ্বাস ভঙ্গেরই শামিল।
সে কারণেই মার্কিনরা এ মুহূর্তে পাকিস্তানিদের সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্কের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পাকিস্তানি ইচ্ছা বা পছন্দকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। ভুল বোঝাবুঝির কারণ সম্পর্কে যে উত্তাপ সৃষ্টি হয়ে আছে, তাকে প্রশমন করাই এ সময়ের অগ্রাধিকার। মার্কিন প্রশাসনের জনৈক সিনিয়র কর্মকর্তা এমনটাই মনে করেন। শেষ পর্যন্ত আমেরিকার জন্য অবস্থা এমন থাকবে না। 'আমরা অবশ্যই পুনরায় ড্রোন হামলাও পুনরারম্ভ করব- তাতে পাকিস্তানিদের অনুমোদন চাই থাকুক বা না থাকুক। আফটার অল, এটি যুদ্ধ- আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে।'
ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু-পরবর্তী মিরনশাহ টাউনে অনুষ্ঠিত শোক ও ভোজের জমায়েতে যেসব জঙ্গি একত্র হয়েছিল তাঁদের স্মৃতিচারণায় লাদেনের নিজকে সুরক্ষা দেওয়ার অতিসতর্কতার কথা উঠে এসেছিল। পাকিস্তানে এক স্থান থেকে অন্যত্র পাড়ি দেওয়ার সময় যেসব সতর্কতা নেওয়া হতো লাদেনের অতি বিশ্বাসী সহচর ও কুরিয়ার আবু আহমদ আল কুয়েতি তাঁর গৃহীত কৌশলগুলোর বর্ণনাও দিয়েছিলেন। এই কুরিয়ার আসলে পাকিস্তানি পশতুন যে কিছু সময় কুয়েতে অবস্থান করার কারণে সহযোদ্ধারা তাঁকে এই নামে ডাকত। তবে নৈশভোজে অবগতদের অনেকেই লাদেনের মৃত্যুর জন্য তাঁর (কুয়েতির) অসাবধানতাকে দায়ী করেছিলেন। তাঁর একাধিক অসতর্ক পদক্ষেপ মার্কিনিদের লাদেনের আস্তানার ক্লু দিয়েছিল। নৈশভোজে আগতরা জাওয়াহিরিকে ঘিরে একই ধরনের ভুল না করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে।
কুরিয়ার কুয়েতি বিশ্বাসঘাতক না হলেও তাঁর একই গাড়ি নিয়ে বারবার অ্যাবোটাবাদে লাদেনের আস্তানায় যাওয়া এবং একই সেলফোনের ব্যবহার, যা সহজেই মনিটর সাধ্য ছিল, লাদেনের অবস্থানের ক্লু দিয়েছিল মার্কিন গোয়েন্দাদের। একত্র হওয়া আল-কায়েদা ও তালেবান যোদ্ধার ড্রোন হামলায় তাদের অনেক সহযোগীর মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ ও বিলাপ করেছিল। এমন সব ট্র্যাজেডি সংঘটিত হওয়ার কারণে লাদেনের জীবনের শেষ বছরটিও তার জন্য অত্যন্ত দুঃসময় ছিল।
আয়মান জাওয়াহিরি ২০০৫ সালের লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড আক্রমণ ও বেনজির হত্যার নেপথ্য নায়ক ছিলেন। এ দুটি অপারেশনই জাওয়াহিরির নেতৃত্বে মাত্রা সংযোজন করেছিল। তাঁর অনেক সহযোগীকে পাকিস্তানের সহযোগিতায় মার্কিনিরা হত্যা করলেও আল-কায়েদার অপারেশনের পরিধি এখন অনেকটাই সম্প্রসারিত হয়েছে সোমালিয়ায় ও উত্তর আফ্রিকায়। কিন্তু আয়মান জাওয়াহিরির প্রিয় কর্মক্ষেত্র পাকিস্তান ও আফগানিস্তান যেখানে তাঁর মতাদর্শের সহচর ওসামা বিন লাদেনই তাঁকে প্রথমে এনেছিলেন। এখনো সম্ভবত ওই একই অঞ্চলে কোনো ভক্ত-সমর্থকের আশ্রয়ে আগামী দিনের সন্ত্রাসের ছক কাটছেন তিনি। জাওয়াহিরি সম্ভবত এখনো আল-কায়েদার সবচেয়ে প্রিয় একই চারণভূমিতে মার্কিন গোয়েন্দাদের চোখে ধূলি দিয়ে অবস্থান করছেন। ড্রোন হামলা তাঁর জন্য উন্মুক্ত হলেও জাওয়াহিরিকে তাদের হেলফায়ারের টার্গেট করার জন্য অঞ্চলটি বিশাল বিস্তৃত।
তাই তার নিরাপত্তা আগামী বেশ কিছু সময়ের জন্য নিশ্চিত, যদিও মার্কিনিরা বসে নেই এবং তাদের অস্ত্রের নল সর্বক্ষণই মার্কিনিদের এখনকার এই এক নম্বর শত্রুকে খুঁজে চলেছে।
লেখক: সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.