সুশাসন-আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদ ও সরকার by এ এম এম শওকত আলী
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ বৈঠকে পরিষদ সরকারকে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আরও যত্নবান হওয়ার পরামর্শ দেয়। যে কয়েকটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে তা হলো এক. ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড, দুই. গণমাধ্যমে দু-একজন মন্ত্রীর অতিকথন, তিন. সহযোগী সংগঠনের কাউন্সিল গঠন এবং চার. আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহারকারী এক শ্রেণীর আমলা সম্পর্কে সরকারের অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন।
সরকারের প্রায় দেড় বছর সময়কালে প্রথম বৈঠক হয়েছে। এর আগে হলে হয়তো বা একই পরামর্শ এ পরিষদ সরকারকে প্রদান করার সুযোগ গ্রহণ করতে সক্ষম হতো। দেরিতে হলেও কাজটা ভালো হয়েছে। যে দল ক্ষমতা গ্রহণ করে, সে দলকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। দলের অভ্যন্তরে সুশাসন এবং সরকারের অভ্যন্তরেও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এ ধরনের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক সার্বিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত জরুরি। এ ধরনের বৈঠকের অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো এর ফলে সরকার ও ক্ষমতসীন দলের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ক্ষোভের আশঙ্কা হ্রাস পায়।
ক্ষমতাসীন দলের প্রধান এবং সরকারপ্রধান ভিন্ন ব্যক্তি হলে এ ধরনের মত বিনিময় গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোরই অংশবিশেষ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো অবশ্য এ কাঠামো এবং মত বিনিময়ের সংস্কৃতি অর্জনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। কী কারণে হয়েছে তা গবেষণার দাবি রাখে। পার্শ্ববর্তী দেশে এ প্রথা ১৯৪৭ পরবর্তী সময় থেকেই চালু হয়েছে। এ প্রথার কখনো রদবদল করা হয়নি। এ থেকে অনুমান করা যে, টেকসই গণতন্ত্রের জন্য এ ধরনের রাজনৈতিক নীতি সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। এ নীতি অনুসরণের ফলে দল সরকার থেকে পৃথক হলেও একই সঙ্গে দলীয় পরিষদের মাধ্যম ক্ষমতাসীন সরকার ও দলের মধ্যে যোগসূত্র অক্ষুণ্ন থাকে।
উন্নত গণতান্ত্রিক কাঠামোতে এর অন্যতম সুফল হলো দল ও সরকারের মধ্যে ক্ষমতার বিভাজন। এ প্রথার মধ্যে আরও একটি ইতিবাচক উপাদান বিদ্যমান। তা হলো রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমে পরবর্তী নির্বাচনে দল জয়ী হলে দলের নেতাকে সরকারপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত করা হয়। অর্থাৎ তার নেতৃত্বের স্বীকৃতি ও পুরস্কার প্রদান করা হয়। আর নির্বাচনে জয়ী হতে ব্যর্থ হলে চিরাচরিত প্রথায় ওই নেতাকে দলীয়প্রধান হিসেবে পদত্যাগ করতে হয়। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যেও নির্বাচন-পরবর্তী সময় এ ঘটনা অতীতের মতোই ঘটেছে।
ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে পরিষদ অনুষ্ঠিত সভায় যে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছে, তা সরকারের মন্ত্রীরা এমনকি প্রধানমন্ত্রীও অবহিত রয়েছেন। এর মূল কারণ প্রথম থেকেই গণমাধ্যম এ বিষয়ে জোরালোভাবে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, এখনো সে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের কিছু মন্ত্রী এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করলেও অঙ্গ সংগঠনের অনভিপ্রেত কর্মকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে এ কথা অনুমান করা সম্ভব যে, সংশ্লিষ্ট অঙ্গ সংগঠন কোনো কোনো জায়গায় নিজস্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই কাজ করছে। তারা দলীয় অনুশাসন মানতে রাজি নয়। ফলে সুশাসন ব্যাহত হচ্ছে।
আওয়ামীপন্থী এক ধরনের আমলাদের সম্পর্কে পরিষদ সরকারকে সতর্ক থাকার যে পরামর্শ দিয়েছে, সে বিষয়টিও প্রনিধানযোগ্য। দল যদি ক্ষমতাসীন সরকার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন নাও থাকে, তাহলেও ক্ষতি নেই। যে বিষয়টি প্রয়োজন তা হলো, দলের পরিষদ থেকে যেসব পরামর্শ দেয়া হয়, তার মূল্যায়ন করা এবং ন্যায্য হলে গ্রহণ করা। এ ক্ষেত্রেও কিছু সমস্যা রয়েছে। ন্যায্য পরামর্শ উপেক্ষা করলে দল ও সরকারের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। এর ফলে দল ও সরকার উভয়ই দুর্বল হয়। অন্যদিকে দলকে তুষ্ট রাখার জন্য সব ধরনের অন্যায়-আবদার মেনে নিলে সুশাসন ব্যাহত হয়। এ দুয়ের মধ্যে সমন্বয় করা একটি জটিল বিষয়। এ সমস্যার সমাধান ওই সব নেতারাই করতে সক্ষম, যাদের আত্মবিশ্বাস রয়েছে। দলীয় নেতা নেতৃত্ব প্রদান করবে রাষ্ট্রের স্বার্থে। সংকীর্ণ দলের স্বার্থে নয়। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা এ সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয়নি।
দলীয় মুখোশধারী আমলারা সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কোনোভাবেই সহায়ক শক্তি হিসেবে পরিচ্ছন্ন গণতান্ত্রিক কাঠামোতে স্বীকৃতি লাভ করে না। যুক্তরাজ্যে লৌহমানবী নামে পরিচিত মার্গারেট থ্যাচার এক সময় সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে এ ধরনের ব্যক্তিদের সীমিতভাবে সরকারের শীর্ষ পদে নিয়োগের চিন্তা করেছিলেন। এ নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়। অবসরপ্রাপ্ত কিছু মন্ত্রিপরিষদ সচিব মার্গারেটকে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ না করার জন্য খোলাখুলিভাবে মত প্রকাশ করেন। শেষ পর্যন্ত এটা করা হয়নি। কারণ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থ্যাচার প্রতিষ্ঠিত নিয়মের ব্যতিক্রম করে স্থায়ী শাসন কাঠামোকে দুর্বল করাকে যুক্তিযুক্ত মনে করেননি। বাংলাদেশে ১৯৯১ পরবর্তী সময়ে ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠিত রীতিকে অতিক্রম করে স্থায়ীত্ব লাভ করেছে।
বর্তমান ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনী ইশতেহারে প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এ দলের উপদেষ্টা পরিষদ এ প্রসঙ্গে যে পরামর্শ দিয়েছেন, তাতে মনে হয় এ প্রতিশ্রুতি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। সাধারণ নাগরিকদের এ সম্পর্কে কী ধারণা, তা বলা মুশকিল। তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ সম্পর্কিত অনেক সংবাদ সাক্ষ্য দেয় যে, মুখোশধারী আমলাদের প্রশাসনিক বিষয়ে অশুভ তৎপরতা এখনও বিদ্যমান। দলীয় পরিষদের পরামর্শও একই সাক্ষ্য বহন করে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির প্রসঙ্গও পরিষদের সভায় আলোচিত হয়। পরিষদে মত প্রকাশ করা হয় যে, শিক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত তালিকার পুনরায় নিরীক্ষা উপদেষ্টাকে দিয়ে করানোর সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। সংসদীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোতে মন্ত্রীই এ বিষয়ে ক্ষমতাবান। তালিকাভুক্তির সংশোধনের দায়িত্ব তার, উপদেষ্টার নয়। প্রশাসনে এ ধারা অব্যাহত থাকলে সরকারের কাঠামো সংসদীয় গণতন্ত্র না হয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্ভর কাঠামো হবে।
এ সম্পর্কে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতা অনুসরণযোগ্য। মাওবাদীদের সহিংস কর্মকাণ্ডের ফলে প্রায় ৯০ জন কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ সদস্য নিহত হয়। সংসদে বিরোধী দলের তোপের মুখে পড়েন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরম। পরবর্তী পর্যায়ে গণমাধ্যমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর সীমিত ম্যান্ডেটের বিষয় উল্লেখ করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী গণমাধ্যমে এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন এই বলে যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এ ঘটনার পূর্বে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে আলাপ করেন। ভারতেও একজন জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা রয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তো এ উপদেষ্টাকে বিষয়টি দেখতে বলেননি।
সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দল ও ক্ষমতাসীন সরকারের নিবিড় যোগাযোগ সহায়ক শক্তির একমাত্র উৎস নয়। দল কর্তৃক নির্বাচনে প্রদত্ত অঙ্গীকার বাস্তুবায়নের জন্য আরও কয়েকটি উপাদানের প্রয়োজন। ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে নিবিড় যোগসূত্র এর অন্যতম একটি উপাদান। এ যোগসূত্রের অভাব হলেও সুশাসন ব্যাহত হয়। একে অপরের প্রতি যদি দুই দল আক্রমণাত্মক মনোভাব পোষণ করে এবং মনোভাবের বহির্প্রকাশ ঘটায়, তাহলেও সুশাসনের অভাব দৃশ্যমান হয়। বিগত দশক ধরেই এর বহু প্রমাণ পাওয়া গেছে। পরিষদ কর্তৃক কিছু মন্ত্রীর অতিকথনের বিষয়টিও এর সাক্ষ্য বহন করে। প্রতিষ্ঠিত রীতি অনুযায়ী নির্ধারিত ব্যক্তির রাজনীতির বিষয়ে দলীয় অবস্থান জনসমক্ষে তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও প্রায় সব বিষয়ে কিছু মন্ত্রী বিরোধী দল সম্পর্কে উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান করেন। এর ফলে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে দূরত্বই শুধু বৃদ্ধি পায় না বরং বিদ্বেষপূর্ণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার জন্ম দেয়। এসব বিষয়ে সরকারকে চিন্তাভাবনা করতে হবে।
সুশাসন প্রতিষ্ঠার সহায়ক শক্তির অন্য উৎস হলো দল নিরপেক্ষ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী যাঁরা মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ লাভ করবেন। কারণ মেধাশূন্যতাসম্পন্ন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোনো সময়ই দক্ষতা অর্জনে সফল হবেন না। দক্ষতাশূন্য শাসন ব্যবস্থাপনা কখনো সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। প্রাথমিকভাবে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টি উপলব্ধি করেই মন্ত্রীসহ সচিবদের দক্ষতার সঙ্গে সরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য একাধিকবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়েছে কি না, সে বিষয়টি মূল্যায়ন সরকারকেই করতে হবে। মূল্যায়নের ভিত্তিতে পরবর্তী কৌশল অবলম্বন করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় দলের সক্রিয় অংশগ্রহণের কোনো অবকাশ নেই। তবে এ প্রক্রিয়ায় কোনো দলীয় মতামত থাকলে পরিষদ অবশ্যই তা প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় দলীয় ব্যক্তিরা যদি সরাসরিভাবে সম্পৃক্ত হন, তাহলে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাবে দুষ্ট হবে। অথবা এ ধরনের সমালোচনা হবে।
সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার সবকয়টি রাজনৈতিক দল নিজস্ব নির্বাচনী ইশতেহারে প্রকাশিত করেছে। এ সত্ত্বেও সুশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি বিভিন্ন মহল থেকে বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। এ কারণে অনুমান করা যায়, যে অর্থবহ সুশাসন এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে এ কথাও সত্য যে, সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারই এককভাবে দায়ী নয়, যদিও এর সিংহভাগ দায়িত্ব সরকারের। এরপর দায়িত্ব অন্যান্য রাজনৈতিক দলের। অন্যদিকে সরকারি কর্মকাণ্ড নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালনার প্রত্যক্ষ দায়িত্ব সরকারের। অন্য কারও নয়।
এ এম এম শওকত আলী: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা; সাবেক সচিব।
ক্ষমতাসীন দলের প্রধান এবং সরকারপ্রধান ভিন্ন ব্যক্তি হলে এ ধরনের মত বিনিময় গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোরই অংশবিশেষ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো অবশ্য এ কাঠামো এবং মত বিনিময়ের সংস্কৃতি অর্জনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। কী কারণে হয়েছে তা গবেষণার দাবি রাখে। পার্শ্ববর্তী দেশে এ প্রথা ১৯৪৭ পরবর্তী সময় থেকেই চালু হয়েছে। এ প্রথার কখনো রদবদল করা হয়নি। এ থেকে অনুমান করা যে, টেকসই গণতন্ত্রের জন্য এ ধরনের রাজনৈতিক নীতি সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। এ নীতি অনুসরণের ফলে দল সরকার থেকে পৃথক হলেও একই সঙ্গে দলীয় পরিষদের মাধ্যম ক্ষমতাসীন সরকার ও দলের মধ্যে যোগসূত্র অক্ষুণ্ন থাকে।
উন্নত গণতান্ত্রিক কাঠামোতে এর অন্যতম সুফল হলো দল ও সরকারের মধ্যে ক্ষমতার বিভাজন। এ প্রথার মধ্যে আরও একটি ইতিবাচক উপাদান বিদ্যমান। তা হলো রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমে পরবর্তী নির্বাচনে দল জয়ী হলে দলের নেতাকে সরকারপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত করা হয়। অর্থাৎ তার নেতৃত্বের স্বীকৃতি ও পুরস্কার প্রদান করা হয়। আর নির্বাচনে জয়ী হতে ব্যর্থ হলে চিরাচরিত প্রথায় ওই নেতাকে দলীয়প্রধান হিসেবে পদত্যাগ করতে হয়। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যেও নির্বাচন-পরবর্তী সময় এ ঘটনা অতীতের মতোই ঘটেছে।
ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে পরিষদ অনুষ্ঠিত সভায় যে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছে, তা সরকারের মন্ত্রীরা এমনকি প্রধানমন্ত্রীও অবহিত রয়েছেন। এর মূল কারণ প্রথম থেকেই গণমাধ্যম এ বিষয়ে জোরালোভাবে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, এখনো সে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের কিছু মন্ত্রী এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করলেও অঙ্গ সংগঠনের অনভিপ্রেত কর্মকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে এ কথা অনুমান করা সম্ভব যে, সংশ্লিষ্ট অঙ্গ সংগঠন কোনো কোনো জায়গায় নিজস্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই কাজ করছে। তারা দলীয় অনুশাসন মানতে রাজি নয়। ফলে সুশাসন ব্যাহত হচ্ছে।
আওয়ামীপন্থী এক ধরনের আমলাদের সম্পর্কে পরিষদ সরকারকে সতর্ক থাকার যে পরামর্শ দিয়েছে, সে বিষয়টিও প্রনিধানযোগ্য। দল যদি ক্ষমতাসীন সরকার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন নাও থাকে, তাহলেও ক্ষতি নেই। যে বিষয়টি প্রয়োজন তা হলো, দলের পরিষদ থেকে যেসব পরামর্শ দেয়া হয়, তার মূল্যায়ন করা এবং ন্যায্য হলে গ্রহণ করা। এ ক্ষেত্রেও কিছু সমস্যা রয়েছে। ন্যায্য পরামর্শ উপেক্ষা করলে দল ও সরকারের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। এর ফলে দল ও সরকার উভয়ই দুর্বল হয়। অন্যদিকে দলকে তুষ্ট রাখার জন্য সব ধরনের অন্যায়-আবদার মেনে নিলে সুশাসন ব্যাহত হয়। এ দুয়ের মধ্যে সমন্বয় করা একটি জটিল বিষয়। এ সমস্যার সমাধান ওই সব নেতারাই করতে সক্ষম, যাদের আত্মবিশ্বাস রয়েছে। দলীয় নেতা নেতৃত্ব প্রদান করবে রাষ্ট্রের স্বার্থে। সংকীর্ণ দলের স্বার্থে নয়। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা এ সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয়নি।
দলীয় মুখোশধারী আমলারা সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কোনোভাবেই সহায়ক শক্তি হিসেবে পরিচ্ছন্ন গণতান্ত্রিক কাঠামোতে স্বীকৃতি লাভ করে না। যুক্তরাজ্যে লৌহমানবী নামে পরিচিত মার্গারেট থ্যাচার এক সময় সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে এ ধরনের ব্যক্তিদের সীমিতভাবে সরকারের শীর্ষ পদে নিয়োগের চিন্তা করেছিলেন। এ নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়। অবসরপ্রাপ্ত কিছু মন্ত্রিপরিষদ সচিব মার্গারেটকে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ না করার জন্য খোলাখুলিভাবে মত প্রকাশ করেন। শেষ পর্যন্ত এটা করা হয়নি। কারণ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থ্যাচার প্রতিষ্ঠিত নিয়মের ব্যতিক্রম করে স্থায়ী শাসন কাঠামোকে দুর্বল করাকে যুক্তিযুক্ত মনে করেননি। বাংলাদেশে ১৯৯১ পরবর্তী সময়ে ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠিত রীতিকে অতিক্রম করে স্থায়ীত্ব লাভ করেছে।
বর্তমান ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনী ইশতেহারে প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এ দলের উপদেষ্টা পরিষদ এ প্রসঙ্গে যে পরামর্শ দিয়েছেন, তাতে মনে হয় এ প্রতিশ্রুতি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। সাধারণ নাগরিকদের এ সম্পর্কে কী ধারণা, তা বলা মুশকিল। তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ সম্পর্কিত অনেক সংবাদ সাক্ষ্য দেয় যে, মুখোশধারী আমলাদের প্রশাসনিক বিষয়ে অশুভ তৎপরতা এখনও বিদ্যমান। দলীয় পরিষদের পরামর্শও একই সাক্ষ্য বহন করে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির প্রসঙ্গও পরিষদের সভায় আলোচিত হয়। পরিষদে মত প্রকাশ করা হয় যে, শিক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত তালিকার পুনরায় নিরীক্ষা উপদেষ্টাকে দিয়ে করানোর সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। সংসদীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোতে মন্ত্রীই এ বিষয়ে ক্ষমতাবান। তালিকাভুক্তির সংশোধনের দায়িত্ব তার, উপদেষ্টার নয়। প্রশাসনে এ ধারা অব্যাহত থাকলে সরকারের কাঠামো সংসদীয় গণতন্ত্র না হয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্ভর কাঠামো হবে।
এ সম্পর্কে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতা অনুসরণযোগ্য। মাওবাদীদের সহিংস কর্মকাণ্ডের ফলে প্রায় ৯০ জন কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ সদস্য নিহত হয়। সংসদে বিরোধী দলের তোপের মুখে পড়েন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরম। পরবর্তী পর্যায়ে গণমাধ্যমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর সীমিত ম্যান্ডেটের বিষয় উল্লেখ করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী গণমাধ্যমে এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন এই বলে যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এ ঘটনার পূর্বে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে আলাপ করেন। ভারতেও একজন জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা রয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তো এ উপদেষ্টাকে বিষয়টি দেখতে বলেননি।
সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দল ও ক্ষমতাসীন সরকারের নিবিড় যোগাযোগ সহায়ক শক্তির একমাত্র উৎস নয়। দল কর্তৃক নির্বাচনে প্রদত্ত অঙ্গীকার বাস্তুবায়নের জন্য আরও কয়েকটি উপাদানের প্রয়োজন। ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে নিবিড় যোগসূত্র এর অন্যতম একটি উপাদান। এ যোগসূত্রের অভাব হলেও সুশাসন ব্যাহত হয়। একে অপরের প্রতি যদি দুই দল আক্রমণাত্মক মনোভাব পোষণ করে এবং মনোভাবের বহির্প্রকাশ ঘটায়, তাহলেও সুশাসনের অভাব দৃশ্যমান হয়। বিগত দশক ধরেই এর বহু প্রমাণ পাওয়া গেছে। পরিষদ কর্তৃক কিছু মন্ত্রীর অতিকথনের বিষয়টিও এর সাক্ষ্য বহন করে। প্রতিষ্ঠিত রীতি অনুযায়ী নির্ধারিত ব্যক্তির রাজনীতির বিষয়ে দলীয় অবস্থান জনসমক্ষে তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও প্রায় সব বিষয়ে কিছু মন্ত্রী বিরোধী দল সম্পর্কে উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান করেন। এর ফলে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে দূরত্বই শুধু বৃদ্ধি পায় না বরং বিদ্বেষপূর্ণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার জন্ম দেয়। এসব বিষয়ে সরকারকে চিন্তাভাবনা করতে হবে।
সুশাসন প্রতিষ্ঠার সহায়ক শক্তির অন্য উৎস হলো দল নিরপেক্ষ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী যাঁরা মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ লাভ করবেন। কারণ মেধাশূন্যতাসম্পন্ন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোনো সময়ই দক্ষতা অর্জনে সফল হবেন না। দক্ষতাশূন্য শাসন ব্যবস্থাপনা কখনো সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। প্রাথমিকভাবে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টি উপলব্ধি করেই মন্ত্রীসহ সচিবদের দক্ষতার সঙ্গে সরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য একাধিকবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়েছে কি না, সে বিষয়টি মূল্যায়ন সরকারকেই করতে হবে। মূল্যায়নের ভিত্তিতে পরবর্তী কৌশল অবলম্বন করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় দলের সক্রিয় অংশগ্রহণের কোনো অবকাশ নেই। তবে এ প্রক্রিয়ায় কোনো দলীয় মতামত থাকলে পরিষদ অবশ্যই তা প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় দলীয় ব্যক্তিরা যদি সরাসরিভাবে সম্পৃক্ত হন, তাহলে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাবে দুষ্ট হবে। অথবা এ ধরনের সমালোচনা হবে।
সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার সবকয়টি রাজনৈতিক দল নিজস্ব নির্বাচনী ইশতেহারে প্রকাশিত করেছে। এ সত্ত্বেও সুশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি বিভিন্ন মহল থেকে বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। এ কারণে অনুমান করা যায়, যে অর্থবহ সুশাসন এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে এ কথাও সত্য যে, সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারই এককভাবে দায়ী নয়, যদিও এর সিংহভাগ দায়িত্ব সরকারের। এরপর দায়িত্ব অন্যান্য রাজনৈতিক দলের। অন্যদিকে সরকারি কর্মকাণ্ড নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালনার প্রত্যক্ষ দায়িত্ব সরকারের। অন্য কারও নয়।
এ এম এম শওকত আলী: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা; সাবেক সচিব।
No comments