চারদিক-আশা-নিরাশার দোলাচলে নিরাপদ মাতৃত্ব by রাখী দাশ পুরকায়স্থ

মানুষকে পৃথিবীর সব সুখানুভূতি গ্রহণের এক ও অদ্বিতীয় সুযোগ—যা কবি সুকান্তের ভাষায়, ‘যে শিশু ভূমিষ্ঠ হলো আজ রাতে, সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক’—যিনি দান করেন তিনি আমাদের মা-জন্মদাত্রী-জননী-সাহসিকা।যে আবেগ আর দাবি নিয়ে মায়ের কাছ থেকে ন্যায্য-অন্যায্য চাহিদা আমরা পূরণ করি, সেই মাকে তাঁর প্রাপ্য দেওয়ার বেলায়


আমাদের আবেগ শতভাগ কাজ করে কি না পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে—প্রশ্নটি সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এই যে গত ২৮ মে বিশ্ব নারীস্বাস্থ্য দিবস পালিত হয়ে গেল দেশে দেশে—বাংলাদেশে, যেখানে প্রতিবছরের মতো এবারও উঠে এল নারীর-মায়ের নিরাপদ থাকার বিষয়গুলো। পরে এগুলোর বিশ্লেষণ হয়, কিছু করার কথা বলা হয়—বলতে হয় এবং তা ফলোআপ করার লক্ষ্যে একদল দাঁড়ায় দায়বদ্ধতাকে বারবার চিহ্নিত করতে—তা সমুদ্রে খড়কুটো নিয়ে ভেসে থাকার মতো হলেও এতে আশাবাদ ছড়ায়, তীরে পৌঁছানোর শক্তি-সাহস জোগায়।
১৯৯৫-এর বেইজিং ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনায় নারীর ক্ষমতায়নের পথে চিহ্নিত ১২টি সমস্যার অন্যতম একটি ক্ষেত্র হিসেবে ‘নারীস্বাস্থ্য’ যখন চিহ্নিত হয়, নারীর স্বাস্থ্য বিষয়কে সামাজিক উন্নয়নে সম্পৃক্ত করে আইসিপিডি ঘোষিত হয়, তখন পরিবার, সমাজ ও দেশ তথা সরকারের করণীয় ও দায়বদ্ধতার নির্ধারিত বিষয়টিও সামনে আসে।
সাধারণত স্বাস্থ্য, বিশেষত নারীর স্বাস্থ্য নিয়ে কথা হলে তাঁর রোগশোকের কথাই কেবল আসে। কিন্তু মাকে সামনে রেখে যদি ভাবি, তাহলে পৃথিবীর সব সচেতন মানুষকেই বলতে হবে—স্বাস্থ্য মানে কোনো রোগশোক থাকা বা না-থাকা নয়; তা একটি পূর্ণাঙ্গ শারীরিক-মানসিক-সামাজিক মঙ্গলময় একটি অবস্থা, যা কিনা পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা পালন করে। সে কারণেই জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নারী যে বৈষম্যের মধ্যে বাস করেন, তার অবসান প্রয়োজন।
নারীর স্বাস্থ্য, বিশেষত মাতৃত্বজনিত ঝুঁকি এবং মাতৃমৃত্যুর তথ্য থেকে নারীর যাপিত জীবনের বঞ্চনার, বৈষম্যের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য তথ্যাবলির চিত্রিত জলছাপ আমরা লক্ষ করি। সরকারি উদ্যোগের পরিসংখ্যান, বেসরকারি উদ্যোগ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের গবেষণা তথ্যের বিশ্লেষণে এ চিত্র সমর্থন পায়।
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই বাংলাদেশে প্রতিবছর শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ১২ হাজার নারী মৃত্যুবরণ করেন। অন্যকথায় ১২ হাজার শিশু মাতৃহীন হয়। ৯০ শতাংশ নারী সন্তান জন্ম দেন বাড়িতে ধাত্রী বা আত্মীয়দের সহায়তায়, ৮০ শতাংশ নারী সন্তান জন্মের পরপর মারা যান (বিবিএস রিপোর্ট, মহিলা পরিষদ সার্ভে রিপোর্ট ২০০৯; ডা. সামিনা চৌধুরী); যা একান্তই প্রতিরোধযোগ্য।
দেখা যায়, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, উচ্চ রক্তচাপ, জন্ডিস, অতিমাত্রায় জ্বর, দীর্ঘ সময় ধরে প্রসব ব্যথার কারণে মাতৃমৃত্যু ঘটে। স্বাস্থ্যগত কারণের পাশাপাশি মাতৃস্বাস্থ্য-ঝুঁকির ক্ষেত্রে আর্থিক অসচ্ছলতা ও সম্পদ না-থাকা, নারীর প্রতি পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে চিকিৎসাকেন্দ্রে যেতে না পারা, নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা না থাকা, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্বাস্থ্যসেবা না-পাওয়ার সঙ্গে বাল্যবিবাহের কারণে অপ্রাপ্ত বয়সে মাতৃত্ব, খাবারের অপ্রতুলতা ও অপুষ্টি, অজ্ঞতা-অসচেতনতা, বারবার সন্তান ধারণ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মতো বিষয়গুলো ভূমিকা রাখে।
নারীর মাতৃকালীন স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে পরিবার, সমাজ এবং স্বাস্থ্যসেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সম্পৃক্ততা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দেখা যায়, বাল্যবিবাহ ও বয়ঃসন্ধিকালে প্রায় ৬০ শতাংশ নারী সন্তানধারণ করায় তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। আজীবনের জন্য ভগ্নস্বাস্থ্যের একজন মানুষে পরিণত হন। যথাযথ চিকিৎসা ও তা গ্রহণের অভাব, পুষ্টিকর খাবারের বিষয়ে বৈষম্য ও অসচেতনতা দেশের ভবিষ্যৎ জনসম্পদের সুস্থতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। যে কারণে গত ১ থেকে ১২ মার্চ নিউইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দপ্তরে নারীর মর্যাদাবিষয়ক কমিশনের (সিএসডব্লিউ) ৫৪তম অধিবেশনে ১৯৯৫-এর বেইজিং ঘোষণা-কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর ১৫ বছরের কার্যক্রমের মূল্যায়ন সভায় নারীস্বাস্থ্য, বিশেষত মাতৃস্বাস্থ্য-ঝুঁকি ও মাতৃমৃত্যু প্রতিরোধের বিষয়টি আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান পায়।
৫ মার্চের স্বাস্থ্যবিষয়ক সভায় আন্দোলনকর্মীদের তোলা তুমুল তর্কবিতর্কে স্থান পায় সরকারের মানসিক নির্যাতন, মাতৃমৃত্যু, বাল্যবিবাহ, অনিরাপদ গর্ভপাত, প্রজননস্বাস্থ্য পরামর্শ ও সেবাদানের দুর্বল কর্মসূচি গ্রহণের মূল কারণগুলোর বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। নারীর জীবনচক্রে সুস্থ স্বাস্থ্য অর্জনে যথাযথ স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক তথ্য জানার অধিকারকে নিশ্চিত করতে হবে।
১২ মার্চ সকালে গৃহীত সাতটি সুপারিশের মধ্যে অন্যতম একটি বিষয় হচ্ছে এই মাতৃস্বাস্থ্য-ঝুঁকি ও মাতৃমৃত্যু প্রতিরোধ। এতে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার জন্য নারীস্বাস্থ্যক্ষেত্রের অসমতার মূল কারণ চিহ্নিত করা এবং এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান অসমতা দূর করার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে; যা বেইজিং ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন অঙ্গীকারকে পুনর্ব্যক্ত করবে।
বাংলাদেশে বেইজিং-পরবর্তী এই ১৫ বছরে স্বাস্থ্য, বিশেষত নারীস্বাস্থ্য খাতে সরকারি উদ্যোগ পর্যালোচনার দাবি রাখে। ২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস সরকারিভাবে পালন কয়েক বছর ধরে বন্ধ আছে। এ তথ্য জানার অধিকার সাধারণ মানুষের আছে। তবে ইতিবাচক অর্জন আছে, তা বলতেই হবে। মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, চাহিদা-টার্গেট কতটুকু অর্জিত হয়েছে দেখা দরকার। কমিউনিটি ক্লিনিক যথার্থভাবে বাস্তবায়িত হলে এর সুফল অবশ্যই সাধারণ নারীরা ভোগ করবেন। স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়াধীন। নির্ধারিত সময়সীমা এবং পদক্ষেপের তথ্য জানার জন্য উৎসুক সুবিধাপ্রত্যাশী জনগোষ্ঠী। স্বাস্থ্যব্যবস্থা, বিশেষত নারীস্বাস্থ্যের সেবার ক্ষেত্রে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির সমন্বয় এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মরতদের জেন্ডার-সচেতনতা নিয়ে কাজ করার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অস্বীকার করার উপায় নেই, সব দায়িত্ব সরকারের নয়—এ ক্ষেত্রে ভূমিকা পালনকারী হিসেবে বেসরকারি উদ্যোগ, সিভিল সোসাইটি, সাধারণ মানুষ; তথা নারী জনগোষ্ঠীর সচেতন সংগঠিত কর্মপ্রয়াসও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কনভেনশনে স্বাক্ষরদানকারী হিসেবে মূল উদ্যোক্তা হচ্ছে সরকার। আর তাই দৃষ্টি যাবে বারবার সরকারের গৃহীত কার্যক্রম—তা সমন্বয় এবং সব কার্যক্রম মানুষকে জানানোর বিষয়টিতে।

No comments

Powered by Blogger.