বাতায়ন পথে নিরীক্ষণ- অথঃ সেলফোন কথা by আতাউর রহমান
মুঠোফোনকে কিছুদিন আগেও যারা বাহুল্য মনে করতেন তারাও আজ সেলফোন মুষ্ঠিবদ্ধ করে হাঁটাচলা করেন। এত আদর করে মুঠোফোনকে ধরেন যেন তারা প্রাণের জিনিস বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন। অস্বীকার করার উপায় নেই, আধুনিক বিশ্বে মুঠোফোন অত্যাবশ্যকীয় যোগাযোগের একটি প্রয়োজনীয় যন্ত্র।
আমি মুঠোফোনের কারিগরি পারঙ্গমতায় বিস্মিত হই। এক ভদ্রলোককে আমি জানতাম। আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। তিনি নামাজ পড়া শেষে দীর্ঘ মোনাজাতে বসতেন এবং একটা সময় বার বার বলতেন—আল্লাহ তুমি কত বড় কারিগর এবং কাঁদতে থাকতেন। এভাবেই কাঁদতে কাঁদতে উনি মোনাজাত শেষ করতেন। আমার এখন চিত্কার করে বলতে ইচ্ছে করে—হে মানুষ! তুমি আল্লাহর ইচ্ছায় কত বড় কারিগর হয়েছ। ছোট একটি চিপেসর ভেতর দিয়ে সেলফোনে জাদুর খেলা হয়। আমরা যখন চট্টগ্রামে স্কুলে পড়ি তখন লালদীঘির ময়দানে একজন জাদুকর চিত্কার করে বলে উঠত, ‘চাইন্স ও ধ্যানের খেল্’। এভাবে হায়দারি হাঁক মেরে সে লোকজনকে জড়ো করত। পরে বুঝেছিলাম, জাদুকর ক্যানভাসিংয়ের মতো করে বলতে চাইত সব জাদুর খেলাই সায়েন্স ও ধ্যানের খেলা অর্থাত্ জাদুবিদ্যায় কিছু ধ্যানযোগ আছে এবং কিছুটা বিজ্ঞানও আছে। আসলে ধ্যানের মাধ্যমে আত্ম-আবিষ্কার যেমন করা যায় তেমনি ধ্যান করেই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার অথবা দার্শনিক তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়। ধ্যান তো মনোসংযোগেরই নামান্তর। আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের অনেকে প্রতিজ্ঞা করে বসেছিলেন, তারা সায়েন্সের নবতম সংযোজন সেলফোন ব্যবহার করবেন না। কারণ এই ফোন একটা উটেকা ঝামেলা, যখন তখন ফোন এসে জীবনের সহজাত প্রবাহকে নষ্ট করে। শেষ অব্দি তারা কেউ তাদের প্রতিজ্ঞায় অটল থাকতে পারেনি। এখন দেখি সবাই হাতের মুঠোয় মোবাইল ফোন উঠিয়ে নিয়েছেন। এই সেলফোন যেমন আধুনিক বিশ্বের অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনীয় একটি জিনিস, তেমনি একটি ঝুট-ঝামেলারও বস্তু বটে। সেলফোন অনেক মানুষকে মিথ্যুক বানিয়ে ফেলেছে। আমি আড্ডায় রত বন্ধু-বান্ধবদের বেশ কয়েকজনকে দেখেছি স্ত্রীর বাসায় ফেরার ডাক পেয়ে নির্বিবাদে বলে যাচ্ছে—আমি ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে আছি অথবা জরুরি একটি মিটিং করছি। অবশ্য স্ত্রীরাও আজকাল শব্দ থেকে আন্দাজ করে নিতে পারেন স্বামী ব্যক্তিটি আসলে কী করছেন। তবে সেলফোনের উপকারিতা অনস্বীকার্য। গ্রামে-গঞ্জে কৃষক ও কর্মজীবী সম্প্রদায় আজকাল সস্তায় যেমন ফোন সেট কিনতে পারে, পাশাপাশি অত্যন্ত জরুরি কথার আদান-প্রদানও করতে পারে। সেলফোন এক কথায় সারা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। কোরবানি ঈদের সময় গরুর হাট থেকে সেলফোনে বাসার কাজের মানুষ অথবা ছেলে অথবা পরিবারের পক্ষে ক্রেতা ব্যক্তি বাসার কর্তাকে অথবা কর্ত্রীকে গরুর কয় দাঁত গজিয়েছে, কত চর্বিদার, কত দাম ইত্যাদি বিষয়ে যোগাযোগ করতে দেখেছি। ভিক্ষুকদের অনেকেই আজকাল সেলফোন ব্যবহার করে। এক ভিক্ষুক অন্য ভিক্ষুককে সেলফোনে খবর দেয় কোথায় জাকাত, ফিত্রা বা জেয়াফতের আয়োজন হয়েছে। একদিন হয়তো বাংলাদেশের ১৫ থেকে ১৬ কোটি (শিশুসহ) মানুষের সবার হাতে সেলফোন থাকবে। সেদিন শব্দ দূষণ হয়ে মানুষ হয়তো পাগল হয়ে জঙ্গলে চলে যাবে। সেলফোনে কী নেই। গেমস, ক্যালকুলেটার, ক্যালেন্ডার, ইন্টারনেটসহ আধুনিক যুগের সব প্রয়োজনীয় উপাদান আছে। আজকাল হাতঘড়ি অলঙ্কার হিসেবে পরা হয়। সেলফোনে ঘড়িও আছে। সেলফোনে গেমস খেলে ছোট-বড় সবার ভালো সময় কাটে। ইন্টারনেটে ঢুকে কম্পিউটারে যা করা যায়, সেলফোনেও তা করা যায়। ই-মেইল পাঠানোটা ঝামেলার মনে হলে এসএমএসে দস্তুরমত একটা চিঠি পাঠানো যায় এবং খরচ খুব বেশি পড়ে না। সেলফোন বিপদের কারণও হয়। গাড়ি চালানোর সময় সেলফোনে কথা বলতে গিয়ে অনেক অ্যাকসিডেন্ট হয়। রাস্তা পার হতে হতে সেলফোনে কথা বলাটা এখন সাধারণ দৃশ্য। এতেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। চোর, ডাকাত ও সন্ত্রাসীদের কাছে মোবাইল ফোন থাকার কারণে সমাজে দুষ্কর্ম বেড়ে গেছে। দুষ্কর্মের বিহিত করার জন্য সেলফোনের ব্যবহারকেও অস্বীকার করা যায় না। সেলফোন মানুষের কথা বলা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা গভীর রাত পর্যন্ত সেলফোনে কথা লেনদেন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমার মতো বয়স্ক লোক টেলিভিশনে নাটকের শুটিং করতে গিয়ে যখন ফাঁকা বসে থাকি তখন গায়ে পড়ে সময় ও একাকিত্ব কাটানোর জন্য বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতজনদের বিরক্ত করি। সব কথার শেষ কথা হলো, আধুনিক বিশ্বে সেলফোন প্রযুক্তি আমাদের নিত্যকার জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে, সুতরাং এর সঠিক ব্যবহার আমাদের নিশ্চিত করা কর্তব্য। প্রযুক্তি ছাড়া আমাদের চলে না, আবার প্রযুক্তি আমাদের অনক সময় বিপদের কারণ হয় এবং সেখানেই মানুষের শুভবোধ ও বুদ্ধিকে ব্যবহার করতে হয়।
মানুষ যেদিন পারমাণবিক শক্তি আবিষ্কার করল, দুঃখজনকভাবে সেই নব-আবিষ্কার মানব কল্যাণে ব্যবহৃত না হয়ে ধ্বংসযজ্ঞে ব্যবহৃত হলো। একটি ছোট বোমায় জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো। এখন শুনি, পারমাণবিক শক্তি শান্তির জন্য মানব কল্যাণে ব্যবহৃত হবে। কিছুটা হয়তো হচ্ছেও; কিন্তু তার চেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে এক দেশ অন্য দেশের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আধিপত্য বিস্তারের চোখ রাঙানোর হাতিয়ার হিসেবে। যদি আমরা সত্যিকার অর্থে বহু সংস্কৃতি ও বহু বিশ্বাস নিয়ে এক বিশ্বের স্বপ্ন দেখি, যেখানে মানুষে-মানুষে কোনো বিভেদ থাকবে না; তাহলে মানুষের আবিষ্কৃত সব প্রযুক্তিকে মানবকল্যাণে নিয়োজিত করতে হবে।
লেখক : অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক
No comments